লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Tuesday, October 5, 2021

শ্রীময়ী মুখোপাধ্যায়, শারদীয়া সংখ্যা

শ্রীময়ী মুখোপাধ্যায়ের মুক্তগদ্য


অপ্রাসঙ্গিক

কখনও কখনও কিছু এলোমেলো সময় আসে, যখন মনের অগোছালো ভাবটা অকারণ খোঁচাখুঁচি করতে আরম্ভ করে। যদিও আমার ‍মন কোনোদিনই গোছানো ছিল না, কারোরই থাকে না। কিন্তু এই সময়গুলোতে কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ধারপাশ দিয়েও যায় না মনটা। তখন কোনো কিছুরই কার্যকারণ, পরিপ্রেক্ষিত, প্রতিবেশ বুঝতে ইচ্ছে হয় না। কোনো থিসিস অথবা হায়ারার্কিই আর অর্থযুক্ত বলে মনে হয় না। 'আমি' চারপাশের সবটা ঝাপসা লাগে, নগণ্য মনে হয়। ঠিক সেই মুহূর্তগুলোতে 'সবার উপরে মানুষ সত্য' প্রবাদটা অস্থিমজ্জায় উপলব্ধি সম্ভব হয়ে ওঠে। সেই সময়ে কোনো অ্যারিস্টটল, মার্ক্স, হোমার, মহাভারত কিংবা impressionism, Dadaism, বিশ্বযুদ্ধ, ভ্যান গগ— কিছুই আর হৃদয়ে সামান্যতম টোকাও দেয় না।

 

তখন কেবলমাত্র একটা রূপকথার দরকার হয়।

বিশ্বে যা কিছুর অর্থ আছে,সেই সবটুকুকে অস্বীকার করতে ইচ্ছে হয় তখন অর্থহীন, তাৎপর্যহীন হতেই ভাল্লাগে। সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা মিথ্যে প্রতিপন্ন করতে ব্যগ্র হয়ে উঠি। বাস্তবতার চেয়ে অনেক আলোকবর্ষ দূরে একটা মিরর ওয়ার্ল্ড থেকেই যায়। এই মিরর ওয়ার্ল্ডের উপস্থিতিটা সব মানুষের জীবনেই ভীষণভাবে কাম্য। এতে নিজেকে বরাবর বাস্তববাদী ভেবে আসা ধারণায় একটু আধটু ধূলো পড়ে বটে, সে পড়ুকগে!

 

অসংখ্য মৃত্যু দেখেও নার্ভ না হারানোয় নিজেকে হার্টলেস বলে সন্দেহ হবার পরমুহূর্তেই হঠাৎ ডিজনি ব্রেভ হতে ইচ্ছা হয়...ভাগ্যের পিছনে দৌড়ানোটাই কি একমাত্র রিলেটেবলধুত!

 

কথায় বলে, 'যা সবার তা কারোর নয়'

আচ্ছা, তাহলে কি সেই ফর্মুলা মেনেই বলা যেতে পারে, 'যেখানে সবাই পলায়নপর সেখানে কাউকেই এস্কেপিস্ট বলা যায় না'? যা সবার তাই তো সাধারণ আর সাধারণের সংজ্ঞা হয় না।

কেবলমাত্র জ্বরের ঘোরে নয়, তথাকথিত সুস্থতার তাপমাত্রাতেও কখনও কখনও প্রলাপ বকতে ভালো লাগে। সেইসব তালকাটা প্রলাপের জেরে মন, মাথা এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে, সেখানে আর কোনো যুক্তি খাটে না। তখন বিশ্বের অন্যতম সেরা লেখকের বহুল চর্চিত, তুমুল জনপ্রিয়বিতর্কিত উপন্যাসের থেকেও 'তেলেনাপোতা আবিস্কার' অনেকবেশী তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়।

সে যাই হোক, তেলেনাপোতা আবিস্কারের স্পর্ধা নাই হতে পারে, তবে মিরর ওয়ার্ল্ডের ডিজনি ক্যারেক্টারের সাথে বলডান্স করতে কোনো বাধা থাকে না।

লম্বা চুল, কাঁচের জুতো অথবা তীর-ধনুকের অভাবটা আর যাই হোক অন্তত মিরর ওয়ার্ল্ডে complex খাওয়াতে পারে না এতটুকুও।

এটুকুই তো অবাস্তবতার সান্ত্বনা হয়ে টিকে রয়।

 

অবচেতন

খাদের ধারে দাঁড়ানোর অভ্যেসটা একেবারে চলে যায়নি বলেই হয়তো কোনো এক হেমন্তের পিছু ধাওয়া করতে করতে পাহাড়ে ছুটে যাওয়া যায়।

          একটা খুবই অচেনা রাস্তা ধরে ডাঁয়ে বেঁকে  গিয়ে চেনা পাহাড়টাকে পেলেও, ঝোরাটার অস্তিত্ব টের না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাসটা পাতার সরসরানিতে নিজের কান অবধিই পৌঁছোয় না ।

পাথরের গায়ে জলের দাগ জলে ধুয়ে যায় না !

 

নীচের শ্যাওলা ধরা গভীর কালো গহ্বরটার দিকে তাকালে কেমন যেন সম্মোহিত লাগে।

পশ্চিমের যে রাস্তাটা কোনো নামভুলে যাওয়া গ্রামে গিয়ে মেশে, তার ধারে ধারে ফুল ফুটে থাকে।  ছোট্ট ছোট্ট বুনো ফুলনীল রঙের।

মুঠোয় করে তুলে নেওয়ার নিষেধ না থাকলেও মুঠো ভরানোর চেষ্টা বৃথা।

দূরের ঐ কখনও যেতে না পারা গ্রামটায় তিনটে ছেলেমেয়ে হয়তো আসে কখনও কখনও ফুল তুলতে, দেখা হয় না ওদের সাথে।

মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে খাদের দিকে তাকানোর ভয়টা খাদের একদম ধারে গিয়ে দাঁড়ালে আস্তে আস্তে কেটে যায়। অবাক লাগে!

    আগেরবারের বয়ে আনা চারটে নুড়ি ছিল, শহুরে মাঝরাতে কানের কাছে ধরলে ঝরনার জলের শব্দ খেলা করেবাকি রাতটা ঘুম হয় না আর।

আকাশের কপালে পড়ে থাকা কুঁচো চুল গুলো যখন আবছা করে ফেলে সবটা,

গরম ভাপ ওঠার মতই ধোঁয়া হয়ে যায় চশমার কাঁচগুলো, সামনের রাস্তাটা চোখে পড়ে না আর।

যেটা অবধারিত রূপকথা হতে পারত, সেটা ভ্রমণকাহিনীতে পরিণত করার এ ব্যর্থতাহয়ত চা বাগানের সবুজেই লুকিয়ে ফেলতে হয়...

 

ঘুম...

রাত্তিরে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেলে, দিন রাতের তফাৎটা ঠাহর হয় না। যে কোনোদিন রাতে ঘুম ভাঙলে পায়ে হাওয়াই চটি গলিয়ে ছাদে উঠলে তারা গুলো দেখা যায়।

রাতের অন্ধকারটা সেই ত্যারাব্যাঁকা ঝিকিমিকি গুলোর জন্য আরেকটু স্পষ্ট হয়ে ওঠে বটে, তবু ঘোরটা ঠিক কাটতে চায় না। ঘুমটা আসে না, আবার জাগা চোখদুটোও আচমকা বুজে আসতে চায়...হাওয়ায় চুলগুলো ওড়ে অথচ এলোমেলো খোঁপাটা খুলে যায় না কিছুতেই।

ছাদের দরজাটা ক্যাঁচকোঁচ করলেও ভুতের গল্প তৈরীই হয় না, লেখা তো হয়ই না । শুধু পা টিপে টিপে গিয়ে আলতো ছিটকিনিটা দিয়ে আসতে হয়। নির্ঘুমে থাকা বাবা মাকে জাগাতে ইচ্ছে হয় না।

তারাগুলো কথা বলে না, দিক বোঝালেও ছাদে দাঁড়িয়ে মাঝরাতে আর দিক বুঝতে ভাল্লাগেনা।

শীত করে না, তবুও জ্বর আসে আস্তে আস্তে...ধুম জ্বর...

ঘন্টা কেটে যায়, সূর্য ওঠে, শুধু ভোর হয় না...নীচে নেমে আসতে হয়।

নিঃশব্দে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে আসতে হয় বাড়ি থেকে। গেটের তালাটা খোলাই থাকে সেদিন কোনোভাবে, চাবি লাগে না আর।

রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলে পড়া থেকে রোজ বাড়ি ফেরার চেনা গলিটা হঠাৎ ভোরে কেমন যেন গুলিয়ে যায়, ল্যাম্পপোষ্টের ছায়ার দৈর্ঘ্য মাপতে হয় রাস্তার দূরত্ব জানতে। হাওয়াই চটির স্ট্র্যাপটাও হঠাৎ করেই ছিঁড়ে যায়, ওটার মায়া ওখানেই ত্যাগ করতে হয়। আসলে খোঁড়াতে ইচ্ছে হয় না...এই আর কি!

চায়ের দোকানে উনুন ধরে, আঁচ বাড়ে...চা চাপে...জল ফুটে ফুটে মরে আসে...

পোড়া চা পাতায় বারবার চা হয়, চা টাও রঙ বদলায়...মানুষ তো নয়...তাই চিনি দিয়ে ম্যানেজ হয়ে যায়।

 

হাঁটতে হাঁটতে আবার ফিরতে হয়।

ছেঁড়া হাওয়াইটার একটা পায়েই থাকে…

একপাটি টাই এনে তুলে রাখতে হয় ।

এবার কেমন জানি শীত লাগে,

শুধু....ঐ, ঐযে....ঘুম ভেঙে ওঠা মানুষগুলো....

ওরা তবুও জাগে না...

2 comments:

  1. ভীষণ সুন্দর ❤
    - আকাশ দা

    ReplyDelete
  2. অপূর্ব গদ্য। একটানে পড়ে ফেলার মতো।

    ReplyDelete