লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Wednesday, January 20, 2021

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৪

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প

ফেরা


মণিবাবুর গাড়িতে জায়গা না পেলে আজ আর ফেরা হত না আমার। সিনেমা লাইনে কাজ করি, রোজ রাত হবারই কথা। কিন্তু এত রাত হয় না কখনও। এমনিতেই কলকাতার পরিস্থিতি এখন খুব একটা ভালো নয়। ধরপাকড় আর গুমখুনে ছেয়ে গেছে শহরটা। তার উপর আমি খোঁড়া মানুষ বলে স্টুডিও থেকে সন্ধেরাতেই ছাড়া পাই। তবে আজ তা হবার জো ছিল না। প্রোডিউসার আগরওয়াল-এর সাথে আমাদের ডিরেক্টর রমেনবাবু'র ঝামেলা চলছিল অনেকদিনই। আজ তো সন্ধেবেলা সেটের মধ্যেই ধুন্ধুমার বেঁধে গেল। অবিশ্যি তারপর ঝামেলা মিটে ও গেছে, কিন্তু ওই প্যাক আপ হতে হতে এগারোটা বেজে গেল। সুযোগ বুঝে কাটতেও পারলুম না আর।

শেষে উদ্ধার করলেন মণিবাবু। তিনি বর্ষীয়ান অভিনেতা, এই লাইনে আছেন সেই বড়ুয়াবাবুর সময় থেকে, গাড়িতে ওঠার সময়ে আমায় ডেকে নিলেন রাশভারী মানুষটি। মণিবাবু যাবেন লবণ হ্রদের দিকে। ওদিকে এখন বাড়ি তৈরির ঝোঁক তৈরি হচ্ছে। শুনেছি জমিজমাও সস্তা। আবার আমি ফিরব আর্মহারস্ট স্ট্রিট। তাই অনেকটা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শ্রীমানি বাজারের মুখে নেমে যখন হাতঘড়ি দেখি, তখন রাত বারোটা বেজে দশ।

উত্তর কলকাতার ব্যস্ত সমস্ত বড় রাস্তা এখন শুনশান। নভেম্বরের শেষ, শীত টাও বেশ জম্পেশ পড়েছে। তাই অলিগলি সব দরজা জানলা এঁটে গভীর ঘুমে মগ্ন। দূরে দূরে পুলিশের সাইরেন ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। আজকাল দেখছি টহল পুলিশের ভয়ে দেহাতি ঝাঁকা মুটে ওয়ালারাও রাত হলে বেমালুম উধাও হয়ে যায়। অদ্ভুত এক অবিশ্বাসের দমবন্ধ পরিবেশে আটকা পড়েছে মহানগর। এই নিস্তব্ধ আর আতঙ্কিত শহরটায় যেন এখন একা আমিই জেগে! আগেই বলেছি, জোরে পা চালানোর উপায় আমার নেই, খোঁড়া মানুষ। তাও লাঠিতে ভর করে যতটা পারা যায় তাড়াতাড়ি হাঁটি।

চারমাথা'র মোড় পেরিয়ে অর্মহারস্ট স্ট্রিটের রাস্তায় ঢুকতে যাব, দেখি কালো শাল ঢাকা একটি ছায়ামূর্তি হাতিবাগান এর দিক থেকে এসে আমার বাড়ির রাস্তায় ঢুকল। মূর্তিটি এক যুবকের। কালো শালের নীচ থেকে আদ্দির পাঞ্জাবি আর ঢোলা পায়জামা দেখা যাচ্ছে। খুব ধীরে, যেন পায়ের আওয়াজ না পড়ে, সেভাবেই মিহি ধোঁয়াটে কুয়াশায় হেঁটে যাচ্ছে যুবকটি। তার গড়ন, তার হাঁটার ধরন আমার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। একবার মুখ ঘুরিয়ে ছিল সেই ছায়ামূর্তি। আধো আলো, আধো অন্ধকারে, কুয়াশার ভিতর সেই মুখ দেখে দমবন্ধ হয়ে এসেছে আমার। সুবল! ঝাঁকড়া চুল, চাপদাড়ি, আর সেই জ্বলন্ত একজোড়া চোখ। কোনও ভুল নেই। এগিয়ে যাচ্ছে সুবল। চার এর পল্লী গলির মুখে ফুল আর ধূপ কাঠির প্যাকেট পেরিয়ে অবলীলায় গলির ভিতর মিলিয়ে গেল আটমাস আগে এনকাউন্টারে মৃত সুবল!

আমি তখন ঘামছি, সুবলের মুখে যাকে দেখলাম সে আমার বাড়ির গলিতে, আমারই বাড়িতে ঢুকেছে। ভাবলেই আমার গা ভারী হয়ে আসছে! কীভাবে যে পা চালিয়ে বাড়ির গেটে এসেছি, তা আমি জানি না। তবে গেটের মুখে শোভাদিকে দেখে ধড়ে প্রাণ এল আমার। শোভাদি অপ্রকৃতিস্থ। সাত-আট মাস আগে ছোট ছেলে সুবলের মৃত্যু সংবাদের পর থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন। রোজই রাত করে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমি ফেরার পথে হেসে কথা বলি। পরে সুবলের দাদা বৌদি বুঝিয়ে সুঝিয়ে দোতলায় নিয়ে যায়। আজ তাকে দেখেই যেন আশ্রয় পেলাম আমি। আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে সেই বিধবা বললেন, "এই ফিরছ? অনেক রাত হয়ে গেল আজ। দ্যাখো কাণ্ড! সুবলটা এখনও এল না!"

আমি কোনোমতে মাথা নাড়ি। এই শোকে বিহ্বল মাকে কি তাঁর আত্মজর অতৃপ্ত আত্মার আভাস দেওয়া যায়! সুবলের দাদাকে খবর দেব ভাবতে ভাবতে কালো দরজার গেট খুলে উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় এলাম। শিখা আলো জ্বেলে জল এনে দিল। বললাম, "বিমলের বৌকে খবর দাও তো"।

শিখা বলল, "এত রাতে ওদের ডেকে কাজ নেই। আজ দুপুরে শোভাদি মারা গেছেন"। আমার হাত থেকে জলের মগটা পড়ে গেল! টলে পড়ে যাবার আগের মুহূর্তে শিখার গলা পেলাম, "ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক, সময় দেয়নি! একটু আগে নিমতলা থেকে ফিরল সব!"

 

পুনশ্চ: বাহাত্তর সালের সেই শীতের রাতে বাঁচার তাগিদে ভুয়ো মৃত্যু সংবাদ ছড়ানোর পরেও, কোনোভাবে খবর পেয়ে মাকে শেষ দেখা দেখতে সত্যিই লুকিয়ে এসেছিল নকশাল নেতা সুবল। কিন্তু না, মায়ের সাথে সুবলা'র আর দেখা হয়নি।

সৌরভ মাহান্তী, ১৪

সৌরভ মাহান্তী'র কবিতা

 

এ ই   শ হ রে র   রা খা ল

 

পাতারা ঝরেছে বহুদিন আগে। তখনও শীতের সকাল।

ফেলে আসা চোট, কুড়িয়ে রাখত এই শহরের রাখাল।

 

১.

এক-একটা শীতকাল ফুরিয়ে আসে ঝরে যাওয়াদের গল্প লিখতে লিখতে। চামড়া খসে পড়ার শব্দে কান্না পায় যে কপোত-কপোতীদের, তারা জানে আজ কার ঘরে নুন ফুরিয়ে এল, কার বটিতে আঁশটে গন্ধ।

 

বেলা শেষে কপোত-কপোতীরা উড়ে যায়। আনন্দ সহকারে রোদ আসে রাখালের ছাদে। রাখালও একে একে উঠোনে বিছিয়ে রাখে মাংসের দোকানগামী পশুদের শোক...

 

২.

যেসমস্ত পথে মানুষ হেঁটেছিল বহুদিন আগে সে পথে হাঁটতে গিয়ে দেখি, পথের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে কোনো এক রাখালের বাঁশি ভেঙে পড়ে আছে। বাঁশি কি বেজেছিল কোনোদিন? তবে সে বাঁশি ভাঙবে কেন?

 

এসব প্রশ্ন করো না আমায়। সুর যে কি বেদনার তোমায় কিভাবে বোঝাই এ অপরাহ্নবেলায়...

 

৩.

প্রভুর গাভী হারিয়ে যাওয়াতে একশো চাবুক খেয়েছিল যে রাখালবালক, আজ তার কথা মনে পড়ে রাঙাধুলোর। তুমি দেখেছো তাকে সারাটাদুপুর আদুড় গায়ে গাঁয়ের মোড়ে মোড়ে ফিরতে। তার মুখে ক্ষীণকায় বাঁশির আঘাত, পিঠে চাবুকের দাগ; বুকেতে কদমফুল।

 

সন্ধেবেলা শঙ্খ বাজলেই যে পাখিরা ঘুমিয়ে যায়। এ ভাবনা ভুল।

দূরের পোল্ট্রিকাটা দোকান থেকে উড়ে আসছে পালক

একটা...দুটো...তিনটে...

সাদা পালক আর ভাঙা বাঁশির টুকরো।

সন্দীপন দাস, ১৪

সন্দীপন দাসে’র কবিতা

 

১. দোয়াব


আর এভাবেই তুমি কেড়ে নিচ্ছ একে একে সব...

বশীভূত আগুন, শেষ তুরুপের তাস, ঐশ্বরিক সব ক্ষমতাও

আমাদের বন্ধুদের সবার অলক্ষ্যে সন্ধে নামছে

আলোর বমি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে মাটির খিদে, প্রজাপতির দল

মায়াবী তূণ লুকিয়ে অদূরে অপেক্ষা করছে জাদুজানলা

যে জানলার সামনে একদিন ঘরে ফেরার পথ হারিয়ে ফেলেছি আমি

আজ সেই জানলার সামনে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন হারিয়ে কাঁদছে অভি,

আত্মহত্যা ভুলে পাখির আকাশরক্ত মুছে আয়না

তবু সন্ধে নামছে হেমলক বন জুড়ে

ডানাপোড়া গন্ধের মতো...

গোপন মন্ত্রের মতো...

হারানো পথের মতোই...

আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছি অভিঐ পাখির আকাশ, আয়না― সবার শরীর ফুঁড়ে

ঝাঁকে ঝাঁকে আবারও উড়ে যাচ্ছে প্রজাপতির দল...

জাদুজানলা থেকে ভেসে আসছে বিষণ্ণ এসরাজের সুরধুলোর ব্যথা,

তোমার বিজয়ের কাহিনী, লেখা এ কবিতা...

 

#

সন্ধে নামছে...

আর এভাবেই তুমি কেড়ে নিচ্ছ একে একে সব...

সব...


২. ভলক্যানো


আকাশ মেঘলা, মনখারাপ করে শুয়ে আছে নদী

একটা সারস উড়ে এসে বসে ঠোঁটে এক অদ্ভুত আলো নিয়ে

অন্ধকার তা দ্যাখে, দ্যাখে সন্ধেমণি ফুল, মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবও...

কিন্তু কেউ সেই আলো ছুঁতে পারে না

শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দ্যাখে তুমি কী নিপুণতায়

ওই আলো নিয়ে মেখে নাও তোমার সারা শরীরে

আর তারপর...

তারপর ঠোঁটে করে সমস্ত মনকেমনমেঘরঙা ইচ্ছে

আর সম্রাটের জন্মান্তর নিয়ে উড়ে যাও কোনো এক

ভলক্যানোর দেশে...

আমার সমস্ত ফেরা মিথ্যে হয়ে যায়

দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখি আকাশ মেঘলা,

মনখারাপ করে শুয়ে আছে চোখ হারানো একটা সারস...

 

৩. সম্মোহন


মাঝেমাঝে খুব অভিমান হয় তোমার যখন একটা রোদেলা সকাল তোমায় বারবার লুকোচুরি খেলায় হারিয়ে দ্যায় আর প্রথাগতভাবে তোমার পৃথিবীকে দু'-তিনটে পলাশ বানিয়ে পিছন ফিরে মুচকি হেসে চলে যায় উদ্ধত সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো... তুমি কাফের! কাফের! বলতে বলতে ছুটে যাও প্রাচীন জলাশয়ের কাছে যেখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে একটা অসমাপ্ত যুদ্ধএকটা মনখারাপের বিকেল... তুমি জলাশয়ে ঝুঁকে পড়ো নিজের মুখ দেখার জন্য, দেখতে পাও না...তার বদলে দেখতে পাও সাম্যবাদের সবুজ রঙমুখ থুবড়ে পড়া একটা অন্ধ পাখির সঙ্গম...তাই দেখে পথ ভুল করে ফ্যালে সমস্ত শিকার, সমস্ত আততায়ী... তোমার আরও মনখারাপ হয়ে যায়... তোমাকে টার্গেটে রেখে কাঁধে ন্যাপস্যাক ঝুলিয়ে অদূরে অপেক্ষা করেন মানুষবেশী ঈশ্বর। পথের সাথে মিশে থাকা লাল, নীল, সবুজ-সব রঙেরও অভিমান হয়ওরা জলাশয়ের দিকে এগিয়ে যেতে চায় শব্দ ছুঁড়ে দিতে... ছুঁড়ে দিতে সঙ্গমলোভী সব যুদ্ধদেরও... তোমার সব গুলিয়ে যায়... তুমি আবার শুন্য থেকে শুরু করতে চাও... শুরু করতে চাও পানিপথের প্রথম যুদ্ধ থেকে...আর ঠিক তখনই কাফের! কাফের! বলতে বলতে ছুটে আসেন অদূরে অপেক্ষা করা মানুষবেশী ঈশ্বর... আবারও তোমার সবকিছু গুলিয়ে যায়... চোখের দৃষ্টি ব্লার হয়ে যায়। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ইসকাবনের গোলামবিবি, সাহেবের কর্পোল অস্থিরতা... তুমি ভয়ে চোখ বুঁজে ফেলো... মনে মনে ভাবো এবারও যুদ্ধ জেতা হল না তোমার... আবারও অভিমান হল তোমার... নিয়ন আলোর রাত তোমায় আরো একবার লুকোচুরি খেলায় হারিয়ে দিল আর তোমার গোলামবিবি, সাহেবদের অভিমানের বাংলা ভাষা বানিয়ে পিছন ফিরে মুচকি হেসে চলে গ্যালো উদ্ধত মোঘল সম্রাট বাবরের মতো... তোমার বুঝি এখন কান্না পাচ্ছে খুব?...

 

৪. জেরোফাইট


আর এভাবেই অবহেলায় কাটছে বিকেলগুলো

একটা কাঁটাগাছ ভিজে যাচ্ছে...

শুধু কিছু চেরা  জিভ লকলক করা সাপ শুধু দেখছে

কিভাবে তাদের মুখের শিকার আলো হয়ে ফুটে থাকছে রাজপথের শিরা-উপশিরা জুড়ে

অদূরে গাছের ডালে বসা পাখিটিও রঙ ভুল করে

মুখ থুবড়ে পড়ছে ওই তীব্র আলোর সামনে

আর এভাবেই এসব দৃশ্য ঢুকে পড়ছে কবির

কার্নিশ,দেওয়ালঅটোবায়োগ্ৰাফি জুড়ে

যেখানে অবহেলায় কাটছে বিকেলগুলো...

আর একটা কাঁটাগাছ ভিজে যাচ্ছে অনবরত...

 

 

৫. ডুয়ার্স

 

এখানে এখন আকাশের রং হলুদ

ঝালং-এর বিন্দু নদীর তীরে সেই কোন সকাল থেকে বসে

তুমি বুঝে নিচ্ছ জলের ওঠা-পড়ার শব্দ

জলস্রোতের সাথে পাথরের গোপন সন্ধি...

#

এখানে এখন গাছেদের রং লাল

রকস্ আইল্যান্ডের এই লাল পাইন, রডোডেনড্রন-এর

মধ্যে বসে লাঞ্চ করতে করতে তুমি একবারমাত্র

মুখ তুললে... দেখলে আশ্চর্য ভাবেই একটা পাহাড়ী পথ এসে মিশল

তোমার আঁচলে, আর তুমি মুচকি হেসে আঁচলটা গুটিয়ে নিলে...

#

হোটেলে ফেরার পথে গরুমারা অভয়ারণ্য যেখানে

আমাদের গাড়ির আওয়াজে ভয় পেয়ে ছুটে যাওয়া

বাইসন, হাতি, হরিণের পেছন পেছন তুমিও ঢুকে গেলে জঙ্গলে

তোমার পেছন পেছন পুরো দার্জিলিং শহর, টি-গার্ডেন, মেসোজোয়িক এরা, রিচার্ড অ্যাভেডন...

আর আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম তখন

অভিমানের রঙ কালো

ঠিক গতরাতের ট্রাইবাল ডান্স আর বোনফায়ারের

আগুনের ডগার মতো...

হোটেলের পাশের মূর্তি নদীর চাঁদভাঙা শান্ত জলের মতো...

#

দূরে... অনেকটা দূরে নীচুস্বর এ হুঁইশেল দিয়ে

নিউ মাল স্টেশন ছেড়ে যায় কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস...

#

আর টুপি হাতে ডিরেক্টর সামসিং-এর কুয়াশাবৃত পথে

তখনও একা দাঁড়িয়ে... একা...

শীর্ষা, ১৪

শীর্ষা’র কবিতা


অণু-পরমাণুর কবিতা

 

নূপুর

সামান্য ধাতুর কাছে যাবজ্জীবন বাঁধা

থাকছে গতি

 

গতি

সন্তানের হাসিটি ঢুকে পড়ল

মায়ের ঠোঁটে

 

ঠোঁট

অন্ধকারের জানালায় বাসা বানাচ্ছে

দুটি পাখি

 

পাখি

চিলতে আকাশের বুকে গড়ে উঠল

পালকের স্বপ্ন-শহর

 

শহর

নিজস্ব আস্তিনে লেগে থাকা বাসি

লিপস্টিকের দাগ

 

দাগ

একটি বক্ররেখা প্রেতাত্মা সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে

ঘুমের ভেতর

 

ঘুম

অবিশ্বাস্য কবিরাজি গাছ মায়ের স্বরযন্ত্রে

বসত বানিয়েছে

 

বসত

ইঁটের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে ফুচকা এবং আলুর

অবৈধ আলাপ

 

আলাপ

ফেরিওলা চুরি করে নিয়ে গেল দ্বিপ্রাহরিক

আরামের ঋতু

 

ঋতু

রোগ এবং শরীর সঙ্গমে লিপ্ত একজোড়া

কোকিলের চোখ

বাপন চক্রবর্তী, ১৪

বাপন চক্রবর্তী’র কবিতা

 

অরূপরতন

 

অরূপরতন ডাকব যাকে

সেই কথাটি আড়াল থাকে

সেফটিপিনে স্মৃতির কোণাতে...

 

কীভাবে সেই বিকেলবেলা

ছায়ার সাথে শালিখ বলা

ভুলব এসে বিজন প্রপাতে...


তখন  সারাদিনের পুতুলখেলা

ছড়িয়ে দিয়ে কুড়িয়ে ঝোলা

পথের ক্ষত ফিরবে বাসাতে...

 

আর কিউট কোনও মনখারাপে

হঠাৎই যার অধর কাঁপে

ফিরেছে সেও, মধুর, তোমাতে...

 

ছায়াকাহিনি

 

মেঘের ছায়ায় ভাসমান মুখখানি

ছড়িয়ে পড়েছে বন্ধনহীন চুলও

দুপুরবেলার সবকিছু তক্ষুনি

রহস্যচোখে ছায়ার শরীর ছুঁল...

আলো ছোঁয়াছুঁয়ি গাছের পাতায়, ডালে

বর্ষাবিকেল নাম ধরে ডাকি তাকে

জলের ছায়ায় এবং ছায়ার জলে

আজ হারিয়ে ফেলেছি এতদিন ধরে খুঁজে বেড়িয়েছি যাকে...

 

অ্যালবাম

 

পৌঁছতে পারিনি তাই দুপুরের গায়ে মরা শীত…

কেউ যেন রোদ্দুরে মুছেছে ভিজে হাত।

ওরা এসে নির্জনতা উল্টে দিচ্ছে ছাতে। চরাচর সিপিয়া অ্যালবাম।

তোমার চোখের কাছে, তবু, নতজানু হতে চাই...

খোলস খসিয়ে ফেলে দেহ থেকে

                           আকাশের শীত-চোখে

                                  পৌঁছতে পারিনি বলে

দুপুরের সবকিছু দাঁড়িয়ে রয়েছে...         

অসম্ভব প্রতীক্ষায়...

 

বসন্তদিন

 

অনুগ্রহ করে শুনবেন... এভাবে বসন্তদিন ডেকে ফিরেছে।

সমুদ্র ছিল ভীষণ সামুদ্রিক

মাংস আর যৌনঢেউ সারাদিন

চন্দ্রালোক ভিজিয়ে যেত রাত্রি।

নুন ছিল না তখনও ভালোবাসায়।

 

বিকেলবেলার গল্পরৌদ্রে আমাদের ঢেউরিক্সা

       অন্যমনস্ক হয়ে যেত সূর্যাস্তের দিকে

 

ফিরে যাওয়ার সময় সবাই হাঁ করে দেখছিল

নোনতা হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে অগোপন তথ্যসূত্র...

 

একাকী

 

এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল।

আশ্বিনের দ্বিপ্রহর। একমাঠ রৌদ্র।

কেউ যেন আসবে তাই... ছায়াকে ঠেলছে রোদ

                     রোদ্দুরে ছায়ার কণ্ঠস্বর...

কথাদিন অবসিত তারার আকাশে...

 

এভাবেই হেরে যেতে যেতে

              প্যারাসিটামল পথে

                     একাকী দাঁড়িয়ে থাকতে হবে...

সাত্যকি, ১৪

সাত্যকি’র কবিতা


অভিযান 

১.

আমি তো কখনও চাইনি

শহর হয়ে যাক

মফস্সলের এই একটুকরো জায়গা

 

দ্রুতগামীতা ভালো, কিন্তু যন্ত্রণাদায়ক

মফস্সলের ঢিকঢিকে চলন

এই বেশ

             খানিক ধুলো উড়ে আসা

              চুলে বিলি কেটে দেওয়া

কিছু গাছ হাঁসেদের সাঁতারের শব্দ

শালিকের গায়ে বসে থাকা বিকেল

ধান কাটা হয়ে যাওয়ার পর পড়ে

থাকা বার্ধক্যের মাঠ

 

এই বেশ

আমি কখনও চাই না শহরে হয়ে উঠুক

এই সব সকালের মতো প্রিয় ছবির মফস্সল   

 

২.

ভোর এখন কোনো অমীমাংসিত গল্পের ঠিকানা লিখে যায়

আর সেই ঠিকানায় লেখা নাম খুঁজে খুঁজে কেটে যায় পড়ে থাকা দৈনিক সময় 

তারপর অবসন্নতা হাসি কান্নাগুলো জড়ো হয় টেবিলের পাশে যেখানে রাত নেমে আসে

এখন জ্বর হলে কেউ নেই কপালে হাত রেখে সেই জ্বরের উষ্ণতাকে হারিয়ে দেওয়ার

বান্ধবীদের হাত ধরার সময় যে শেষ

মেঘ যেমন প্রত্যেক গাছের উপর থেকে চলে যায় দূরের সরণিতে 

তারাও চলে গেছে তেমনই পড়ে আছে মায়া   

সেই মায়া থেকে কিছু কুড়িয়ে রেখেছি

এগুলোই ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাবো আগামীর অভিযানে

ভেবেছি সেই অভিযানের একটা নাম দেবো

তোমাদের ফেলে রাখা সেই আলতা রঙের দুপুর থেকে কুড়িয়ে নেবো

তারপর থেকে সে আমার অভিযানের সঙ্গী হবে

সঙ্গী শব্দটা আজ বেশ আটকে ধরতে চায়

চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখতে বলে

একবার হাতড়ে দেখতে বলে কাঁধের ব্যাগ

চেয়ে দেখতে বলে কলেজ স্ট্রিট থেকে বারাসাতের পড়ে থাকা পথ

আমি যশোর রোডের পাশে দাঁড়িয়ে দেখি উড়তে থাকা ধুলো

একবার ঘুরে দেখতে বলে কুয়াশার নিচে পড়ে থাকা কলেজের মাঠ

মাঠের প্রত্যেক ঘাস আজ হলুদ

আমি যদি জিজ্ঞাসা করি কেন এই রূপ 

তার কোনো উত্তর সে দেয় না

মুখ ঘুরিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে

পর মুহূর্তে তাকিয়ে বলে একবার দেখবে নাকি ওই,ওই যে মাঠের পাশ দিয়ে

রেললাইনের দিকে চলে যাওয়া পথ

দেখে এসো অনেক মায়া পড়ে আছে পারলে কুড়িয়ে নিও

আমি যাব কি যাব না ভাবতে ভাবতে কখন যে পা বাড়িয়ে ফেলি খেয়াল থাকে না 

যখন সেই সব দিন ঘিরে ধরে খেয়াল হয় আমি হেঁটে যাচ্ছি তাদের গায়ের উপর দিয়ে

সেই পথের ধারের ঘাসেরা তেমনই আছে যেমন ছিল

তবে সেই খালের জলে এখনও অনেক শ্যাওলার বাস তাকিয়ে থাকলে মুখ দেখা যায় না

আর একটু এগিয়ে যাই পুকুর বিকেলের মাঠ রেলের ধার

প্রত্যেকেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে

আর ফিসফিস করে

আমি ওসব বুঝি না

কয়েক পলক দেখি তারপর এগিয়ে যাই এবার পথ শেষ

ফিরে আসিদেখি তখনও মাঠে দাঁড়িয়ে আছে

তাকিয়ে আছে আকাশে রঙ করা মেঘেদের দিকে 

আমি আর কথা বলি না এবার এগিয়ে যাই সামনের পথে

আমার পিছনে পিছনে একটা ছায়া এগিয়ে আসছে বেশ বুঝতে পারি 

তবে এই যাত্রা পথের নামটা এখনও ঠিক করতে পারি নি!  

 

৩.

প্রত্যেক সন্ধ্যার একটা নিজস্ব চেহারা আছে একটা গন্ধ রেখে যায় কয়েকটা দুমুখো সাপ ছেড়ে দেয় তার কয়েকটা কিছু পিঁপড়ে আর কিছু কুঁচে মাছের শরীর নেমে আসে নিবিড় অন্ধকারের ভিতর তারপর তারার নীচে কখনও চাঁদের নীচে নালার মতো অগভীর রাতে বয়ে যায় বসিয়ে দেয় একটা তীব্র ঘ্রাণ কয়েকটা মানুষের শরীরে কয়েকটা পশুর শরীরে... উদ্ভিদ দু পায়ে হেঁটে নদী পার হয় বালি চকচকে নদী তীরে বসে থাকা নেশা গ্রস্ত মাঠ কয়েকটা অনুচ্চ পাহাড়ের মতো ঘাস মৌমাছির মতো যারা এই সন্ধ্যায় গন্ধ নিতে আসে তারাও এই সন্ধ্যার নিমন্ত্রিত অতিথিদের একজন তারা চাঁদ আর মৌরলা মাছের মতো হাওয়ার নীচে প্রত্যেক সন্ধ্যা আমার তোমার চোখের প্রসারিত দৃষ্টির সমান্তরালে একটা চেহারা রেখে যায়, একটা গন্ধ রেখে যায়...

অন্তর চক্রবর্তী, ১৪

অন্তর চক্রবর্তী'র কবিতা


বৃক্ষমানব ও পয়গম্বর


১.

ষোলোটি ছায়াময় অরণ্য

পিছু নিয়েছে হরিণীর...

 

ভ্রমণ এখনও বোঝেনি,

 

কীভাবে

রহস্য সুপূর্ণা হতে পারে...

 

ঝুপ করে আলো নামল

আর ক্ষুর ছেঁকে ধরল অন্তিম

 

এই তবে ষোলোকলা ?

 

উদগ্রীব হরিণশিশু হয়ে

জেগে উঠল ঋতু

 

ভাঙচুর রহস্যের পাড়ে...

 

পা থেকে অরণ্যে

গড়িয়ে যাচ্ছে

 

চারটি ছায়াময় তেপান্তর...

(২০১৯, কৃতজ্ঞতা : জীবনানন্দ দাশ)

 

২.

তুমি

সেই সমর্পণ

অর্পণের প্রভূত অতীত...

 

যাত্রামুখ কেড়ে নিল

 

খাদ

অর্জন

তোমার আগামী বিপরীত...

 

ত্রস্ত শাদা আরশি থেকে খসে পড়ল চোখ

ঘুম এড়ানো জলসৌধ ভেজাচ্ছে প্রেতলোক...

 

তুমি

সেই অনর্গল

বিরলের চিহ্নজোড়া পা'য়...

 

চিরন্তন ফিরে এল

 

মূল

বল্কল

তোমার আগামী ঝরনায়...

(২০২০, কৃতজ্ঞতা : বাবা)

 

৩.

চিন্তক,

মানসীকে কেন ডাকো ?

দেহকল্প শোনাও ?

 

ঘুমরস নিতান্ত মিহি

একথা অজানা নয় তার...

 

পায়ে পায়ে গলি এসে

চিরে দ্যায়

আজন্ম প্রাসাদের লেশ...

 

তরলের থেকেও তরল

 

দিগন্ত

অশ্রু

স্নানে

 

মানসী ভেসে উঠছে

সুনীরা প্রসূতিগাছ হয়ে...

 

চিন্তক,

 

আমায় শিখিও দেহস্বর

মনোজ আকাশকুঁড়ি থেকে...

 

তোমার আলোয়

রেখে যাচ্ছি

 

নির্জন

আয়ুভাঙা শিথিল ঘোড়াদের...

(২০২০, কৃতজ্ঞতা : অমৃতা)