লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Wednesday, January 20, 2021

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৪

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প

ফেরা


মণিবাবুর গাড়িতে জায়গা না পেলে আজ আর ফেরা হত না আমার। সিনেমা লাইনে কাজ করি, রোজ রাত হবারই কথা। কিন্তু এত রাত হয় না কখনও। এমনিতেই কলকাতার পরিস্থিতি এখন খুব একটা ভালো নয়। ধরপাকড় আর গুমখুনে ছেয়ে গেছে শহরটা। তার উপর আমি খোঁড়া মানুষ বলে স্টুডিও থেকে সন্ধেরাতেই ছাড়া পাই। তবে আজ তা হবার জো ছিল না। প্রোডিউসার আগরওয়াল-এর সাথে আমাদের ডিরেক্টর রমেনবাবু'র ঝামেলা চলছিল অনেকদিনই। আজ তো সন্ধেবেলা সেটের মধ্যেই ধুন্ধুমার বেঁধে গেল। অবিশ্যি তারপর ঝামেলা মিটে ও গেছে, কিন্তু ওই প্যাক আপ হতে হতে এগারোটা বেজে গেল। সুযোগ বুঝে কাটতেও পারলুম না আর।

শেষে উদ্ধার করলেন মণিবাবু। তিনি বর্ষীয়ান অভিনেতা, এই লাইনে আছেন সেই বড়ুয়াবাবুর সময় থেকে, গাড়িতে ওঠার সময়ে আমায় ডেকে নিলেন রাশভারী মানুষটি। মণিবাবু যাবেন লবণ হ্রদের দিকে। ওদিকে এখন বাড়ি তৈরির ঝোঁক তৈরি হচ্ছে। শুনেছি জমিজমাও সস্তা। আবার আমি ফিরব আর্মহারস্ট স্ট্রিট। তাই অনেকটা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শ্রীমানি বাজারের মুখে নেমে যখন হাতঘড়ি দেখি, তখন রাত বারোটা বেজে দশ।

উত্তর কলকাতার ব্যস্ত সমস্ত বড় রাস্তা এখন শুনশান। নভেম্বরের শেষ, শীত টাও বেশ জম্পেশ পড়েছে। তাই অলিগলি সব দরজা জানলা এঁটে গভীর ঘুমে মগ্ন। দূরে দূরে পুলিশের সাইরেন ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। আজকাল দেখছি টহল পুলিশের ভয়ে দেহাতি ঝাঁকা মুটে ওয়ালারাও রাত হলে বেমালুম উধাও হয়ে যায়। অদ্ভুত এক অবিশ্বাসের দমবন্ধ পরিবেশে আটকা পড়েছে মহানগর। এই নিস্তব্ধ আর আতঙ্কিত শহরটায় যেন এখন একা আমিই জেগে! আগেই বলেছি, জোরে পা চালানোর উপায় আমার নেই, খোঁড়া মানুষ। তাও লাঠিতে ভর করে যতটা পারা যায় তাড়াতাড়ি হাঁটি।

চারমাথা'র মোড় পেরিয়ে অর্মহারস্ট স্ট্রিটের রাস্তায় ঢুকতে যাব, দেখি কালো শাল ঢাকা একটি ছায়ামূর্তি হাতিবাগান এর দিক থেকে এসে আমার বাড়ির রাস্তায় ঢুকল। মূর্তিটি এক যুবকের। কালো শালের নীচ থেকে আদ্দির পাঞ্জাবি আর ঢোলা পায়জামা দেখা যাচ্ছে। খুব ধীরে, যেন পায়ের আওয়াজ না পড়ে, সেভাবেই মিহি ধোঁয়াটে কুয়াশায় হেঁটে যাচ্ছে যুবকটি। তার গড়ন, তার হাঁটার ধরন আমার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। একবার মুখ ঘুরিয়ে ছিল সেই ছায়ামূর্তি। আধো আলো, আধো অন্ধকারে, কুয়াশার ভিতর সেই মুখ দেখে দমবন্ধ হয়ে এসেছে আমার। সুবল! ঝাঁকড়া চুল, চাপদাড়ি, আর সেই জ্বলন্ত একজোড়া চোখ। কোনও ভুল নেই। এগিয়ে যাচ্ছে সুবল। চার এর পল্লী গলির মুখে ফুল আর ধূপ কাঠির প্যাকেট পেরিয়ে অবলীলায় গলির ভিতর মিলিয়ে গেল আটমাস আগে এনকাউন্টারে মৃত সুবল!

আমি তখন ঘামছি, সুবলের মুখে যাকে দেখলাম সে আমার বাড়ির গলিতে, আমারই বাড়িতে ঢুকেছে। ভাবলেই আমার গা ভারী হয়ে আসছে! কীভাবে যে পা চালিয়ে বাড়ির গেটে এসেছি, তা আমি জানি না। তবে গেটের মুখে শোভাদিকে দেখে ধড়ে প্রাণ এল আমার। শোভাদি অপ্রকৃতিস্থ। সাত-আট মাস আগে ছোট ছেলে সুবলের মৃত্যু সংবাদের পর থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন। রোজই রাত করে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমি ফেরার পথে হেসে কথা বলি। পরে সুবলের দাদা বৌদি বুঝিয়ে সুঝিয়ে দোতলায় নিয়ে যায়। আজ তাকে দেখেই যেন আশ্রয় পেলাম আমি। আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে সেই বিধবা বললেন, "এই ফিরছ? অনেক রাত হয়ে গেল আজ। দ্যাখো কাণ্ড! সুবলটা এখনও এল না!"

আমি কোনোমতে মাথা নাড়ি। এই শোকে বিহ্বল মাকে কি তাঁর আত্মজর অতৃপ্ত আত্মার আভাস দেওয়া যায়! সুবলের দাদাকে খবর দেব ভাবতে ভাবতে কালো দরজার গেট খুলে উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় এলাম। শিখা আলো জ্বেলে জল এনে দিল। বললাম, "বিমলের বৌকে খবর দাও তো"।

শিখা বলল, "এত রাতে ওদের ডেকে কাজ নেই। আজ দুপুরে শোভাদি মারা গেছেন"। আমার হাত থেকে জলের মগটা পড়ে গেল! টলে পড়ে যাবার আগের মুহূর্তে শিখার গলা পেলাম, "ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক, সময় দেয়নি! একটু আগে নিমতলা থেকে ফিরল সব!"

 

পুনশ্চ: বাহাত্তর সালের সেই শীতের রাতে বাঁচার তাগিদে ভুয়ো মৃত্যু সংবাদ ছড়ানোর পরেও, কোনোভাবে খবর পেয়ে মাকে শেষ দেখা দেখতে সত্যিই লুকিয়ে এসেছিল নকশাল নেতা সুবল। কিন্তু না, মায়ের সাথে সুবলা'র আর দেখা হয়নি।

No comments:

Post a Comment