লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com
Showing posts with label গল্প. Show all posts
Showing posts with label গল্প. Show all posts

Sunday, September 25, 2022

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শারদ সংখ্যা

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটোগল্প


জিলিপি

 

সন্ধে হচ্ছে। যদিও ঘুরঘুট্টি অন্ধকার নামতে দেরি আছে। এখন চারপাশে বিকেলমরা ছাই ছাই রঙের আলো। খানিকটা কুয়াশার মতো। তেতে ওঠা দিনের শেষটুকু চেটেপুটে নিচ্ছে বাতাস। অজস্র কিচিরমিচিরের মধ্যে বড়ো রাস্তার ধারে জেগে উঠছে সান্ধ্যকালীন বাজার।

এধারে মাঠ। মাঠের শেষে কালীমন্দির থেকে কাঁসরের শব্দ ভেসে যাচ্ছে ওধারের ক্ষেতে। মন্দিরের পাশ দিয়ে যে ইটের রাস্তাটা হরিপুরা গঞ্জের দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তায় বৈশাখী অমাবস্যার মেলা বসেছে। একে একে কাঠিভাজা, গজা, জিলিপির দোকানগুলি বাঁশের ঠেকনা ওঠাচ্ছে। হুক করে আনা আলোয় বিশাল স্টোভে রসে জাল দেওয়া চলছে। কড়া মিঠে আর ভাজার গন্ধ ধোঁয়া হয়ে উঠে যাচ্ছে।

বড়ো রাস্তার ওধারে দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেতের ঢাল বেয়ে শেষ গোধূলির আলোয় উঠে আসছে একটা মুখ। প্রথমে উঠে এল রুক্ষ কোঁকড়ানো চুল, ঘোলাটে দুটো চোখ, আর উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ডিম্বাকৃতি মুখমণ্ডলে নরম দাড়ি-গোঁফের মাঝমধ্যিখানে জেগে থাকা অল্প কালচে ঠোঁট। তারপর ঈষৎ ঝুঁকে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এল নস্যি রঙের হাফশার্ট আর কালো প্যান্ট পরা রোগাটে একটা শরীর। বেঁটেখাটো ছেলেটা বড়ো রাস্তায় উঠে দুই হাত ঘষে ঘষে ঝাড়লো। তারপর টলতে টলতে কালীমন্দিরের পাশের রাস্তায় এগিয়ে গেল সে।

আজ শুধু চুমকি বিবি জানে, ইমরোজ গঞ্জে ঢুকেছে।

দুই হাত মুঠো করে প্রাণপণ চাপ দিল চুমকি। নলকূপ ককিয়ে উঠল। লোহার বালতিটায় লালচে জল নেমে এল। ভরা বালতিটা উঠোনের ধারে বয়ে নিয়ে গেল। কলঘরের টিনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। জাফরিকাটা খোপের ফাঁক বেয়ে শেষ বিকেলের লাল আলো এসে পড়েছে প্রায়ান্ধকার চৌখুপিতে। অনেকটা সময় নিয়ে যত্নে গা ধুয়ে নিল চুমকি।

ঘরে ঢুকে আলো জ্বালালো সে। ঘরটা একটেরে। জোরালো ডুমলাইটে সবুজ দেওয়াল দৃশ্যমান হল। সবুজ রংটা একবছর আগে নিকাহর সময়ে করিয়েছিল রহমত। তার জন্য চুমকির আব্বার থেকে টাকা আদায় করেছিল, সে জানে। টাকা দিতে ভ্যানরিকশাটা বেচে দিয়েছিল চুমকির আব্বা। এখন মালপত্তর নিয়ে হেঁটে বড়ো রাস্তার বাজারে যায়। শীতের সময় গায়ে লাগে না। ভরা গ্রীষ্মে কষ্ট হয়। সবুজ রং চোখে লাগে বলে চুমকি প্লাস্টিকের কালো কালো প্রজাপতি এনে দেওয়াল সাজায়।

মেটে রঙের ছাপা শাড়িটা ফুলে আছে। আয়নার তাক থেকে কুমকুমের বাটিটা পেড়ে এনেও আবার রেখে দিল চুমকি। কড়কড়ে মাড় দেওয়া শাড়িটার ভাঁজে ভাঁজে হাত চালিয়ে ফুলে ওঠা শাড়িটা বাগে আনলো। যত্ন করে হলুদ টিপের ফোঁটা দিল কপালে। আলতো আলতো আঙুল চালিয়ে হাতখোঁপার কাঁটাগুলো পরীক্ষা করে নিল। তারপর চৌকির তলা থেকে বের করে আনলো একটা জুতোর বাক্স। জুতো নেই। ভিতরে একটা ছেনি, দুটো ছোটো ছোটো হাতুড়ি, দিঘা থেকে কুড়নো কিছু ঝিনুক আর এক আঙুল লম্বা একটা শিশি। আতরের। রহমতের। লুকিয়ে রাখে। রহমতের না ফেরার দিনগুলোতে চুমকি লুকিয়ে লুকিয়ে আতর মাখে।

গলায় আর কাঁধের মাঝে আতর ঘষে নেয়। কব্জিতেও আতর দেয়। তারপর পয়সা ক’টা গুনে নিয়ে হাতব্যাগটা মুড়ে ফেলে বুকের ভাঁজে চালান করে। আলো নিভিয়ে ঘর বন্ধ করে চারপাশটা দেখে নেয়। সাবধানের মার নেই। বাড়ির পিছনে একটা মজা খাল। লোকে বলে সোনাই খাল। সেদিকটা দেখে এসে নিশ্চিন্ত হয়। সন্তর্পণে বেরিয়ে যায় চুমকি।

ঘন আলোয় ঢুকে কপালের ঘাম মুছে নিল ইমরোজ। গুমোট গরমে ভিড় বাড়ছে মেলায়। এদিকটা আগে ফাঁকা ফাঁকা ছিল। এখন দুয়েকটা বাইরের লোকের দোকান বসছে। হরিপুরা গঞ্জ খুব তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে। ছেলেপুলেরা শহরে চলে যাচ্ছে। শহরের পয়সা নিয়ে এসে বাড়ি-ঘর পাকা করছে। ক্ষেতখামার এখনও কিছু বেঁচে আছে বটে, কিন্তু মানুষের বুকের ভিতর থেকে ক্ষেতখামার উঠে যাচ্ছে। সরে যাচ্ছে। বদলে ইটের রাস্তা বসছে। পাঁচিল উঠছে। বুকের ভিতর থেকে ঢালাইয়ের একটানা আওয়াজ আসছে।

ইটের রাস্তাটার একধারে বাদামি কাপড়ে ঘেরা জায়গা। বাইরে টুনিবাল্ব জ্বলা গায়ে একটা রোবট দুই হাত ওঠাচ্ছে নামাচ্ছে। রোবটটার হাতে ধরা একটা গ্লোসাইন বোর্ড। তাতে লেখা- ‘ভিডিও নাইট’। ‘ভিডিও নাইট’ উঠছে, নামছে। ভিডিও নাইটের তাঁবুর পাশে একটা ভাজা মিষ্টির দোকান। অস্থায়ী। ভাজা মিষ্টির গন্ধে ইমরোজের পেটের খিদেটা ঘুলিয়ে উঠল। কাঠের বারকোশে থরে থরে সাজানো জিবেগজা, কাঠিভাজা, জিলিপি, খাজা। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দুটো নোট বের করে আনলো। একঠোঙা জিলিপি কিনে একটুকরো ভেঙে ঠোঁটের ভিতর দিতেই সকাল থেকে উপোসি পেট চনমনিয়ে উঠল। ইমরোজ এগিয়ে চলল।

মেলার আলো পেরিয়ে গেলে বাকি পাড়াটা অন্ধকার। অন্ধকারে দূরে দূরে একটা দুটো দোকান। দোকানের ভিতর টিমটিমে আলো। নিভু নিভু টিউবলাইট। এই এলাকায় বিদ্যুতের সমস্যা খুব। কয়েকটা পেটোয়া লোক অবশ্য নিজেদের ঘরে আলোর ব্যবস্থা করেছে। তাদের ঘরে বাকিরা চোখ টেরিয়ে তাকায়। সমীহ করে। সোনাইয়ের খাল বুজিয়ে সেখানে চিনিকল বসবে। তখন সঠিকভাবে আলো আসবে। ইমরোজ শুনেছে।

পালপাড়ায় ঢোকার মুখে ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আলো। হলুদ হলুদ আলোয় ইমরোজের চোখে হাসি দেখা দিল। দূর থেকে মুখোমুখি এগিয়ে আসছেন একজন। বাদামি পাঞ্জাবি আর সাদা ধুতি পরে এগিয়ে আসছেন জগৎজ্যোতি ভট্টাচার্য। হরিপুরা উচ্চবিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক। জগৎ স্যারকে দেখে ইমরোজ মাথা ঝুঁকিয়ে হেসে দাঁড়িয়ে পড়ল। 

‘তুই ইমরোজ না?’ ক্লাসে প্রথম হওয়া ছাত্রকে চিনতে পারলেন জগৎ স্যার।

‘হ্যাঁ স্যার। ভাল আছেন?’

‘ওই আর কী? যেমন থাকি। তা তুই আজকাল এখানে থাকিস না?’

‘না স্যার। মাঝেমাঝে আসি’।

‘থাকিস কোথায়? কী করিস’?

‘কলকাতার দিকে থাকি। বড়বাজারে একটা মশলা কারখানায় কাজ করি’। নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিতে দিতে ভিতরে আত্মবিশ্বাসের ঢেউ টের পাচ্ছে ইমরোজ।

‘আর পড়লি না কেন? ভাল ছাত্র ছিলিস। এভাবে ছেড়ে দিলি?’

‘আব্বা হুট করে মরে গেল। জমিজমা নেই, খাওয়ানোর কেউ নেই। কাজ খুঁজতে গিয়ে আর পড়া হল না’। ইমরোজের স্বরে ঈষৎ তাচ্ছিল্য লেগে রইল।

‘আজকাল তো কত নাইট কলেজ হয়েছে শুনেছি। সেখানে যেতে পারিস না?’

‘রাতে অন্য কাজ করি’। রোয়াব চেপে জবাব দিল ইমরোজ। ভিতরটা তার ফেটে যাচ্ছে।

হাল ছেড়ে দিলেন জগৎ স্যার। ‘অ! যা ভাল বুঝিস কর। ভাল থাক! ভাল থাক!’ বলে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। ইমরোজ এগিয়ে গেল।

খানিক এগিয়ে পিছনে ফিরতেই অবাক হল সে। জগৎ স্যার দাঁড়িয়ে পড়েছেন। পিছু ফিরে তাকে দেখছেন। চোখাচোখি হতে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। কাছে গেল ইমরোজ। মাথাটা ঝুঁকিয়ে জরুরি ভঙ্গিমায় জগৎ স্যার বললেন, ‘যা করবি ভেবে করবি বাবা। মনে নেই? ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না! 

পালপাড়ার মোড় থেকে অল্প দুলে দুলে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন স্যার। ডানদিকে ঘাড় হেলিয়ে দিল ইমরোজ। ঠোঙা থেকে আরেকটা জিলিপি তুলে কামড় বসালো সে। এগিয়ে গেল খানপাড়ায়, নিজের ভিটের দিকে।স্কুলবাড়ির সামনে খোলা জমি। হাল আমলে জমিটার গায়ে রাস্তাটা পিচের হয়েছে। ইমরোজদের সময় ঘাস উঠে মাটির পায়ে চলা পথ ছিল। পথটা উঠে গেছিল সোজা এক তলার করিডোরে। দুটো সিঁড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে ক্লাসের আগে ঘন্টা বাজায় গোবিন্দদা। ইমরোজ ভাবে, কতকাল দেখা হয়নি।

হলুদ স্কুলবাড়ি ছাড়ালেই বাঁশবাগান। এখন সেখানে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। এখান থেকে খানপাড়া অবধি আলোর ব্যবস্থা নেই। কবে হবে জানা নেই। রাগে একটা গালাগালি বেরিয়ে আসে মুখ থেকে। মাথাচাড়া দেওয়া রাগটা থামাতেই ঠোঙা থেকে আরেকটা জিলিপি তুলে মুখে পুরে দেয় ইমরোজ। পেটের ছুঁচোটা আপাতত শান্ত হয়েছে। আরও দুটো জিলিপি পড়ে আছে ঠোঙায়। ঠোঙাটা মুড়িয়ে রাখে সে।

শিকদারদের উঠোন পেরোলে পুকুর ধারের পথ দিয়ে ভিটেয় ঢোকা যায়। না হলে কসাইপাড়া দিয়ে যেতে অনেকটা ঘুরপথ হয়। শিকদাররা এপাড়ার সম্পন্ন পরিবার। দোতলার ঘরে লো ভোল্টেজে টিউব জ্বলে। ক্ষীণ আকাশি দেওয়াল দেখা যায়। খোলা জানালার বাইরেটা আলো হয় না। শুধু ঘরটুকু দেখা যায়। বাড়ির পিছনেই শিকদারদের বাগান। পাঁচিলের অনেকটা ভাঙা। ভাঙা পাঁচিল দিয়ে ঢুকলেই ইমরোজের ভিটে। আব্বার ভিটে। টালি চালের নিচে দুটো পাকা ঘর। বন্ধ পড়ে থাকে। প্রায় ভগ্নদশা। সাপখোপের রাজ্য হয়েছে শুকনো কুয়োতলা। পিছনে বয়ে গেছে খাল। লোকে বলে সোনাই খাল।

অনেকক্ষণ গুমোটের পরে পুকুরধারে হাওয়া দিচ্ছে। হয়ত দূরে কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। সেদিক থেকে বাতাস আসছে জলের গন্ধ মেখে। ইমরোজের শরীর জুড়িয়ে যায়। হাওয়া খেতে বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে বসে পড়ে সে। এই ঘাটে খেলতে আসত সে। মা মরা ছেলে, বাপটা সারাক্ষণ লোকের জমিতে মুনিষ খাটে, তবে লেখাপড়ায় মাথা ছিল। তাই দুয়েকজনের সমীহ জুটে যেত। সম্পন্ন শিকদাররা খানপাড়ার অন্য বাচ্চাদের দূর দূর করলেও ইমরোজ ঘাটে বসার নীরব অনুমতি পেয়েছিল। এই ঘাটে বসে ভরা দুপুরে সে ভাবত, সে কে? কোন ধুলোমাটি থেকে সৃষ্টি হল? এই বিপুল পৃথিবীতে তার নিজস্ব অস্তিত্বের প্রমাণ কী? একটা শরীর? এই-ই প্রমাণ? এর বাইরে কিছু নেই? এর বাইরে যদি কিছু থাকে তবে কী সেই অদৃশ্য যোগ যা তার অস্তিত্বের প্রমাণ?

‘কে রে? কে ওখানে? ওখানে কে বসে?’

   হাতে জিলিপির ঠোঙাটা একমনে দেখছিল ইমরোজ। আচমকা আরেকজনের উপস্থিতি জেনে মুখ তুলল সে।

ওহ! এ তো মিনতি চাচির গলা। রাগত কন্ঠস্বর। ইমরোজ টের পেল। ফের ভিতরের আত্মবিশ্বাস ঢেউ খেলে গেল যেন। ঘাড় ফিরিয়ে বলল, ‘আমি। ইমরোজ। বাগানধারে সৈয়দের ছেলে। মনে পড়ে?’

গোলাপি শাড়ি পরে মিনতি চাচি এগিয়ে এলেন। আধখানা চাঁদের আলোয় ভাল করে ঠাহর করে নিশ্চিন্ত হলেন। খুশিও হলেন। মুনিষের ছেলেটাকে ছোটবেলায় খেতে দিতেন। শুকনো মুখে পুকুরঘাটে এলে দোতলার জানালা বা ছাদ থেকে ডেকে নিতেন। ডাকখোঁজ ছিল অনেকদিন। তারপর সৈয়দ মুনিষ মরল, ছেলেটা শহরের দিকে কোথায় যে চলে গেল! এতদিন পরে দেখা।

‘ছিলিস কোথায় তুই? ভিটেয় তো ঘুঘু চড়ে! কোথায় পড়ে থাকিস?’

‘কলকাতায় থাকি গো চাচি। একটা মশলা কারখানায় কাজ করি’।

‘এখানে বাপ-ঠাকুরদার গেরাম ছেড়ে অতদূরে অনাথের মতন পড়ে থাকা কি ভাল? লেখাপড়া করিস আর?

‘ছেড়ে দিয়েছি’। হাসিমুখে জানায় ইমরোজ।

‘এখেনে জমির কাজ করতে পারিস না?’

‘পারি না। শিখিনি কিছু’।

‘থাকবি ক’দিন? 

‘আজ রাতেই ফিরে যাবো’।

‘সে কি! এতকাল পরে বুড়ি ছুঁতে ভিটেয় ফিরলি?’

‘একটা কাজ আছে’। ইমরোজ টের পায় উত্তেজনায় মাথার ভিতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। তবু নম্রস্বরে উত্তর দেয়। মিনতি চাচি ছেলেবেলায় তাকে খেতে দিয়েছে। মায়াটান ছিল।

চাচি কী বুঝলেন কে জানে, ‘দেখিস ব্যাটা, কুসঙ্গে পড়িস না! অভাবে স্বভাব নষ্ট করিস না!’ বলে শিকদারদের উঠোনের দিকে হাঁটা লাগালেন।

আরেকটা জিলিপি খেতে গিয়ে থেমে গেল ইমরোজ। ঘাট থেকে উঠে পড়ল। বাগানের ভাঙা পাঁচিলের দিকে হাঁটতে শুরু করল। অনেকক্ষণ পর টের পেল, সে অল্প অল্প জেগে উঠছে!

ভিটের ধারে পাঁচিলের গা ঘেঁষে অন্ধকারে মিশে দাঁড়িয়ে ছিল চুমকি। এখন চুমকি বিবি। ইমরোজকে টের পেয়ে আঁকড়ে ধরল। খয়াটে বুকের মধ্যে টেনে নিল। কথা বলার সুযোগ পেল না ইমরোজ। তার জিভে মিশে যাচ্ছে চুমকির জিভ। নাকে আসছে আতরের কড়া গন্ধ… 

এখন ভোর। ঠিক ভোর নয়। শেষ রাত শেষ হওয়া ভোর। ক্ষেত থেকে যেমনভাবে সূর্য বিদায় নিয়েছিল, তেমনভাবে ফিরে আসছে সে। একই রং ছড়িয়ে। একই প্রগলভতায়। ক্ষেতের শেষ প্রান্তে উঁচু ঢিবিটায় ঘাসের ওপর বসে আছে ইমরোজ। শরীর ক্লান্ত। চুমকি, তার ছেলেবেলার চুমকি, অন্যের হয়ে যাওয়া চুমকি তাকে নিঃশেষ করেছে কাল। সে খুব ভালবাসে এই মেয়েটাকে। তার চেয়েও বেশি ভালবাসে আলি সাহেবকে। হিসেবমতে আলি সাহেবের সব কথা মিলে গেছে! বাধা আসবে। আলি সাহেব বলেছিল বাধা এলেও সে যেন না ডরায়।

সেই দুপুরটা আজও মনে করতে পারে ইমরোজ। তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। সবাই ভিড় করে এসেছিল বড়ো রাস্তার ধারে। জায়গাটা ঘিরে রেখেছিল পুলিশ। একইরকম দুলে দুলে রাস্তা পার হচ্ছিলেন জগৎ স্যার। ব্রেক ফেল করেছিল পাঞ্জাব লরির। স্পটডেড।

বছর খানেক পরে একদিন রাতের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ইমরোজের। তখন আব্বা বেঁচে ছিল। এমন চিৎকার প্রায়ই আসে। তবু সেদিনকার চিৎকারে অন্য কিছু ছিল। আকাশ ফাটিয়ে ফেলার মতন কিছু। ‘চল তো দেখি!’ বলে উঠে বেরিয়ে গিয়েছিল আব্বা। শেষমেশ শিকদারদের উঠোনে পৌঁছে ভয়ংকর দৃশ্য দেখেছিল ইমরোজ। শিকদারদের ছোটো চাচা মদ খেয়ে এসে বাড়াবাড়ি রকমের অশান্তি করছিলেন। মিনতি চাচির ধৈর্য ভাঙতে তেড়ে গিয়েছিলেন। তাতেই উঠোনের ধারে পড়ে থাকা বাঁশ নিয়ে এসে স্ত্রীর মাথায় সজোরে বসিয়ে দিয়েছেন শিকদার চাচা। স্পটডেড।

আলি সাহেবের সবকটা কথা মিলে যায়। আলি সাহেব তার প্রাণের বন্ধু, পথপ্রদর্শক। ইমরোজ তার কালো প্যান্টের পকেট থেকে বের করে আনলো পিতলের কৌটো। প্যাঁচ কষে আটকানো। আলি সাহেবের দেওয়া। ঢাকনা খুলে দেখে নিল। ভিতরে কিছুটা লাল ভরেছে সে। কালচে। শুকিয়ে এসেছে। আকাশের রঙের সাথে মিল নেই।

প্যাঁচ বন্ধ করে পকেটে পুরে উঠে পড়ল ইমরোজ। খাল পেরিয়ে ট্রেন ধরবে সে। খিদিরপুরের গুমটিতে আলি সাহেবের কাছে যেতে হবে। 

ভোর কেটে এখন সকাল। সাতসকাল। শিকদারদের বাগানে বছর কয়েক আগে মিনতি চাচির মতন চেঁচিয়ে উঠল কেউ। মেটেরঙের শাড়ি জড়ানো মেয়েটা চিত হয়ে পড়ে। মুখটা চেনা চেনা লাগে। পাশের পাড়ার মেয়ে। চোখদুটো আধবোজা। মাথাটা বাঁ দিকে ফেরানো। ঠোঁটের চারপাশে জিলিপির মতো কিছু গুঁড়ো হয়ে লেগে আছে। বাঁ দিকের কষ বেয়ে গ্যাঁজলা নেমে গেছে। সাথে ডান পায়ের গোছে শাড়িটা উঠে গেছে। সেখানে বেশ কিছুটা জায়গা কাটা। রক্ত শুকিয়ে গেছে। মাছি ঘুরছে।

ভিড় বাড়ছে। ঘিরে থাকা ভিড় থেকে বেরিয়ে এল কেউ কেউ। তড়িঘড়ি পাশের গ্রামে রহমতের দ্বিতীয় সংসারে ছুটে গেল কেউ কেউ।

‘ওরে রহমত! ঘরে আছিস? শিগগির চ! তোর বিবি বিষ খেয়েছে!’

 

                        সমাপ্ত

সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়, শারদ সংখ্যা

সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটোগল্প

মধ্যবিত্ত


রোববার নাগাদ মুচকুন্দ দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, এই যে তার থলেটা(বাজারের) ক্রমশ ভারী হয়ে যাচ্ছে আর হাতলের নাইলন ডানহাতের চার আঙুলের কর বরাবর কেটে বসে যাচ্ছে এবং তার মতো আগু-পিছু দাঁড়ানো অন্যান্য মানুষদেরও মুখচোখ দেখে সহজেই এই সাম্যাবস্থাটি অনুমান করা যাচ্ছে, এই এতগুলো মস্তিষ্ক সম্মিলিত ভাবে এটা সহ্য করছে কেন?

 

কারণটা সম্ভবত বাঁ হাতের অপেক্ষাকৃত ছোট অথচ অপার সম্ভাবনাময় এবং মূল্যবান থলেটির মধ্যে নিহিত। যেখানে কুচো-মাঝারি-বড় তাই কাটা মাছেদের রূপোলি আহ্বানে সাড়া দেওয়ার পরও আরও খানিকটা শূন্যস্থান পড়ে থাকে। সেই শূন্যস্থানে গ্রামার টামারের ধার না ধেরেই নানা আকারের নানা প্রকারের একেকটি নধর দেহাংশ প্রবেশ করে।

 

মুচকুন্দর স্থির বিশ্বাস ঈশ্বরের অনেক অবতারের মধ্যে মুরগিও একটি অবতার। না তাই বলে পাঁঠা-পাঁঠি-ভেড়া কিংবা কাছিমের গোপনতাকে সে মোটেই ছোট করে না কিন্তু মুরগির প্রতি তার অনেকটা প্রথম প্রেমিকার চকোলেট চুমুর মতো দুর্বলতা আছে। আচ্ছা, মুরগি এত স্বর্গীয় বলে অনায়াসে মারা যাওয়ার পর অনায়াসে স্বর্গবাসী হয়, তা তো নিশ্চিত। বাংলা সাহিত্যের জ্ঞানীরা লিখে গিয়েছেন। স্বর্গেও তাহলে তাদের জন্য খোঁয়াড় রয়েছে। কিন্তু সেখানে যখন তারা ভাজা-সেদ্ধ-আধসেদ্ধ(না, নারকীয় ভাবে নয়) হয়ে থালা-বাটি-প্লেটের গরিমা বাড়ায়, তারপরে কি তাদের পুনর্জন্ম হয়? স্বর্গে কিছুদিন থেকে আরও বেশি স্বাদে ভরপুর হয়ে তারা কি আবার ফিরে আসে? ওই যে খাঁচার মধ্যে কেউ ডানা ঝাপটাচ্ছে(অকারণে) কেউ ধ্যান করছে কেউ মাতালের মতো ঢুলুঢুলু চোখে এই তালঢ্যাঙা লাইনটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, ওর মধ্যেই কি কেউ স্বর্গের অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত? মুচকুন্দ তীক্ষ্ণ চোখে বোঝার চেষ্টা করে। সেরকম কিছুই নাগালে পায় না। হতাশ হয়। বুঝতে পারে, ভালোবাসায় এখনও খামতি রয়ে গেছে, না হলে মুরগিদের নিজস্ব ভাবনা বা স্মৃতিচারণ সে এতদিন পরেও কেন ধরতে পারে না!

 

লাইনটা খুব ধীরে এগোচ্ছে। এক একটা আস্ত প্রাণী ক্যুইক মার্চের ছন্দে খাঁচা থেকে বেরোচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকটি অর্ধ-আবিষ্কৃত জ্যামিতিক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে ওজনযন্ত্রের ওপর আর তারপর কালো প্লাস্টিকের ব্যাগে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে ঝপাৎ শব্দে কোনও এক নাইলনের ব্যাগের সম্ভাব্য স্বাদ ও মূল্য দুটোই বাড়িয়ে গন্তব্যের দিকে দৌড়চ্ছে অবলীলায়।

 

জল্লাদ না না কসাই(আচ্ছা আরেকটু নরম কিছু বলা যায় না?) ছেলেটার বাঁ-হাতের মধ্যমার ঠিক মাঝখানটায় একটা বড়সড় আঁচিল। যখন একটি মুরগি জাতধর্মের হরেক চাহিদা পেরিয়ে বঁটির সামনে গলা পাতে আর ছ্যাঁড়াৎ করে একটা অপার্থিব শব্দ হয় আর মুন্ডুটা মাটিতে ছিটকে পড়ে হঠাৎ ভাষা ফিরে পায় যেন আর ধড়টা ডানার শক্তি ও তাৎপর্য সবেমাত্র বুঝতে পেরে ছরফর অথবা ছড়ফড় শব্দে খুশি বা আপত্তি জাহির করতে থাকে তখন মুচকুন্দ প্রতিবার বড় মুগ্ধ হয়ে সেই আন্দোলন চাক্ষুষ করে। একমূহুর্তের জন্যও চোখ সরায় না। কিন্তু মুশকিল টা হয় তার একটু পরেই। ছেলেটা যেই মন দিয়ে জ্যামিতি আঁকতে বসে মুচকুন্দের চোখ আপনা-আপনি ব্যাদড়া বাছুরের মতো ওই আঁচিলটার ওপরে গিয়ে থিতু হয়। প্রতিবার বঁটির ফলার গা বেয়ে টকটকে সৌন্দর্য গড়িয়ে পড়ে, ছেলেটার আঙুল গুলো অফুরন্ত হোলির আনন্দে মাতোয়ারা হয় আর মুচকুন্দ আঁতকে ওঠে। এই বুঝি আঁচিলটা আলাদা হয়ে গেলো। এই বুঝি সাধের পাকস্থলীর গায়ে মিশে গেল ঈষৎ ছাইরঙের একটা তুলতুলে গুটিপোকা।

মুচকুন্দ চোখ সরিয়ে নিতে চেয়ে বলল,

"দেখুন দেখুন, ওই যে ছোট্টমতো মুন্ডুটা এইমাত্র মাটিতে পড়লো, ওটা কেমন সুন্দর কথা বলার চেষ্টা করছে। ওই দেখুন, পরিষ্কার 'আ' বললো!"

সামনের ভদ্রলোক সিগারেটে একটা লম্বা টান মেরে ধোঁয়াটাকে ছাড়তে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে সেটা গিলবেন না ধরে রাখবেন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে প্রবল বিষম খেলেন। মুচকুন্দ তাড়াতাড়ি পিঠ চাপড়াতে গিয়ে শুনলো ভদ্রলোক নিঃশ্বাস নিতে নিতেই খুব হালকা করে "বোকা-ইত্যাদি", তৎসহ " সক্কাল সক্কাল এইসব শান্তির ছেলেগুলো যে কোত্থেকে এসে জোটে!" এই কথা'কটি স্পষ্ট উচ্চারণে বলে ফেললেন। মুচকুন্দ ভীষণ মুগ্ধ হয়ে গেল,

"আরে মশাই, আপনি যে দেখছি নাক দিয়ে চমৎকার কথা বলতে পারেন! কী দারুণ প্রতিভা! আমাকে শেখাবেন?"

ভদ্রলোক এবার কান ভুরু  কুঁচকে কিছু একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলালেন, তারপর স্বাভাবিক গলায় বললেন,

"দাদা, এত সকালেই চড়িয়ে এসেছেন না কি? ভুলভাল বকে মাথা খাচ্ছেন কেন?"

মুচকুন্দ অবাক হয়ে সঙ্গে সঙ্গে পাজামার গিঁটের নিচটায় তাকাল,

"না দাদা, চড়িয়ে তো আসিনি! সেরকম চড়েও না কোনওদিন! আপনার এরকম মনে হচ্ছে কেন?"

ভদ্রলোক একবার মুচকুন্দের কপাল থেকে পায়ের পাতা অবধি চোখ দিয়ে পায়চারি করলেন। কী যেন ভেবে একটু সরে দাঁড়ালেন আর বললেন,

"দাদা, আপনি আমার আগে দাঁড়ান।"

"এমা, না না তা কী করে হয়! আপনি এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন..."

"আরে কোনও অসুবিধে নেই। আমার অভ্যেস আছে। আপনি আগেই আসুন।"

"ধন্যবাদ আপনাকে", বলে মুচকুন্দ আর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেলো।

চতুর্ভুজ ষড়ভুজের চেয়ে ত্রিভুজ অথবা বৃত্তই বেশিরভাগ খদ্দেররা পছন্দ করে। দোকানি ছেলেটা খুব ভালো করে জানে। সে নিপুণ কায়দার মোচড়ে উপপাদ্য ও সম্পাদ্যগুলি একের পর এক শেষ করে নম্বর গুনে নিয়ে বাক্সে ঢোকায় আর মুচকুন্দ একসময় লাইন থেকে বেরিয়ে আসে। ভরন্ত ভাদ্রের রোদ এখন বড় বেশি গায়ে পড়ছে নাছোড় ভিখারির মতো। কাজেই হনহনিয়ে হাঁটতে থাকে সে।

ডানহাতের থলেটির ভেতর দায়গ্রস্ত গেরস্থের মতো সব্জি গুলো একে অন্যের পেছনে মুখ লুকোচ্ছে। মুচকুন্দ হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে একটা ক্যাপসিকামের দিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে সেটা একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বেশ কয়েকটা ধনেপাতার ছাউনির নিচে গা-ঢাকা দেয়। মুচকুন্দ হঠাৎ কেমন উদাস বোধ করে। বাবার কথা মনে পড়ে তার।

একমাথা চুল, অত্যন্ত ঘন দাড়ি(যার ফলে বাবাকে কোনওদিন গাল চুলকোতে হতো না) আর পুরু ঠোঁটের সুদর্শন বাবা। একমাত্র ছেলে সামনে এলেই চোখ কুঁচকে যেত তাঁর। মুচকুন্দের মুখটা একেবারেই তাঁর মতো শুধু ওই চুল দাড়ি আর ঠোঁটের গাঢ়ত্ব বাদ দিয়ে। না মানে চুল তার ছিলো, তবে খুবই পাতলা, সহজেই খুলির রঙ দেখা যেত। একবিন্দু দাড়িও কোনওদিন গজায়নি, এমনকি মরসুমি ক্রিমও তার গালে বসতি স্থাপন করতে পারত না, দ্রুত স্খলনের লজ্জা নিয়ে গড়িয়ে যেত। আর তার ঠোঁট, একটা সময় পর্যন্ত প্রায় নজরেই আসত না। মা মাঝে-সাঝে কাপড় মেলার ক্লিপ দিয়ে অধরোষ্ঠ দুপাশে টেনে রাখতেন। এই ছোটখাটো ব্যাপারগুলোকে সামান্য কল্পনা করে নিতে পারলেই ছেলে আর বাবা একেবারে যমজ। কিন্তু বাবার কল্পনাশক্তি ছিল না, থাকলেও সে বাবাকে ভয় পেত।

হপ্তার শেষাশেষি  মায়ের কোলে বসে উত্তমকুমার আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দিকে মায়ের মতোই জুলজুল করে তাকিয়ে থাকত মুচকুন্দ। একটু বড় হওয়ার পর যখন সে বুঝল উত্তমকুমার আর সৌমিত্র টিভির বাইরে কোথাও থাকেন না তখন সে লুকিয়ে বাবা-মা'র ঘরে যেতে শুরু করে। কেন লুকিয়ে? তা সে জানত না কিন্তু চুপিচুপি যেতেই ইচ্ছে করত বরাবর। আলমারি খুলে বাবার শার্ট ফতুয়ার মধ্যে মুখ গুঁজে দিতো। বাবা যখন অফিস থেকে ফিরে ঘামে ভেজা জামাপ্যান্ট বারান্দার আলনায় ছুড়ে ফেলে বাথরুমে যেতেন তখন ওই জামাটায় বিশেষত প্যান্টের কোমরের কাছটায় ছোট্ট নাক দাড়িহীন গাল আর প্রায়-অদৃশ্য ঠোঁটসহ সে কেমন একটা মিশে যেতে চাইত।

বেশ চলছিলো। একদিন বাবার চোখে পড়ে যায়। অবশ্য তার আগে অ্যাশট্রে থেকে বাবার ফেলে দেওয়া সিগারেটের ফিল্টার তুলে নিয়ে ঠোঁটে প্রাণপণ চেপে ধরা রয়েছে। স্কুল থেকে ফেরার সময় ভরাভরতি ট্রেনের কামরায় অচেনা লোকের সঙ্গে কোমরের নিচে নিরূপায় এবং আশ্চর্য ঘেঁষাঘেঁষির চাহিদা রয়েছে। ন্যাদাইদাদার হাত ধরে লৌকিকতাহীন দুপুরে চিলেকোঠায় গিয়ে তখনও অর্ধস্ফুট ঠোঁটে অদ্ভুত এক স্বাদ ও ব্যথার অনুভূতি রয়েছে। তা এসব পেরিয়ে যেদিন বাবার নজরে পড়ে যায়, সেদিন বাবার চোখের দিকে চোখ পড়তে শিউরে উঠেছিল সে। আরও অবাক হয়েছিল যে ব্যাপারটায়, বাবা বকুনি বা পিটুনি কোনওকিছুরই বিন্দুমাত্র ধারপাশ দিয়ে যায়নি আর এতে তার আশ্বস্ত হওয়ার কথা থাকলেও সে যেন কীরকম এক অস্বস্তির কবলে পড়ে প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের পছন্দের কর্মকাণ্ডগুলো নিজের মধ্যেই গুটিয়ে নিয়েছিল।

কয়েকদিনের মধ্যেই তার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হয়। একদিন বাবার বন্ধু ডাক্তার কাকা এসে খানিকক্ষণ কীসব পরীক্ষা-টরীক্ষা করে। তারপর গম্ভীর মুখে পাশের ঘরে গিয়ে বাবা-মা'র সঙ্গে সিলেবাসের ভার্সাই চুক্তির মতো কঠিন কোনও এক শলাপরামর্শ করে। পরের দিন থেকে হঠাৎ তার স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ হয়। পাড়ায় শক্তিশালী কোনও এক জাদুমন্ত্রে সবাই জেনে যায় যে, তার নাকি ভয়ানক অসুখ করেছে। বিছানা থেকে এখন অনেকদিন ওঠাই বারণ। বন্ধুরা দু'একবার দেখা করতে আসে আর বাবার চোখ তাকে যেন জাদুবলেই সম্পূর্ণ বোবা বানিয়ে রাখে।


একে একে বন্ধুরা দূরে সরে যায়, দুয়ে দুয়ে বন্ধুদের চেহারা আবছা হয়ে যায়, তিনে তিনে তাদের নামগুলোও মনে পড়ে না, চারে চারে, পাঁচে পাঁচে, ছয়ে ছয়ে, সাতে সাতে একের পর এক দিদিমণি তাকে পড়াতে আসে এবং বাড়ি বসেই সে উঁচু থেকে উঁচুতর ক্লাসে প্রমোশন পেতে থাকে, আটে আটে সে বুঝতে পারে বাবা নামক লোকটার ক্ষমতা বিশাল, না'হলে স্রেফ বাড়ি বসে এতগুলো রেজাল্ট আর সার্টিফিকেটের কাগজ কীভাবে তার করায়ত্ত হয়? নয়ে নয়ে হঠাৎ একদিন সে একটা চকচকে আপিসে যাতায়াত শুরু করে যেখানে সবাই বোবা ঘাড় গুঁজে খালি কাজ করে যায় আর দশ অবধি এসে সে নিজেকে অতুলনীয় এক ছাদনাতলায় আবিষ্কার করে আর শুভদৃষ্টির সময় অন্যদিকের দৃষ্টির শুভময়তা সে সহজেই টের পায় কেননা এই নতুন আঁখিপল্লবের সন্ধান ও রচনা বাবা নিজের হাতে সাঙ্গ করেছিলেন। বাবার ওপর অগাধ ভরসা বশতঃ সে এই নবাগতা সংযোজনের টিকে যাওয়া বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়।

 

বাবা-মা দু'জনেই প্রায় একইসঙ্গে তার ঠিক পরপর যেন অনেকযুগের চেপে রাখা শ্বাস প্রচন্ড গতিতে ছাড়তে ছাড়তে মুচকি হেসে চোখ বুজে ফেলেন।

মুচকুন্দ অ্যাদ্দিনে ভেদ করবার যথেচ্ছ সুযোগ যদিও পেয়েছে এবং এখনও পায় কিন্তু  তার মনের অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং মুখচোরা এক গলির মধ্যে ধারণ করবার যে ইচ্ছাটি সে একসময় লালন করত, সেটি বিকলাঙ্গ হয়ে স্বাভাবিক অভিযানের দিক থেকে লক্ষ্মীপেঁচার মতো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অবশেষে।

বেঁচে থাকা এক বড়সড় বালাই তাই অভিমান ঘেন্নায় বিবর্তিত হতে যতটা সময় লাগে তার ইঞ্চিটাক আগে সে খড়কুটোর মতো এই মুরগিপ্রেম আঁকড়ে ধরেছে। একে শখ, আবেশ কিংবা অনুগামীতা যা'ই বলা হোক, তার কিচ্ছু আসে যায় না। বউ নামক প্রাণীটির শরীরের সক্ষমতার প্রতি সমস্ত ঈর্ষা সে ঝোল ও ঝালের সৌকর্যে মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে এইভাবে।

ডোরবেল বাজানোর কিছুক্ষণ পরে বউ দরজা খোলে।

বউয়ের শরীর থেকে টাটকা অক্সিজেন ভেসে আসে আর মুচকুন্দের নাক জ্বালা করে। সে কলঘরের দিকে যেতে যেতে থলে দুটো একরকম ছুড়েই মারে বউয়ের দিকে। রোজকার মতো আজও বউ ক্যাচ মিস করে না।

মুচকুন্দ কৃত্রিম বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে নাক ঘষে। চোখ ছোঁয়।

গলা থেকে সাবান বোলাতে বোলাতে নাভির ঠিক ওপরে এসে থামে। টের পায় ফেনা গড়াচ্ছে। গড়িয়ে নামছে। নাভি পেরোচ্ছে। তলপেট ছুঁয়ে ফেলল এবার আর একটু...আর একটু নামলেই...সে চোখ টিপে বন্ধ করে বৃষ্টির বেগ বাড়িয়ে নেয়। ততক্ষণে অত্যাশ্চর্য এক সুগন্ধী বাড়ির আনাচে-কানাচে জবরদখল বসিয়েছে।

মুচকুন্দ রান্নাঘরের চেয়ে একটু দূরে ডাইনিং টেবিলে এসে বসে। টিভি চালায়--কোথায় যেন যুদ্ধ বেধেছে। যে দেশ হারছে তার মজুত করা সব খাবার যে দেশ জিতছে তারা খেয়ে নিচ্ছে বেমালুম আর একবারও ঢেঁকুর তুলছে না। হেরো দেশ থেকে পিলপিল করে মানুষ বেরিয়ে আসছে। অনেক উঁচু থেকে ছবি তুলছে কেউ অথচ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তারা মানুষ ছাড়া অন্য কিছু নয়। মুচকুন্দ ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো, "তাহলে কি মহাকাশ থেকেও মানুষকে মানুষ বলে চেনা যাবে যদি কারও ফোকাস পালোয়ানের মতো হয়?" চারদিকে তাকিয়ে দেখল শোনার মতো কেউই নেই। একটু লজ্জা পেলো সে।

 

মানুষগুলো এদিকে টিভির গোটা পর্দা জুড়ে লাইন দিয়েছে। বিরাট লাইন। এগোচ্ছেও না মোটে। মানুষগুলো ধৈর্য হারিয়ে একে অন্যের ঘাড়ের ওপর উঠে এগোতে চাইছে কিন্তু কেউ জায়গা ছাড়তে রাজি নয়। লাইন আরও লম্বা হচ্ছে মিনিটে মিনিটে। যে দেশ থেকে তারা বেরিয়ে আসছে তার ধারণ ক্ষমতা আন্দাজ করে মুচকুন্দ মুগ্ধ ও উত্তপ্ত হয়ে উঠল। অথচ যে দেশে তারা যাচ্ছে সেখানে কারও হাতে আঁচিল নেই। দেরী হচ্ছে, সময় লাগছে খুব।

 

মুচকুন্দ আরও উত্তপ্ত হয়ে টিভি থেকে চোখ সরালো আর অন্যান্য দিনের মতোই মুগ্ধ হয়ে গেলো। ঝাঁঝালো সুগন্ধী অদূরের কড়াই থেকে উড়ে এসে তার রোমকূপে বসছে ধীরে ধীরে।

 

"কী গো, হলো তোমার? আর কতক্ষণ?"

"এই তো, হয়ে এসেছে"

টিভির পর্দায় গোলমালটা এইটুকুর মধ্যেই আরও বেড়ে গিয়েছে। লাইনে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ দু'হাত তুলে চেঁচাচ্ছে। ওসব দেশেও কীর্তনের চল আছে না কি! তবে যেভাবে মুখ বিকৃত করে চেঁচাচ্ছে তাতে মনে হয় গালাগালিই দিচ্ছে কাউকে। বৃদ্ধের চোখ সামনের দিকে আর দুটো হাত আকাশের দিকে। মুচকুন্দ বুঝতে পারল না বৃদ্ধ ঠিক কাকে গালাগালি দিচ্ছেন। যে দেরী করাচ্ছে তাকে না কি ভগবানকে! দু'জনকে একসঙ্গেও দিতে পারেন। চেঁচাতে চেঁচাতে বৃদ্ধের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। গলার শির অসম্ভব ফুলে গিয়ে শুয়োরের গোঙানির মতো শোনাচ্ছে। বোধহয় অনেকক্ষণ জল খাননি। একজনও তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করছে না।


"কী গো, কী হলটা কী?"

"এই তো, দিচ্ছি এবার!"

 

হঠাৎ দারুণ শব্দে টিভির পর্দাটা যেন থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। একসঙ্গে একহাজারটা মেশিনগান অবাধ্য ফলতঃ অনাথ শিশুর মতো তারস্বরে কান্নাকাটি আরম্ভ করলো। পর্দার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ধবধবে সাদা, পরক্ষণে ধূসর, পরক্ষণে কালো। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না আর। শুধু ঘন ঘন ছ্যাঁড়াৎ ছ্যাঁড়াৎ করে কীসের একটা শব্দ আছড়ে পড়ছে। এই বুঝি ছিটকে পর্দার এপারে চলে আসে। ভলিউমটা এত বাড়াল কে? রিমোটটা কোথায়? হাতের কাছেই তো ছিলো! আঃ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? রিমোটটা কোন চুলোয়?


"বলি মরে টরে গেলে নাকি? এতক্ষণ লাগে একটা সামান্য কাজ করতে?"

"এই তো, এসে গে..." 

পরের টুকু মুচকুন্দ শুনতে পেলো না। এত শব্দ এত শব্দ!


পৃথিবী যেন আড়মোড়া ভাঙবার আর সময় পেলো না! হাতড়ে হাতড়ে মুচকুন্দ একটা টুকরোর নাগাল পেয়েই শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিতে মুখে ফেলল আর সঙ্গে সঙ্গে ত্রিলোক-বিদারী এক চিৎকার নিজেকে দেখে নিজেই আতঙ্কিত হয়ে মেঝেয় আছড়ে পড়ে খানখান হয়ে গেলো।

 

না ঝাল না নুন না মিষ্টি কেউ কাউকে ঘুণাক্ষরেও চিনতে পারে নি। থালার ময়দান জুড়ে একের পর একের পর এক নিখুঁত উপপাদ্য-সম্পাদ্যেরা হাসিমুখে তাকিয়ে রয়েছে অথচ কেউ কাউকে চিনতে পারছে না। সবাই একে অন্যের থেকে মুখ ফিরিয়ে কোনদিকে যে তাকিয়ে আছে বোঝাই যাচ্ছে না।

 

মুচকুন্দ হাঁ-করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। রোমকূপগুলো একটা একটা করে শুয়ে পড়ছে যার যার প্রিয় ভঙ্গিমায়। হাতদুটো কেমন জলের মতো হালকা এবং বিপজ্জনক লাগছে। অতিকায় একটা হিমবাহ গলে তার প্রত্যেকটা শিরার মধ্যে চলাচল বইয়ে দিচ্ছে যেন কতকালের চেনা।

 

মুচকুন্দ হাঁ বন্ধ করল। তারপর হাসি হাসি মুখে পা ছড়াল ময়দানে। লাইনটা এগোচ্ছে এবার।

আঃ বড় আরাম...বড় আরাম...

কিঞ্জল রায়চৌধুরী, শারদ সংখ্যা

কিঞ্জল রায়চৌধুরী'র ছোটোগল্প 

 নষ্টনীড়

নিজের নাম থেকে আ-কারটা ঘষে ঘষে তোলবার চেষ্টা করে চলেছে মিতা। ওরকম প্রতিবারেই করে। বিশেষ করে রাস্তায় অন্বেষাকে মুখোমুখি দেখলেই তার না-পাওয়া ইচ্ছেগুলো রক্তের ভেতর খলখলিয়ে ওঠে। তখন যেন আরও বেশি করেই সে তার মেয়ে-জন্মটাকে গায়ের জোরে অস্বীকার করতে চায়।

ক্লাস এইটে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারপর থেকেই মায়ের সুখ শান্তি গেছে উবে। মা, নীলিমা, এমন একটা সন্তান পেটে ধরবার আক্ষেপে দগ্ধ হতে হতে এখন কেবলমাত্র পোড়া ছাই হয়ে ধিকিধিকি জ্বলছেন। মায়ের জ্বলনে মিতার অবশ্য ভ্রূক্ষেপটুকুও নেই। সারাক্ষণ এক মর্দানি গরমে তার অন্তর বাহির টগবগ করে ফুটছে।

প্রথমটায়, বড় হওয়ার সন্ধিমুহূর্তে সে নিজেও নিজেকে নিয়ে বিস্মিত হয়েছিল। ছোটো করে ছাঁটা বয়কাট চুলে, দাড়িগোঁফ না গজানো আপাত মসৃণ গালের ওপর একপরত কাঠিন্য দেখে অবাক হত ঠিকই, কিন্তু নিজেকে কখনোই বেমানান মনে হয়নি তার। ব্রণ খুঁটে খুঁটে মুখে ইচ্ছাকৃত দাগ ফেলে তার মজা বেড়ে যেত তিনগুণ। বার-দুয়েক রেজারও চালিয়েছে গালে। দাড়ি-গোঁফ গজায়নি, গাল কেটে রক্তাক্ত হয়েছে। ব্লেডের সেই দাগ এখনও পুরোপুরি মেলায়নি, যত দিন গেছে, প্রথম রক্তক্ষরণের সেই আনন্দ তাকে শিহরিত করেছে! তাই সাইকেল থেকে নামার সময় প্রথম যেদিন রায়ান তার হাফ প্যান্টের নিচে তাকিয়ে চমকে উঠেছিল, বুঝিবা অ্যাক্সিডেন্টালি রক্তপাত ঘটেছে ভেবে— তার গালে আলতো চাপড় মেরে মিতা বলেছিল--‘হোতা হ্যায় বস্!’ সেই থেকে রায়ান তার বেস্টি। শুধুই বেস্ট ফ্রেন্ড, একটা ছেলে যেমন আরেকটা ছেলের ভালো বন্ধু হয়। কী আর করে বেচারা রায়ান! সে তো আর চাইলেও বান্ধবী হতে পারবে না!

তাই বলে নীলিমা, নিজের মা হয়ে এসব মানবেন কেন? সোমত্থ মেয়েটা গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি চাপিয়ে, হাফপ্যান্ট পরে, সাইকেল চড়ে চৌপ্রহর চারিদিকে টো-টো। দিন নেই রাত নেই, রাজ্যের রকবাজ ছেলেবন্ধু জুটিয়ে পাড়ার মোড়ে আড্ডা। তবু যদি তাদের কাউকে নিয়ে লটরপটরের কেচ্ছা রটত, কলঙ্ক হলেও সেটা বুঝিবা সহ্য করে নেওয়া সহজ হত। কিন্তু না, এ মেয়ে যেন সাক্ষাৎ অভিশাপ— এরকমটাই মনে হয় নীলিমার। একদিন তুমুল ঝগড়ার পর সটান মায়ের সামনে এসে শার্ট ছিঁড়ে খালি গায়ে বুক খুলে দাঁড়িয়েছিল মিতা। ‘মর আবাগি! মর মর …দিদিটা শ্বশুরবাড়ির মুখ পুড়িয়ে বাপের ঘর জ্বালাতে ফিরে এসেছে, গলায় দড়ি জোটেনি… এবার তুই অন্তত মরে আমাদের শান্তি দে!...’ বলতে বলতে মায়ের কন্ঠস্বর ক্রমশ বিলাপের মতো ঘ্যানঘ্যান করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে থেমে গিয়েছিল। এখন আর মেয়েকে কিছু বলেন না নীলিমা। ক্ষয়াটে চেহারা নিয়ে, রক্তশূন্যের মতো সাদাটে চাহনি চোখে মেখে ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকেন।

রবীন্দ্রনাথ অতশত বোঝেন না। শুধু বোঝেন তাঁর ছোটো মেয়েটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। প্লাম্বার রবীন্দ্রনাথ সারাটাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি সেরে ফিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলবার অবকাশটুকু পান না। ছোটো মেয়ে যে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে সেটা বুঝেও বোঝেন না করনীয় কী! অবশ্য বড়োটাকে নিয়েও যে মনে খুব উচ্চ আশা কোনোদিন পুষেছিলেন তা নয়; তবু বয়সযোগ্যা মেয়েকে ভালো ঘরে পাত্রস্থ করে সুখী দেখতে কোন বাবা-মা না চায়!

রবীন্দ্রনাথ দেখেশুনেই বড়ো মেয়ে গীতার বিয়ে দিয়েছিলেন। সে বিয়ে টেকেনি। মাস-ছয় গড়াতে না গড়াতেই শ্বশুরবাড়ি থেকে পাহাড়প্রমাণ অভিযোগ। ক্রমে সেসব অভিযোগের কথা হাওয়ায় মিশে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে ফিরে আসতে লাগল রবীন্দ্রনাথের কানে।

প্লাম্বার রবীন্দ্রনাথের দুই মেয়ের কেচ্ছা পাড়াশুদ্ধু লোকের জানা। 

মেয়েটা যে তোমার দেখতে হতকুচ্ছিত, সেটা তো আর মিথ্যে নয় রবীন! ...তার ওপর যদি ঘরের কাজকম্মো রান্নাবান্নাটাও ঠিকঠাক না করতে পারে— সে ভারি লজ্জার কথা…

নটুদার চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে পাড়ার বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ লোকেদের মুখে মাঝেমধ্যেই এইসব শুনতে হত। রবীন্দ্রনাথ রা কাড়তেন না। চুপচাপ শুনতেন। ভিজে সপসপে হাফশার্ট আরও ভিজে যেত ঘামে। কাঁধের ওপর ফেলা গামছা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কপালের ঘাম মুছতেন।

এ-ও না হয় একরকম মেনে নেওয়া, সয়ে নেওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু ছোটো মেয়ে মিতা তার বাবার মানসম্মানের তলানিটুকুও যেন ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চায়! কলমিস্তিরি হলেও রবীন্দ্রনাথের একটা ইজ্জত তো আছে। তাকে এলাকাতেই করে খেতে হয়।

ফ্ল্যাটবাড়ির এক বাবুর ছেলে লন্ডন না কোথা থেকে কীসব কোর্সটোর্স করে এসেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বললেন, মিতাকে ভালো ডাক্তার বা সাইকি দেখান রবি কাকু। বললেন, অনেকের মধ্যেই এমন দোগলা লক্ষণ দেখা যায়। আদিমকাল থেকে পশুপাখিদের মধ্যেও এমন দেখা গিয়েছে! রবীন্দ্রনাথ এতসব জটিল ব্যাপার বোঝেন না। এমনও হয়! কই আমাদের বেলায় তো কারওর মধ্যে এমন কোনোদিন দেখিনি! দেখেছি কি! সংশয় দানা বাধে মনে। তুই এমন কেন হলি মা!...

আজ ঘরদোরের জিনিসপত্র ঘেঁটে তছনছ করে ফেলেছে মিতা। পুরোনো বাক্সপ্যাঁটরা খুঁজে খুঁজে বের করে এনেছে তার বার্থ সার্টিফিকেট। মেঝেয় ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে সার্টিফিকেটের নাম থেকে আ-কারটা চিরতরে মুছে ফেলতে চাইছে। সে মিতা থেকে ‘মিত’ হতে চায়। তারপর অন্বেষাকে ভালোমতো টের পাইয়ে দেবে তাকে রিফিউজ্ করার খেসারত কেমন করে দিতে হয়। ইরেজার ঘষে ঘষে কালো করে ফেলেছে নামের আ-কার। আ-কার তো নয়, এ যেন জন্মদাগ।

মিতার দিদি গীতা, হতকুচ্ছিত কালো মেয়ে গীতা--শ্বশুরবাড়ির কালি মেখে যেন আরও কালো হয়ে উঠেছে। মা কিছু বলছে না দেখে তাকেই এগিয়ে আসতে হল। কী করছিস তুই মিতা? পাগল হয়ে গেলি?

তুই থাম! —মিতা মুখঝামটা দিয়ে ওঠে। নিজের তো মুরোদ ছিল না একটা প্রেম করবার। সলমানকে মুখ ফুটে বলতে গিয়ে অপমানিত হয়ে কেঁচোর মতো গুটিয়ে গেলি! তারপর বাবা-মা যেখা‌নে হাতপা বেঁধে ফেলে দিল, সেখানে গিয়ে লাথি ঝাঁটা খেয়ে ফিরেও এলি মাথা নীচূ করে। তোকে সাফ বলে রাখছি দিদি, আমার ব্যাপারে একদম নাক গলাতে আসবি না! শুধু এটুকু জেনে রাখ, সলমানকে আমি ছাড়ব না।

নীলিমা দু-মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে মেরে যান। পুরোনো ড্রেসিংটেবিলের পারা-চটা আয়নায় তাঁর প্রতিবিম্ব ভারি বিচ্ছিরি দেখায়।

সলমানের অভিনয় একবারই দেখেছিল মিতার দিদি গীতা। পাড়ার ক্লাবের ‘নষ্টনীড়’ নাটকে। বইটা সে পড়েনি, তবে সিনেমার সৌমিত্রর সাথে মিলিয়ে দেখে মনে হয়েছিল সলমানই সেরা কিন্তু মনের সেই অভিজ্ঞতা সে কি জানাতে পারবে সলমানকে? সলমান গরিব কিন্তু শিক্ষিত ছেলে। ফর্সা, হালকা দাড়িগোঁফ। দেখতে ভারি মিষ্টি। নাটক করা ছেলে হলেও তার কোনো অহংকার নেই। খদ্দরের গোলাপি শার্ট পরে সাউথ সিঁথির মোড়ে টেবিল পেতে দিনেরবেলায় চা-বিস্কুট বিক্রি করে। কলেজের ছেলেমেয়েরা ঝাঁক বেঁধে ভিড় জমায় সলমানের চায়ের দোকানে। সলমানের চায়ের বিশাল চাহিদা। এতসব জেনেও গীতা একদিন তার অফুরান ভালো লাগা বুকে নিয়ে সলমানের দোকানে গিয়ে সাহস করে বলেছিল, আমি আপনার অভিনয় দেখেছি। একদম প্রথম লাইনের চেয়ারেই বসেছিলাম। আপনি আমাকে দেখেননি?

কই না-তো! ঠিক খেয়াল করিনি। যাই হোক, আমার অভিনয় ভালো লেগেছে, জানানোর জন্য ধন্যবাদ।

আর কিছু বলেনি সলমান। একবারের জন্যেও ফিরে তাকায়নি তার দিকে। কলেজের মেয়েগুলোর দুধ কম, চিনি বেশি এসব নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এক ভাঁড় চা-ও কি তার প্রাপ্য ছিল না! সে না হয় পয়সা দিয়েই খেত। যেন তার কোনো অস্তিত্বই সলমানের চোখে পড়ছিল না সেদিন! গীতা আর দাঁড়ায়নি। সেই প্রথম, সেই শেষ।

কিন্তু এইমাত্র কী বলল মিতা? সলমানের ওপর ওরই বা এত রাগ কিসের? দিদির ওপর দরদ থেকে নিশ্চয়ই নয়!

কী হয়েছে, আমায় খুলে বলনা বোন!

মিতা ঝট করে ঘাড় তোলে যেন ফণাওঠা সাপ। তার জলভরা চোখ আরও বেশি লালচে দেখায়। দু’হাত দুপাশে ছিটিয়ে চিৎকার করে ওঠে –‘অন্বেষা আমার! শুধু আমার আমার আমার!...তোর সলমান আমার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি শেষ করে দেব সলমানকে…’

শান্ত হ বোন!

চুপ থাক তুই! আর হ্যাঁ, আমি কারও বোন-টোন নই।

আবার বার্থ সার্টিফিকেটের ওপর ঝুঁকে পড়ল মিতা। এবার আর ইরেজার নয়। আ-কারটাকে ব্লেড দিয়ে ঘষটে তোলার চেষ্টা করছে। চোখ থেকে টপটপ করে দু’বার নোনা জল পড়ল বার্থ সার্টিফিকেটে। মনে পড়ছে স্কুল ছাড়ার আগের দিন অন্বেষার গালে চুমু খাওয়ার কথা।

ক্লাসে দুজনে একসঙ্গেই থার্ড বেঞ্চে বসত। পড়ার নোটস ভাগাভাগি করত, টিফিন ভাগ করে খেত। আর সুযোগ পেলেই অন্বেষার হাতটা মুঠোয় চেপে ধরত। মেয়েদের অমন সহচরী খেলা হয়। কিন্তু এই সাধারণ ব্যাপারটা ক্রমশ বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। হাত ছাড়িয়ে নিতে শুরু করল অন্বেষা। দূরে সরে যেতে লাগল…

স্কুল ছেড়ে পুরোপুরি বখে গিয়েছিল মিতা। অন্বেষা দূর থেকে দেখলেও পাত্তা দিত না। মিতা ইলেক্ট্রিকের কাজ জানত, টুকটাক কাজ করত। কনস্ট্রাকশনের ইটবালি সাপ্লাইয়ের কাজ ধরল। লোন করে স্কুটার কিনেছে। সেই স্কুটারে ‘উড়তি ফিরুঁ’ ‘উড়তি ফিরুঁ’ করে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। আজ সিগারেটের দোকানে স্কুটার থামিয়ে গুটখা কিনছিল। তখনই হঠাৎ অন্বেষার সাথে দেখা। মিতা কথা বলতে যাবে…মুখ ফিরিয়ে নিল অন্বেষা। বয়ফ্রেন্ড ছিল। সে-ও চেনা। দিদির নষ্টনীড়ের নায়ক গোলাপি শার্ট পরা সলমান মন্ডল। তারই হাত মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাস্তা পারাপার হয়ে গেল অন্বেষা! দৃশ্যটা ভাবলেই মিতার চোখ জ্বালা করে উঠছে…পণ করেছে নামের শেষে আ-কার এবার কিছুতেই আর রাখবে না…

রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রপাতির থলে-হাতে বাড়ি ফিরছিলেন সাইকেলটা হাঁটিয়ে। পা চলছে না। প্যাডেল মারতেও ইচ্ছে করছে না আজ। এমনিতেই কলমিস্তিরির কাজ ভারি ঝামেলার। তার ওপর আজ পয়সাকড়ি পাননি। কাজটাই যে হল না পুরোপুরি। ফ্ল্যাটবাড়ির এক বাবুর বাথরুমে জল পাস হচ্ছে না। নালি জাম। জলভারা বাথরুমে উপুড় হয়ে পাইপ লাইনে এক হাত ঢুকিয়েও কিচ্ছু খুঁজে পাচ্ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। শার্ট প্যান্ট জলে ভিজে ঘেমেনেয়ে একাকার। নালির ভেতর যতদূর হাত যায়, সেঁধিয়ে দিচ্ছিলেন…নাহ্! কিচ্ছু নেই। নাকি চেষ্টা করেও পেরে উঠছেন না রহস্যটা জানতে। মাথায় ঘুরছে একটাই প্রশ্ন, ‘তুই এমন কেন হলি মা?’

Sunday, February 20, 2022

সোহিনী চ্যাটার্জী

সোহিনী চ্যাটার্জী-র গল্প

 

অপরিচিতা

                                          (১)

কিছু কিছু রাত স্তব্ধতার চাদরে মুখ ঢেকে, শিরশিরে শীত আর ঝিরঝিরে বৃষ্টির ছন্দে শহরের বুকে নিত্যনতুন রূপকথা লিখতে ভালবাসে। সূর্য ওঠার আগে পর্যন্ত, বৃষ্টির রূপোলী স্পর্শ দিয়ে বিভিন্ন রঙের রূপকথার জন্ম ঘটায়। রাত যত ফুরিয়ে আসে, রূপোলী রূপকথাগুলোর শরীরেও অন্ধকারের গোপনীয়তা সরিয়ে, সূর্যের স্পর্শ মেখে স্বীকৃতি পাওয়ার তৃষ্ণা জাগে। তবে সূর্য ওঠার পর হাজার ব্যস্ততা আর ট্রাফিকের ভিড়ে এই রূপকথাগুলো যে কোথায় হারিয়ে যায়তারা আদপে কোনওদিনও পূর্ণতা পায় কিনা, তার খোঁজ কেউ পায় না, বলা বাহুল্য খোঁজ রাখে না কারণ শত হোক, তারা রূপকথা তো! রূপকথা যে একদিন হারিয়ে যাবে তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে? হারিয়ে যাওয়াই তো তার ভবিতব্য!

ঘড়ির কাঁটা বলছে রাত একটা বেজে চল্লিশ মিনিট। ডিসেম্বরের নিঝুম কলকাতায় বৃষ্টি নেমেছে আলতো ছন্দে। আর একটা রূপোলী রূপকথা তার ঝিলমিলে ডানা মেলে প্রণয়ের আকাশে উড়ে যাওয়ার উপক্রম করছে সুব্রতর মোবাইলে রাত জাগা মেসেঞ্জারের স্ক্রিনটার ভেতর থেকে। মেসেঞ্জারের দুই পাড়ে রাত জেগে বসে থাকা দুজন মানুষ বোধহয় একটু একটু করে স্পর্শ করতে পারছে এই রূপকথাটা। সুব্রতর কাচের জানালা ভেদ করে আসা সোনালী ল্যাম্পপোস্টের ভিজে আলোটা অকারণে হেসে যাচ্ছে ওদের দেখে। টিং করে আবার একটা মেসেজ ঢুকল তার ফোনে

কি গো, বললে না তো, এই যে তোমার গান গাইতে এত ভালো লাগে, গলাটাও এত সুন্দর, তাহলে গায়ক না হয়ে খামোকা ইঞ্জিনিয়ার হলে কেন?

অনন্তরূপার এই প্রশ্নে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল সুব্রত। সবে এক মাস হল ফেসবুকে তার আলাপ হয়েছে এই মেয়েটার সঙ্গে। এর মধ্যেই নিজের সম্বন্ধে অনেক কথা বলে ফেলেছে সুব্রত। কিন্তু ঐ পাড়ের মানুষটা এখনও অবধি কিছুই বলেনি। এমনকি ওর একটা ছবি পর্যন্ত দেখেনি সুব্রত। অনন্তরূপার প্রোফাইলের আলো-আঁধারি প্রোফাইল পিকচারে শুধু এক গোছা চুলে ঢাকা একটা রহস্যময়ী মুখের কিছুটা ছায়া ছায়া অংশ ছাড়া আর কিছুই বোঝা যায় না। তার প্রোফাইলে আর কোনও ছবিও নেই। টাইমলাইন জুড়ে শুধুই রাশি রাশি কবিতা। ছবি চাইতে গেলে বলে এখনও তাকে দেখার সময় হয়নি সুব্রতর। প্রোফাইলের নামটাও আসল নয়, ম্যাডামের মতে এখন আসল নাম জানারও নাকি সুব্রতর সময় হয়নি।

সে তো তুমিও অনেক কিছুই বলোনি অনন্তরূপা। এই কথাটা আমিও নাহয় নাই বললাম।

ঐ দেখো, রাগ করলে তো? তোমাকে তো বলেছি, আগে আমার কবিতা দিয়ে আমায় চেনো, তারপর সব বলবো। এখনো সময় হয়নি তোমার সবটা জানার সুব্রত।

রাগ করিনি, কিন্তু এত কিসের গোপনীয়তা বলো তো তোমার? তুমি একটুও বিশ্বাস করো না আমায় তাই না? বিশ্বাস করলে সব বলতে।

ওরে পাগল, নাম, পরিচয় এই সবই তো পার্থিব। এসবের ঊর্ধ্বে গিয়ে এই মানুষটাকে চেন না। কবিতাগুলো বুঝতে পারলে অনেকখানি জেনে যাবি আমার ব্যাপারে।

ধুর! আবার জ্ঞান দেওয়া শুরু হয়ে গেল। এই কী চাও বলো তো তুমি? এইসব জ্ঞান দিয়েই সারা জীবন চলবে? আর কিছু জানতে পারব না তোমার ব্যাপারে কখনও? কী চাও সেটা সত্যি করে বলো তো আমায়, আমিও তাহলে সেভাবেই মিশবো তোমার সাথে।

কী আবার চাইবো! আপাততঃ একটা গান শুনতে চাই। আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে  কী এনেছিস/ হাসির কানায় কানায় ভরা নয়নের জল/ বাদল-হাওয়ায় দীর্ঘশ্বাসে যূথীবনের বেদন আসে/ ফুল ফোটানোর খেলায় কেন ফুল-ঝরানোর ছল…” এই গানটা রেকর্ড করে একটু পাঠাও তো। রাত অনেক হল, এটাই শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বো।

তুমি না আর শুধরোবে না!

খামোকা ঝামেলা না করে পাঠাও না গানটা। প্লিজ।

আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। পাঠাচ্ছি।

গিটারটা নিয়ে গান রেকর্ড করতে বসল সুব্রত। বাইরের বৃষ্টিটা বোধহয় সেই গান শুনতেই আরেকটু ঝেঁপে এলো।

 

                                                            (২)

দুপুর একটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। অফিসের ক্যান্টিন থেকে টিফিন সেরে এসে, মোবাইলের নেটটা অন করতেই ভুরুটা কুঁচকে গেল সুব্রতর। রোজ একটা থেকে দেড়টার মধ্যে একবার ফোন বা অন্তত একবার মেসেজ করে অনন্তরূপা। কিন্তু আজ কোন মেসেজ বা মিসড কল কিছুই নেই। গত চার মাসে একটু একটু করে সম্পর্ক গাঢ় হয়েছে সুব্রত আর অনন্তরূপার। এখন হোয়াটসঅ্যাপ বা ফোনেই অধিকাংশ সময় কথা বলে তারা। রাত জাগা মেসেঞ্জারের এখন পদোন্নতি হয়েছে সারা রাতের ফোন কলে। তবে অনন্তরূপার আসল পরিচয় এখনও জানতে পারেনি সুব্রত। দেখাও করেনি দুজন কোনওদিন। অনন্তরূপা দেখা করতে বা নিজের পরিচয় দিতে এতটা অনিচ্ছুক বলে ভেতর ভেতর তার ওপর একটা চাপা অভিমান আছে সুব্রতর। তবে অনন্তরূপাকে সে খুব বেশি জোর করতে সাহস পায় না। সে জানে অনন্তরূপাও তাকে ভালবাসে, ভালবাসার টান সে অনুভব করতে পারে, কিন্তু কোনো একটা অজানা কারণে তার আসল পরিচয় সে সুব্রতকে কিছুতেই দিতে চায় না। সুব্রতরও আজকাল তার পরিচয় জানতে চাইতে একটু ভয় করে। তার মনে হয়, অনন্তরূপার সাথে তার এই নামহীন সম্পর্কটা যেন একটা স্বপ্ন, ওর পরিচয় জেনে গেলেই যেন স্বপ্নটা শেষ হয়ে যাবে, ঘুমটা ভেঙে যাবে অসময়ে। ফোনটা ডেস্কের নিচে রেখে ল্যাপটপে আঙুল রাখতেই সুব্রতর ফোনটা বেজে উঠল। অনন্তরূপা ফোন করেছে।

হ্যালো

কী ব্যাপার? আজ এত দেরি করলে ফোন করতে? মেসেজও করোনি কোনও। টেনশন হচ্ছিল। তুমি ঠিক আছো তো?

আরে হ্যাঁ রে বাবা আমি একদম ঠিক আছি। তুমি বড্ড বেশি চিন্তা করো আজকাল।

কী আর করবো! চিন্তা করা ছাড়া আর কোন উপায় রেখেছো আমার? ফোনে না পেলে যে বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেবো, তাও তো হবে না। আর কোনওভাবে যে বাড়ির খোঁজ করব, কী বলবো লোককে? যার বাড়ি খুঁজছি তার নামটাও আমি জানি না?

আরে! হঠাৎ বাড়ি নিয়ে পড়লে কেন বলো তো? আমার দেরি হল একটা লেখা শেষ করতে গিয়ে বুঝলে? আর তাছাড়া...

তাছাড়া?

তাছাড়া সারপ্রাইজ পেতে গেলে একটু অপেক্ষা করতে হয়। নাহলে সারপ্রাইজের মজাটা থাকে না। আর আমি চাইনি সেই মজাটা নষ্ট হোক।

মানে?

মানে কালকে তোমার জন্মদিন না?

তোমার মনে ছিল?

আমার মনে থাকবে না তো কার থাকবে শুনি? কাল তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

সারপ্রাইজ? কী সারপ্রাইজ শুনি?

এখনই শুনবে না রাতে বলব?

বলো না বাবা! এখন না শুনলে আমার কিন্তু কাজে মন বসবে না। আমি কিন্তু

রাত্রি অবধি অপেক্ষা করতে পারবো না বলে দিলাম।

আচ্ছা রে বাবা বলছি বলছি শোনো। কাল ভাবছি তোমার এতদিনের আব্দারটা মিটিয়ে দেব। দেখা করবো তোমার সাথে, তোমার অফিসের পাশের ক্যাফেটায় অপেক্ষা করো। আর এইযে তোমায় রাত অবধি অপেক্ষা না করিয়ে এখনই বলে দিলাম সারপ্রাইজটা, সেইজন্য কাল তোমার থেকে আমার একটা চকোলেট পাওনা রইলো কিন্তু।

সুব্রতর ফোন ধরা হাতটা সজোরে কেঁপে উঠল একবার। তার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এসব কি বলছে অনন্তরূপা! তার মনে হল এই গোটা পৃথিবীতে যতটুকু আনন্দের বাস, সবটুকু আজ এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। আজকের আগে অনন্তরূপাকে অনেকবার দেখা করতে বলেছে, তার পরিচয় জানবার জন্য জেদ করেছে, কিন্তু অনন্তরূপার

সাথে সত্যি সত্যি দেখা হলে সে যে এতটা খুশি হবে, এতটা খুশি যে সে কোনওদিন হতে পারে, সেটা কখনও উপলব্ধি করতে পারেনি সুব্রত।

কী গো চুপ করে রইলে কেন? দেখা করবে না? নাকি চকোলেট দেবে না? কোনটা?

এই তুমি সত্যি বলছো? তুমি সত্যি দেখা করবে কালকে আমার সাথে?

বোঝো কাণ্ড! ভর দুপুরবেলায় ফোন করে তোমায় খামোকা মিথ্যে বলতে যাবো কেন? তবে একটা কথা তোমায় আগেই বলে রাখি সুব্রত। কালকের পর থেকে আমাদের সম্পর্কটা কিন্তু আর নাও থাকতে পারে। এটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি, আমার টাইমলাইনে শেষ কিছুদিনে পোস্ট করা কবিতাগুলো পড়লেই বুঝতে পারবে যে আমি কতখানি দ্বন্দ্বে ছিলাম। তারপর মনে হল এত ভেবে আর কী হবে, যা হবে দুজনের ভালোর জন্যই হবে নিশ্চয়। রবি ঠাকুর অভয় দিলেন, “ভাল মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে…” তাই সত্যটাকে সহজ ছন্দে পরিস্ফুট করে তুলতেই কাল যাচ্ছি তোমার সঙ্গে দেখা করতে।

এসব কী বলছ তুমিএত ভাল একটা খবর শুনিয়ে মনটা ভেঙে দিচ্ছ কেন? দেখা হলে সম্পর্ক শেষ হবে কেন শুধু শুধু? তুমি কি আর এই সম্পর্কটা রাখতে চাও না? তাই দেখা করে সান্ত্বনা পুরস্কার দিয়ে চলে যাচ্ছ?

ধুর! তুমি কিছুই বোঝো না। আমি কি একবারও বলেছি যে আমি সম্পর্কটা আর রাখতে চাই না? আমি শুধু এটাই বলছি যে যা হবে সেটা মেনে নেওয়ার শক্তিটুকু রেখো নিজের মধ্যে। যাই হোক, তুমি কাজ করো, পরে কথা হবে আবার, রাখি।

অনন্তরূপা ফোন রেখে দেওয়ার পর, আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইলো সুব্রত। নানা রকমের চিন্তা ভাবনা আশঙ্কা, তাকে ঘিরে ধরেছে একসঙ্গে। শেষ দুপুরের ক্লান্ত রোদ্দুর তার কপালের দুশ্চিন্তার ভাঁজগুলো ছুঁয়ে দিয়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে কোথায়। তার ভয়টাই সত্যি হবে না তো? স্বপ্নটা শেষ হয়ে যাবে না তো? ঘুম ভেঙে যাবে না তো অসময়ে?

                                                                     (৩)

ক্যাফের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে যেতেই একটা দমকা হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগল সুব্রতর মুখে। হাওয়ায় ভর করে যেন হাজারটা স্বপ্নের গন্ধ লুটোপুটি খেতে খেতে আঙুল বুলিয়ে দিয়ে গেল সুব্রতর বুকে। আজ তার স্বপ্ন সত্যি হওয়ার দিন। কাল রাতে নিজেকে অনেক বুঝিয়েছে সুব্রত, আজ যাই হয়ে যাক না কেন, অনন্তরূপাকে সে তার থেকে আলাদা হতে দেবে না। নিজের ইচ্ছেশক্তির ওপর এইটুকু বিশ্বাস আছে তার। তাই এখন আর ভয় করছে না । এখন শুধু এক পৃথিবী অপেক্ষা জমাট বেঁধে রয়েছে তার বুকে। অনন্তরূপার আসার কথা ছিল ঠিক দুপুর একটার সময়। এখন ঘড়িতে একটা বেজে পাঁচ মিনিট। কেন যে এত দেরি করছে কে জানে। সুব্রত একবার ভাবলো তাকে ফোন করে দেখবে কিনা। তারপর ভাবল থাক, আর একটু অপেক্ষা করতে যেন তারও ইচ্ছে করছে। অনন্তরূপার সাথে থাকতে থাকতে সেও এখন অপেক্ষার মাধুর্যটা বুঝতে শিখেছে। অনন্তরূপা যদি প্রথম দিন-ই তার সাথে দেখা করতে রাজি হতো, তাহলে আজকের দিনটা এতটা বিশেষ হয়ে উঠত না সুব্রতর কাছে। আজ এত আনন্দ, এত ভাল লাগা, সবকিছু ওই অপেক্ষারই ফল। আসার সময় একতোড়া হলুদ গোলাপ কিনে এনেছে সুব্রত। অনন্তরূপার হলুদ গোলাপ খুব পছন্দ। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনন্তরূপার সাথে প্রথমদিন ফেসবুকে আলাপ হওয়া থেকে শুরু করে সব কথা মনে পড়ছিল সুব্রতর। যে ইচ্ছেগুলো নিয়ে সে কাল পর্যন্ত তার মনে এত ভয় ছিল, এত সংশয় ছিল, আজ সবকিছু সত্যি হতে চলেছে।

ভাবনার স্রোতে ভেসে যেতে যেতে ঘড়ির দিকে খেয়ালই করেনি সুব্রত। ওয়েটারের ডাকে চমক ভাঙল তার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল দুটো বাজছে। কী ব্যাপার? এতটা দেরি হওয়ার তো কথা নয়। অনন্তরূপা কি তাহলে চিনতে পারেনি তাকে? ও কি এখানেই আছে কোথাও? নাহ! এবার একবার ফোন করতেই হচ্ছে। পকেট হাতড়ে ফোনটা বের করে অনন্তরূপার নম্বর ডায়াল করতে যেতেই, তার ফোনটা বেজে উঠল। অনন্তরূপা ফোন করেছে। এবার বোধহয় অবশেষে তার অপেক্ষা শেষ হবে। প্রচন্ড উত্তেজনায় ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে একটা অপ্রত্যাশিত পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো।

মিঃ সুব্রত রায় বলছেন?

আজ্ঞে। কিন্তু আপনি কে? এই ফোনটা পেলেন কোথায়? এই ফোনের যে মালিক সে কোথায়?

দাঁড়ান। শান্ত হোন। আমি লোকাল থানার সাব ইন্সপেক্টর অমিত সুর। এই ফোনের যিনি মালিক, অর্থাৎ অপরাজিতা পাল, তাঁর একটা ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ক্যাবে করে যাচ্ছিলেন কোথাও একটা। ড্রাইভার, প্যাসেঞ্জার দুজনেই স্পট ডেড। ঘটনাস্থল থেকে তাঁর মোবাইল ফোন, আর একটা ব্যাগ উদ্ধার করা গেছে। ফোন চেক করতে গিয়ে দেখলাম আপনার নম্বরেই সবথেকে বেশি কল গেছে এই মোবাইল থেকে। আপনি নিশ্চয়ই ওঁর খুব পরিচিত কেউ হবেন। তাই আপনাকে ফোন করছি । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ঘটনাস্থলে চলে আসুন, ডেড বডি নিয়ে এক্ষুনি হসপিটালে যেতে হবে ডেথ সার্টিফিকেট জেনারেট করার জন্য। আর এতগুলো স্টেপ ওঁর কোনও পরিচিতের উপস্থিতি ছাড়া আমাদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়।

স্পট ডেডকথাটার পরে আর কোনো কথাই ঢোকেনি সুব্রতর কানে। তার মনে হচ্ছে সে যেন আর তার দেহভার সামলে রাখতে পারছে না। এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। তবু কী একটা ক্ষীণ আশাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

কী নাম বললেন? অপরাজিতা পাল? কিন্তু এই ফোনটা তো অনন্তরূপার..

অনন্ত সামথিং না? হ্যাঁ ওটা তাঁর ছদ্মনাম মনে হয়। ওঁর ব্যাগ থেকে পাওয়া আইডি কার্ডে আসল নামের পাশে ব্র্যাকেটে এই নামটাও লেখা আছে। যাই হোক, চলে আসুন তাড়াতাড়ি। আমি লাইভ লোকেশন পাঠাচ্ছি আপনার হোয়াটসঅ্যাপে। ডেডবডি নিয়ে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না।

ফোনটা ছিটকে পড়ে গেল সুব্রতর হাত থেকে। চাপা কান্নার দমকে তার শরীর কেঁপে উঠছে বারবার, কিন্তু সে কাঁদতে পারছে না, কাঁদার শক্তিটুকুও এখন তার নেই। সে শুধু ভাবছে ভাগ্যের এ কেমন পরিহাসহা ঈশ্বর! তাদের প্রথম দেখা তাহলে এইভাবেই হবার ছিল? যাকে দেখার জন্য আর কয়েক মুহূর্ত আগে পর্যন্ত তার অপেক্ষার বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল, এখন তাকেই দেখতে যাচ্ছে সে, কিন্তু পৃথিবীর সব আনন্দ আর স্বপ্নের রং পাল্টে একটা কালচে বিষাদের বিষ এখন ঘিরে ধরেছে তাকে। এই বিষ রঙের তীব্র হুঙ্কার, স্বপ্ন, রং, প্রেম এই সবকিছুর ওপর থেকে তার বিশ্বাসগুলোকে টেনে ফেলে দিচ্ছে কোন গভীর অন্ধকার খাদের ভেতর। চরম তিক্ততায় ভরিয়ে দিচ্ছে চারিদিক।

 

                                                                    (৪)

ঘটনাস্থল সুব্রতর অফিস থেকে খুব একটা দূরে ছিল না। ক্লান্ত পায়ে সেখানে পৌঁছে ভিড় ঠেলতে ঠেলতে ডেডবডির সামনে এগিয়ে যেতে লাগল সুব্রত। কিন্তু সেখানে পৌঁছে সে যেটা দেখল, তার জন্য সে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। বিস্ময়ের সীমা রইল না তার। এ তো সেই তার কলেজের সহপাঠী অপরাজিতা পাল! পরমা সুন্দরী ছিল একসময়। ফার্স্ট ইয়ারে সুব্রত তাকে পছন্দও করত। সে বুঝত উল্টো দিকের মানুষটাও তাকে পছন্দ করে। মাঝে মাঝে টিফিন ব্রেকে কথা হত দুজনের। কিন্তু দুজনের দুজনকে ভাল লাগার কথাটা কেউ কোনওদিন সাহস করে বলে উঠতে পারেনি। তারপর স্ট্রিম আলাদা বলে, দুজনের সেকশন আলাদা হয়ে যায়। যোগাযোগ বা একে অপরের প্রতি আকর্ষণও কমতে থাকে। অবশ্য অপরাজিতার দিক থেকে আকর্ষণ বোধহয় কোনওদিনই কমেনি। তাই তো থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় অপরাজিতার ওপর যখন অ্যাসিড অ্যাটাকটা হল, হসপিটাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেই সে প্রথম এসেছিল সুব্রতর কাছে। এসেছিল সঙ্গ খুঁজতে, একটা বন্ধুত্বের হাত আশা করেছিল সে সুব্রতর কাছ থেকে। অ্যাসিড অ্যাটাকের খবর কলেজে সবাই জানত। সুব্রতও জানত। তবু যেন এই অবস্থায় কিছুতেই চিনতে পারছিল না সে অপরাজিতাকে। তার বিভৎস মুখ দেখে ভয় করছিল সুব্রতর, একটু একটু ঘেন্নাও করছিল। সকলের সামনে অপরাজিতাকে নিজের বন্ধু বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করছিল তার। অপরাজিতাও বোধহয় বুঝেছিল সে কথা। তাই কিছু না বলেই, চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গিয়েছিল সেদিন। আর কোনওদিন আসেনি সুব্রতর কাছে। তার সেই চলে যাওয়াটা কোনওদিন ভুলতে পারেনি সুব্রত। যতবার সে কথা মনে পড়ত, লজ্জায় নিজের সামনেই নিজের মাথা হেঁট হয়ে যেত তার।

কিন্তু সেই অপরাজিতাই যে অনন্তরূপা, সেটা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। আনমনেই অপরাজিতার মুখের পোড়া দাগের ওপর হাত বোলাতে থাকে সুব্রত। আজ একটুও ঘেন্না লাগছে না তার। তার বুকের ভেতরটাও তো ঠিক এইভাবেই পুড়ছে। সেখানেও এমনি অজস্র পোড়া দাগ। তাই ওই পোড়ার যন্ত্রণাটা আজ অনেকটাই বুঝতে পারছে সুব্রত, আঙুল দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করছে পোড়া দাগগুলো।

চলুন মিঃ রায়, এই বডি আর ফেলে রাখা ঠিক হবে না। যা রক্তপাত হয়েছে, তাতে আর ফেলে রাখলে পচন ধরতে শুরু করবে। ও হ্যাঁ, ঘটনাস্থল থেকে ওঁর মোবাইল আর ব্যাগ ছাড়া আরেকটা জিনিসও উদ্ধার হয়েছে। আপনার নাম লেখা একটা প্যাকেট। এই বলে একটা গোলাপি রঙের প্যাকেট এনে সুব্রতর হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলেন সাব ইন্সপেক্টর অমিত সুর। কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকেটটা খুলে সুব্রত দেখল একটা গীতবিতান রাখা রয়েছে। তার প্রথম পাতায় কবিসুলভ জড়ানো হাতের লেখায় লেখা আছে রবি ঠাকুরেরই একটা গানের কিছুটা অংশ,

তুমি মোর পাও নাই পরিচয়

তুমি যারে জান সে যে কেহ নয়, কেহ নয়

মালা দাও তারি গলে, শুকায় তা পলে পলে,

আলো তার ভয়ে ভয়ে রয়

বায়ুপরশন নাহি সয়॥

এসো এসো দুঃখ, জ্বালো শিখা,

দাও ভালে অগ্নিময়ী টিকা।

মরণ আসুক চুপে, পরমপ্রকাশরূপে,

সব আবরণ হোক লয়

ঘুচুক সকল পরাজয়…”

বইটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সুব্রত। শেষবেলার রোদ্দুর আলতো বিলি কেটে দিয়ে যাচ্ছে সুব্রতর ক্লান্ত চুলে। সেই একই রোদ্দুর গিয়ে পড়ছে অনন্তরূপার অ্যাসিডে পুড়ে যাওয়া মুখের ওপর। এই আলোর সাজে খুব জীবন্ত লাগছে অনন্তরূপাকে। তার ফেসবুকের ছায়া ছায়া প্রোফাইল পিকচারের থেকে অনেক অনেক বেশি জীবন্ত লাগছে। যে অনন্তরূপা আজ পর্যন্ত সবচেয়ে রহস্যময়ী নারী ছিল তার জীবনে, আজ যেন সে নিজেই এই সূর্যের রঙ ধরে এসে নিজেকে মেলে ধরতে চাইছে সুব্রতর চোখের সামনে। সুব্রতও একটু একটু করে চিনতে পারছে তাকে। সুব্রতর চোখের কোলটা এখনও ভিজে। কিন্তু এখন আর আগের মতো অসহায় লাগছে না তার। মনে হচ্ছে একটু একটু করে যেন সে চিনতে শিখছে অনন্তরূপাকে। তবে পুরোটা চিনে উঠতে আরও একটু সময় লাগবে। অনন্তের রূপ যার তাকে চিনতে তো সময় লাগবেই! একটা জীবন সময় কি তার জন্য যথেষ্ট?