লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com
Showing posts with label গল্প. Show all posts
Showing posts with label গল্প. Show all posts

Sunday, January 12, 2025

প্রণয় গোস্বামীর ছোটোগল্প, ছায়ারোদ নতুন সংখ্যা

 মাংস ভাত

প্রণয় গোস্বামী

 

 

                                টেঁপির মায়ের অভাব অনটনের সংসারটায় আজ বেশ সুসার এসেছে। তিনবছর আগে স্বামী যোগেন দিল্লিতে রাজমিস্ত্রি কাজ করতে গিয়ে তিনতলা থেকে পড়ে যখন মারা গেল। মাথায় যেন বজ্রপাত হয়েছিল সেদিন! চার চারটে ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে কি যে অসুবিধায় দিন কাটছিল তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। সেসময় দিল্লির  ঠিকাদারের দেওয়া দুই লাখ টাকা ব্যাঙ্কে রেখে সুদ বাবদ মাসে এগারো'শো টাকা আর পাড়ার সমীর দাদাবাবু বিডিওকে বলে কয়ে বিধবা ভাতা একটা করে দিয়েছিলেন সেখান থেকে মাসে এক হাজার টাকা। এই দুই হাজার একশো টাকায় চারটে ছেলেমেয়ের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে পারে সে। নিজে যে কারও বাড়িতে ঘরমোছা বাসনমাজর কাজ করবে তারও উপায় নেইসেসময় ছোট মেয়েটার সবে দুইমাস বয়স। অতটুকু বাচ্চা কার কাছে রেখে কাজে যাবে! তাই অগত্যায় খেয়ে না খেয়ে বাচ্চাগুলো মানুষ করতেই হবে। এই দুর্মূল্যের বাজারে ভালোমন্দ তেমন কিছু জোটে না কপালে। ছেলে মেয়েগুলো পাশের বাড়িতে মাছ মাংস রান্না হলে মা'কে জ্বালিয়ে মারে এক্কেবারে। তখন টেঁপির মায়ের চোখের জল ফেলা ছাড়া উপায় কিছু নেই। তাদের কে বোঝাবে, এসব ভালোমন্দ খাওয়া তাদের জন্য নয়! এখন অবশ্য টেঁপি'টা একটু বড়ো হয়েছেযখন বাপ'টা মরে তখন তো সাত বছরএই বছরে সে দশে পড়ল। এখন একটু বুঝতে শিখেছে, কিন্তু ছোট দুটো? তারা তো কিছুই বুঝতে চায় না। এই তো গত বছর দুগ্গাপুজোয়ছোট ছেলেটা নতুন জামা নেবে তো নেবেই, কিন্তু দুই'হাজার টাকায় কি আর সংসার চলে বলুন দেখি? তবুও পাড়ার ফেরিওয়ালার থেকে ছয়শো টাকা দিয়ে তিনজনের জন্য তিনটে জামা কিনে দিয়েছিল টেঁপির মা। তার পরনের শাড়ীটারও তো শতচ্ছিন্ন দশাতাকে অবশ্য পাশের বাড়ির সমীর দাদাবাবুর বৌ একটা নতুন শাড়ি দিয়েছিল। যাই হোক, কোনও মতে দিন যে কাটছে না তা নয়তবে ওই যে, প্রাণে বাঁচার জন্য যেটুকু মোটা ভাত কাপড় দরকার সেটুকুই। টেঁপির মা বাচ্চাদের নিয়ে পাড়ায় দুগ্গামেলায় যেতেই ভয় করেছোটছেলেটা যা দস্যি হয়েছে কি বলবো, যা দেখবে সেটাই কেনা চাই তার। তারই বা কি দোষ বলুন! সে তো আর জানে না যে ছোটবেলায় বাবা মারা গেলে ওসব পাওয়া যায় না। তা যাক গে, আজ কিন্তু টেঁপির মায়ের বাড়িটা খাসীর মাংসের গন্ধে এক্কেবারে ম ম করছে। ছেলে মেয়ে গুলোর তো আর তর সইছে না যেন! বারবার করে শুধু মাকে জিজ্ঞেস করেই চলেছেও মা রান্না হলো? টেঁপির মা কপট ধমক দিয়ে বলে, একটুখানি দাঁড়া বাপু, উনুন তেকে কড়াটা নামাতি দেবিনে? খাবি তো! তোদের কে দিয়ে তবেই তো আমার শান্তি। হঠাৎ গলাটা ধরে আসে তার,ধরা গলায় স্বগোতোক্তির মতন করে বলে,আজ তিনবছর পর ছা গুলোর মুকে মাংস তুলি দেচ্ছি! সবার বাড়িতে পরব পার্বনে ভালোমন্দ রান্না হয়! ও ঠাকুর আমারে তুমি এত শাস্তি কেন দিচ্ছ বলো দেকিনি! সবার মুকে অন্ন জোগাও,আর শুদু আমার ছা গুলোই কি তোমার এত্ত ভারি হয়ে গেচিল গো? যে ওদের বাপটাকে তুলি নিলে? ওদের বাপ বেঁচি তাকলে নিচ্চয় ওদের অমন হাভাতের মতন দিন কাটাতে হতোনি! যা হোক কাজকম্ম করেনিজে না খেয়ে ছা গুলোর মুকে দুটি ভালোমন্দ দেচ্চিলো লোকটা। তারেই তুলি নিলে গোএই তোমার বিচার!

 

 

               পঞ্চায়েত নির্বাচন সামনেই,পাড়ার হোদল থেকে শুরু করে কালু মন্টু সান্টু হাবলু, কাবলু পর্যন্ত সকলেই এখন ভীষণ ব্যস্ত। আরে এরাই তো এখন নেতা! এরা সবাই বছরভর একসঙ্গে কাজকর্ম করলেও এখন কিন্তু বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে একে অপরের প্রতিপক্ষ।পাঁচবছর তেমন কেউ এদের পোছে নাবাজারে যেমন হঠাৎ করে আদার দাম বাড়ে, ঠিক তেমন এদের দামটাও হঠাৎ বেড়ে যায়। যখন দাম বাড়ে তখন কদরও বাড়েদাম কমলে আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবে। কিন্তু ভোটের সময় এলেই হোদল কাবুল হাবুলদের দায়িত্বের অভাব নেই। প্রায় প্রতিদিনই কারও না কারও বাড়ির উঠোনে দলীয় সভা বসে।মাঝে মাঝে কোলকাতা থেকে বড়ো নেতারা সভা করতে এলে সেই সভায় লোক নিয়ে যাওয়ার সব দায়িত্ব এদের কাঁধেই। এখন বিভিন্ন জন বিভিন্ন দলের নেতা। সকলের কাঁধেই দায়িত্বের পাহাড়। কিভাবে ভোট যোগাড় করতে হবেকিভাবে পতাকা লাগাতে হবেকার পাড়ায় বাতি লাগবেকার ঘরেতে রান্নার চাল নেই! শুধু বলতে দেরি, সঙ্গে সঙ্গে টাকা বের করে দিচ্ছেন নির্বাচনে দাঁড়ানো বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা। তাদের থেকে সাহায্য সামগ্রী নিয়ে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে দেরি করছে না হোদল মন্টু কালু সান্টুর হাবলু কাবলুর দল। টেঁপির মায়ের বাড়িতে খাসীর মাংস তো হোদলই দিয়ে এসেছে আজ সকালে। টেঁপির মা অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিল, কে দিল? কেন দিল? কিন্তু হোদলের সাফ কথা, আরে দিয়েচে যখন খেয়ে নাও। বছরভর তো আর খাসীর মাংস কিনে খেতি পারবে নি! এসময় বাবুরা দেচ্চেন, খেয়ে নাও। শুধু ভোটটা ঠিক জায়গা মতো দিতি হবে। টেঁপির মা আপত্তি করতে যাচ্ছিলইএমন সময় কোথা থেকে টেঁপি এসে হোদলের হাত থেকে মাংসের প্যাকেটটা ছোঁ মেরে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলকি আর করা, টেঁপির মাও আর কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেল।

 

 

                            এদিকে সুখ একেবারে উথলে উঠেছে চা দোকানদার মঙলুর। তার চায়ের দোকান একেবারে উপচে পড়ছে খদ্দেরে। সকাল থেকে শুরু করে একেবারে রাত্তির বারোটাহাত বন্ধ নেই তার।মন্টু সান্টুরা আগে সকাল সন্ধ্যে এককাপ করে চা খেয়ে কাজে চলে যেতআর এখন? আর বলবেন নাসারা দিনে তো মোটামুটি দশ কাপ হচ্ছেই! অন্যসময় অধিকাংশ খদ্দেরই ধারে চা খায়, অনেক সময় মঙলুর সঙ্গে তো বকেয়া টাকা আদায় নিয়ে কত বাকবিতণ্ডা হয় তার ঠিক নেই। আর এখন? ধার বলতে নেইনগদ কড়কড়ে টাকা। টাকা তো সব নির্বাচনে দাঁড়ানো প্রার্থীরাই দিচ্ছেন। তাদের এখন একটাই কাজ, সকালবেলায় চায়ের দোকানে এসে কে কে চা খেয়েছে, কে কে খায়নি,সেটা জিজ্ঞেস করা। আর দোকানি মঙলুকে বলা যেচা দে সবাইকেমঙলু যদি জিজ্ঞেস করে সঙ্গে বিস্কুট দেবো কি? সঙ্গে সঙ্গে ধমকের সুরে তাকে বলা যেএটা আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে? দে সবাইকে চা বিস্কুট। যে যে পান খাবে তাকে পানও দে। প্রার্থীরা সকলেই এখন গৌরি সেন। মঙলুর ঘরে যেন লক্ষী এসে পড়েছে গো! মন্টুসান্টুহোদল ভোদল, কালু ভোদাইসকলেই চা বিস্কুট খেয়ে তারপর একটা করে একশো জর্দা দিয়ে পান খেয়ে ঠোঁট দুটো লাল করে বসে রয়েছে দোকানে। সেখানে আলোচনার শেষ নেইরাজ্য সরকার থেকে শুরু করে কেন্দ্র সরকার পর্যন্ত সকলের বাপ ঠাকুর্দার মুণ্ডুপাত চলছে সমানে।

 

          এইতো আজই সক্কালবেলা মঙলুর দোকানে বসে হোদল বলে, পচা দা এবারও  সিওর জিতছে।তাকে কেউ হারাতে পারবে নে। পাশেই বসে ছিল কাবলুসে আবার নীল রঙের প্রার্থীসে হরি বাবুর টাকায় চা বিস্কুট খেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলে  উঠলকি বললি? পচা জিতছে? পচা যদি জেতেতাহলে আমি একলক্ষ টাকা বাজি রাখলেম। কাবলু দিনমজুরী করেসে কোথা থেকে একলক্ষ টাকা পাবে! সে দিকে তার  হুঁস নেই, কিন্তু বলেই বসলো। দুজনের ভীষণ বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে গেল, বাকবিতণ্ডা থেকে হাতাহাতি। একেবারে যুদ্ধের পরিবেশ। মঙলুর দোকানের চায়ের কাঁচের গ্লাস ভেঙে চুরমার। অনেক কষ্টে দুজনকে আলাদা করা হলো। সবুজ প্রার্থী পচা, আর নীল প্রার্থী হরি মিলে ক্ষয়ক্ষতির সাময়িক হিসেব নিকেষ কষে ক্ষতিপূরণের টাকা মিটিয়ে দিল মঙলুর। আপাতত এলাকা শান্ততবে আবার কখন যে মঙলুর চায়ের গ্লাস ভাঙবে তার ঠিক নেই। সে যখন ভাঙে ভাঙুক গেটাকা তো প্রার্থীরা দিচ্ছেনই, ক্ষতি কি!

 

 

               টেঁপির মায়ের শোবার ঘরটি বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরি করা তার উপরে কাদামাটি দিয়ে লেপাই করে কোনমতে বসবাস করছে। তাদের পাড়ার প্রায় সকলেরই পাকা ঘর। প্লাস্টার করা দেয়ালতাতে খুব সুন্দর করে রঙ করা। প্রায় সকলেই নিজ নিজ বাড়ির দেয়ালে লিখে রেখেছেন, বিজ্ঞাপন লাগাবেন না। অতএব দলীয় প্রার্থীদের দেয়াল লিখন লেখার একমাত্র জায়গা হলো, টেঁপির মায়ের দেয়ালটা। সেই কাঁদামাটি লেপা দেয়াটারও জরাজীর্ণ দশা। তাতেই জ্বলজ্বল করছে তিনটি দলের তিনটে দেয়াল লিখন।সকলেই  উন্নততর পঞ্চায়েত গড়তে নিজ নিজ দলের প্রার্থীকে ভোট দেবার আবেদন করেছেন। সমীর বিকেলে কর্মস্থল থেকে ফিরে টেঁপির মায়ের দেয়ালের লেখাগুলো পড়ছে আর ভাবছেএই দেয়ালেই গতবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে উন্নয়নের কথা লেখা ছিল। আবারও এই দেয়ালেই উন্নয়নের আবেদন! গত পাঁচ বছরে উন্নয়ন যে একেবারে হয় নি তা কিন্তু নয়। পঞ্চায়েতের গত বছরের জয়ী প্রার্থী‌ পচার উন্নয়ণ অবশ্যই হয়েছে। তার ঝাঁ চকচকে বাড়ি হয়েছেগাড়ি হয়েছেতাইতো তার বাড়ির দেয়ালে আর উন্নয়নের দেয়াল লিখন লেখা যায় না। সেখানে লেখা রয়েছে, "বিজ্ঞাপন লাগাবেন না।" টেঁপির মায়ের দেয়ালটাই উন্নয়নের একমাত্র প্রতীক। তবে যাই হোকতাই হোক টেঁপির মায়ের ছাঁ'গুলো কিন্তু আজ তিনবছর পর খাসীর  মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে খুব হাসছিল। বিকেলে রাস্তায় সমীরকে দেখতে পেয়ে ছোট মেয়েটা আধো আধো গলায় বলেও জেটু আজকে আমার মা কি নান্না করেচে বলো তোসমীর কৌতুহলী হয়ে জানতে চায়, কি রেঁধেছে? ছোট্ট মেয়েটি আধো আধো গলায় বলে......., মাংক ভাত।

 

           দুইদিন ধরে আকাশটা কেমন যেন মেঘে ঢেকে রয়েছেআজ পূর্ণিমা। চাঁদের আলো'কে পৃথিবীতে আসতে দিতেই চায়না মেঘের দল, আচমকাই হয়তো একটু ফাঁক পেয়ে আকাশটা কেমন রূপোলি আলোয় ঝলমলিয়ে উঠলো যেন! ঝলমলে চাঁদের আলোয় পরিস্কার পড়া যাচ্ছে টেঁপির মায়ের মাটি লেপা বেড়ার  দেয়ালে উন্নয়নের লেখাগুলো, "উন্নততর পঞ্চায়েত গড়তে এই চিহ্নে ভোট দিন।"

কিঞ্জল রায়চৌধুরীর ছোটোগল্প, ছায়ারোদ নতুন সংখ্যা

টিকটকার্‌স

কিঞ্জল রায়চৌধুরী

 

শট ওয়ান। লোকেশন মোহরকুঞ্জ। ‘কুঞ্জে কুঞ্জে গুঞ্জে অলি...’ ওইখানে। ভিডিয়ো হবে। টিকটক। শেয়ার করলে দেখবে সবাই। লাইকের পর লাইক কমেন্টস অউসাম! লাভলি! বিউটিফুল! মোহরকুঞ্জে বিউটিফুল সব ফুলগাছের ঝাড়ি। ন্যান্সি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পাবলোর হাতে ফোনের ক্যামেরা। ব্যাকগ্রাউন্ডে নানারকম মিউজিক-থিম। তোলা ভিডিয়ো ওগুলোর সাথে জুড়ে দিলেই শট 'ওকে'।

ন্যান্সি আঠেরো, পাবলো উনিশ। পারফেক্ট কাপল্। ন্যান্সি পোজ দেয়, পাবলো ছবি তোলে। টিকটকে ভিডিয়ো করে  দেয়।

আঙুলে লিপস্টিক লাগিয়ে গালে  আর  নাকে অল্প  করে  ঘষে নিয়েছে ন্যান্সি, খানিকটা চোখের পাতায় আর একটুখানি গ্লিসারিন। জল কাটছে। ঘন ঘন নাক টানছে ফুটফুটে মিষ্টি মেয়েটা। কান্না কান্না মুখ। শট রেডি। পাবলো ক্যামেরা তাক করেছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে কে যেন প্রশ্ন করল ‘আরে তুনে উসকো কেয়া দিয়া?’

ন্যান্সি  মুখের কাছে দু-হাতের সবকটা আঙুল জুড়ে হার্ট সাইন তৈরি করে। মানে দিল। ‘অউর ফির উসনে কেয়া কিয়া?’ এবার হার্ট সাইনের ভেতর দিয়ে ন্যান্সি চুমুর ভঙ্গিতে ঠোঁট বাড়িয়ে দেয়। আলতো  একটু হাসি চোখের কোল  বেয়ে দু-এক বিন্দু জল গড়িয়ে যায় টপাক টপাক সাথে সাথে ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক বেজে ওঠে, আর অনেকগুলো প্রজাপতি উড়ে যায় মুখের সামনে দিয়ে ওটা বাই ডিফল্ট।

মোহরকুঞ্জে বসা গোটা পাঁচেক কাপল থমকে গিয়েছে ওদের কাণ্ড দেখে। চুমু খেতে ভুলে গিয়েছে দু-একজন। পাবলোর ভুরুতে ভাঁজ। একবার ভিডিয়ো দেখছে, আর-একবার ন্যান্সিকে। ও কি সত্যিই কাঁদছিল! এখনও যে মুখ থমথমে, চোখে জল! না না যাঃ! ওই তো হাসছে... কাট!

 

শট টু। আজ লোকেশন বিধাননগর রোডের স্টেশন-প্ল্যাটফর্ম। আজকের থিম ‘জান তেরে নাম’। ব্যাকগ্রাউন্ডে বুক ঢিবঢিব হার্টবিট। একেবারে শেষপ্রান্তে শিয়ালদাগামী ট্রেন ঢুকতেই লাফ দিয়ে প্ল্যাটফর্মের কিনারায় চলে গেল ন্যান্সি। কেউ কিছু বোঝার আগে, অতর্কিতেই। পাবলো ফোন তুলে রেডি। ন্যান্সি দু-হাত মেলে দিয়েছে যেন পাখির ডানা, ওর পোকেমন আঁকা হলুদ গেঞ্জি ছুটে-আসা গোটা ট্রেনটাকে আড়াল করে ফেলেছে। হাওয়ায় উড়ছে চুল।

ট্রেনের হুইসিল আর হার্টবিট মিশে একাকার। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। হঠাৎ পা ফসকায়... পাবলোর হাতের ফোন ক্যামেরা  তখন  শূন্যে। খুঁজে  পাচ্ছে না ন্যান্সিকে!  ওর পোকেমন গেঞ্জিও উধাও! তার বদলে হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসছে শুধুই একটা চলন্ত ট্রেন...

একটু দূরেই ধাক্কাধাক্কি। লোকের ভিড়। লাইনের ধার থেকে সেখানে ঝুঁকে পড়েছে একগাদা মেয়ে-পুরুষ। কেউ বুঝতে পারছে না কেন এমন হল! পাবলোও বুঝতে পারছে না। ভিডিয়োটা টিকটকে চট করে আপলোড হয়ে গেছে। শেয়ারও হয়ে গেছে ফেসবুকে। ফোন হাতে দাঁড়িয়ে সে কেমন যেন হতভম্ব। অসহায়! শট ওকে হয়নি। থিমের মধ্যে সত্যি এমন কিছু তো ছিল না! বার বার ভিডিয়োর রিপ্লে ঘেঁটে ঘেঁটে সে ন্যান্সিকে খুঁজে চলেছে সমানে...

ঠিক তখনই  চারপাশের ভিড়ের ভেতর থেকে আলাদা হয়ে দাঁড়ায় কিছু মানুষ, অদ্ভুত তাদের চোখের ঠান্ডা চাহনি, ঠোঁটে অনুভূতিহীন হাসি...  যেন  গ্রহান্তর  থেকে  নেমে  এসেছে। সবাই ফোন তাক করে পাবলোর দিকে গোটা ঘটনাটা ওরা সব লাইভ ভিডিয়ো করে টিকটক-এ ছেড়ে দিতে চাইছে এক্ষুনি, তারপর শেয়ার হবে, লাইক পড়বে, কমেন্টস

 

ন্যান্সির মা দুশ্চিন্তায়। সন্ধে হতে চলল, মেয়ের ফেরার নাম নেই। আজ তো কোচিং অফ! ফিরে আসবে বলেছিল বিকেলের আগে। এখন ফোন করলে ফোনটাও ধরবে না। ধরলেই “আসছি তো মা! —কেন ফোন করছ বারবার?— আচ্ছা রাখছিএসব বলেই কুটুস করে কেটে দেবে ভালো করেই এটা জানে ন্যান্সির মা। বিরক্তি আসে। এই হয়েছে এক টিকটকার জেনারেশন! দিনারাত্তির আদাড়বাদাড়ে, জলের ধারে নেচে-গেয়ে-হেসে-কেঁদে ভিডিয়ো কী জানি বলে? রিল, রিলের পর রিল বানিয়ে চলেছে! আপনমনে হাসে আয়নাকে হাসায় সেলফি! সময় অসময় নেই, বিড়বিড়িয়ে চলেছে কানে তার গুঁজে। কে যে কার সেই ফিশফিশ শোনে, বোঝা দায়! আজও নির্ঘাত সেই ছেলেটাকে নিয়ে ছবি তুলতে মেতে উঠেছে!

সদ্য অভ্যস্ত হাতে স্মার্টফোন তুলে নেয় স্মার্ট ন্যান্সির উদ্‌বিগ্ন মা। আঙুল চলে যায় ফেসবুকে বোঝা যাবে অন্তত মেয়ের এই মুহূর্তের স্ট্যাটাসটা কী!

এই তো, পোস্ট দিয়েছিল পাবলো, ওই ছেলেটা, কী একটা ভিডিয়ো শেয়ার করেছে ঘণ্টা দুই আগে। মেয়ের ক্যাটকেটে লাল ঠোঁটের ওপর ভিজে চোখের নোনাজল চিকচিক, আর কত কত উড়ে যাওয়া প্রজাপতি! ‘দিল দিয়া, দিল লিয়া চলছে... আসুক আজ বাড়িতে!  অঙ্ক খাতায় মাঙ্কি এঁকে ক্লাসে জমা দেওয়া বার করে ছাড়বে... এই যে, এই তো আরেকটা ভিডিয়ো এটা আবার কোথায়? কে জানে কোন স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম! নাম দেখা যাচ্ছে না দেখে তো উলটোডাঙাই মনে হচ্ছে। দুঃসাহী মেয়ে তার ছুটে-আসা দুরন্ত ট্রেনের হাওয়ায় উড়ন্ত চুল ঝাঁকিয়ে, দু-হাত ছড়িয়ে যেন ট্রেনটাকেই জড়িয়ে ধরতে চাইছে!

ন্যান্সির মা টাইম মিলিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, ভিডিয়োটা শেয়ার হয়েছে পঁয়তাল্লিশ  মিনিট আগে। তার মানে তখন উলটোডাঙাতেই ছিল, এখনও কি ওখানেই... “কৃপয়া সুরক্সিট দূরি বর্‌কারার রাখিয়ে...তিন নাম্বার প্ল্যাটফর্ম সে থ্রু ট্রেন...” বলতে বলতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ট্রেনটা!... এরপর... ভিডিয়োটা কেমন যেন হিজিবিজি ঝাপসা...

ভিডিয়োটা ভাইরাল হয়েছে, প্রাণের খুশিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে এর ওর টাইমলাইনে। ন্যান্সির মা সব ভিডওয়োগুলোই ফরোয়ার্ড করে খুঁজতে থাকে মেয়েকে, পাচ্ছে না... হঠাৎ ফোন! রিংটোন ঘনঘন বাজছে। এমন প্রতিদিনই উড়োফোন আসে, প্র্যাংক কল! ধরা যায় না, অচেনা নাম্বার। টিরিক করে মেসেজ ঢুকল মেসেঞ্জারে ‘মনীশ কলিং! আর্জেন্ট। প্লিজ্ রিসিভ!’ ন্যান্সির বাবা! এইসময় হঠাৎ অন্যের ফোন থেকে? ঘুরিয়ে কল করার আগেই প্লপ্ করে একটা ভিডিয়োর লিঙ্ক ঢুকল হোয়্যাটসঅ্যাপে... দ্রুত ক্লিক! সার্ভার ডাউন, ঘুরছে, খুলল অবশেষে

কাঁদোকাঁদো গলায় প্রলাপের মতো লাইভ বকে চলেছে ওই ছেলেটা, পাবলো। “আমি কান্না রুখতে পারসি না বন্ধুরা... আমি এইখানে এই প্লাটফরমে আমার বান্ধবীকে নিয়ে ভিডিয়ো করসিলাম! এই রেলওয়ে ট্র্যাকে ভীষণ বড়ো একটা ট্রেন... তারপর থেকেই ন্যান্সিকে আর খুঁজে পাস্‌সি না! আমি যে কী করি! তোমরা কমেন্টে সাজেশন দাও বন্ধুরা! ভিডিয়োখানা প্রচুর প্রচুর শেয়ার করো!... এইখানে অনেক লোক, আমি কী করি, আমায় কমেন্টে জানাও...”

ন্যান্সির মা চারবার ভিডিয়োটা দেখল। বুঝতে পারছে না এটা কি রিল? না আসল? মনীশকে হোয়্যাটসঅ্যাপে ধরে ‘মনটা বড়ো আনচান করছে গো?’

ইতিমধ্যেই মনীশের অফিস কলিগ সুব্রত একটা হোয়্যাটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে ফেলেছে, টকাটক অ্যাড করে ফেলল অনেক চেনা অচেনা নাম্বারকে। গ্রুপ চ্যাটিংয়ে আলোচনা চলছে ‘ন্যান্সি মিসিং ফ্রম হার ভিডিয়ো টুডে! বাট হাউ অ্যান্ড হোয়াই?’ সবাই কিছু না কিছু বলছে, সবাই চিন্তিত! ভাবনা ভাইরাল হচ্ছে! নোটিফিকেশনের বন্যা... কেউ একজন মুসৌরি ভ্রমণের এস্টিমেট পাঠিয়ে দিল, সব গ্রুপেই হয়তো এমনই পাঠায়!   আরেকজন কেউ আরও একটা গ্রুপ ক্রিয়েট করেছে, তাতে ন্যান্সিকেও অ্যাড করে দিল! আর সবচেয়ে আশ্চর্যের, ন্যান্সি নিজেও ওখানে রিপ্লাই করছে! — “আয়াম ফাইন নাউ, এনজয়িং মাই টিকটকার্‌স ডে!..”

এটা কী করে হল মনীশ? ন্যান্সির ফোন কি তাহলে চুরি গেল?’ গ্রুপ ডিসকাশন শুরুর আগেই কে যেন ততক্ষণে  আরও একটা গ্রুপ বানিয়ে ফেলল ‘ন্যান্সিসেলফোন মিসিং গ্রুপ

কলিং বেল বাজল। ন্যান্সির মা দৌড়ে যায় দরজা খুলতে। হয়তো দরজা খুললেই রোজকার মতো মেয়েটা বলবে “মা খেতে দাও, ভীষণ খিদে পেয়েছে!’

Saturday, January 11, 2025

সোহিনী চ্যাটার্জী'র ছোটোগল্প, ছায়ারোদ নতুন সংখ্যা

নয়নতারা

 

সোহিনী চ্যাটার্জী

 

|১|

সকাল সাতটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। কুয়াশার চাদর গায়ে দিয়ে সবে আড়মোড়া ভাঙছে নতুন সূর্যটা। পাতা ঝরানো কাঠগোলাপ গাছটা এখনো দু'একটা খয়েরী পাতার বাহারে নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করছে ভোরের আলোয়।

আজ‌ সোমবার। একটু তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে টুবাই। স্কুলে তার ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা হবে আজ। টুবাই এবার ক্লাস ফাইভে উঠবে। মা বলেছে, এই পরীক্ষায় প্রথম দশ জনের মধ্য স্থান পেলে, পাশের পাড়ার বিকাশ‌দা’র দোকান থেকে তার সবচেয়ে পছন্দের রিমোট কন্ট্রোল গাড়িটা কিনে দেবে। সেটা পেলে টুবাই কোন কোন্‌ বন্ধুকে সবচেয়ে আগে দেখাবে, কাদের সাথে সবার আগে খেলবে, সবকিছু ঠিক করে রেখেছে। অপেক্ষা এখন শুধু রেসাল্টের। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে এইসবই ভাবছিল টুবাই। ব্যস্ত ভঙ্গীতে দুধ কর্নফ্লেক্সের বাটি হাতে ঘরে ঢুকলো মা। ধমকের সুরে বলল, "কিরে! এখনো টাই'টাও পড়িসনি? আটটা বাজতে যায়। আয়, আমি বেঁধে দিচ্ছি। ততক্ষণ কর্নফ্লেক্সেটা খেয়ে নে।"

ঠিক এই সময় কলিং বেলটা বাজল। কর্নফ্লেক্সের বাটিটা মেঝেতে রেখে বারান্দায় দৌড়ে গেল টুবাই। এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন দরজার কাছে। পরনে একটা মলিন, তাপ্পি দেওয়া ফতুয়া, আর ঢলঢলে একটা পায়জামা। কাঁধে একটা মলিন শ্যাওলা রঙের ঝোলা ব্যাগ। মুখের অর্ধেকের বেশি অংশ ঢাকা সাদা দাড়িতে। চোখের রঙ কটা। এই লোকটাকে চেনে টুবাই। পাড়ায় সবাই ওকে বিধু পাগল বলে ডাকে। ফুটপাতের পাশে ঐ পুরোনো বাড়ির রকটায় বসে থাকে। সারাদিন কি যেন সব লেখে। রাতে আর তাকে দেখা যায় না। সকাল হলে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়ে, আর বলে, "গল্প নেবে? অনেক রকম গল্প লিখেছি, একটা গল্পের দাম মাত্র পাঁচ টাকা। নেবে?"

আজ অবধি লোকটার একটা গল্পও বিক্রি হয়েছে বলে শোনেনি টুবাই। সবাই বলে লোকটা নাকি পাগল। এক সময় খুব ভালো লিখত, কিন্তু বিভিন্ন বইমেলায়, পাবলিশারদের দোরে দোরে ঘুরেও পয়সার অভাবে একটাও বই কোনদিন প্রকাশ করতে পারেনি। তারপর চরম অর্থাভাবে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই বিধুর এমন অবস্থা। টুবাইয়ের খুব ইচ্ছে করে একদিন ওর টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে গল্প কিনতে। মায়া হয় লোকটার জন্য। কিন্তু মা জানতে পারলে খুব রাগ করবে বলে সাহস পায় না।

বিধু তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলল, "কিগো খোকাবাবু, একটা গল্প নেবে? ঠিক তোমার পছন্দের মতো একটা খাসা গল্প আছে। দাম পাঁচ টাকা।"

টুবাই কিছু বলার আগেই, পিছন থেকে তার মা চিৎকার করে ওঠে, "কিরে টুবাই! তুই আবার ঐ লোকটার সাথে কথা বলছিস? আটটা বাজে, এখনো অবধি খাবারটাও শেষ করিসনি। এক্ষুনি পুলকার এলো বলে। ভেতরে আয় বলছি!"

টুবাই আর কিছু না বলে চুপচাপ ঘরে ফিরে আসে। কিছুক্ষণ পর পুলকার এলে, রওনা হয়ে যায় স্কুলের দিকে।

 

|২|

 

বিকেল চারটে বেজে পনেরো মিনিট। অস্তগামী লাল সূর্যটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছে টুবাই। মাত্র পাঁচ নম্বরের জন্য সে ক্লাসে প্রথম দশ জনের মধ্যে স্থান পায়নি। মা, বাবা কেউ তার সাথে কথা বলছে না। তার কাঁদতেও ইচ্ছে করছে না, পড়তেও ইচ্ছে করছে না। থেকে থেকে বিধু পাগলের মতো মনে হচ্ছে নিজেকে। তার সাথেও তো কেউ কথা বলে না। সে একাই লেখে, একাই সবার সাথে কথা বলে, আবার উত্তর না পেয়ে হাসি মুখে একাই ফিরে যায়। হঠাৎ কি মনে হতে, এক ছুটে বারান্দায় চলে গেল টুবাই। সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বিকাশদা’র দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আজকেও তার প্রিয় রিমোট কন্ট্রোল গাড়িটা চোখে পড়ল। কিন্তু আজ বড়ো অভিমান হল গাড়িটার ওপর, তাকাতেও ইচ্ছে করল না ঐদিকে। দোকান পেরিয়ে পাড়ার একমাত্র খেলার মাঠটার সামনে এসে দাঁড়াল টুবাই। অঙ্কিত, বাবলা, ওরা সবাই ক্রিকেট খেলছে। টুবাইকে ডাকলো বেশ কয়েকবার। আজ খেলতে ইচ্ছে করছে না টুবাইয়ের। সে সাইকেলের স্পীড বাড়িয়ে চলে গেল। মাঠটা পেরোতেই দেখতে পেল বিধু, সেই পুরোনো বাড়িটার রকে বসে আছে। কি সব যেন লিখছে সাদা পাতায়। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। লোকটাকে দেখে অবাক লাগে টুবাইয়ের, এত অপমান, এত অবজ্ঞা সহ্য করেও সব সময় হাসিটা লেগেই থাকে তার মুখে। সে কাছে এগিয়ে দেখার চেষ্টা করল কি লিখছে লোকটা? কোন জাদুমন্ত্র নাকি? চোখ তুলে একগাল হেসে বিধু বলল, "আরে খোকাবাবু, কি ব্যাপার, আজ মাঠে খেলতে যাওনি?" কি মনে হতে টুবাই বলল, "তোমার পাশে কিছুক্ষণ বসতে দেবে গো?" আবার ঠিক একই রকম হেসে, নিজের পাশে জায়গা করে দিতে দিতে বিধু বলল, "এসো বাবু, বসো এখানে।" টুবাই বসল। তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে, বিধু জিজ্ঞেস করল, "তোমার মন খারাপ?" টুবাই ওপর নিচে মাথা নাড়ালো। বলল, "তোমার সাথে তো কেউ কথা বলে না বিধু দাদু। তোমার মন খারাপ করে না?"

বিধু আবার এক গাল হেসে বলল, "কই না তো! আমার তো বেশ ভালো লাগে। কেউ কথা বললে, সেই মানুষটার একটা নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায় ঠিকই। কিন্তু কেউ যখন কোন কথা শোনার পরেও উত্তর দেয় না, তখন সে কি কি উত্তর দিতে পারত, উত্তরের ভিত্তিতে দিলে বাকি কথোপকথনটা কোন দিকে গড়াত, সেই সব সম্ভাবনা দিয়েই কত ভিন্ন ভিন্ন কত রকম গল্প হয়ে যায়! আমার গল্প লিখতে সুবিধাই হয়।" খুব অবাক লাগল টুবাইয়ের, এভাবে তো সে কখনো ভেবে দেখেনি। টুবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে, উদাহরণ দেওয়ার ভঙ্গীতে বিধু বলল, "এই যেমন ধরো তুমি জিজ্ঞেস করলে আমার পাশে বসতে পারো কিনা। আমি হ্যাঁ বললাম, তাই তোমার সাথে এত কথা হচ্ছে। ধরে নাও আমি যদি না বলতাম। তাহলেও অনেক গুলো সম্ভাবনা হতে পারত, এক তুমি রেগে যেতে, আমাকে কিছু খারাপ কথা বলতে। দুই তুমি কথা না বাড়িয়ে চলে যেতে। তিন তুমি জোর করে আমার পাশে এসে বসতে। একেক ক্ষেত্রে একেক ভাবে সংলাপ এগোত। আমার বিভিন্ন গল্পে বিভিন্ন ঘটনা কাজে লাগত।"

আরো অবাক হয়ে গেল টুবাই। মানুষ এভাবেও ভাবতে পারে? সে বলল, "তোমার কাছে কি সব মন খারাপেরই ওষুধ আছে বিধু দাদু?" এবার হোহো করে হেসে ওঠে বিধু। "মন খারাপ? ভালো বললে খোকাবাবু। অনেকদিন মন খারাপ হয়নি আমার। তোমার কি মনে খারাপ বলো? ভেবে দেখি ওষুধ থাকে যদি।" এবার আর না চাপতে পেরে বলেই ফেলল টুবাই, " আমি ক্লাসে এক থেকে দশের মধ্যে আসতে পারিনি তাই মা বাবা আমার সাথে কথা বলছে না। আর আমার প্রিয় লাল রিমোট গাড়িটাও কিনে দিচ্ছে না।" বিধু কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, "তোমার দুঃখটা কোনটা দাদুভাই? মা বাবা কথা বলছে না সেটা? প্রথম দশের মধ্যে স্থান পায়নি সেটা? নাকি রিমোট গাড়ি কিনে দেয়নি সেটা?" প্রশ্নটা শুনে বেশ চিন্তায় পড়লো টুবাই। এইভাবে তো সে ভাবেনি। মাথা চুলকে বলল, "যদি বলি তিনটের জন্যেই মন খারাপ?" বিধু বলল, "বেশ। তাহলে কোনোটাই তেমন গভীর নয়। ওষুধ আছে আমার কাছে, তুমি আমার সাথে এসো।" সাইকেলটা দাঁড় করানো রইল রকের গা ঘেঁষে। বিধুর হাত ধরে এগিয়ে চলল টুবাই। রাস্তার বাঁকটা পেরোলেই একটা ছোট্ট পুকুর। পুকুরের উপরে একটা পাথরের ঢিপি। আর সেটা পেরোলেই একটা ঘন জঙ্গল। ঢিপিটার ওপর গিয়ে বসল বিধু। আঙুলের ইশারায় পাশে এসে বসতে বলল টুবাইকে। সূর্য ডুবে গেছে কিছুক্ষণ হল। তার শেষ লাল টুকু এখনো লেগে আছে পৃথিবীর গায়ে। এক অদ্ভুত মায়া মায়া রঙ ধরেছে জলে। জলের উপর কাঁপা কাঁপা ছায়া পড়েছে টুবাইয়ের। সেই ছায়াতেও শেষ সূর্যের রঙ লেগে। বিধু বলল, "জলের ভেতরেই আরেকটা তুমি আছো। সেই তোমার কোনো কিছু অধরা নয়। আকাশ, জল, এমনকি সূর্য অবধি স্পর্শ করতে পারে সেই আরেকটা তুমি। তোমার যত দুঃখ আছে, তুমি ওকে বলো। দেখবে ভালো লাগবে।" টুবাই তাই করল। সবকিছু বলতে গিয়ে কেঁদেও ফেলল দু একবার। বিধু বসে রইলো পাশে, কিন্তু কোনো সান্ত্বনা দিল না। কিছুক্ষণ পর টুবাই যখন ফিরল, তখন সে অনেকটা হালকা। গাড়িটার কথাও খুব একটা মনে পড়ছিল না আর।

 

 

এরপর প্রায় রোজই বিকেল বেলায় বিধুর সাথে দেখা করতে যায় টুবাই। বিধু কখনো কখনো তাকে বাগানে নিয়ে যায়। সন্ধে না হওয়া পর্যন্ত তারা দুজন মিলে শুয়ে থাকে আকাশের নিচে। আকাশের কাছে নিজের সুখ, দুঃখ, পাওয়া, না পাওয়া সব কিছুই খুব ছোট মনেহয়। অনেক সময় তারা আবার যায় ঐ পুকুরটার ধারে। সন্ধেবেলায় তারা ঝিলমিল করে। ধ্রুবতারা চিনিয়ে দেয় বিধু। তারাদের নিয়েও কত রকম গল্প বলে। তারা গঙ্গার ঘাটে যায়, দেখে কত নৌকা খেয়া পারাপার করছে নিভে আসা আলোয়। চুপি চুপি অনেক কথা বলে যায় চোরা ঢেউয়ের গর্জন। তাদের ভাষা বুঝতে পারে না টুবাই। শুধু বুকের মধ্যে কি যেন অনুভব করে। বিধু বলে, আরেকটু বড়ো হলে সেই ভাষাও নাকি সে বুঝতে পারবে, অনেক গল্প লেখা যাবে তখন। মাঝে মাঝে তার বাড়ি থেকে আমলোকী নিয়ে আসে বিধু। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে নুন লঙ্কা মাখা আমলকী খেতে দিব্যি লাগে টুবাইয়ের। তার সমবয়সী বন্ধুদের সাথে আর খেলতে যেতে ইচ্ছে করে না। বিধু থাকলে সব সন্ধেই যেন রূপকথা হয়ে যায়।

 

|৩|

বিকেল ছটা। বিধু আর টুবাইয়ের বন্ধুত্ব হওয়ার পর, মাঝখানে পেরিয়ে গেছে একটা বছর। এখন টুবাইয়েরো বিধুর মতো জীবনটা রূপকথার মতো লাগে। কোন দুঃখই আর দুঃখ বলে মনে হয়না। বিধুর শরীর বেশ কিছুদিন ধরে খুব একটা ভালো নেই। তাই সে আর রোজ আসতে পারছে না। প্রতি শুক্রবার দেখা করে তারা। আজ নিয়ে দ্বিতীয় শুক্রবার, বিধু আসেনি দেখা করতে। আকাশে ঘন মেঘ। বাদলা হাওয়ায় ভিজে মাটির গন্ধ লেগে। ইদানিং বড়ো চিন্তা হয় টুবাইয়ের। বিধু তো আগে এমন করেনি কোনদিন। সে তো বিধুর বাড়িও চেনে না যে খোঁজ নেবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরেই আসছিল টুবাই। হঠাৎ পিছন থেকে একটা মিহি কন্ঠস্বর শুনতে পেল, "দাদুভাই!"

ফিরে তাকাতেই টুবাই দেখল শীর্ণকায় শরীরে একটা ছেঁড়া চাদর জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে দাঁড়িয়েছে বিধু। এতদিন বাদে প্রিয় বন্ধুকে দেখে আনন্দের থেকেও বেশি কান্না পেল তার। এ কি অবস্থা হয়েছে বিধুর! সে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল বিধুকে। বলল, "একি অবস্থা তোমার বিধু দাদু!" বিধু কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, "শরীরটা একদম ভালো যাচ্ছে না দাদুভাই। তোমার সঙ্গে কিছু জরুরী কথা আছে বলেই এলাম। এসো আমার সঙ্গে।" খেলার মাঠ পেরিয়ে, পুকুর ধার পেরিয়ে জঙ্গলের ভেতরের রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা টিনের চালের ঘর। ঘরের ঠিক পাশে একটা নয়নতারা গাছ। সেখানেই এসে থামল বিধু। দরজা খুলে বলল, "এই আমার বাড়ি দাদুভাই। কখনো তোমায় আনিনি ভাবলাম একবার শেষবার অন্তত নিয়ে আসি। বন্ধু বলতে আমার গল্পেরা ছাড়া এক তুমিই তো ছিলে!" ঘরের ভেতর একটা মাটির প্রদীপ জ্বলছে। ঘরের এক পাশে একটা ছোট্ট মাটির উনুন। আরেক দিকে একটা খাটিয়া, আর বিছিয়ে রাখা একটা মলিন চাদর। টুবাইকে খাটিয়ায় বসতে বলে,  চাদরটা জড়িয়ে তার পাশে এসে বসল বিধু।‌ বলল, "দাদুভাই, পরের শুক্রবার থেকে তুমি আর আমার জন্য অপেক্ষা করো না কেমন? আমি যা যা মন খারাপের ওষুধ জানতাম, তোমায় এতদিন শিখিয়েছি। মনে রেখো।" শুনে টুবাইয়ের চোখ ছাপিয়ে জল এলো। তার শিশু মনেও সে বুঝতে পারলো, এই বোধহয় তার শেষ দেখা বিধু দাদুর সাথে। এত মন খারাপের মন্ত্র জানা সত্ত্বেও তার চোখের জল বাঁধ মানলো না। কোনরকমে বলল, "তোমায় ছাড়া থাকার যে দুঃখ, তার কোন ওষুধ নেই দাদু?" এই প্রথমবার হাসতে পারল না বিধু। তার চোখেও কি জল? টুবাইয়ের মাথায় হাত রেখে বলল, "তোমার দিদা বেঁচে থাকতে ঐ নয়নতারা গাছটা লাগিয়েছিলাম আমরা দুজন মিলে। একদিন জ্বরের ঘোরে ওষুধের অভাবে তোমার দিদা মারা গেল। আমি ওষুধ, পথ্য কোন ব্যবস্থাই করতে পারিনি। রয়ে গেল শুধু ঐ নয়নতারা গাছটা। ওকেই প্রাণ দিয়ে বড়ো করলাম। আমারো খুব ইচ্ছে, একদিন নয়নতারা হয়ে যাবো তোমার দিদার মতো। এরপর থেকে নয়নতারা দেখলে তাকে যত্ন করো কেমন? দুঃখ কমবে কিছুটা । তবে এই বাড়িতে আর এসো না। এই জঙ্গলেও আর এসো না দাদুভাই। আমার খোঁজ করো না, আর দুঃখ করো না।"

বিধুর বলার ধরণে এমন কিছু একটা ছিল, হাজার ইচ্ছে থাকতেও একটাও পাল্টা প্রশ্ন করতে পারলো না টুবাই। চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল সে।

 

।৪।

আরো চারটে বছর কেটে গেছে। এ বছর মাধ্যমিক দেবে টুবাই। এখন সে ক্লাস টপার। পড়াশোনা ছাড়া আর বিশেষ কোনদিকে নজর থাকে না টুবাইয়ের। অবসরে সে গল্পের বই পড়ে। গল্পের বইয়ের মধ্যে দিয়ে কথা বলতে চায় বিধু দাদুর সাথে। একদিন টিউশন ফেরতা রাস্তা খারাপ থাকায়, তাকে কিছুটা সাইকেল ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা ধরতে হল। এসে পড়লো বিধু দাদুর সেই রকটার সামনে। হঠাৎ কি মনে হতে সে বাড়ির দিকের রাস্তায় না গিয়ে পুকুর পেরিয়ে সেই জঙ্গল যেদিকে ছিল, সেই রাস্তা ধরল। বহু বছর পর এইদিকে এলো টুবাই। বিধু দাদুর নিষেধ মেনে কোনদিন আসেনি আর এদিকে, আর আসার কথা ভাবলেই বড্ড কান্না পেত তার। জঙ্গলটা আর নেই। একটা পাঁচতলা এপার্টমেন্ট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ দেখলে বিশ্বাসই করবে না এখানে জঙ্গল ছিল একটা সময়। ফিরে আসতে গিয়েও, একবার থমকে দাঁড়ালো টুবাই। এপার্টমেন্টের ছাদের ঠিক নিচে একটা ফাটল ধরেছে। আর সেই ফাটল থেকেই মুখ বার করে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে একটা নয়নতারা গাছ।

 

সমাপ্ত

Sunday, September 25, 2022

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শারদ সংখ্যা

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটোগল্প


জিলিপি

 

সন্ধে হচ্ছে। যদিও ঘুরঘুট্টি অন্ধকার নামতে দেরি আছে। এখন চারপাশে বিকেলমরা ছাই ছাই রঙের আলো। খানিকটা কুয়াশার মতো। তেতে ওঠা দিনের শেষটুকু চেটেপুটে নিচ্ছে বাতাস। অজস্র কিচিরমিচিরের মধ্যে বড়ো রাস্তার ধারে জেগে উঠছে সান্ধ্যকালীন বাজার।

এধারে মাঠ। মাঠের শেষে কালীমন্দির থেকে কাঁসরের শব্দ ভেসে যাচ্ছে ওধারের ক্ষেতে। মন্দিরের পাশ দিয়ে যে ইটের রাস্তাটা হরিপুরা গঞ্জের দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তায় বৈশাখী অমাবস্যার মেলা বসেছে। একে একে কাঠিভাজা, গজা, জিলিপির দোকানগুলি বাঁশের ঠেকনা ওঠাচ্ছে। হুক করে আনা আলোয় বিশাল স্টোভে রসে জাল দেওয়া চলছে। কড়া মিঠে আর ভাজার গন্ধ ধোঁয়া হয়ে উঠে যাচ্ছে।

বড়ো রাস্তার ওধারে দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেতের ঢাল বেয়ে শেষ গোধূলির আলোয় উঠে আসছে একটা মুখ। প্রথমে উঠে এল রুক্ষ কোঁকড়ানো চুল, ঘোলাটে দুটো চোখ, আর উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ডিম্বাকৃতি মুখমণ্ডলে নরম দাড়ি-গোঁফের মাঝমধ্যিখানে জেগে থাকা অল্প কালচে ঠোঁট। তারপর ঈষৎ ঝুঁকে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এল নস্যি রঙের হাফশার্ট আর কালো প্যান্ট পরা রোগাটে একটা শরীর। বেঁটেখাটো ছেলেটা বড়ো রাস্তায় উঠে দুই হাত ঘষে ঘষে ঝাড়লো। তারপর টলতে টলতে কালীমন্দিরের পাশের রাস্তায় এগিয়ে গেল সে।

আজ শুধু চুমকি বিবি জানে, ইমরোজ গঞ্জে ঢুকেছে।

দুই হাত মুঠো করে প্রাণপণ চাপ দিল চুমকি। নলকূপ ককিয়ে উঠল। লোহার বালতিটায় লালচে জল নেমে এল। ভরা বালতিটা উঠোনের ধারে বয়ে নিয়ে গেল। কলঘরের টিনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। জাফরিকাটা খোপের ফাঁক বেয়ে শেষ বিকেলের লাল আলো এসে পড়েছে প্রায়ান্ধকার চৌখুপিতে। অনেকটা সময় নিয়ে যত্নে গা ধুয়ে নিল চুমকি।

ঘরে ঢুকে আলো জ্বালালো সে। ঘরটা একটেরে। জোরালো ডুমলাইটে সবুজ দেওয়াল দৃশ্যমান হল। সবুজ রংটা একবছর আগে নিকাহর সময়ে করিয়েছিল রহমত। তার জন্য চুমকির আব্বার থেকে টাকা আদায় করেছিল, সে জানে। টাকা দিতে ভ্যানরিকশাটা বেচে দিয়েছিল চুমকির আব্বা। এখন মালপত্তর নিয়ে হেঁটে বড়ো রাস্তার বাজারে যায়। শীতের সময় গায়ে লাগে না। ভরা গ্রীষ্মে কষ্ট হয়। সবুজ রং চোখে লাগে বলে চুমকি প্লাস্টিকের কালো কালো প্রজাপতি এনে দেওয়াল সাজায়।

মেটে রঙের ছাপা শাড়িটা ফুলে আছে। আয়নার তাক থেকে কুমকুমের বাটিটা পেড়ে এনেও আবার রেখে দিল চুমকি। কড়কড়ে মাড় দেওয়া শাড়িটার ভাঁজে ভাঁজে হাত চালিয়ে ফুলে ওঠা শাড়িটা বাগে আনলো। যত্ন করে হলুদ টিপের ফোঁটা দিল কপালে। আলতো আলতো আঙুল চালিয়ে হাতখোঁপার কাঁটাগুলো পরীক্ষা করে নিল। তারপর চৌকির তলা থেকে বের করে আনলো একটা জুতোর বাক্স। জুতো নেই। ভিতরে একটা ছেনি, দুটো ছোটো ছোটো হাতুড়ি, দিঘা থেকে কুড়নো কিছু ঝিনুক আর এক আঙুল লম্বা একটা শিশি। আতরের। রহমতের। লুকিয়ে রাখে। রহমতের না ফেরার দিনগুলোতে চুমকি লুকিয়ে লুকিয়ে আতর মাখে।

গলায় আর কাঁধের মাঝে আতর ঘষে নেয়। কব্জিতেও আতর দেয়। তারপর পয়সা ক’টা গুনে নিয়ে হাতব্যাগটা মুড়ে ফেলে বুকের ভাঁজে চালান করে। আলো নিভিয়ে ঘর বন্ধ করে চারপাশটা দেখে নেয়। সাবধানের মার নেই। বাড়ির পিছনে একটা মজা খাল। লোকে বলে সোনাই খাল। সেদিকটা দেখে এসে নিশ্চিন্ত হয়। সন্তর্পণে বেরিয়ে যায় চুমকি।

ঘন আলোয় ঢুকে কপালের ঘাম মুছে নিল ইমরোজ। গুমোট গরমে ভিড় বাড়ছে মেলায়। এদিকটা আগে ফাঁকা ফাঁকা ছিল। এখন দুয়েকটা বাইরের লোকের দোকান বসছে। হরিপুরা গঞ্জ খুব তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে। ছেলেপুলেরা শহরে চলে যাচ্ছে। শহরের পয়সা নিয়ে এসে বাড়ি-ঘর পাকা করছে। ক্ষেতখামার এখনও কিছু বেঁচে আছে বটে, কিন্তু মানুষের বুকের ভিতর থেকে ক্ষেতখামার উঠে যাচ্ছে। সরে যাচ্ছে। বদলে ইটের রাস্তা বসছে। পাঁচিল উঠছে। বুকের ভিতর থেকে ঢালাইয়ের একটানা আওয়াজ আসছে।

ইটের রাস্তাটার একধারে বাদামি কাপড়ে ঘেরা জায়গা। বাইরে টুনিবাল্ব জ্বলা গায়ে একটা রোবট দুই হাত ওঠাচ্ছে নামাচ্ছে। রোবটটার হাতে ধরা একটা গ্লোসাইন বোর্ড। তাতে লেখা- ‘ভিডিও নাইট’। ‘ভিডিও নাইট’ উঠছে, নামছে। ভিডিও নাইটের তাঁবুর পাশে একটা ভাজা মিষ্টির দোকান। অস্থায়ী। ভাজা মিষ্টির গন্ধে ইমরোজের পেটের খিদেটা ঘুলিয়ে উঠল। কাঠের বারকোশে থরে থরে সাজানো জিবেগজা, কাঠিভাজা, জিলিপি, খাজা। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দুটো নোট বের করে আনলো। একঠোঙা জিলিপি কিনে একটুকরো ভেঙে ঠোঁটের ভিতর দিতেই সকাল থেকে উপোসি পেট চনমনিয়ে উঠল। ইমরোজ এগিয়ে চলল।

মেলার আলো পেরিয়ে গেলে বাকি পাড়াটা অন্ধকার। অন্ধকারে দূরে দূরে একটা দুটো দোকান। দোকানের ভিতর টিমটিমে আলো। নিভু নিভু টিউবলাইট। এই এলাকায় বিদ্যুতের সমস্যা খুব। কয়েকটা পেটোয়া লোক অবশ্য নিজেদের ঘরে আলোর ব্যবস্থা করেছে। তাদের ঘরে বাকিরা চোখ টেরিয়ে তাকায়। সমীহ করে। সোনাইয়ের খাল বুজিয়ে সেখানে চিনিকল বসবে। তখন সঠিকভাবে আলো আসবে। ইমরোজ শুনেছে।

পালপাড়ায় ঢোকার মুখে ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আলো। হলুদ হলুদ আলোয় ইমরোজের চোখে হাসি দেখা দিল। দূর থেকে মুখোমুখি এগিয়ে আসছেন একজন। বাদামি পাঞ্জাবি আর সাদা ধুতি পরে এগিয়ে আসছেন জগৎজ্যোতি ভট্টাচার্য। হরিপুরা উচ্চবিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক। জগৎ স্যারকে দেখে ইমরোজ মাথা ঝুঁকিয়ে হেসে দাঁড়িয়ে পড়ল। 

‘তুই ইমরোজ না?’ ক্লাসে প্রথম হওয়া ছাত্রকে চিনতে পারলেন জগৎ স্যার।

‘হ্যাঁ স্যার। ভাল আছেন?’

‘ওই আর কী? যেমন থাকি। তা তুই আজকাল এখানে থাকিস না?’

‘না স্যার। মাঝেমাঝে আসি’।

‘থাকিস কোথায়? কী করিস’?

‘কলকাতার দিকে থাকি। বড়বাজারে একটা মশলা কারখানায় কাজ করি’। নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিতে দিতে ভিতরে আত্মবিশ্বাসের ঢেউ টের পাচ্ছে ইমরোজ।

‘আর পড়লি না কেন? ভাল ছাত্র ছিলিস। এভাবে ছেড়ে দিলি?’

‘আব্বা হুট করে মরে গেল। জমিজমা নেই, খাওয়ানোর কেউ নেই। কাজ খুঁজতে গিয়ে আর পড়া হল না’। ইমরোজের স্বরে ঈষৎ তাচ্ছিল্য লেগে রইল।

‘আজকাল তো কত নাইট কলেজ হয়েছে শুনেছি। সেখানে যেতে পারিস না?’

‘রাতে অন্য কাজ করি’। রোয়াব চেপে জবাব দিল ইমরোজ। ভিতরটা তার ফেটে যাচ্ছে।

হাল ছেড়ে দিলেন জগৎ স্যার। ‘অ! যা ভাল বুঝিস কর। ভাল থাক! ভাল থাক!’ বলে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। ইমরোজ এগিয়ে গেল।

খানিক এগিয়ে পিছনে ফিরতেই অবাক হল সে। জগৎ স্যার দাঁড়িয়ে পড়েছেন। পিছু ফিরে তাকে দেখছেন। চোখাচোখি হতে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। কাছে গেল ইমরোজ। মাথাটা ঝুঁকিয়ে জরুরি ভঙ্গিমায় জগৎ স্যার বললেন, ‘যা করবি ভেবে করবি বাবা। মনে নেই? ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না! 

পালপাড়ার মোড় থেকে অল্প দুলে দুলে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন স্যার। ডানদিকে ঘাড় হেলিয়ে দিল ইমরোজ। ঠোঙা থেকে আরেকটা জিলিপি তুলে কামড় বসালো সে। এগিয়ে গেল খানপাড়ায়, নিজের ভিটের দিকে।স্কুলবাড়ির সামনে খোলা জমি। হাল আমলে জমিটার গায়ে রাস্তাটা পিচের হয়েছে। ইমরোজদের সময় ঘাস উঠে মাটির পায়ে চলা পথ ছিল। পথটা উঠে গেছিল সোজা এক তলার করিডোরে। দুটো সিঁড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে ক্লাসের আগে ঘন্টা বাজায় গোবিন্দদা। ইমরোজ ভাবে, কতকাল দেখা হয়নি।

হলুদ স্কুলবাড়ি ছাড়ালেই বাঁশবাগান। এখন সেখানে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। এখান থেকে খানপাড়া অবধি আলোর ব্যবস্থা নেই। কবে হবে জানা নেই। রাগে একটা গালাগালি বেরিয়ে আসে মুখ থেকে। মাথাচাড়া দেওয়া রাগটা থামাতেই ঠোঙা থেকে আরেকটা জিলিপি তুলে মুখে পুরে দেয় ইমরোজ। পেটের ছুঁচোটা আপাতত শান্ত হয়েছে। আরও দুটো জিলিপি পড়ে আছে ঠোঙায়। ঠোঙাটা মুড়িয়ে রাখে সে।

শিকদারদের উঠোন পেরোলে পুকুর ধারের পথ দিয়ে ভিটেয় ঢোকা যায়। না হলে কসাইপাড়া দিয়ে যেতে অনেকটা ঘুরপথ হয়। শিকদাররা এপাড়ার সম্পন্ন পরিবার। দোতলার ঘরে লো ভোল্টেজে টিউব জ্বলে। ক্ষীণ আকাশি দেওয়াল দেখা যায়। খোলা জানালার বাইরেটা আলো হয় না। শুধু ঘরটুকু দেখা যায়। বাড়ির পিছনেই শিকদারদের বাগান। পাঁচিলের অনেকটা ভাঙা। ভাঙা পাঁচিল দিয়ে ঢুকলেই ইমরোজের ভিটে। আব্বার ভিটে। টালি চালের নিচে দুটো পাকা ঘর। বন্ধ পড়ে থাকে। প্রায় ভগ্নদশা। সাপখোপের রাজ্য হয়েছে শুকনো কুয়োতলা। পিছনে বয়ে গেছে খাল। লোকে বলে সোনাই খাল।

অনেকক্ষণ গুমোটের পরে পুকুরধারে হাওয়া দিচ্ছে। হয়ত দূরে কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। সেদিক থেকে বাতাস আসছে জলের গন্ধ মেখে। ইমরোজের শরীর জুড়িয়ে যায়। হাওয়া খেতে বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে বসে পড়ে সে। এই ঘাটে খেলতে আসত সে। মা মরা ছেলে, বাপটা সারাক্ষণ লোকের জমিতে মুনিষ খাটে, তবে লেখাপড়ায় মাথা ছিল। তাই দুয়েকজনের সমীহ জুটে যেত। সম্পন্ন শিকদাররা খানপাড়ার অন্য বাচ্চাদের দূর দূর করলেও ইমরোজ ঘাটে বসার নীরব অনুমতি পেয়েছিল। এই ঘাটে বসে ভরা দুপুরে সে ভাবত, সে কে? কোন ধুলোমাটি থেকে সৃষ্টি হল? এই বিপুল পৃথিবীতে তার নিজস্ব অস্তিত্বের প্রমাণ কী? একটা শরীর? এই-ই প্রমাণ? এর বাইরে কিছু নেই? এর বাইরে যদি কিছু থাকে তবে কী সেই অদৃশ্য যোগ যা তার অস্তিত্বের প্রমাণ?

‘কে রে? কে ওখানে? ওখানে কে বসে?’

   হাতে জিলিপির ঠোঙাটা একমনে দেখছিল ইমরোজ। আচমকা আরেকজনের উপস্থিতি জেনে মুখ তুলল সে।

ওহ! এ তো মিনতি চাচির গলা। রাগত কন্ঠস্বর। ইমরোজ টের পেল। ফের ভিতরের আত্মবিশ্বাস ঢেউ খেলে গেল যেন। ঘাড় ফিরিয়ে বলল, ‘আমি। ইমরোজ। বাগানধারে সৈয়দের ছেলে। মনে পড়ে?’

গোলাপি শাড়ি পরে মিনতি চাচি এগিয়ে এলেন। আধখানা চাঁদের আলোয় ভাল করে ঠাহর করে নিশ্চিন্ত হলেন। খুশিও হলেন। মুনিষের ছেলেটাকে ছোটবেলায় খেতে দিতেন। শুকনো মুখে পুকুরঘাটে এলে দোতলার জানালা বা ছাদ থেকে ডেকে নিতেন। ডাকখোঁজ ছিল অনেকদিন। তারপর সৈয়দ মুনিষ মরল, ছেলেটা শহরের দিকে কোথায় যে চলে গেল! এতদিন পরে দেখা।

‘ছিলিস কোথায় তুই? ভিটেয় তো ঘুঘু চড়ে! কোথায় পড়ে থাকিস?’

‘কলকাতায় থাকি গো চাচি। একটা মশলা কারখানায় কাজ করি’।

‘এখানে বাপ-ঠাকুরদার গেরাম ছেড়ে অতদূরে অনাথের মতন পড়ে থাকা কি ভাল? লেখাপড়া করিস আর?

‘ছেড়ে দিয়েছি’। হাসিমুখে জানায় ইমরোজ।

‘এখেনে জমির কাজ করতে পারিস না?’

‘পারি না। শিখিনি কিছু’।

‘থাকবি ক’দিন? 

‘আজ রাতেই ফিরে যাবো’।

‘সে কি! এতকাল পরে বুড়ি ছুঁতে ভিটেয় ফিরলি?’

‘একটা কাজ আছে’। ইমরোজ টের পায় উত্তেজনায় মাথার ভিতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। তবু নম্রস্বরে উত্তর দেয়। মিনতি চাচি ছেলেবেলায় তাকে খেতে দিয়েছে। মায়াটান ছিল।

চাচি কী বুঝলেন কে জানে, ‘দেখিস ব্যাটা, কুসঙ্গে পড়িস না! অভাবে স্বভাব নষ্ট করিস না!’ বলে শিকদারদের উঠোনের দিকে হাঁটা লাগালেন।

আরেকটা জিলিপি খেতে গিয়ে থেমে গেল ইমরোজ। ঘাট থেকে উঠে পড়ল। বাগানের ভাঙা পাঁচিলের দিকে হাঁটতে শুরু করল। অনেকক্ষণ পর টের পেল, সে অল্প অল্প জেগে উঠছে!

ভিটের ধারে পাঁচিলের গা ঘেঁষে অন্ধকারে মিশে দাঁড়িয়ে ছিল চুমকি। এখন চুমকি বিবি। ইমরোজকে টের পেয়ে আঁকড়ে ধরল। খয়াটে বুকের মধ্যে টেনে নিল। কথা বলার সুযোগ পেল না ইমরোজ। তার জিভে মিশে যাচ্ছে চুমকির জিভ। নাকে আসছে আতরের কড়া গন্ধ… 

এখন ভোর। ঠিক ভোর নয়। শেষ রাত শেষ হওয়া ভোর। ক্ষেত থেকে যেমনভাবে সূর্য বিদায় নিয়েছিল, তেমনভাবে ফিরে আসছে সে। একই রং ছড়িয়ে। একই প্রগলভতায়। ক্ষেতের শেষ প্রান্তে উঁচু ঢিবিটায় ঘাসের ওপর বসে আছে ইমরোজ। শরীর ক্লান্ত। চুমকি, তার ছেলেবেলার চুমকি, অন্যের হয়ে যাওয়া চুমকি তাকে নিঃশেষ করেছে কাল। সে খুব ভালবাসে এই মেয়েটাকে। তার চেয়েও বেশি ভালবাসে আলি সাহেবকে। হিসেবমতে আলি সাহেবের সব কথা মিলে গেছে! বাধা আসবে। আলি সাহেব বলেছিল বাধা এলেও সে যেন না ডরায়।

সেই দুপুরটা আজও মনে করতে পারে ইমরোজ। তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। সবাই ভিড় করে এসেছিল বড়ো রাস্তার ধারে। জায়গাটা ঘিরে রেখেছিল পুলিশ। একইরকম দুলে দুলে রাস্তা পার হচ্ছিলেন জগৎ স্যার। ব্রেক ফেল করেছিল পাঞ্জাব লরির। স্পটডেড।

বছর খানেক পরে একদিন রাতের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ইমরোজের। তখন আব্বা বেঁচে ছিল। এমন চিৎকার প্রায়ই আসে। তবু সেদিনকার চিৎকারে অন্য কিছু ছিল। আকাশ ফাটিয়ে ফেলার মতন কিছু। ‘চল তো দেখি!’ বলে উঠে বেরিয়ে গিয়েছিল আব্বা। শেষমেশ শিকদারদের উঠোনে পৌঁছে ভয়ংকর দৃশ্য দেখেছিল ইমরোজ। শিকদারদের ছোটো চাচা মদ খেয়ে এসে বাড়াবাড়ি রকমের অশান্তি করছিলেন। মিনতি চাচির ধৈর্য ভাঙতে তেড়ে গিয়েছিলেন। তাতেই উঠোনের ধারে পড়ে থাকা বাঁশ নিয়ে এসে স্ত্রীর মাথায় সজোরে বসিয়ে দিয়েছেন শিকদার চাচা। স্পটডেড।

আলি সাহেবের সবকটা কথা মিলে যায়। আলি সাহেব তার প্রাণের বন্ধু, পথপ্রদর্শক। ইমরোজ তার কালো প্যান্টের পকেট থেকে বের করে আনলো পিতলের কৌটো। প্যাঁচ কষে আটকানো। আলি সাহেবের দেওয়া। ঢাকনা খুলে দেখে নিল। ভিতরে কিছুটা লাল ভরেছে সে। কালচে। শুকিয়ে এসেছে। আকাশের রঙের সাথে মিল নেই।

প্যাঁচ বন্ধ করে পকেটে পুরে উঠে পড়ল ইমরোজ। খাল পেরিয়ে ট্রেন ধরবে সে। খিদিরপুরের গুমটিতে আলি সাহেবের কাছে যেতে হবে। 

ভোর কেটে এখন সকাল। সাতসকাল। শিকদারদের বাগানে বছর কয়েক আগে মিনতি চাচির মতন চেঁচিয়ে উঠল কেউ। মেটেরঙের শাড়ি জড়ানো মেয়েটা চিত হয়ে পড়ে। মুখটা চেনা চেনা লাগে। পাশের পাড়ার মেয়ে। চোখদুটো আধবোজা। মাথাটা বাঁ দিকে ফেরানো। ঠোঁটের চারপাশে জিলিপির মতো কিছু গুঁড়ো হয়ে লেগে আছে। বাঁ দিকের কষ বেয়ে গ্যাঁজলা নেমে গেছে। সাথে ডান পায়ের গোছে শাড়িটা উঠে গেছে। সেখানে বেশ কিছুটা জায়গা কাটা। রক্ত শুকিয়ে গেছে। মাছি ঘুরছে।

ভিড় বাড়ছে। ঘিরে থাকা ভিড় থেকে বেরিয়ে এল কেউ কেউ। তড়িঘড়ি পাশের গ্রামে রহমতের দ্বিতীয় সংসারে ছুটে গেল কেউ কেউ।

‘ওরে রহমত! ঘরে আছিস? শিগগির চ! তোর বিবি বিষ খেয়েছে!’

 

                        সমাপ্ত

সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়, শারদ সংখ্যা

সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটোগল্প

মধ্যবিত্ত


রোববার নাগাদ মুচকুন্দ দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, এই যে তার থলেটা(বাজারের) ক্রমশ ভারী হয়ে যাচ্ছে আর হাতলের নাইলন ডানহাতের চার আঙুলের কর বরাবর কেটে বসে যাচ্ছে এবং তার মতো আগু-পিছু দাঁড়ানো অন্যান্য মানুষদেরও মুখচোখ দেখে সহজেই এই সাম্যাবস্থাটি অনুমান করা যাচ্ছে, এই এতগুলো মস্তিষ্ক সম্মিলিত ভাবে এটা সহ্য করছে কেন?

 

কারণটা সম্ভবত বাঁ হাতের অপেক্ষাকৃত ছোট অথচ অপার সম্ভাবনাময় এবং মূল্যবান থলেটির মধ্যে নিহিত। যেখানে কুচো-মাঝারি-বড় তাই কাটা মাছেদের রূপোলি আহ্বানে সাড়া দেওয়ার পরও আরও খানিকটা শূন্যস্থান পড়ে থাকে। সেই শূন্যস্থানে গ্রামার টামারের ধার না ধেরেই নানা আকারের নানা প্রকারের একেকটি নধর দেহাংশ প্রবেশ করে।

 

মুচকুন্দর স্থির বিশ্বাস ঈশ্বরের অনেক অবতারের মধ্যে মুরগিও একটি অবতার। না তাই বলে পাঁঠা-পাঁঠি-ভেড়া কিংবা কাছিমের গোপনতাকে সে মোটেই ছোট করে না কিন্তু মুরগির প্রতি তার অনেকটা প্রথম প্রেমিকার চকোলেট চুমুর মতো দুর্বলতা আছে। আচ্ছা, মুরগি এত স্বর্গীয় বলে অনায়াসে মারা যাওয়ার পর অনায়াসে স্বর্গবাসী হয়, তা তো নিশ্চিত। বাংলা সাহিত্যের জ্ঞানীরা লিখে গিয়েছেন। স্বর্গেও তাহলে তাদের জন্য খোঁয়াড় রয়েছে। কিন্তু সেখানে যখন তারা ভাজা-সেদ্ধ-আধসেদ্ধ(না, নারকীয় ভাবে নয়) হয়ে থালা-বাটি-প্লেটের গরিমা বাড়ায়, তারপরে কি তাদের পুনর্জন্ম হয়? স্বর্গে কিছুদিন থেকে আরও বেশি স্বাদে ভরপুর হয়ে তারা কি আবার ফিরে আসে? ওই যে খাঁচার মধ্যে কেউ ডানা ঝাপটাচ্ছে(অকারণে) কেউ ধ্যান করছে কেউ মাতালের মতো ঢুলুঢুলু চোখে এই তালঢ্যাঙা লাইনটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, ওর মধ্যেই কি কেউ স্বর্গের অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত? মুচকুন্দ তীক্ষ্ণ চোখে বোঝার চেষ্টা করে। সেরকম কিছুই নাগালে পায় না। হতাশ হয়। বুঝতে পারে, ভালোবাসায় এখনও খামতি রয়ে গেছে, না হলে মুরগিদের নিজস্ব ভাবনা বা স্মৃতিচারণ সে এতদিন পরেও কেন ধরতে পারে না!

 

লাইনটা খুব ধীরে এগোচ্ছে। এক একটা আস্ত প্রাণী ক্যুইক মার্চের ছন্দে খাঁচা থেকে বেরোচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকটি অর্ধ-আবিষ্কৃত জ্যামিতিক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে ওজনযন্ত্রের ওপর আর তারপর কালো প্লাস্টিকের ব্যাগে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে ঝপাৎ শব্দে কোনও এক নাইলনের ব্যাগের সম্ভাব্য স্বাদ ও মূল্য দুটোই বাড়িয়ে গন্তব্যের দিকে দৌড়চ্ছে অবলীলায়।

 

জল্লাদ না না কসাই(আচ্ছা আরেকটু নরম কিছু বলা যায় না?) ছেলেটার বাঁ-হাতের মধ্যমার ঠিক মাঝখানটায় একটা বড়সড় আঁচিল। যখন একটি মুরগি জাতধর্মের হরেক চাহিদা পেরিয়ে বঁটির সামনে গলা পাতে আর ছ্যাঁড়াৎ করে একটা অপার্থিব শব্দ হয় আর মুন্ডুটা মাটিতে ছিটকে পড়ে হঠাৎ ভাষা ফিরে পায় যেন আর ধড়টা ডানার শক্তি ও তাৎপর্য সবেমাত্র বুঝতে পেরে ছরফর অথবা ছড়ফড় শব্দে খুশি বা আপত্তি জাহির করতে থাকে তখন মুচকুন্দ প্রতিবার বড় মুগ্ধ হয়ে সেই আন্দোলন চাক্ষুষ করে। একমূহুর্তের জন্যও চোখ সরায় না। কিন্তু মুশকিল টা হয় তার একটু পরেই। ছেলেটা যেই মন দিয়ে জ্যামিতি আঁকতে বসে মুচকুন্দের চোখ আপনা-আপনি ব্যাদড়া বাছুরের মতো ওই আঁচিলটার ওপরে গিয়ে থিতু হয়। প্রতিবার বঁটির ফলার গা বেয়ে টকটকে সৌন্দর্য গড়িয়ে পড়ে, ছেলেটার আঙুল গুলো অফুরন্ত হোলির আনন্দে মাতোয়ারা হয় আর মুচকুন্দ আঁতকে ওঠে। এই বুঝি আঁচিলটা আলাদা হয়ে গেলো। এই বুঝি সাধের পাকস্থলীর গায়ে মিশে গেল ঈষৎ ছাইরঙের একটা তুলতুলে গুটিপোকা।

মুচকুন্দ চোখ সরিয়ে নিতে চেয়ে বলল,

"দেখুন দেখুন, ওই যে ছোট্টমতো মুন্ডুটা এইমাত্র মাটিতে পড়লো, ওটা কেমন সুন্দর কথা বলার চেষ্টা করছে। ওই দেখুন, পরিষ্কার 'আ' বললো!"

সামনের ভদ্রলোক সিগারেটে একটা লম্বা টান মেরে ধোঁয়াটাকে ছাড়তে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে সেটা গিলবেন না ধরে রাখবেন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে প্রবল বিষম খেলেন। মুচকুন্দ তাড়াতাড়ি পিঠ চাপড়াতে গিয়ে শুনলো ভদ্রলোক নিঃশ্বাস নিতে নিতেই খুব হালকা করে "বোকা-ইত্যাদি", তৎসহ " সক্কাল সক্কাল এইসব শান্তির ছেলেগুলো যে কোত্থেকে এসে জোটে!" এই কথা'কটি স্পষ্ট উচ্চারণে বলে ফেললেন। মুচকুন্দ ভীষণ মুগ্ধ হয়ে গেল,

"আরে মশাই, আপনি যে দেখছি নাক দিয়ে চমৎকার কথা বলতে পারেন! কী দারুণ প্রতিভা! আমাকে শেখাবেন?"

ভদ্রলোক এবার কান ভুরু  কুঁচকে কিছু একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলালেন, তারপর স্বাভাবিক গলায় বললেন,

"দাদা, এত সকালেই চড়িয়ে এসেছেন না কি? ভুলভাল বকে মাথা খাচ্ছেন কেন?"

মুচকুন্দ অবাক হয়ে সঙ্গে সঙ্গে পাজামার গিঁটের নিচটায় তাকাল,

"না দাদা, চড়িয়ে তো আসিনি! সেরকম চড়েও না কোনওদিন! আপনার এরকম মনে হচ্ছে কেন?"

ভদ্রলোক একবার মুচকুন্দের কপাল থেকে পায়ের পাতা অবধি চোখ দিয়ে পায়চারি করলেন। কী যেন ভেবে একটু সরে দাঁড়ালেন আর বললেন,

"দাদা, আপনি আমার আগে দাঁড়ান।"

"এমা, না না তা কী করে হয়! আপনি এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন..."

"আরে কোনও অসুবিধে নেই। আমার অভ্যেস আছে। আপনি আগেই আসুন।"

"ধন্যবাদ আপনাকে", বলে মুচকুন্দ আর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেলো।

চতুর্ভুজ ষড়ভুজের চেয়ে ত্রিভুজ অথবা বৃত্তই বেশিরভাগ খদ্দেররা পছন্দ করে। দোকানি ছেলেটা খুব ভালো করে জানে। সে নিপুণ কায়দার মোচড়ে উপপাদ্য ও সম্পাদ্যগুলি একের পর এক শেষ করে নম্বর গুনে নিয়ে বাক্সে ঢোকায় আর মুচকুন্দ একসময় লাইন থেকে বেরিয়ে আসে। ভরন্ত ভাদ্রের রোদ এখন বড় বেশি গায়ে পড়ছে নাছোড় ভিখারির মতো। কাজেই হনহনিয়ে হাঁটতে থাকে সে।

ডানহাতের থলেটির ভেতর দায়গ্রস্ত গেরস্থের মতো সব্জি গুলো একে অন্যের পেছনে মুখ লুকোচ্ছে। মুচকুন্দ হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে একটা ক্যাপসিকামের দিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে সেটা একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বেশ কয়েকটা ধনেপাতার ছাউনির নিচে গা-ঢাকা দেয়। মুচকুন্দ হঠাৎ কেমন উদাস বোধ করে। বাবার কথা মনে পড়ে তার।

একমাথা চুল, অত্যন্ত ঘন দাড়ি(যার ফলে বাবাকে কোনওদিন গাল চুলকোতে হতো না) আর পুরু ঠোঁটের সুদর্শন বাবা। একমাত্র ছেলে সামনে এলেই চোখ কুঁচকে যেত তাঁর। মুচকুন্দের মুখটা একেবারেই তাঁর মতো শুধু ওই চুল দাড়ি আর ঠোঁটের গাঢ়ত্ব বাদ দিয়ে। না মানে চুল তার ছিলো, তবে খুবই পাতলা, সহজেই খুলির রঙ দেখা যেত। একবিন্দু দাড়িও কোনওদিন গজায়নি, এমনকি মরসুমি ক্রিমও তার গালে বসতি স্থাপন করতে পারত না, দ্রুত স্খলনের লজ্জা নিয়ে গড়িয়ে যেত। আর তার ঠোঁট, একটা সময় পর্যন্ত প্রায় নজরেই আসত না। মা মাঝে-সাঝে কাপড় মেলার ক্লিপ দিয়ে অধরোষ্ঠ দুপাশে টেনে রাখতেন। এই ছোটখাটো ব্যাপারগুলোকে সামান্য কল্পনা করে নিতে পারলেই ছেলে আর বাবা একেবারে যমজ। কিন্তু বাবার কল্পনাশক্তি ছিল না, থাকলেও সে বাবাকে ভয় পেত।

হপ্তার শেষাশেষি  মায়ের কোলে বসে উত্তমকুমার আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দিকে মায়ের মতোই জুলজুল করে তাকিয়ে থাকত মুচকুন্দ। একটু বড় হওয়ার পর যখন সে বুঝল উত্তমকুমার আর সৌমিত্র টিভির বাইরে কোথাও থাকেন না তখন সে লুকিয়ে বাবা-মা'র ঘরে যেতে শুরু করে। কেন লুকিয়ে? তা সে জানত না কিন্তু চুপিচুপি যেতেই ইচ্ছে করত বরাবর। আলমারি খুলে বাবার শার্ট ফতুয়ার মধ্যে মুখ গুঁজে দিতো। বাবা যখন অফিস থেকে ফিরে ঘামে ভেজা জামাপ্যান্ট বারান্দার আলনায় ছুড়ে ফেলে বাথরুমে যেতেন তখন ওই জামাটায় বিশেষত প্যান্টের কোমরের কাছটায় ছোট্ট নাক দাড়িহীন গাল আর প্রায়-অদৃশ্য ঠোঁটসহ সে কেমন একটা মিশে যেতে চাইত।

বেশ চলছিলো। একদিন বাবার চোখে পড়ে যায়। অবশ্য তার আগে অ্যাশট্রে থেকে বাবার ফেলে দেওয়া সিগারেটের ফিল্টার তুলে নিয়ে ঠোঁটে প্রাণপণ চেপে ধরা রয়েছে। স্কুল থেকে ফেরার সময় ভরাভরতি ট্রেনের কামরায় অচেনা লোকের সঙ্গে কোমরের নিচে নিরূপায় এবং আশ্চর্য ঘেঁষাঘেঁষির চাহিদা রয়েছে। ন্যাদাইদাদার হাত ধরে লৌকিকতাহীন দুপুরে চিলেকোঠায় গিয়ে তখনও অর্ধস্ফুট ঠোঁটে অদ্ভুত এক স্বাদ ও ব্যথার অনুভূতি রয়েছে। তা এসব পেরিয়ে যেদিন বাবার নজরে পড়ে যায়, সেদিন বাবার চোখের দিকে চোখ পড়তে শিউরে উঠেছিল সে। আরও অবাক হয়েছিল যে ব্যাপারটায়, বাবা বকুনি বা পিটুনি কোনওকিছুরই বিন্দুমাত্র ধারপাশ দিয়ে যায়নি আর এতে তার আশ্বস্ত হওয়ার কথা থাকলেও সে যেন কীরকম এক অস্বস্তির কবলে পড়ে প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের পছন্দের কর্মকাণ্ডগুলো নিজের মধ্যেই গুটিয়ে নিয়েছিল।

কয়েকদিনের মধ্যেই তার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হয়। একদিন বাবার বন্ধু ডাক্তার কাকা এসে খানিকক্ষণ কীসব পরীক্ষা-টরীক্ষা করে। তারপর গম্ভীর মুখে পাশের ঘরে গিয়ে বাবা-মা'র সঙ্গে সিলেবাসের ভার্সাই চুক্তির মতো কঠিন কোনও এক শলাপরামর্শ করে। পরের দিন থেকে হঠাৎ তার স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ হয়। পাড়ায় শক্তিশালী কোনও এক জাদুমন্ত্রে সবাই জেনে যায় যে, তার নাকি ভয়ানক অসুখ করেছে। বিছানা থেকে এখন অনেকদিন ওঠাই বারণ। বন্ধুরা দু'একবার দেখা করতে আসে আর বাবার চোখ তাকে যেন জাদুবলেই সম্পূর্ণ বোবা বানিয়ে রাখে।


একে একে বন্ধুরা দূরে সরে যায়, দুয়ে দুয়ে বন্ধুদের চেহারা আবছা হয়ে যায়, তিনে তিনে তাদের নামগুলোও মনে পড়ে না, চারে চারে, পাঁচে পাঁচে, ছয়ে ছয়ে, সাতে সাতে একের পর এক দিদিমণি তাকে পড়াতে আসে এবং বাড়ি বসেই সে উঁচু থেকে উঁচুতর ক্লাসে প্রমোশন পেতে থাকে, আটে আটে সে বুঝতে পারে বাবা নামক লোকটার ক্ষমতা বিশাল, না'হলে স্রেফ বাড়ি বসে এতগুলো রেজাল্ট আর সার্টিফিকেটের কাগজ কীভাবে তার করায়ত্ত হয়? নয়ে নয়ে হঠাৎ একদিন সে একটা চকচকে আপিসে যাতায়াত শুরু করে যেখানে সবাই বোবা ঘাড় গুঁজে খালি কাজ করে যায় আর দশ অবধি এসে সে নিজেকে অতুলনীয় এক ছাদনাতলায় আবিষ্কার করে আর শুভদৃষ্টির সময় অন্যদিকের দৃষ্টির শুভময়তা সে সহজেই টের পায় কেননা এই নতুন আঁখিপল্লবের সন্ধান ও রচনা বাবা নিজের হাতে সাঙ্গ করেছিলেন। বাবার ওপর অগাধ ভরসা বশতঃ সে এই নবাগতা সংযোজনের টিকে যাওয়া বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়।

 

বাবা-মা দু'জনেই প্রায় একইসঙ্গে তার ঠিক পরপর যেন অনেকযুগের চেপে রাখা শ্বাস প্রচন্ড গতিতে ছাড়তে ছাড়তে মুচকি হেসে চোখ বুজে ফেলেন।

মুচকুন্দ অ্যাদ্দিনে ভেদ করবার যথেচ্ছ সুযোগ যদিও পেয়েছে এবং এখনও পায় কিন্তু  তার মনের অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং মুখচোরা এক গলির মধ্যে ধারণ করবার যে ইচ্ছাটি সে একসময় লালন করত, সেটি বিকলাঙ্গ হয়ে স্বাভাবিক অভিযানের দিক থেকে লক্ষ্মীপেঁচার মতো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অবশেষে।

বেঁচে থাকা এক বড়সড় বালাই তাই অভিমান ঘেন্নায় বিবর্তিত হতে যতটা সময় লাগে তার ইঞ্চিটাক আগে সে খড়কুটোর মতো এই মুরগিপ্রেম আঁকড়ে ধরেছে। একে শখ, আবেশ কিংবা অনুগামীতা যা'ই বলা হোক, তার কিচ্ছু আসে যায় না। বউ নামক প্রাণীটির শরীরের সক্ষমতার প্রতি সমস্ত ঈর্ষা সে ঝোল ও ঝালের সৌকর্যে মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে এইভাবে।

ডোরবেল বাজানোর কিছুক্ষণ পরে বউ দরজা খোলে।

বউয়ের শরীর থেকে টাটকা অক্সিজেন ভেসে আসে আর মুচকুন্দের নাক জ্বালা করে। সে কলঘরের দিকে যেতে যেতে থলে দুটো একরকম ছুড়েই মারে বউয়ের দিকে। রোজকার মতো আজও বউ ক্যাচ মিস করে না।

মুচকুন্দ কৃত্রিম বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে নাক ঘষে। চোখ ছোঁয়।

গলা থেকে সাবান বোলাতে বোলাতে নাভির ঠিক ওপরে এসে থামে। টের পায় ফেনা গড়াচ্ছে। গড়িয়ে নামছে। নাভি পেরোচ্ছে। তলপেট ছুঁয়ে ফেলল এবার আর একটু...আর একটু নামলেই...সে চোখ টিপে বন্ধ করে বৃষ্টির বেগ বাড়িয়ে নেয়। ততক্ষণে অত্যাশ্চর্য এক সুগন্ধী বাড়ির আনাচে-কানাচে জবরদখল বসিয়েছে।

মুচকুন্দ রান্নাঘরের চেয়ে একটু দূরে ডাইনিং টেবিলে এসে বসে। টিভি চালায়--কোথায় যেন যুদ্ধ বেধেছে। যে দেশ হারছে তার মজুত করা সব খাবার যে দেশ জিতছে তারা খেয়ে নিচ্ছে বেমালুম আর একবারও ঢেঁকুর তুলছে না। হেরো দেশ থেকে পিলপিল করে মানুষ বেরিয়ে আসছে। অনেক উঁচু থেকে ছবি তুলছে কেউ অথচ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তারা মানুষ ছাড়া অন্য কিছু নয়। মুচকুন্দ ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো, "তাহলে কি মহাকাশ থেকেও মানুষকে মানুষ বলে চেনা যাবে যদি কারও ফোকাস পালোয়ানের মতো হয়?" চারদিকে তাকিয়ে দেখল শোনার মতো কেউই নেই। একটু লজ্জা পেলো সে।

 

মানুষগুলো এদিকে টিভির গোটা পর্দা জুড়ে লাইন দিয়েছে। বিরাট লাইন। এগোচ্ছেও না মোটে। মানুষগুলো ধৈর্য হারিয়ে একে অন্যের ঘাড়ের ওপর উঠে এগোতে চাইছে কিন্তু কেউ জায়গা ছাড়তে রাজি নয়। লাইন আরও লম্বা হচ্ছে মিনিটে মিনিটে। যে দেশ থেকে তারা বেরিয়ে আসছে তার ধারণ ক্ষমতা আন্দাজ করে মুচকুন্দ মুগ্ধ ও উত্তপ্ত হয়ে উঠল। অথচ যে দেশে তারা যাচ্ছে সেখানে কারও হাতে আঁচিল নেই। দেরী হচ্ছে, সময় লাগছে খুব।

 

মুচকুন্দ আরও উত্তপ্ত হয়ে টিভি থেকে চোখ সরালো আর অন্যান্য দিনের মতোই মুগ্ধ হয়ে গেলো। ঝাঁঝালো সুগন্ধী অদূরের কড়াই থেকে উড়ে এসে তার রোমকূপে বসছে ধীরে ধীরে।

 

"কী গো, হলো তোমার? আর কতক্ষণ?"

"এই তো, হয়ে এসেছে"

টিভির পর্দায় গোলমালটা এইটুকুর মধ্যেই আরও বেড়ে গিয়েছে। লাইনে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ দু'হাত তুলে চেঁচাচ্ছে। ওসব দেশেও কীর্তনের চল আছে না কি! তবে যেভাবে মুখ বিকৃত করে চেঁচাচ্ছে তাতে মনে হয় গালাগালিই দিচ্ছে কাউকে। বৃদ্ধের চোখ সামনের দিকে আর দুটো হাত আকাশের দিকে। মুচকুন্দ বুঝতে পারল না বৃদ্ধ ঠিক কাকে গালাগালি দিচ্ছেন। যে দেরী করাচ্ছে তাকে না কি ভগবানকে! দু'জনকে একসঙ্গেও দিতে পারেন। চেঁচাতে চেঁচাতে বৃদ্ধের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। গলার শির অসম্ভব ফুলে গিয়ে শুয়োরের গোঙানির মতো শোনাচ্ছে। বোধহয় অনেকক্ষণ জল খাননি। একজনও তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করছে না।


"কী গো, কী হলটা কী?"

"এই তো, দিচ্ছি এবার!"

 

হঠাৎ দারুণ শব্দে টিভির পর্দাটা যেন থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। একসঙ্গে একহাজারটা মেশিনগান অবাধ্য ফলতঃ অনাথ শিশুর মতো তারস্বরে কান্নাকাটি আরম্ভ করলো। পর্দার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ধবধবে সাদা, পরক্ষণে ধূসর, পরক্ষণে কালো। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না আর। শুধু ঘন ঘন ছ্যাঁড়াৎ ছ্যাঁড়াৎ করে কীসের একটা শব্দ আছড়ে পড়ছে। এই বুঝি ছিটকে পর্দার এপারে চলে আসে। ভলিউমটা এত বাড়াল কে? রিমোটটা কোথায়? হাতের কাছেই তো ছিলো! আঃ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? রিমোটটা কোন চুলোয়?


"বলি মরে টরে গেলে নাকি? এতক্ষণ লাগে একটা সামান্য কাজ করতে?"

"এই তো, এসে গে..." 

পরের টুকু মুচকুন্দ শুনতে পেলো না। এত শব্দ এত শব্দ!


পৃথিবী যেন আড়মোড়া ভাঙবার আর সময় পেলো না! হাতড়ে হাতড়ে মুচকুন্দ একটা টুকরোর নাগাল পেয়েই শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিতে মুখে ফেলল আর সঙ্গে সঙ্গে ত্রিলোক-বিদারী এক চিৎকার নিজেকে দেখে নিজেই আতঙ্কিত হয়ে মেঝেয় আছড়ে পড়ে খানখান হয়ে গেলো।

 

না ঝাল না নুন না মিষ্টি কেউ কাউকে ঘুণাক্ষরেও চিনতে পারে নি। থালার ময়দান জুড়ে একের পর একের পর এক নিখুঁত উপপাদ্য-সম্পাদ্যেরা হাসিমুখে তাকিয়ে রয়েছে অথচ কেউ কাউকে চিনতে পারছে না। সবাই একে অন্যের থেকে মুখ ফিরিয়ে কোনদিকে যে তাকিয়ে আছে বোঝাই যাচ্ছে না।

 

মুচকুন্দ হাঁ-করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। রোমকূপগুলো একটা একটা করে শুয়ে পড়ছে যার যার প্রিয় ভঙ্গিমায়। হাতদুটো কেমন জলের মতো হালকা এবং বিপজ্জনক লাগছে। অতিকায় একটা হিমবাহ গলে তার প্রত্যেকটা শিরার মধ্যে চলাচল বইয়ে দিচ্ছে যেন কতকালের চেনা।

 

মুচকুন্দ হাঁ বন্ধ করল। তারপর হাসি হাসি মুখে পা ছড়াল ময়দানে। লাইনটা এগোচ্ছে এবার।

আঃ বড় আরাম...বড় আরাম...