মাংস ভাত
প্রণয় গোস্বামী
টেঁপির মায়ের অভাব অনটনের সংসারটায় আজ বেশ সুসার এসেছে।
তিনবছর আগে স্বামী যোগেন দিল্লিতে রাজমিস্ত্রি কাজ করতে গিয়ে তিনতলা থেকে পড়ে
যখন মারা গেল। মাথায় যেন বজ্রপাত হয়েছিল সেদিন! চার চারটে ছোট ছোট ছেলে মেয়ে
নিয়ে কি যে অসুবিধায় দিন কাটছিল তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। সেসময় দিল্লির ঠিকাদারের
দেওয়া দুই লাখ টাকা ব্যাঙ্কে রেখে সুদ বাবদ মাসে এগারো'শো টাকা আর পাড়ার সমীর দাদাবাবু বিডিওকে বলে কয়ে বিধবা
ভাতা একটা করে দিয়েছিলেন সেখান থেকে মাসে এক হাজার টাকা। এই দুই হাজার একশো টাকায়
চারটে ছেলেমেয়ের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে পারে সে। নিজে যে কারও বাড়িতে ঘরমোছা
বাসনমাজর কাজ করবে তারও উপায় নেই, সেসময় ছোট
মেয়েটার সবে দুইমাস বয়স। অতটুকু বাচ্চা কার কাছে রেখে কাজে যাবে! তাই অগত্যায়
খেয়ে না খেয়ে বাচ্চাগুলো মানুষ করতেই হবে। এই দুর্মূল্যের বাজারে ভালোমন্দ তেমন
কিছু জোটে না কপালে। ছেলে মেয়েগুলো পাশের বাড়িতে মাছ মাংস রান্না হলে মা'কে জ্বালিয়ে মারে এক্কেবারে। তখন টেঁপির মায়ের চোখের জল
ফেলা ছাড়া উপায় কিছু নেই। তাদের কে বোঝাবে, এসব ভালোমন্দ খাওয়া তাদের জন্য নয়! এখন অবশ্য টেঁপি'টা একটু বড়ো হয়েছে, যখন বাপ'টা মরে তখন তো সাত বছর, এই বছরে সে
দশে পড়ল। এখন একটু বুঝতে শিখেছে, কিন্তু ছোট দুটো? তারা তো কিছুই
বুঝতে চায় না। এই তো গত বছর দুগ্গাপুজোয়, ছোট ছেলেটা
নতুন জামা নেবে তো নেবেই, কিন্তু দুই'হাজার
টাকায় কি আর সংসার চলে বলুন দেখি? তবুও পাড়ার ফেরিওয়ালার থেকে ছয়শো টাকা দিয়ে তিনজনের জন্য তিনটে জামা কিনে
দিয়েছিল টেঁপির মা। তার পরনের শাড়ীটারও তো শতচ্ছিন্ন দশা, তাকে অবশ্য পাশের বাড়ির সমীর দাদাবাবুর বৌ একটা নতুন শাড়ি
দিয়েছিল। যাই হোক, কোনও মতে দিন যে
কাটছে না তা নয়, তবে ওই যে, প্রাণে বাঁচার জন্য যেটুকু মোটা ভাত কাপড় দরকার সেটুকুই।
টেঁপির মা বাচ্চাদের নিয়ে পাড়ায় দুগ্গামেলায় যেতেই ভয় করে, ছোটছেলেটা যা দস্যি হয়েছে কি বলবো, যা দেখবে সেটাই কেনা চাই তার। তারই বা কি দোষ বলুন! সে তো আর
জানে না যে ছোটবেলায় বাবা মারা গেলে ওসব পাওয়া যায় না। তা যাক গে, আজ কিন্তু টেঁপির মায়ের বাড়িটা খাসীর মাংসের গন্ধে
এক্কেবারে ম ম করছে। ছেলে মেয়ে গুলোর তো আর তর সইছে না যেন! বারবার করে শুধু মাকে
জিজ্ঞেস করেই চলেছে, ও মা রান্না হলো? টেঁপির মা কপট ধমক দিয়ে বলে, একটুখানি দাঁড়া বাপু, উনুন তেকে কড়াটা
নামাতি দেবিনে? খাবি তো! তোদের কে দিয়ে তবেই তো
আমার শান্তি। হঠাৎ গলাটা ধরে আসে তার,ধরা গলায়
স্বগোতোক্তির মতন করে বলে,আজ তিনবছর পর ছা
গুলোর মুকে মাংস তুলি দেচ্ছি! সবার বাড়িতে পরব পার্বনে ভালোমন্দ রান্না হয়! ও
ঠাকুর আমারে তুমি এত শাস্তি কেন দিচ্ছ বলো দেকিনি! সবার মুকে অন্ন জোগাও,আর শুদু আমার ছা গুলোই কি তোমার এত্ত ভারি হয়ে গেচিল গো? যে ওদের বাপটাকে তুলি নিলে? ওদের বাপ বেঁচি তাকলে নিচ্চয় ওদের অমন হাভাতের মতন দিন কাটাতে হতোনি! যা হোক
কাজকম্ম করে, নিজে না খেয়ে ছা গুলোর মুকে দুটি
ভালোমন্দ দেচ্চিলো লোকটা। তারেই তুলি নিলে গো? এই তোমার
বিচার!
পঞ্চায়েত নির্বাচন সামনেই,পাড়ার হোদল থেকে শুরু করে কালু মন্টু সান্টু হাবলু, কাবলু পর্যন্ত সকলেই এখন ভীষণ ব্যস্ত। আরে এরাই তো এখন নেতা!
এরা সবাই বছরভর একসঙ্গে কাজকর্ম করলেও এখন কিন্তু বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে একে
অপরের প্রতিপক্ষ।পাঁচবছর তেমন কেউ এদের পোছে না, বাজারে যেমন হঠাৎ করে আদার দাম বাড়ে, ঠিক তেমন এদের দামটাও হঠাৎ বেড়ে যায়। যখন দাম বাড়ে তখন কদরও বাড়ে, দাম কমলে আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবে। কিন্তু ভোটের সময়
এলেই হোদল কাবুল হাবুলদের দায়িত্বের অভাব নেই। প্রায় প্রতিদিনই কারও না কারও
বাড়ির উঠোনে দলীয় সভা বসে।মাঝে মাঝে কোলকাতা থেকে বড়ো নেতারা সভা করতে এলে সেই
সভায় লোক নিয়ে যাওয়ার সব দায়িত্ব এদের কাঁধেই। এখন বিভিন্ন জন বিভিন্ন দলের
নেতা। সকলের কাঁধেই দায়িত্বের পাহাড়। কিভাবে ভোট যোগাড় করতে হবে, কিভাবে পতাকা লাগাতে হবে, কার পাড়ায় বাতি লাগবে, কার ঘরেতে রান্নার
চাল নেই! শুধু বলতে দেরি, সঙ্গে সঙ্গে টাকা
বের করে দিচ্ছেন নির্বাচনে দাঁড়ানো বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা। তাদের থেকে সাহায্য
সামগ্রী নিয়ে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে দেরি করছে না হোদল মন্টু কালু সান্টুর হাবলু
কাবলুর দল। টেঁপির মায়ের বাড়িতে খাসীর মাংস তো হোদলই দিয়ে এসেছে আজ সকালে।
টেঁপির মা অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিল, কে দিল? কেন দিল? কিন্তু হোদলের সাফ
কথা,
আরে দিয়েচে যখন খেয়ে নাও। বছরভর তো আর খাসীর মাংস কিনে
খেতি পারবে নি! এসময় বাবুরা দেচ্চেন, খেয়ে নাও। শুধু ভোটটা ঠিক জায়গা মতো দিতি হবে। টেঁপির মা আপত্তি করতে
যাচ্ছিলই, এমন সময় কোথা থেকে টেঁপি এসে হোদলের হাত থেকে মাংসের
প্যাকেটটা ছোঁ মেরে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল, কি আর করা, টেঁপির মাও আর কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেল।
এদিকে সুখ একেবারে উথলে উঠেছে চা দোকানদার মঙলুর। তার
চায়ের দোকান একেবারে উপচে পড়ছে খদ্দেরে। সকাল থেকে শুরু করে একেবারে রাত্তির
বারোটা, হাত বন্ধ নেই তার।মন্টু সান্টুরা আগে সকাল সন্ধ্যে এককাপ
করে চা খেয়ে কাজে চলে যেত, আর এখন? আর বলবেন না, সারা দিনে
তো মোটামুটি দশ কাপ হচ্ছেই! অন্যসময় অধিকাংশ খদ্দেরই ধারে চা খায়, অনেক সময় মঙলুর সঙ্গে তো বকেয়া টাকা আদায় নিয়ে কত
বাকবিতণ্ডা হয় তার ঠিক নেই। আর এখন? ধার বলতে নেই, নগদ কড়কড়ে
টাকা। টাকা তো সব নির্বাচনে দাঁড়ানো প্রার্থীরাই দিচ্ছেন। তাদের এখন একটাই কাজ, সকালবেলায় চায়ের দোকানে এসে কে কে চা খেয়েছে, কে কে খায়নি,সেটা
জিজ্ঞেস করা। আর দোকানি মঙলুকে বলা যে, চা দে
সবাইকে, মঙলু যদি জিজ্ঞেস করে সঙ্গে বিস্কুট দেবো কি? সঙ্গে সঙ্গে ধমকের সুরে তাকে বলা যে, এটা আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে? দে সবাইকে চা বিস্কুট। যে যে পান খাবে তাকে পানও
দে। প্রার্থীরা সকলেই এখন গৌরি সেন। মঙলুর ঘরে যেন লক্ষী এসে পড়েছে গো! মন্টু, সান্টু, হোদল ভোদল, কালু ভোদাই, সকলেই চা
বিস্কুট খেয়ে তারপর একটা করে একশো জর্দা দিয়ে পান খেয়ে ঠোঁট দুটো লাল করে বসে
রয়েছে দোকানে। সেখানে আলোচনার শেষ নেই, রাজ্য সরকার
থেকে শুরু করে কেন্দ্র সরকার পর্যন্ত সকলের বাপ ঠাকুর্দার মুণ্ডুপাত চলছে সমানে।
এইতো আজই সক্কালবেলা মঙলুর দোকানে বসে হোদল বলে, পচা দা এবারও সিওর জিতছে।তাকে কেউ হারাতে পারবে নে। পাশেই বসে ছিল কাবলু, সে আবার নীল রঙের প্রার্থী, সে হরি বাবুর টাকায় চা বিস্কুট খেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলে উঠল, কি বললি? পচা জিতছে? পচা যদি জেতে, তাহলে আমি একলক্ষ টাকা বাজি রাখলেম। কাবলু দিনমজুরী করে, সে কোথা থেকে একলক্ষ টাকা পাবে! সে দিকে তার হুঁস নেই, কিন্তু বলেই বসলো। দুজনের ভীষণ বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে গেল, বাকবিতণ্ডা থেকে হাতাহাতি। একেবারে যুদ্ধের পরিবেশ। মঙলুর
দোকানের চায়ের কাঁচের গ্লাস ভেঙে চুরমার। অনেক কষ্টে দুজনকে আলাদা করা হলো। সবুজ
প্রার্থী পচা, আর নীল প্রার্থী হরি মিলে
ক্ষয়ক্ষতির সাময়িক হিসেব নিকেষ কষে ক্ষতিপূরণের টাকা মিটিয়ে দিল মঙলুর। আপাতত
এলাকা শান্ত, তবে আবার কখন যে মঙলুর চায়ের গ্লাস
ভাঙবে তার ঠিক নেই। সে যখন ভাঙে ভাঙুক গে, টাকা তো
প্রার্থীরা দিচ্ছেনই, ক্ষতি কি!
টেঁপির মায়ের শোবার ঘরটি বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরি করা তার
উপরে কাদামাটি দিয়ে লেপাই করে কোনমতে বসবাস করছে। তাদের পাড়ার প্রায় সকলেরই
পাকা ঘর। প্লাস্টার করা দেয়াল, তাতে খুব সুন্দর
করে রঙ করা। প্রায় সকলেই নিজ নিজ বাড়ির দেয়ালে লিখে রেখেছেন, বিজ্ঞাপন লাগাবেন না। অতএব দলীয় প্রার্থীদের দেয়াল লিখন
লেখার একমাত্র জায়গা হলো, টেঁপির মায়ের
দেয়ালটা। সেই কাঁদামাটি লেপা দেয়াটারও জরাজীর্ণ দশা। তাতেই জ্বলজ্বল করছে তিনটি
দলের তিনটে দেয়াল লিখন।সকলেই উন্নততর পঞ্চায়েত গড়তে নিজ নিজ দলের প্রার্থীকে ভোট দেবার
আবেদন করেছেন। সমীর বিকেলে কর্মস্থল থেকে ফিরে টেঁপির মায়ের দেয়ালের লেখাগুলো
পড়ছে আর ভাবছে, এই দেয়ালেই গতবারের পঞ্চায়েত
নির্বাচনে উন্নয়নের কথা লেখা ছিল। আবারও এই দেয়ালেই উন্নয়নের আবেদন! গত পাঁচ
বছরে উন্নয়ন যে একেবারে হয় নি তা কিন্তু নয়। পঞ্চায়েতের গত বছরের জয়ী
প্রার্থী পচার উন্নয়ণ অবশ্যই হয়েছে। তার ঝাঁ চকচকে বাড়ি হয়েছে, গাড়ি হয়েছে, তাইতো তার
বাড়ির দেয়ালে আর উন্নয়নের দেয়াল লিখন লেখা যায় না। সেখানে লেখা রয়েছে, "বিজ্ঞাপন লাগাবেন না।" টেঁপির মায়ের দেয়ালটাই
উন্নয়নের একমাত্র প্রতীক। তবে যাই হোক, তাই হোক
টেঁপির মায়ের ছাঁ'গুলো কিন্তু আজ তিনবছর পর খাসীর মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে খুব হাসছিল। বিকেলে রাস্তায় সমীরকে
দেখতে পেয়ে ছোট মেয়েটা আধো আধো গলায় বলে, ও জেটু আজকে
আমার মা কি নান্না করেচে বলো তো? সমীর কৌতুহলী হয়ে
জানতে চায়, কি রেঁধেছে? ছোট্ট মেয়েটি আধো আধো গলায় বলে......., মাংক ভাত।
দুইদিন ধরে আকাশটা কেমন যেন মেঘে ঢেকে রয়েছে, আজ পূর্ণিমা। চাঁদের আলো'কে পৃথিবীতে আসতে দিতেই চায়না মেঘের দল, আচমকাই হয়তো একটু ফাঁক পেয়ে আকাশটা কেমন রূপোলি আলোয় ঝলমলিয়ে উঠলো যেন! ঝলমলে চাঁদের আলোয় পরিস্কার পড়া যাচ্ছে টেঁপির মায়ের মাটি লেপা বেড়ার দেয়ালে উন্নয়নের লেখাগুলো, "উন্নততর পঞ্চায়েত গড়তে এই চিহ্নে ভোট দিন।"
No comments:
Post a Comment