লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com
Showing posts with label মুক্গতদ্য. Show all posts
Showing posts with label মুক্গতদ্য. Show all posts

Sunday, September 25, 2022

জনক রায়, শারদ সংখ্যা

জনক রায়-এর মুক্তগদ্য

সহজ পাঠের মেয়ে


 

খুকি,

সেই ছোট্ট বেলায় তোমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ। মনে আছে? কী করে মনে থাকবে বলো! আজ প্রায় উনিশ বছর পর আমি তোমাকে কিছু একটা লিখছি, চিঠির আকারে। এতটা সময় ধরে তোমাকে মনে ছিল না! মনে ছিল না বল্লে ভুল হবে, মনে রাখার অবকাশ ছিল না। তোমাকে মনে রাখার সমস্ত অবকাশ চুরি করে নিয়ে গিয়েছে আজকের এই শশব্যস্ত সময়! যার পিঠে চড়ে আমি প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছি কোনও না কোনও লক্ষ্যের দিকে। যে-লক্ষ্যগুলোর কোনও উদ্দেশ্য নেই। শহুরে কামুকতায় যারা আলস্যের চাদর গায়ে জড়িয়ে আছে। এই ইট, কাঠ, সিমেন্ট, পাথরের শহরে থাকতে থাকতে আমার মধ্যেও অবসাদ জড়িয়ে আসছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি— এইভাবে চললে আমি একটা শহুরে আঁতুরের ভেতরে ঢুকে পড়ব। যেখান থেকে বের হয়ে আসা বড্ড বেশি কঠিন! তাই এবার তুমি আমাকে একটু সাহায্য করো, সেই ছেলেবেলায় যেমনটি করেছিলে।

 

মনে আছে তোমার? আমার কিন্তু বেশ মনে আছে। রবিঠাকুর। হ্যাঁ, রবিঠাকুর-ই আমাদের সাক্ষাৎ ঘটিয়েছিলেন। তিনি যদি 'সহজপাঠ' না লিখতেন তাহলে কী আমার, তোমার সঙ্গে দেখা হ'ত? হয়তো হ'ত নাহ্! আর হ্যাঁ, নন্দলালবাবু, ওনাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়! তোমাকে কী সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে এনেছিলেন তিনি। তিনিই পারেন এমনটা করতে। উনি হয়তো তোমার ঈশ্বর, কিন্তু তুমি তো আমার নাকি! আমরা হয়তো শরীরে নেই, অশরীরীতে তো আছি। তাই না? তোমাকে নিয়ে লিখতে গেলে আজও আমার বুকের মধ্যে হাজার মাইলের একটা ট্রেন ছুটে যায়। যার শব্দের আতসবাজি যেন আমার বুকের মধ্যে খেলা করে! কেন এমন হয়, খুকি? বলতে পারো? তুমি তো একটা ছবিই? অথচ এখনও যখন আমি তোমার ওই অশরীরী সাদা-কালো শরীরটার মুখোমুখি হই তখন আমি সদ্য নতুন জল পাওয়া মাছের মতো লাফিয়ে উঠি, আবেগে। আমার বুকের ভেতর সহস্র সামুদ্রিক ঢেউ খেলে যায়। একী শুধু আবেগ, বলো? হয়তো নয়! আমি কী তোমায় একটুও ভালোবাসিনি? তাহলে এমন হয় কেন? আমি জানি, তোমার মধ্যে একটা আক্ষেপমিশ্রিত অভিমান আছে। রবিঠাকুরের দেড়শো বছর আর আমার উনিশ বছরের মধ্যে হয়তো অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। এই সময়ের মধ্যস্থতায় হয়তো অসংখ্য পাণ্ডুলিপি মুদ্রিত হয়েছে বইয়ের আকারে; সেখানে তোমার কথা কেউ লেখেনি। এটাই তোমার অভিমান তো?

 

জানো খুকি, যেদিন প্রথম তোমায় সহজপাঠের দশম অধ্যায়ের পৃষ্ঠায় একটা বেনামী ছড়ার উপরে একটা বটগাছের দোলনায় তোমার সেই মায়াবী ও আভিজাত্যে ভরা মুখটা দেখি সেই মুহূর্তে আমি একশো বছর পিছিয়ে গিয়েছিলাম এখনকার মানুষদের থেকে। তাই তো আজও আমি এদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারি না! সেই তুমি একটা দোলনায় তোমার ঝাঁকড়া এলো চুলে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছো, শরীর জড়ানো শাড়িটা কিছুটা অনাবৃত, হাওয়ায় উড়ছে শাড়ির আঁচল, একপা নিম্নে ঝোলানো, দু'দিগন্তে প্রসারিত তোমার সৌন্দর্যের আভা। এই দৃশ্য দেখে কতকাল আমি আমার নিঝুম দুপুর কাটিয়ে দিয়েছি তার বলার নয়! সেই নিঝুম দুপুরে তুমিই ছিলে আমার যৌনসুখের সঙ্গী। ফ্রয়েডীয় তত্ত্বে আমি ততদিনে পৌঁছে গিয়েছি বয়ঃসন্ধিকালে! তোমার সেই সাদাকালোতে আঁকা মুখটি দেখেই আমার কত সন্ধ্যে  ঘুমিয়ে পড়েছিল, তুমি তা জানো না। জানার কথাও নয়, এ-সব তো তোমাকে বলাই হয়নি!

 

আজকের দিনেও হয়তো এতকিছু বলার ছিল না। কিন্তু কী করব আমি! হাঁপিয়ে উঠেছিলাম আমি জীবন থেকে, যাপন থেকে। এবার তুমি আমাকে একটু তোমার টাটকা বাতাসে আমাকে স্নিগ্ধতা দাও। তোমার শাড়ির আঁচলের ও-প্রান্তে যে নীল আকাশে ঢাকা প্রসারিত রাখালের মাঠ পড়ে আছে সেখানে আমরা বন্য জন্তুর মতো উদ্দাম গতিতে ছুটে বেড়াবো। নেবে তো আমায় তোমার দলে? পাখির গানে ঠোঁট মেলাবো আমরা। যদি ক্লান্ত হয়ে পড়ি তবে তুমি আমাকে তোমার শাড়ির আঁচলের নিচে ঘুম পাড়িয়ে দিও। যে-ঘুম আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারে আমার সেই সুললিত বাল্যকাল। যেখানে কোনও হিংসার গ্লানি নেই, রক্তের দাগ নেই, কাঁচের ভাঙন নেই, রোদের পোড়া গন্ধ নেই! আছে সবুজের আলিঙ্গন, মায়ের মুখের ডাক, তোমার সঙ্গ আর পৃথিবীর ঘূর্ণন।

 

আরও কত কথা যে আমার জিভের ওপর জড়সড় হয়ে আছে তা তোমাকে লিখে শেষ করতে পারব না। আর একদিন না-হয় লিখব তোমাকে। লেখার ছলে কিছু কথাই তোমাকে দিলাম, দিলাম আমার ঠোঁটের ভাঁজ তোমার ঠোঁটে। আদর নিও, লক্ষ্মীটি...

 

ইতি তোমার সহজপাঠক

উল্লাস 

'সহজপাঠের মেয়ে, তোমাকেই লিখছি'

 

( রবিঠাকুরের 'সহজপাঠ' শিশুপাঠ্য গ্রন্থের দশম অধ্যায়ে যে মেয়েটির ছবি আছে, তাকে এই চিঠি লেখা। এটা মূলত লেখা নয়, ফ্যান্টাসি! )

Thursday, February 17, 2022

পল্লব গোস্বামী

পল্লব গোস্বামী-র মুক্তগদ্য

লালপাহাড়

       

লালপাহাড় বলে কোনো পাহাড় নেই পৃথিবীতে। তবু লাল আছেমুমূর্ষু এক পাহাড়ও আছে। আর আছে কাজললতা নামের এক পাহাড়ের মেয়ে।

গায়ে তার ধানী রঙের শাড়ি। পাকড়া পাপিয়াদের সাথে সারাদিন ওড়াউড়ি। উড়েউড়ে ঘুরে বেড়ানো কালো কালো সব মেয়ে-পুরুষ;  গাই-ছাগল-মোষেদের সাথে। হাওয়ার ঝোঁকে আমি কাছে যেতেই,

সে বলে ওঠে, "বোলোপে"।

 

আমি তাকে বন্ধু হতে বলি। কন্টিকারির পাতা স্মারক এনে, সে বন্ধু পাতায়। পাতায় পাতায় রটে যাই আমরা। এক ছুটে তাকে নিয়ে যাই আমাদেরও গ্রাম। তালাই পেতে বসাই কাজল মাখানো ঘরে। ঘর থেকে অদূরেই বহাল। সেখানে আমরা একসাথে চাষ করি। ঘুগিতে মাছ ধরি। পেটে ঘাটো খাই। খেতে খেলতেই ছলকে যায় বিকেল।

তারপর আবার সেই তড়ার পথ বেয়ে পাহাড়।

 

ফেরার পথে চোখ রাঙিয়ে ওঠে হাজার সিঁদুরে মেঘের চোখ। মুথাঘাসের মাঠ পেরোতেই, ভয়ে কাঁপন ধরে যায় কাজললতার।

সে বলে, ' বোলোপে '...

রক্তে আমার আদিম জাগরণ। 

 

জাগ্রত চোখে চেয়ে উঠে দেখি,

সারা আকাশের লাল নিয়ে,

যেন এক অন্ধ কবি লিখে চলেছেন

এক অনন্তহিম বর্ণের কবিতা...

প্রদীপ ঘোষ

প্রদীপ ঘোষে’র মুক্তগদ্য

ডায়েরির একটা পাতা

 

একটি বন্ধ দরজা অপার রহস্যের সমাহার। শুধু একটাই বলবো, বেশি তো বলতে আসিনি! হতেই পারে অন্য কেউ তখন চন্দ্রবদন; সঙ্গতে তুমি সুহাসিনী!

 

সে যাহোক কিন্তু একটি তালা বন্ধ দরজা মানে অনেক কিছু। কিন্তু কোনো রহস্য নেই, খানিকটা ওই ওপেন সিক্রেট। যেমন তস্করে-র বিপরীত চিন্তা গৃহস্থের! হতে পারে। আবার অনুপস্থিতির কারণে হয়তো পরিচিত কাউকে-ই সাময়িক প্রবেশের অননুমতি! হতে পারে। বিশেষ কাউকে বুঝিয়ে দেয়া, চিরতরে এ গৃহাশ্রমে তুমি ব্রাত্যজন! তাও তো হতে পারে! নয় কি?

 

নিজেদের শিকারে-র ওপর, বাঘ বা সিংহ থাবা বসাতে এলে যেভাবে নেকড়েরা ছিটকে সরে যায় খনিকের তরে!

কুপির আলো কেঁপে উঠলে; মুলিবাঁশের বেড়ার এ জলসাঘরে আঁধারে আলো জেগে ওঠে তেমনই। কিন্তু আমি! গৃহস্বামী জানি, আলো থির হলে অন্ধকার আবার জাঁকিয়ে বসবে। আসলে আলোর পরিখা সদা-ই অন্ধকারের বৃত্তে আবদ্ধ। নেকড়ের দল সংখ্যায় বেশি হওয়াতে, এক-ই ভাবে। বাঘ বা সিংহকেও পিছু হটতে-ই হবে।

 

শক্তি বা ক্ষমতা বেশি বলে না বুঝেই ওদের মতো এভাবে কেড়ে নিতে গিয়ে বোকাবনে পিছুহটা কিংবা যাত্রাদলের অধিকারী হওয়া আমার বিবমিষার। তাহলে মাইকেলের মতো "আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়"! নাকি নবীনচন্দ্র সেনের মতো "ধন্য আশা কুহকিনী" বলব?

 

বুকে রক্ত নদীর ঝিলাম বয়ে চলে অনুক্ষণ। এই যে অন্ধকারের একবগ্গা অভিযান মেসিডোনিয়ানের মতো! এতো, এতোবার! সহ্য করেছি কী করে, ভেবেছো কখনো? অভিমান আমারও তো হয়! নিজের সঙ্গে-ই পরাজয়ের গ্লানিতে অপরিসীম লজ্জায় টেক্টোনিক প্লেট নড়ে গিয়ে যে কোনোদিন ভিসুভিয়াস জেগে উঠে আমাকেই ছাই করে দিতে পারে।

 

ঠিক তখন-ই এ পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে জ্বলন্ত ধূমকেতু দেখে মানতের অমিত প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতায় চায়ের কাপে তুমি চিনি দ্রব। অভিমান মানুষকে নিরেট করে তোলে এমন-ই যেন চিত্তবৈকল্য তরল নাইট্রজেনে ডুবে থাকা সিমেন। এ দেহে মন বলে কিছু থাকে নাকি আর? থাকলেও তার সাকিন আমার জানা নেই। তোমাকে-ই বা জানতে পারলেম কই নন্দিনী! হ্যাঁ বলতে পারো; শেষবেলায় কেন? আগে কেন বলিনি ?

 

পৌরবের রাজার মতো বিক্রমের-অনুগ্রহ চাইনি তোমার কাছে কখনও; লেডি মেসিডোনিয়ান। চাইনি রাজা পুরু-র মতো, না বিক্রম আর না-ই অনুগ্রহের সামন্ত রাজার সম্মান; কোনোটা-ই আকাঙ্ক্ষার ছিল না কোনোদিন।

 

তাবাদে অবহেলার ক্ষত যে তখনো সারেনি........

 

প্রশস্তির হাত রাখো কাঁধে, মধু তিষ্ঠতি জিহ্বাগ্রে

কুন্তলে রাখো শরমাছতো বোঝেনি তুমিই ধীবর।

Tuesday, October 5, 2021

শ্রীময়ী মুখোপাধ্যায়, শারদীয়া সংখ্যা

শ্রীময়ী মুখোপাধ্যায়ের মুক্তগদ্য


অপ্রাসঙ্গিক

কখনও কখনও কিছু এলোমেলো সময় আসে, যখন মনের অগোছালো ভাবটা অকারণ খোঁচাখুঁচি করতে আরম্ভ করে। যদিও আমার ‍মন কোনোদিনই গোছানো ছিল না, কারোরই থাকে না। কিন্তু এই সময়গুলোতে কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ধারপাশ দিয়েও যায় না মনটা। তখন কোনো কিছুরই কার্যকারণ, পরিপ্রেক্ষিত, প্রতিবেশ বুঝতে ইচ্ছে হয় না। কোনো থিসিস অথবা হায়ারার্কিই আর অর্থযুক্ত বলে মনে হয় না। 'আমি' চারপাশের সবটা ঝাপসা লাগে, নগণ্য মনে হয়। ঠিক সেই মুহূর্তগুলোতে 'সবার উপরে মানুষ সত্য' প্রবাদটা অস্থিমজ্জায় উপলব্ধি সম্ভব হয়ে ওঠে। সেই সময়ে কোনো অ্যারিস্টটল, মার্ক্স, হোমার, মহাভারত কিংবা impressionism, Dadaism, বিশ্বযুদ্ধ, ভ্যান গগ— কিছুই আর হৃদয়ে সামান্যতম টোকাও দেয় না।

 

তখন কেবলমাত্র একটা রূপকথার দরকার হয়।

বিশ্বে যা কিছুর অর্থ আছে,সেই সবটুকুকে অস্বীকার করতে ইচ্ছে হয় তখন অর্থহীন, তাৎপর্যহীন হতেই ভাল্লাগে। সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা মিথ্যে প্রতিপন্ন করতে ব্যগ্র হয়ে উঠি। বাস্তবতার চেয়ে অনেক আলোকবর্ষ দূরে একটা মিরর ওয়ার্ল্ড থেকেই যায়। এই মিরর ওয়ার্ল্ডের উপস্থিতিটা সব মানুষের জীবনেই ভীষণভাবে কাম্য। এতে নিজেকে বরাবর বাস্তববাদী ভেবে আসা ধারণায় একটু আধটু ধূলো পড়ে বটে, সে পড়ুকগে!

 

অসংখ্য মৃত্যু দেখেও নার্ভ না হারানোয় নিজেকে হার্টলেস বলে সন্দেহ হবার পরমুহূর্তেই হঠাৎ ডিজনি ব্রেভ হতে ইচ্ছা হয়...ভাগ্যের পিছনে দৌড়ানোটাই কি একমাত্র রিলেটেবলধুত!

 

কথায় বলে, 'যা সবার তা কারোর নয়'

আচ্ছা, তাহলে কি সেই ফর্মুলা মেনেই বলা যেতে পারে, 'যেখানে সবাই পলায়নপর সেখানে কাউকেই এস্কেপিস্ট বলা যায় না'? যা সবার তাই তো সাধারণ আর সাধারণের সংজ্ঞা হয় না।

কেবলমাত্র জ্বরের ঘোরে নয়, তথাকথিত সুস্থতার তাপমাত্রাতেও কখনও কখনও প্রলাপ বকতে ভালো লাগে। সেইসব তালকাটা প্রলাপের জেরে মন, মাথা এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে, সেখানে আর কোনো যুক্তি খাটে না। তখন বিশ্বের অন্যতম সেরা লেখকের বহুল চর্চিত, তুমুল জনপ্রিয়বিতর্কিত উপন্যাসের থেকেও 'তেলেনাপোতা আবিস্কার' অনেকবেশী তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়।

সে যাই হোক, তেলেনাপোতা আবিস্কারের স্পর্ধা নাই হতে পারে, তবে মিরর ওয়ার্ল্ডের ডিজনি ক্যারেক্টারের সাথে বলডান্স করতে কোনো বাধা থাকে না।

লম্বা চুল, কাঁচের জুতো অথবা তীর-ধনুকের অভাবটা আর যাই হোক অন্তত মিরর ওয়ার্ল্ডে complex খাওয়াতে পারে না এতটুকুও।

এটুকুই তো অবাস্তবতার সান্ত্বনা হয়ে টিকে রয়।

 

অবচেতন

খাদের ধারে দাঁড়ানোর অভ্যেসটা একেবারে চলে যায়নি বলেই হয়তো কোনো এক হেমন্তের পিছু ধাওয়া করতে করতে পাহাড়ে ছুটে যাওয়া যায়।

          একটা খুবই অচেনা রাস্তা ধরে ডাঁয়ে বেঁকে  গিয়ে চেনা পাহাড়টাকে পেলেও, ঝোরাটার অস্তিত্ব টের না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাসটা পাতার সরসরানিতে নিজের কান অবধিই পৌঁছোয় না ।

পাথরের গায়ে জলের দাগ জলে ধুয়ে যায় না !

 

নীচের শ্যাওলা ধরা গভীর কালো গহ্বরটার দিকে তাকালে কেমন যেন সম্মোহিত লাগে।

পশ্চিমের যে রাস্তাটা কোনো নামভুলে যাওয়া গ্রামে গিয়ে মেশে, তার ধারে ধারে ফুল ফুটে থাকে।  ছোট্ট ছোট্ট বুনো ফুলনীল রঙের।

মুঠোয় করে তুলে নেওয়ার নিষেধ না থাকলেও মুঠো ভরানোর চেষ্টা বৃথা।

দূরের ঐ কখনও যেতে না পারা গ্রামটায় তিনটে ছেলেমেয়ে হয়তো আসে কখনও কখনও ফুল তুলতে, দেখা হয় না ওদের সাথে।

মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে খাদের দিকে তাকানোর ভয়টা খাদের একদম ধারে গিয়ে দাঁড়ালে আস্তে আস্তে কেটে যায়। অবাক লাগে!

    আগেরবারের বয়ে আনা চারটে নুড়ি ছিল, শহুরে মাঝরাতে কানের কাছে ধরলে ঝরনার জলের শব্দ খেলা করেবাকি রাতটা ঘুম হয় না আর।

আকাশের কপালে পড়ে থাকা কুঁচো চুল গুলো যখন আবছা করে ফেলে সবটা,

গরম ভাপ ওঠার মতই ধোঁয়া হয়ে যায় চশমার কাঁচগুলো, সামনের রাস্তাটা চোখে পড়ে না আর।

যেটা অবধারিত রূপকথা হতে পারত, সেটা ভ্রমণকাহিনীতে পরিণত করার এ ব্যর্থতাহয়ত চা বাগানের সবুজেই লুকিয়ে ফেলতে হয়...

 

ঘুম...

রাত্তিরে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেলে, দিন রাতের তফাৎটা ঠাহর হয় না। যে কোনোদিন রাতে ঘুম ভাঙলে পায়ে হাওয়াই চটি গলিয়ে ছাদে উঠলে তারা গুলো দেখা যায়।

রাতের অন্ধকারটা সেই ত্যারাব্যাঁকা ঝিকিমিকি গুলোর জন্য আরেকটু স্পষ্ট হয়ে ওঠে বটে, তবু ঘোরটা ঠিক কাটতে চায় না। ঘুমটা আসে না, আবার জাগা চোখদুটোও আচমকা বুজে আসতে চায়...হাওয়ায় চুলগুলো ওড়ে অথচ এলোমেলো খোঁপাটা খুলে যায় না কিছুতেই।

ছাদের দরজাটা ক্যাঁচকোঁচ করলেও ভুতের গল্প তৈরীই হয় না, লেখা তো হয়ই না । শুধু পা টিপে টিপে গিয়ে আলতো ছিটকিনিটা দিয়ে আসতে হয়। নির্ঘুমে থাকা বাবা মাকে জাগাতে ইচ্ছে হয় না।

তারাগুলো কথা বলে না, দিক বোঝালেও ছাদে দাঁড়িয়ে মাঝরাতে আর দিক বুঝতে ভাল্লাগেনা।

শীত করে না, তবুও জ্বর আসে আস্তে আস্তে...ধুম জ্বর...

ঘন্টা কেটে যায়, সূর্য ওঠে, শুধু ভোর হয় না...নীচে নেমে আসতে হয়।

নিঃশব্দে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে আসতে হয় বাড়ি থেকে। গেটের তালাটা খোলাই থাকে সেদিন কোনোভাবে, চাবি লাগে না আর।

রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলে পড়া থেকে রোজ বাড়ি ফেরার চেনা গলিটা হঠাৎ ভোরে কেমন যেন গুলিয়ে যায়, ল্যাম্পপোষ্টের ছায়ার দৈর্ঘ্য মাপতে হয় রাস্তার দূরত্ব জানতে। হাওয়াই চটির স্ট্র্যাপটাও হঠাৎ করেই ছিঁড়ে যায়, ওটার মায়া ওখানেই ত্যাগ করতে হয়। আসলে খোঁড়াতে ইচ্ছে হয় না...এই আর কি!

চায়ের দোকানে উনুন ধরে, আঁচ বাড়ে...চা চাপে...জল ফুটে ফুটে মরে আসে...

পোড়া চা পাতায় বারবার চা হয়, চা টাও রঙ বদলায়...মানুষ তো নয়...তাই চিনি দিয়ে ম্যানেজ হয়ে যায়।

 

হাঁটতে হাঁটতে আবার ফিরতে হয়।

ছেঁড়া হাওয়াইটার একটা পায়েই থাকে…

একপাটি টাই এনে তুলে রাখতে হয় ।

এবার কেমন জানি শীত লাগে,

শুধু....ঐ, ঐযে....ঘুম ভেঙে ওঠা মানুষগুলো....

ওরা তবুও জাগে না...