লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com
Showing posts with label উপন্যাস. Show all posts
Showing posts with label উপন্যাস. Show all posts

Monday, April 11, 2022

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

তার হাতে মেঘ, অন্নজল (তৃতীয় পর্ব)

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়


                                    

অবশেষে আলোর বিন্দু দেখা গেল। বিন্দু থেকে বৃত্ত, বৃত্ত থেকে তা ধীরে ধীরে আগুনের গোলা হয়ে উঠছে যেন। আলোটা এগিয়ে আসছে। আসতে আসতে সিগন্যালের সবুজ আলোটা ঢেকে দিল সেই আলো। প্রায় কুড়ি মিনিট পরে আপ লাইনে ট্রেন ঢুকছে। মুখ বাড়িয়ে দেখল দেবল। সরে এল। সদ্য ধরানো চারমিনারটা ফেলে দিয়ে সিমেন্টের বেদির সামনে, জোরালো টিউবের নিচে এসে দাঁড়াল।

রং ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না দেবলের। খয়েরি, কালো, লাল শাড়ি, কারোর নীল ওড়না, কারোর জংলা প্রিন্টের শার্ট, কেউ সাদা খোলের তাঁত। আধেক মিনিট সজাগ দৃষ্টি দ্রুত এদিক ওদিক ঘোরে।

ট্রেন ছেড়ে দিল। নয় কামরার দানবীয় শুঁয়োপোকার মতো যান ফের ধীরে ধীরে বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল। একটা জটলা শ্রান্ত পায়ে একযোগে সামনের ঢাল বরাবর নেমে যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে লোক কমে আসছে। পাথরের গায়ে ঠুকঠাক আওয়াজ তুলে একরাশ মানুষ রেললাইন পার হয়ে যাচ্ছে। একটা ভিড় মুহূর্তে তৈরি হল, মুহূর্তে আবছা হল, এখন ছত্রখান হয়ে দু’ধারে ভাগাভাগি মফস্বলের কোণায় কোণায় সেঁধিয়ে যাবে। দেবলের পরিচিত আকাশি শাড়িটা ভিড়ের মধ্যে নেই।

হালকা চিন্তার ধোঁয়ায় মাথাটা ভরে গেল দেবলের। পরের ট্রেনে আসছে কি? অপেক্ষা করে যাবে? এত দেরি তো হয় না কখনও! প্রায় ফাঁকা হয়ে আসা দু’নম্বর প্ল্যাটফর্ম ধরে ডাউন লাইনের দিকে এগিয়ে গেল দেবল। সামনে একটি কাঁচা রঙের গন্ধ মাখা সিমেন্টের চৌকোণা থাম। থামের গায়ে হলুদ রঙের টাইম-টেবিল ঝোলানো। পরের আপ লোকাল ষোলো মিনিট পরে। অপেক্ষা করে যাওয়াই যায়। ফিরে এসে নির্দিষ্ট সিমেন্টের বেদিতে বসল দেবল। তিন নম্বর সিগারেটটা ধরাবে কিনা ভাবছে, পাশ থেকে অজয়দা ডাকল।

‘চা দেব নাকি এক কাপ?’

কালচে হয়ে আসা থার্মোকলের বেঁটে দেওয়ালে তিনদিক ঘেরা একটা পাম্পস্টোভ নিয়ে বেদির পাশে টিনের টেবিলে দাঁড়িয়ে থাকে অজয়দা। দেবলকে চেনে। নিত্য অফিসযাত্রীদের সবার মুখ চেনে।

অজয়দা সব খবর রাখে। ক্রিকেটের স্কোর থেকে মহাভারত সিরিয়াল, সব বিষয়ে সমান উৎসাহ তার। মনের মতো লোক পেলে একবার কথা শুরু হলে আর থামতে চায় না। আজ চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট ধরে অপেক্ষারত দেবলকে দেখছে। একের পর এক ট্রেন আসছে। বেদিটা থেকে উঠে বারবার মুখ বাড়িয়ে দেখছে, ফের প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হচ্ছে, সিগারেটের প্যাকেট শেষ হচ্ছে, দেবল ঠায় দাঁড়িয়ে। তা দেখেই একটু বুঝি মায়া হল তার। বলল,

‘কতক্ষণ বসে আছো দেখছি, একটু চা দিই? পরের ট্রেন আসতে আসতে এক কাপ হবে নাকি?’

আজ সন্ধের চা-টা হয়নি। পরের ট্রেনটা দেখেই যাবে যদি, চা নিয়ে বসাই ভাল ভেবে দেবল বলল,

‘দাও একটা ছোটো’।

এর আগে অন্তত আঠেরোবার ফোটানো চায়ের পাতাসমেত কেটলিটা স্টোভে বসিয়ে পাম্প করতে শুরু করল অজয়দা।

হিম পড়ছে। দুদিকের ছোট প্ল্যাটফর্ম প্রায় জনশূন্য। রেললাইনের দিকে দূরে তাকালে সাদাটে ধোঁয়ার মতো মিহি কুয়াশা বোঝা যায়। শীত এখনও জাঁকিয়ে পড়েনি ঠিকই, তবে শীত আসবার আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। এমন নিস্তব্ধতায় আচমকা পাম্প স্টোভের ঘরঘর শব্দটা দেবলের হালকা দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিল। এতক্ষণ গা করেনি যা, সেই অস্বস্তিটা বাড়িয়ে তুলল।

টিনের টেবিলের সামনে সাজানো চার পাঁচটা বয়াম। তার মধ্যের একটা থেকে দুটো সন্দেশ বিস্কুট তুলে খবরের কাগজে মুড়ে দেবলের দিকে বাড়িয়ে দিল অজয়দা। এতক্ষণে খিদে টের পেল দেবল। একটাও কথা খরচ না করে কাগজের মোড়কটা হাতে তুলে নিল।

বিস্কুট দুটোর সদ্ব্যবহার সেরে মানিব্যাগ থেকে একটা পাঁচটাকার কয়েন বের করে বয়ামের ঢাকনায় রেখে দিল দেবল। চায়ের ভাঁড়টা নিয়ে বেদিতে ফিরে আসার আগে অজয়দা আবার ডাকল,

‘আজ খুব দেরি হয়ে গেল না? ট্রেনের কোনো গণ্ডগোল তো শুনিনি!’

কথা বললে মাথার ভিতরে পাক খেয়ে ওঠা চিন্তাটা সাময়িক কমে। কিন্তু, এখন এই লোকটার কৌতূহল কমানোর দায় নিতে ভাল লাগছে না দেবলের। অন্য সময়ে সে নিজেও অজয়দার জ্ঞানের কথায় কৌতুকবশত তাল ঠুকে দেয়, কখনোসখনো আড্ডার চালে বাজারের হাল-হকিকত জানতে চায়, কিন্তু আজ ভাল লাগছে না। মনের গভীর কোনও স্তর থেকে একটা দুশ্চিন্তা ঠেলে উপরিতলে আসতে চাইছে। এত দেরি তো হয় না কখনো!

‘হুঁ’ বলে চায়ের ভাঁড়টা নিয়ে বেদিতে এসে বসে, চা খেতে খেতে দুপুরবেলাকার কথা ভাবে দেবল। সরকারদার টেবিল থেকে ফোন করার সময়ে অর্চনাদি ফোন তুলেছিল। কাঙ্ক্ষিত গলার আওয়াজ না পেয়ে ‘ও.টিতে আছে’ জেনে ফোন রেখে দিতে হয়েছিল। তখন থেকেই মন দমে গিয়েছিল। তবু রোজকার একই সময়ের ট্রেন থেকে নামবে জেনে অপেক্ষা করে গেছে দেবল। এখন সাড়ে দশটা বাজতে যায়, চেনা মুখটার দেখা নেই।

একটা ঘোষণা শুরু হল। পিঠ টানটান করে বসল দেবল। কয়েক মুহূর্ত পড়েই বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকে গেল তার। ডাউন লাইনের ট্রেন আসছে। বিরক্তিতে আধখাওয়া চায়ের ভাঁড়টা সামনের লাইনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। অজয়দা দেখল। অলক্ষ্যে মুখ টিপে হাসল। তারপর গুনগুন করতে করতে স্টোভ পরিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ফুটব্রিজের সিঁড়ির নিচে কম্বল জড়িয়ে শুতে আসা পাগলিটা ভাঁড় ভাঙার আওয়াজে শেডের আলোয় তাকিয়ে দেখল। তারপর কুটকুটে কম্বল টেনে নিয়ে নির্বিকার মুখে পাশ ফিরে শুলো।

রাত বাড়ছে। উল্টোদিকের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে একটামাত্র খাবারের দোকান ঝাঁপ বন্ধ করছে। দোকানের দেওয়াল বরাবর আড়াআড়ি চলে যাওয়া ইস্পাতের বেড়ার ওধারে অনেকগুলি বাল্বের ক্ষীণ রেখা প্রভাব ফেলতে না পারার ভঙ্গিমায় চোখে খেলে যাচ্ছে। রেলবাজার গুটিয়ে আসছে। সেখান থেকে কেউ কেউ চটের গাদা, বেঁচে যাওয়া আনাজ নিয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠে আসছে। এমন সময়ে আরেকটা ঘোষণা শুরু হল।

একইভাবে ধাতব পাতের গায়ে আলোর ছটা দেখা গেল। সবুজ রঙের বিশালাকায় শুঁয়োপোকার মতো দেখতে ট্রেনটা আপ লাইনে ঢুকল। দেবলের মন হল তীক্ষ্ণ হুইসলের শব্দেও সে নিজের হৃদপিণ্ডের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ট্রেন থামল। নির্দিষ্ট লেডিস কম্পার্টমেন্টের খোলা দরজা থেকে একটা, দুটো, তিনটে অপরিচিত মুখ নামছে। তারপর নেমে এল আকাশি শাড়ি পরা একটা চেনা মুখ। উঠে দাঁড়াল দেবল।

শাড়ির কুচি সামলে কালো ব্যাগটা আরও একবার কাঁধে টেনে নিয়ে দ্রুত পায়ে এগোচ্ছিল শোভা। হালকা চাদরটা সঙ্গে নিতে ভুলে গিয়েছিল সকালে, এখন শীত শীত করছে। নিকষ কালো অন্ধকার রেললাইন থেকে একটা মিহি শীতল হাওয়া দিচ্ছে। ক্লিপ থেকে আলুথালু বেরিয়ে আসা চুলের গোছা হাওয়ায় উড়ছে, মুখে পড়ছে। চুল সরিয়ে সামনে বেদির কাছে চোখ যেতেই মুখ আলো হয়ে গেল শোভার। এত রাতে স্টেশনে দেবলকে আশা করেনি সে।

ট্রেন থেকে নামা গুটিকয়েক লোক সরে যেতেই এগিয়ে গেল শোভা। প্যাকিং বাক্সে বয়ামগুলো ভরে ফেলতে ফেলতে সেদিকে তাকিয়ে আরও একবার মুখ টিপে হাসল অজয়দা।

এতক্ষণের অপেক্ষা, উৎকণ্ঠা মুছে যাওয়ার পরে চোরাস্বস্তি উপভোগ করছে দেবল। কিন্তু তার প্রকাশ কম। যেকোনো আবেগ প্রকাশের ভাষা কম জানে সে। দেবলের সৌভাগ্য, সেইসকল চুপকথা শোভা বুঝতে পারে।

‘ইসস অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছো?’ করুণ চোখে মুখ তুলল শোভা।

‘ভাবলাম ট্রেনের কোনও গণ্ডগোল কিনা!’

‘আর বোলো না, নাইট শিফটের রেখা আসেনি, লাস্ট মিনিটে আমাকেই ওটি করতে হল!’

‘দুপুরে ফোন করেছিলাম, অর্চনাদি ধরেছিল’।

‘তখনও ওটি চলছিল। একদিনে দু-দুটো ওটি। শরীরে আর কিছু থাকে!’

‘কালকে অফ ডে?’

‘অর্চনা দি বলল বটে, তবে ওই মেট্রনকে বিশ্বাস নেই। কখন ডেকে নেবে কে জানে!’

‘আজ বিকেলে সরকারদার টেবিলে বাপি ফোন করেছিল। আসতে চায়। কাল যদি ছুটি থাকে একবার ডেকে নিতে…’

মুহূর্তে খরচোখে তাকায় শোভা। কথা বলতে বলতে রেললাইন পেরিয়ে ইস্পাতের বেড়া থেকে বেরিয়ে আসছে ওরা। বন্ধ হয়ে আসা মার্কেটের ভিতর দিয়ে হাঁটছে। শেষ হেমন্তের নীরব রাত্রি চারপাশ ঘিরে রেখেছে। একটা দুটো শাটার নামানোর আওয়াজ মাঝেমধ্যে সেই নিস্তব্ধতা খানখান করে দিচ্ছে। জামাকাপড়ের ছোটো ছোটো দোকানে, প্রসাধনীর কাচ ঘেরা খুপরির আলো নিভে আসছে। কালভার্টের সামনেটায় বড় ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোর গায়ে ধোঁয়াটে কুয়াশা। সেই আলোয় শোভার মুখে অভিব্যক্তির দ্রুত পাল্টে যাওয়া দেখল দেবল। সামাল দিতে বলল,

‘আসতে যখন চাইছে একবার কথা বলেই দেখো না’।

তীব্র স্বরে শোভা বলল,

‘গতমাসে কত নিয়ে গিয়েছিল মনে নেই তোমার?’

‘মনে আছে। কিন্তু এবারে তো একই কারণ না’ও হতে পারে!’

‘এবারে কারণ আরও গুরুতর। তিন-চারদিন আগে দুপুরবেলায় নার্সিংহোমে ফোন করেছিল মা। যা বলল তাতে বুঝলাম বাপি গাড়ি কিনবে। সেকেন্ডহ্যান্ড মারুতি ভ্যান। রোজগেরে দিদি হিসেবে তার অর্ধেক দামটা অন্তত আমার দেওয়া উচিত!’

একথায় হো হো করে হেসে উঠতে ইচ্ছে হল দেবলের। শোভা বা দেবলের অবস্থা কারোর অজানা নয়। তারপরেও এই অসম্ভব কথা বললে হাসি পায় বৈ কি! তবু সংযত থেকে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিমায় বলল,

‘তুমি? তুমি কোত্থেকে…? উনি এক বলেছেন আর তুমি আরেক বুঝেছ!’

‘মা’কে, বাপি’কে আমি তোমার থেকে বেশি চিনি দেবল। বাপি’কে মা’ই পাঠাচ্ছে। দিনকে দিন এই পাঠিয়ে দেওয়া বাড়ছে’।

শোভার পরিবারের এই বিরক্তিকর অধ্যায় নিয়ে বেশি কথা বাড়াতে চায় না দেবল। ওদের বিয়ের বয়স মাত্র সাত-আট মাস। এর মধ্যে বাপিকে প্রায়ই আসতে দেখেছে। কখনো শোভার কাছে, কখনো দেবলের কাছে অর্থসাহায্য চেয়েছে। চাইতে চাইতে চাওয়াটাকেই একটা জোরের জায়গায় পরিণত করতে চেয়েছে। দেবল সবটা টের পেয়েও কিছু বলেনি। বলাটা ভাল দেখায় না বলে বলেনি। তাছাড়া শোভার ভাঙাচোরা শৈশব ও কৈশোরের গল্প শুনে মায়া হয়েছে। ঝাড়া হাত পা একা মানুষ হলেও সম্পর্কের রাজনীতি দেবল বোঝে। তাই বাধা দিয়ে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে চায়নি। কিন্তু এখন দিনের পর দিন শোভা নিজেই রেগে উঠছে। এই অদ্ভুত সমস্যার সমাধান খুঁজে পায় না সদ্য বন্ধু হওয়া দুটো মানুষ।

সদ্য বন্ধুই বটে! মা মারা যাওয়ার পর বেশ কিছু বছর একাই গুছিয়ে নিয়েছিল দেবল। রোজগার বলতে ডালহৌসির পুরনো মার্চেন্ট অফিসে স্বল্প মাইনের কাজ, আর বাকি সময়টায় বিনোদন বলতে অফিস সেরে পুরনো পাড়ায় আড্ডা। সকালবেলার খবরের কাগজ আর দু’চারটে গানের ক্যাসেট ছাড়া আর কিছুর প্রতি তেমন মোহ ছিল না। কালেভদ্রে বড়দি বা ছোড়দির বাড়ি যাওয়া, কুটুম্বিতা বলতে ওইটুকুই বুঝত সে।

কিন্তু দিদিরাই উঠে পড়ে লাগল বিয়ে দিতে। বাপ মা মরা, ভাড়ায় থাকা স্বল্প মাইনের এমন পাত্রের জন্যে বাংলায় মেয়ে কম নেই, কিন্তু দিদি-জামাইবাবুর সাথে শোভা নামের যে পাত্রীকে দেখতে গিয়েছিল দেবল, সে ছিল অন্যরকম। একেবারেই অন্যরকম।

সেই সন্ধেটা মাঝেমাঝে মনে পড়ে দেবলের। শোভাকে মনে করিয়ে দিয়ে দু’জনে বেজায় হাসাহাসি করে। সেদিন তখনও সন্ধেটা আকাশের সবটুকু গ্রাস করেনি। নীল অন্ধকারের মাঝে বিকেলবেলার ঘোলাটে মায়া অল্প লেগে রয়েছে। ছিটে বেড়ার দরজা পেরিয়ে সামনে কয়েকটা জোড়া ইট পাতা। বর্ষাটা যাবে যাবে করেও যাচ্ছে না। আবার রাতেও শরতের আকাশ বোঝা যায় বেশ। ইটের গায়ে সাবধানে পা রেখে এগোচ্ছিল দেবলরা। সামনে সদর দরজার সিঁড়িতে দেখে একটি মেয়ে। মেয়েটির পরনে কালো পাড়ের সাদা শাড়ি। বাড়িতে থাকা বয়স্কা বিধবা মা-ঠাকুমার শাড়ি যেমন হয়। চুলটা খোলা, মেয়েটি মুখ নিচু করে হাঁটুর উপর রাখা একটি আংটি খুব মন দিয়ে পরিষ্কার করছে, ফলে চুলের গোছা দু’কাঁধ বেয়ে সামনের দিকে নেমে এসে আংশিক আড়াল করেছে মুখ। পায়ের আওয়াজে মুখ তুলল সে। দেবল দেখল মেয়েটির কপালে কালো সোয়েটের টিপ। চোখদুটি ভারি উজ্জ্বল। আর থুতনির ডানদিকে একটি তিল। প্রসাধনহীন জলধোয়া লাবণ্যময় একটি মুখ। বাড়ির কর্তার নামটা বলতে মেয়েটা উত্তর দিল না। উল্টে ওদের চমকে দিয়ে সহসা এক লাফে উঠোনে নেমে এল। তারপর তড়িৎপায়ে ছুটে পাশের একটি বাড়িতে ঢুকে গেল। এমন ঘটনায় দিদি-জামাইবাবু স্তম্ভিত। দেবল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভরসন্ধেয় অচেনা বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আর কাউকে ডাকবে কিনা ভাবছে, এমন সময়ে কাঠের দরজা খুলে বেরিয়ে এল দেবলের চেয়ে বয়সে খানিক ছোট এক যুবক। বাপির আগমনে জীবনে প্রথমবার পাত্রী দেখতে যাওয়ার কাজটা সফল হয়েছিল।

অল্পক্ষণ পরে যখন পাশের বাড়ি থেকে কোনও এক জাদুবলে রঙচঙে শাড়ি পরে থুতনির তিল ও কালোর জায়গায় নীল টিপ সমেত ওই মেয়েটি এসে শান্তভাবে বসল, তখন তাকে দেখেই অন্তত নিজের সিদ্ধান্তটুকু ভেবে নিয়েছিল দেবল। মেয়েটি নার্সিং কলেজ থেকে পাশ করে একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে ইন্টার্নশিপ করে, সেই টাকাতে ছোটভাইকে পড়াচ্ছে, বাবা মারা গেছে অনেক বছর আগে, আর নিজের, সম্পূর্ণ নিজের একটি বাড়ি তৈরির স্বপ্ন দেখে। এইসব দেবল পরে জেনেছে। তারও পরে জেনেছে মেয়েটাকে ঘিরে তার মা-ভাইদের সম্পর্কের কূটনীতি, আর্থিক চাপসৃষ্টি, আর অবহেলার আখ্যান। মাঝেমাঝে উচ্ছল মেয়েটাকে অসহায় লেগেছে। মাঝেমাঝে বড্ড হিসেবি, গোছানো, শান্ত, গৃহলক্ষ্মী মনে হয়েছে।

দিদি-জামাইবাবু সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল পরে। তারপরে দুর্গাপুজো এল। নবমীর দিন একবেলা ছুটি পেয়ে শোভা এসেছিল কলেজ স্কোয়ারের সামনে। সেদিন খুবই কুন্ঠিত হলেও কী মনে করে দেবল নিয়ে গিয়েছিল একটি জামরঙা শাড়ি। শাড়ি চেনে না সে। দোকানদার বলল জর্জেট, দামে কুলিয়ে গেল, তাই সাত পাঁচ না ভেবে কিনে ফেলল।

তারপর বসন্তে বিয়ে। কোনও দাবিদাওয়া ছাড়া বিয়ে করতে চেয়েছিল দেবল। কিন্তু বিয়ের পরে একটি বিষয় দেখে হতবাক না হয়ে পারেনি। একে একে সমস্ত তৈজসপত্র, দামী শাড়ি, উপহার যখন মা-ভাইরা সরিয়ে রাখছে, কী এক অদ্ভুত ভাবনায় তা টের পেয়ে আগে থেকেই মাইনের স্বল্প জমানো টাকায় নিজের জন্যে, দেবলের সাথে সংসারের জন্যে কিছু কিছু কিনে রেখেছিল শোভা। তা খুবই সামান্য হলেও সম্পর্ক গাঢ় হওয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিল।

গত সাত-আটমাসে অল্প অল্প জমিয়ে ঘরের টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনেছে ওরা। কোথাও যাওয়া হয়নি। কাছেপিঠে সমুদ্রে যাওয়ার কথা এক-আধবার তুলেছিল দেবল। শোভাই বাধা দিয়েছে। আগে ঘর গোছাতে চেয়েছে। যাওয়ার সময় তো পড়েই রয়েছে। মাঝেমধ্যে বাপি এসেছে, মা এসেছেন, ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কথা বলেছেন, অর্থের জন্যে শোভাকে চাপ দিয়েছেন, পরোক্ষে দেবলকেও, কিন্তু তা দু’জনের গড়ে ওঠা বন্ধুত্বের মাঝে বাধা হয়ে যায়নি। আসলে যখন দুটো একা মানুষ, ভাঙা মানুষ একে অপরকে আঁকড়ায়, তখন বোধহয় এমনটাই হয়।

প্লাস্টিকের ছোট্ট প্যাকেটে সয়াবিনের ঝোল পুরে আঙুলের কায়দায় গিঁট বেঁধে দিল ছেলেটা। সাথে খবরের কাগজে রোল করা কয়েকটা হাতরুটি। দোকানটা বন্ধ হবার আগে শেষ খদ্দের দেবল আর শোভা। এত রাতে আর কিছু পাওয়া গেল না। দাম মিটিয়ে মন্দিরের পাশের আলো-আঁধারি রাস্তায় মিলিয়ে গেল দুই মানব মানবী।

ক্যাম্পের রাস্তাটা শুনশান। বড় মুদির দোকানটার কাঠের পাল্লা বন্ধ। দুয়েকটা কুকুর কুণ্ডলী পকিয়ে শুয়েছিল। ওদের দেখে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে ডেকে উঠল। ভয়ে দেবলের হাত ধরল শোভা। গা ঘেঁষে সরে এল। সামনেই নতুন তৈরি হাউসিং-এর বিশাল চওড়া টিনের গেট। সেখানে মাফলার জড়িয়ে টুলে বসে আছে এক উর্দিধারী গার্ড। বাদামি চামড়ার খোলে ভরা একটা চৌকো রেডিও তার পায়ের কাছে রাখা। রেডিওয় একটা গান বাজছে। কিছুটা পুরনো। টুল থেকে কয়েক পা দূরে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাসুর দোকানের চাতালে পা ছড়িয়ে আরও একজন বসে আছে। রূপম।

দেখে মায়া হয় ওদের। পাড়ার ছেলে। শুনেছে খুব মেধাবী ছিল। কীভাবে যে এমনটা…! যদিও পাড়ায় কানাঘুষো অনেক খবরই ঘোরে।

রূপম আজ রাতে ঘরে ঢুকতে পারেনি। শেষ নভেম্বরের রাত। তাকে কেউ খুঁজতে আসেনি। এক পায়ে চটি নেই, মায়ের রোঁয়া ওঠা কালো শালটা এখন মাথা আর গলায় পেঁচিয়ে অদৃশ্য কাউকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করে চলেছে সে। একটানা গালাগালি করতে করতে কেঁদে ফেলছে সে। তার ক্ষোভ, তার অভিমান, তার কান্না ভাসছে, ভেসে যাচ্ছে নিস্তব্ধ হিম হাওয়ায়। তার সাথে মিশে যাচ্ছে বেতার তরঙ্গে ভেসে আসা একটি সুর… “ইয়ে রুত কি রংরলিয়া, ইয়ে ফুলো কি গলিয়া রো পড়ি, মেরা হাল সুনা তো মেরে সাথ ইয়ে কলিয়া রো পড়ি, এক নেহি তু দুনিয়া আসু বরসা রাহি হ্যায়… ইয়াদ আ রাহি হ্যায়, তেরি ইয়াদ আ রাহি হ্যায়, ইয়াদ আনে সে তেরে যানে সে জান যা রাহি হ্যায়…”

সোজা রাস্তাটা থেকে ডানদিকের গলিতে বাঁক নিলে হলুদ রঙের চারতলা বাড়ি। গলির মুখে ঢুকতে দেবলের হাত ছেড়ে দেয় শোভা। সদ্য দরজা বন্ধ হয়েছে বিজন রায়ের বাড়ির। দরজায় টোকা দিতে হাত কেঁপে যায় দেবলের।

 

                                 

 

ছাদের ঘরে আলো জ্বলে। সারারাত।

মধ্যরাত ঘন হয়। একে একে সমস্ত বাড়ির আলো নিভে যায়। কেবল ঘোষালদের তেতলায় ছাদের ঘরে আলো জ্বলে সারারাত। বিভা ঘুমিয়ে পড়েন না। সারারাত ঘরে আলো জ্বেলে রেখে বিছানায় বসে থাকেন। প্রায় শেষ রাতের দিকে চোখ লেগে গেলে কিছুক্ষণ ঢুলতে থাকেন। ভোরের প্রথম পাখিটি ডেকে ওঠে, বিভা তখন সফেদ বালিশের গায়ে একটি বাহু রেখে মাথা এলিয়ে দেন। কালো আকাশে ফিকে রং ধরে, একটা দুটো প্রাণ জেগে ওঠে, জেগে ওঠার শব্দ হয়, শব্দ বাড়ে, ঘরে জ্বলতে থাকা মেকি আলো সর্বশক্তিমানের কাছে মাথা নোয়ায়, গুরুত্ব হারায়, আর রোদের প্রথম রেখা দেখা গেলে বিভা উঠে পড়েন। দীর্ঘদিন ধরে তাঁকে দেখে মনে হয় কতকাল ওই চোখ দুটোয় ঘুম নেই।

উঁচু নিচু অন্ধকার ছাদ পেরিয়ে মাঝখান দিয়ে ভাঙা পিচের রাস্তাটা অল্প দূরে জি.টি রোডে মিশেছে। ফাঁকা জি.টি রোডে মাঝরাতের দু’চারটে ভিনদেশী লরির যাতায়াত। চোখের নিমেষে সেগুলি আসে যায়। ভারী চাকার কম্পন টের পাওয়া যায় না, হুশ-হাশ শব্দ কানে আসে। তার ওধারে নদী, বাঁধানো ঘাট। ভাগীরথী-হুগলী। এলাকার সবার কাছে গঙ্গা। গঙ্গার ঘাটে শিবমন্দির। সেখানেও সারারাত আলো জ্বলে। ঘোলাটে জলের উপর থেকে মিঠে হাওয়া উঠে আসে। ঘোষাল বাড়ির তেতলার ছাদে সেই হাওয়া ঢোকে না। তবু রাত বারোটার কাঁটা এগিয়ে গেলে ছাদের দরজায় খুট শব্দ হয়। এমন শীতল রাতেও তার অন্যথা হয় না। দরজা খুলে যায়। বিভার ঘরের জানালায় উঁকি দেয় দুটো চোখ। প্রথম প্রথম সেই নজর ছিল সতর্ক, সমীহপূর্ণ, ভয়মিশ্রিত। বছরখানেক হল সেই দৃষ্টি থেকে ভয় উবে গেছে। এখন সেই নজরে খানিক গা-সওয়া ভাব। যেন পরোয়াহীন। কিছুটা তাচ্ছিল্যও কি? বুঝে ওঠেন না বিভা। শুধু ওই তরতাজা যুবকের মুখের দিকে তাকালে তিনি শিউরে ওঠেন, তাঁর বিবমিষা জাগে! তুষারের মুখের আদলে চেপে বসেছে ওর বড়কাকার মুখের আদল। এই আদল বিভা সহ্য করতে পারেন না।

তুষার লক্ষ্য করে না। বড়োকাকিমা এই ঘরে প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে নিজেকে বন্দি করে রেখেছেন। কালেভদ্রে নিচে নামেন। সারারাত ঘুমোন না, আর যত দিন গেছে ততই নিজেকে এক নির্বাক মূর্তি বানিয়ে তুলেছেন।

তুষারের বড়োকাকাকে খুব একটা মনে পড়ে না। খুব যে কাছের কেউ ছিলেন তা’ও নয়। বছর কুড়ি আগে, যখন এই ঘোষাল বাড়ির পূব দিকটা সম্পূর্ণ ধসে পড়েনি, যখন এইদিকের মেঝে এমন জায়গায় জায়গায় ক্ষয়ে যায়নি, তারও তিরিশ বছর আগে জমিদারি উঠে গেলেও যখন কাটা কাপড়ের ব্যবসাটা ভালই চলছে, দালানের পলেস্তারা সবটা খসে যায়নি, যখন পশ্চিমদিকে নিয়মিত চুনকাম পড়ে, যখন ঠাকুমা বেঁচে, সেই তখন, চার বছর বয়সে বড়োকাকাকে শেষবারের মতো দেখেছিল তুষার। খুব একটা স্নেহশীল ছিলেন না। তুষারের শিশুমন স্নেহ টের পায়নি। তারপর একদিন জিপে করে উধাও হয়ে গেলেন। বড় হতে হতে তুষার দেখল প্রতিপত্তি আগেই ছিল না, কিন্তু এখন কেমন বাঁকা চোখে তাদের বাড়ির দিকে সবাই দেখে। একটি উধাও হওয়া বাড়ির মানুষগুলোকে পাল্টে দিল। তাদের স্বপ্ন মরে গেল। সম্মানের আশা মরে গেল। গৃহকর্ত্রী ঠাকুমার আচমকা মৃত্যু ঘটল। সবশেষে চালু ব্যবসাটা কেমন জীর্ণ টিমটিমে চেহারা ধারণ করে কোনোরকমে বেঁচেবর্তে রইল।

আর ছিলেন এই বড়ো কাকিমা। শ্রীমতী বিভারানি ঘোষাল। জ্ঞান হওয়ার বয়স থেকে তাঁকে একটি পাথরের মূর্তি ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। আবেগহীন, কঠোর, ঘেন্নামাখা দৃষ্টির এক মধ্যবয়সী নারী। বর্তমানে প্রৌঢ়া এই নারীর দৃষ্টি উপেক্ষা করতে শিখেছে তুষার।

একদিন, ক্লাস ইলেভেনের বন্ধু রাজনকে মেরে রক্তারক্তি করে বাড়ি ফিরেছিল তুষার। তখনও সে রাগে কাঁপছে। তার সতেরো বছর বয়স তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়তে চাইছে। মা তাকে শান্ত করেছিলেন। বিকেলবেলার অন্ধকার মাখা ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তারপর যখন তুষার জানলো রাজন যা বলেছে সব সত্যি, এবং এই সত্যি যে সে জানে, সেকথা বাড়ির কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায়, তখন লজ্জায়, অভিমানে মায়ের আঁচলে মুখ ডুবিয়ে কেঁদেছিল তুষার। বহুদিন রাজনের চোখে চোখ রাখতে পারেনি। মিটমাট করে নেওয়া তো দূরের কথা, দেখতে পেলে এড়িয়ে গেছে। এখনও এড়িয়ে যেতে চায়, রাস্তায় দেখা হলে সামান্য কুশল বিনিময়ের পরেই এড়িয়ে যায়। তুষারের মনে হয় এই একটি ছেলে তার দুর্বলতা জানে। পরমুহূর্তে ভাবে, এলাকার প্রতিটা মানুষ তার ও তাদের দুর্বলতা জানে! আজও কখনো কখনো ক্ষোভে লজ্জায় মাথাটা নুয়ে পড়তে চায়।

ক্লাস ইলেভেনের সেই দিনটা থেকে তুষার তার বড়োকাকিমাকে কিছুটা সহানুভূতির চোখে দেখে। কিন্তু ওই কঠোর, শাপগ্রস্ত চোখ দুটোর সামনে দাঁড়ালে তার সমস্ত সহানুভূতি মরে যায়। তাই পরিবারের বাকি সবার মতো উপেক্ষা বেছে নিয়েছে সে।

মধ্যরাতে ছাদে উঠে আসে যে কারণে, সেই কারণ বড়োকাকিমা বোঝেন। কোমায় থাকা মানুষ তো নন। মস্তিষ্ক সজাগ, সতর্ক, অবিশ্বাসী। কেন বুঝবেন না? কিন্তু পরিবারের প্রায় বোঝা এই মানুষটিকে নিয়ে বেশি ভাবে না তুষার। সে এখন ছাদের ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া নোনা ধরা কার্নিশের গায়ে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে।

একটু পরে একটা গাড়ি ঢুকবে এই রাস্তায়। মারুতি ৮০০। শ্যাওলা শ্যাওলা রং। গাড়ির ভিতরের লোকটাকে চেনে না তুষার। বছরখানেক ধরে কোনোদিনও দেখেনি। শুধু পাশ থেকে নেমে আসবে যে, তাকে দেখার জন্যে, সে ফিরেছে, এটুকু জানার জন্যে শীতেও তুষার ছাদে উঠে আসে। ডলিদি নেমে আসবে। সশব্দে গাড়ির দরজা বন্ধ করবে। গ্রীষ্মকাল হলে কেউ কেউ সেই শব্দে জানালার পর্দা তুলে দেখবে, তারপর চেনা দৃশ্য দেখে ঝপ করে পর্দা ফেলে দেবে। পর্দার তীব্র আপত্তি ডলিদির পিছু নেবে। তবু সে ভ্রুক্ষেপ না করে উল্টোদিকে ন্যাড়া ছাদের সিমেন্ট রঙের বাড়িটায় ঢুকে যাবে।

আজ গাড়িটা এল বারোটা কুড়ির পর। কালো রাজস্থানি ওড়না টেনে ডলিদি নামলো। স্টার্ট দিয়ে গাড়িটা পিছোতে শুরু করল। ছাদের কোণের অব্ধকারে মিশে তুষার মুখ বাড়িয়ে রইল। বেঁটে আর নিচের দিকে ক্ষয়ে আসা জীর্ণ গ্রিলের গেট খুলছে ডলিদি। যতক্ষণ না ঘরে ঢুকছে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে তুষার। কিন্তু, আজ আচমকা পিছন ফিরে উপরে তাকালো ডলিদি। যেন একটা মুখ খুঁজছে।

বড়োকাকিমার বিদ্বেষমাখা দৃষ্টির দিকে পরোয়াহীন দাঁড়াতে পারে তুষার। কিন্তু এই ছাদের দিকে মুখ তুলে থাকা চাহনির সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই তার। সে ঝটিতি সরে আসে।

ছেলেবেলার খেলার সাথী ডলিদি। বড় হয়ে ওঠা থেকে ছাড়াছাড়ি। এখন সম্পর্কের সমীকরণ পাল্টে গেছে, দু’জনের জীবন পাল্টে গেছে। তবু আজ প্রথমবার ডলিদি তাকিয়েছে। বছরের পর বছর ঘুরে গেছে, তুষারের প্রতিদিনের উপস্থিতি টের পেয়ে আজ ডলিদি তাকিয়েছে। হালকা একটি শরীর নিয়ে পায়ে পায়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল তুষার। নিচে নেমে যাওয়ার আগে বড়োকাকিমার ঘরের জানালায় চোখ পড়তে চমকে উঠল সে।

খাট থেকে নেমে এসে জানালার গরাদ ধরে শিকের গায়ে মুখ ঠেকিয়ে তীব্র ক্রোধের এক বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বড়োকাকিমা। মুহূর্তে নিজেকে সামলে উপেক্ষার ওষুধ প্রয়োগ করল সে। ছাদের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ পেলেন বিভা।

নিজের বড়োকাকার মুখের আদল পেয়েছে তুষার। বড়োকাকা যে কাজ করে গেছে, তুষারও সেই কাজ করবে! ভাবলে অবদমিত ঘেন্না জেগে ওঠে বিভার। ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে মাথায়। নিদ্রাহীন দুটো চোখ একলা বিষাদে নেমে যায়, শ্বাসের বেগ বেড়ে যায়, দাঁতের উপর দাঁত চেপে যায় তাঁর।

জমাট অন্ধকারে ডুবে সারারাত ঘরে আলো জ্বেলে রাখেন বিভা। 

 

 

                             ক্রমশ...

Tuesday, January 25, 2022

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

 তার হাতে মেঘ, অন্নজল (দ্বিতীয় পর্ব)

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায় 

“বারে বারে বাঁধ ভাঙিয়া বন্যা ছুটেছে

দারুণ দিনে দিকে দিকে কান্না উঠেছে

ও গো রুদ্র দুঃখে সুখে, এই কথাটি বাজল বুকে

তোমার প্রেমে আঘাত আছে, নাইকো অবহেলা… নয় নয় এ মধুর খেলা…”

 

ঠিক এই পঙক্তিতে পৌঁছে যত্ন বেড়ে যায় বাবুয়ার। বড় প্রিয় গান তার। গমগমে স্বরে এক পৃথিবী দরদ ঝরে পড়ল। দ্বিতীয়বার শুরু করল বাবুয়া।

 

এই সময়টায় জানালা গলে ভরদুপুরের রোদ পড়ে তক্তপোশে। সবার ভাত খাওয়া হয়ে যায়, সকড়ি, এঁটো তুলে, কুয়োপাড়ের বিড়ালগুলোকে খাইয়ে, দরজা জানালা ভেজিয়ে এই সময়টায় ঘুমিয়ে পড়ে মা। এই সময়ে বাবা দোকান থেকে ফেরে না। রোদের গায়ে হিমেল হাওয়া বোঝা যায়। নিরিবিলি পাড়াটা আরও একটু চুপ করে যায়, আশেপাশের বাড়িগুলো নিস্তেজ হয়ে ঝিমোয়, আর তাকে কিছু বলার মতো কোত্থাও কেউ থাকে না। তাই এই সময়টায় নিশ্চিন্তে রেওয়াজে বসে বাবুয়া। আজও বসেছিল। হঠাৎ তীব্র ঝনঝন আওয়াজে চমকে থেমে গেল সে।

 

কেউ এসেছে। আরও একবার শুনে পরখ করল বাবুয়া। গ্রিলের গায়ে বন্ধ তালা দিয়ে সজোরে আঘাত করছে কেউ। একটানা নয়, থেমে থেমে। যেন আঘাতের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সাথে রয়েছে কুণ্ঠাবোধও।

 

হারমোনিয়াম ছেড়ে ওঠার আগে গলা তুলে হাঁক দেয় বাবুয়া।

 

‘কে?’

 

কোনও সাড়া আসে না। উঠতে গিয়েও থেমে যায় সে। রিডের উপর আঙুল চালাতে তোড়জোড় শুরু করে। পরক্ষণেই গ্রিলের গায়ে আবার তালা ঠুকল কেউ।

 

এবারে উঠে পড়ে বাবুয়া। আজকাল ঘর বারান্দায় হাঁটাচলা করতে ছড়িটা ব্যবহার করে না সে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতেও নয়। এতগুলো বছরে আন্দাজ হয়ে গেছে। অভ্যেসবশে দরজা, জানালা, চাবি রাখার টেবিল, বারান্দার গ্রিল সবই চেনে। চলাফেরাতেও আগের চেয়ে দ্রুততা এসেছে। শুধু রাস্তায় বেরোলে আলো নিভে আসা চোখে চশমার আড়ালটা রাখে, হাতে ছড়িটা থাকলে একটু ভরসা পায়।

 

টেবিল হাতড়ে চাবিটা নিয়ে দরজার পাল্লা ধরে বেরিয়ে এল বাবুয়া। সাবধানী গলায় আবারও জিজ্ঞেস করল,

 

‘কে?’

 

একটা স্বর বাজল কানে। কব্জির বাধায় সমস্ত চুড়ি একত্রে ঝামরে পড়ার মতো স্বর। কিঞ্চিৎ ভয়ের সাথে নম্রতা মাখানো একটা স্বর।

 

‘একটা ফোন করা যাবে?’

 

বাবুয়া জন্মান্ধ নয়। প্রায় ষোলো বছর বয়স অবধি পৃথিবীর রং রূপ সে ভালই চিনেছে, জেনেছে। তারপর ধীরে ধীরে মাথায় জল জমতে শুরু করে, স্নায়ুর জটিল রোগে দৃষ্টি আবছা হতে থাকে। মাথা থেকে জল বের করার এক চিকিৎসা পদ্ধতি মাঝেমধ্যে সারা হয়, আবার মাঝেমধ্যে বহু বহু দিন হয় না। তবু এখনও অন্ধকার হয়ে আসা চোখে বিভিন্ন রং কল্পনা করতে পারে সে। এই যেমন এখন, বাবুয়ার মনে হল বন্ধ গ্রিলের ওপারে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পরনে একটা গাঢ় সবুজ চুড়িদার, বুকের কাছে ফেলে রাখা বাসন্তি রঙের ওড়না। ভারি অদ্ভুতভাবে এও মনে হল, যে এসেছে সে’ও হয়তো মেরুন ফ্রেমের চশমায় আড়াল করেছে চোখ। এই স্বর বাবুয়া চেনে না। তবু মনে হল, যে এসেছে সে চেনা। 

 

অল্প অধৈর্য হয়ে মেয়েটি আবার ডাকল।

 

‘বলছিলাম, একটা টেলিফোন করা যাবে?’

 

সম্বিৎ ফেরে বাবুয়ার। চাবির গোছায় একটাই চাবি। দুপুরবেলাগুলোয় তার সুবিধার্থে রাখা। সেটা দিয়ে আঙুলের আন্দাজে তালা খুলতে খুলতে বলে,

 

‘হ্যাঁ, আসুন’।

 

বারান্দায় রাখা কেঠো টেবিলটায় একটা লাল-কালো রিসিভার রাখা। সাথে মিটারে লাল আলোর নম্বরে বিল দেখার ব্যবস্থা। পরিবারে বাড়তি রোজগারের জন্যে চলনসই। দুপুরবেলায় প্রতিবেশী কেউ টেলিফোন করতে এলে, তাকে কথা বলবার সময়টুকু দিয়ে মিটার দেখতে মা’কে ডেকে আনে বাবুয়া। যদিও দুপুরবেলায় বড় একটা কেউ আসে না, তবু এই ব্যবস্থা করা। আজ এসেছে। তাকে পাশ কাটিয়ে এইমাত্র টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল মেয়েটা। বত্রিশ বছরের পুরনো নাকে এক মেয়েলি সুবাস টের পেল বাবুয়া। মিটারের শব্দে বুঝল, কানে টেলিফোন তুলে নিয়েছে মেয়েটা।

 

মা’কে ডেকে দিতে ঘরের দরজার দিকে এগোয় বাবুয়া। খুব নিচু চৌকাঠ পা ফেলে ফেলে পেরিয়ে যায়, ঠিক তখুনি আবারও মেয়েটার স্বর কানে আসে,

 

‘আমি বলছি, শোনা যাচ্ছে?’

 

বাবুয়ার মনে হল, অদ্ভুত স্বরে কথা বলে মেয়েটা। ফোনের ওপারে যে আছে সে’ও নিশ্চয়ই মেয়েটার স্বর শুনলেই চিনতে পারে। নাম বলার কোনও প্রয়োজন পড়ল না তো! এখন মেয়েটা আরও চাপা স্বরে কথা বলছে, মাঝেমধ্যে হু, হাঁ উত্তর দিচ্ছে। তবু এই চাপা গলার আর্দ্রতা টের পাচ্ছে বাবুয়া। কে জানে কেন, বাবুয়ার মনে হল, ফোনের ওপারে যে আছে, সে পুরুষ।

 

শুধু এই স্বর শোনার লোভে এই প্রথমবার দেওয়ালের এপারে দাঁড়িয়ে রইল বাবুয়া। মা’কে ডাকতে যাওয়ার কথা ভুলে গেল সে। হয়তো বা যেত, কিন্তু কথা শুরু হওয়ার সামান্য পরেই মেয়েটার স্বর ভেঙে গেল যে! চাপা হলেও কথা বলতে বলতে আচমকা গলা ধরে এল তার। বাবুয়া টের পেল, তীব্র কান্নার ঢেউ আটকাবার চেষ্টা করছে মেয়েটা। পারছে না, তবু সামাল দিয়ে আবার বলছে,

 

‘না, দু’দিনে আমি কী করে পারবো, বোঝো একটু… না, না, বাড়িতে নয়, বাড়িতে ফোন করলে অসুবিধা হয়… আমি দেখছি, একটু ভরসা রাখো… প্লিজ’।

 

একটা দেওয়াল আর জানালার ব্যবধানে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা মেয়ে। সে কাঁদছে। কখনও নিজেকে সামলাচ্ছে। স্বর শুনে চিনে নেওয়ার মতো পরিচিত কারোর কাছে মিনতি করছে। কখনও ধৈর্য হারিয়ে ফিসফিসিয়ে হলেও রেগে উঠছে। আবার কখনও তার গলা এমন অতল খাদে নেমে যাচ্ছে যে কিছুই আর টের পাওয়া যাচ্ছে না। তবু বাবুয়া দাঁড়িয়ে থাকে। অপরাধ মেনেও দরজার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটির গলায় অদ্ভুত এক টান, এই ঈষৎ ভাঙা রিনরিনে স্বর বাবুয়ার পা দুটোকে চৌকাঠের কাছেই আটকে রেখেছে।

 

হঠাৎ বাবুয়ার মনে হল এই দুপুরবেলা, নির্জন বারান্দাটা, এই মেয়েটার স্বর, তার কান্না সবটাই স্বপ্ন। হয়তো সে তক্তপোশের গায়ে শরীর এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। হয়তো দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে অথচ চোখ লেগে যাওয়ার কারণে ঘরে আলো জ্বালায়নি সে। হয়তো সুরের ভিতরে সে এমন কোনও দৃশ্য কল্পনা করছে। এমন কতকিছুই হতে পারে, তবু তার ভাবনা ভেঙে একটু পরে ফোন রেখে দিল মেয়েটা। বাবুয়ার মনে নেই ঠিক কতক্ষণ সে দাঁড়িয়ে ছিল, কয়েক মিনিট বা কয়েক ঘণ্টাও হতে পারে। ফোন রেখে দিলে আপনা থেকে খচমচ শব্দে বিল উঠতে শুরু করল। দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাবুয়া বলল,

 

‘একটু দাঁড়ান, মা’কে ডাকছি’।

 

মেয়েটা বোধহয় বাবুয়ার অপারগতা এতক্ষণে টের পেল। শান্ত, নম্র স্বরে বলল,

 

‘আঠাশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা হয়েছে’।

 

বাবুয়া ভাবল, এরপরেও মা’কে ডাকতে গেলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চশমাবতীকে অবিশ্বাস করা হবে।

 

‘বেশ, দয়া করে খুচরো দিলে ভাল হয়’।

 

একটা হাতব্যাগের চেন খোলার আওয়াজ হল। গুণে গুণে কিছু নোট আর খুচরো কয়েন টেবিলে রাখল মেয়েটা। তারপর আবারও সেই সুবাস পেল বাবুয়া, তাকে পাশ কাটিয়ে গেল। গ্রিলের কাছে গিয়ে মেয়েটা বলল,

 

‘আসছি, দরজাটা বন্ধ করে দিতে পারেন’।

 

তারপর চটিজুতোসমেত পায়ের আওয়াজ তিন ধাপ সিঁড়ি নেমে বাঁশের গেটটার দিকে মিলিয়ে গেল, বাবুয়া টের পেল। চাবিটা আনেনি সে। দু’পাল্লার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে সে ভাবে, মেয়েটা কে? এই পাড়ার? একই পাড়ার সবাই তো তাকে চেনে। তবে কি পাশের পাড়ার? বা নতুন এসেছে? তবু এই গলার আওয়াজ সে আগে কখনও শুনেছে।

 

পাশের মান্না মাঠে বল ফেলেছে। দুয়েকটা চিৎকার, খেলতে আসার উচ্ছ্বাস ভেসে আসছে। পাশের বাড়িতে কেউ বোধহয় টিভি চালালো, উচ্চগ্রামে। সামনের সরু রাস্তাটা দিয়ে যেতে যেতে কে যেন টিপ শব্দে ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বালিয়ে গেল। সত্যিই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। বাবুয়ার মনে হল, মাঠের ওধারে এখন আকাশের লাল রং। যখন খেলতে যেত, তখন এমন লাল-কমলা রং দেখতে পেত। হাঁসের ডিমের কুসুম মার্কা সূর্যটা জাহাজবাড়ির আড়ালে নেমে যেত। আজ এত বছর পর ভিতরে কোথাও খুব হালকা চিনচিনে যন্ত্রণা বুঝতে পারল। আরেকবার মাঠে যেতে ইচ্ছে হল। না খেললেও, পাশের পাঁচিলটায় বসে খেলা দেখা যেত যদি একবার!

 

বাবুয়ার আরও ইচ্ছে হল, দুপুরবেলা যে সবুজ রঙের মেয়েটি এল, তার সম্পর্ক যেন না ভাঙে। সে যেন টেলিফোনের ওপারের পুরুষটির সাথে সম্পর্ক জুড়ে রাখে। তারা জুড়ে থাকলে মেয়েটি হয়তো আরও একটিবার আসবে। 

 

 

 ঘরের ভিতরে বেলা পড়ে আসার ঘন ছায়া। আয়নার পাশে কালো অন্ধকার জমাট বাঁধছে। কুহু ভাবল,  এমন সময়ে তার শ্যামলা মুখখানি আরও শ্যামলা লাগে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আয়নায় নিজেকে জরিপ করছে সে। যখন রোদ ছিল, তখন দুধে আলতা পিওর সিল্কটা পরবে ঠিক করেছিল। এখন রোদ মরে আসা বাদামি আলোয় আকাশি ইক্কত পরতে ইচ্ছে করছে। কিংবা সাদা জমিতে সোনালি সুতোর কাজ করা তাঁতের সালোয়ারটা। অনেকক্ষণ ধরে নানান পোশাক ছড়িয়ে বারবার নিজেকে দেখেছে সে, কোনওটাই ঠিক মনে ধরেনি তার। এবারে পোশাক ছেড়ে ছোট্ট লম্বাটে বাক্সটা হাতে তুলে নিল সে। রূপোলী বর্ডার দেওয়া খয়েরি খাপের ভিতর অদ্ভুত রঙের লিপস্টিক। কুহু জানত এই রঙটা মেরুন। উপহার যে এনেছে, সমীর, সে বলল এই রঙটা মেহগিনি। ঠোঁটের উপর পরম যত্নে বুলিয়ে নিতে নিতে কুহু দেখল রঙটা তার মুখের সাথে মানায় ভাল।

 

উপহার! উপহারের পাহাড়ে বসে থাকে কুহু। একলা। এমন উপহার অনেক পায় কুহু। এই ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দামী শাড়ি, নীল ইক্কত, অভিজাত সালোয়ার, বিভিন্ন প্রসাধনী, সবই উপহারে পাওয়া। নীল ইক্কতটা মলয় দিয়েছিল। পাশের পাড়ায় থাকত। ইন্ডিয়ান আর্মিতে কাজ করত। তার শখ ছিল পরের ছুটিতে ফিরে এসেই কুহুকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। কুহুরও খুব একটা অমত ছিল না। কিন্তু মলয়ের অনুপস্থিতিতে শেখর এল। কলেজের বান্ধবী সুপর্ণার দাদা, প্রায় ছ’ফুটের মতো লম্বা, তামাটে রং, কোঁকড়ানো চুল, চাপদাড়ি, এমন সুপুরুষকে দেখেই মলয়ের বিদায় পাকা হয়ে গিয়েছিল। শেখর লেখাপড়ায় ভাল, বোন সুপর্ণাকে পড়া বুঝিয়ে দিত। কুহুরও পড়া বোঝার প্রয়োজন পড়ত। সুপর্ণার বাড়ি ঘন ঘন ছুটে যেত। শেখরের আড় ভাঙতে খুব যে সময় লেগেছিল তা নয়, বরং কুহুরই মোহ ভেঙেছিল যেদিন ‘গীতবিতান’ এনে তার সামনে রেখেছিল শেখর। উপহার! চোখের দিকে তাকিয়ে কুহু বুঝেছিল, গম্ভীর ছেলেটা খুব অল্প সময়ে আটকা পড়েছে। কিন্তু এই উপহারে আগ্রহ ছিল না কুহুর। তার দুনিয়ার সাথে এই ছেলেটার দুনিয়া কত আলাদা বুঝে গিয়েছিল সে। আলাদাই তো! সুপর্ণা কোনোদিনও কুহুদের এই দুই কামরার টালির বাড়িতে আসেনি। সুপর্ণাদের বাড়ির সবকিছুই অন্যরকম, তিনতলার বিরাট পরিসর, লাইব্রেরি ঘর, মার্জিত রুচির বৈঠকখানা, শিক্ষা ও আভিজাত্যের অহংকারী ছাপ! সেখানে অতি অল্প সময়ে, আগের উপহারে পাওয়া পোশাকে দেখেই কুহুকে কী না কী ভেবে নিয়েছিল শেখর!

 

অতি দ্রুত জাল কেটে ফেলতে কুহু জানে। হঠাৎ উদাসীনতার মুখোশ এঁটে এড়িয়ে যাওয়ার প্রাচীন কৌশলে সরে এসেছে কুহু। অথচ শেখরকে আঘাত দেওয়া গেছে, কুহুর গায়ে লেগে থাকা পলকা কাচের অহংকারে টোকা লাগেনি এতটুকু। আসলে উপহার! উপহার! উপহারের বহর দেখেই কে যে ওকে বোঝে আর কার সাথে পোষাবে না, সবটা বুঝে যায় কুহু।

 

সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে সমীর অনেক বেটার। কুহু জানে, সমীর তার চাহিদা বোঝে। জিটি রোডের ধারে সমীরের বাবার বিশাল লজ, সাথে আরও কীসব বেনামি ব্যবসা, কাঁচা টাকার ওড়াউড়ি। সমীর নিজেও যাকে বলে ব্যায়ামবীর। বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করে, যদিও বিদ্যের দৌড় শেখরের মতো নয়, তবু কুহুকে তো উপহারে মুড়ে রাখে। সে নিজেও সমীরের চাহিদা বোঝে। কিন্তু এব্যাপারে তার ছুঁৎমার্গ আছে। কতটা আভাস দেবে আর কতটা খেলাবে, সে অনুপাতের হিসেব কুহু ভাল জানে।

 

এক কথায় কুহু অত্যন্ত আকর্ষণীয় শরীরের অধিকারী। স্কুলবেলা শেষের আগেই একথা ভাল করে বুঝে নিয়েছিল সে। তার কোমর ছাপিয়ে নেমে আসা চুল খুলে দিয়ে, গাঢ় কাজল টেনে, ঠোঁটে মেহগিনি বুলিয়ে এই যে একটু পরেই পরিপাটি হয়ে অভিসারে বেরোবে, কুহু জানে মোড়ের মাথার ছাত্র সমিতি ক্লাবের ছেলেরা তাকে কী বলে ডাকবে… ‘চাবুক’!

 

শ্যামলা রঙের জন্যে চাপা হীনমন্যতা রয়েছে কুহুর। কিন্তু উপযুক্ত প্রসাধনচর্চায় তাকে নিজের হাতিয়ার বানিয়ে ফেলতে পেরেছে সে। এখন আর কোনোকিছুতেই তেমন ডরায় না সে। পালকের মতো নির্ভার মন নিয়ে একেকটি বিকেলে বেরিয়ে পড়ে কুহু। সমীরের থেকে একেকটি মহার্ঘ্য উপহার নিয়ে ঘরে ফেরে। ষাট পাওয়ারের বাল্বের নিচে আধময়লা বিছানার চাদরে ছড়িয়ে সাজিয়ে রাখে উপহার। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।

 

‘আলো জ্বালিসনি’?

 

নিভার ডাকে ফিরে তাকায় কুহু। প্রায় ছায়ান্ধকার ঘরেও নিভার চোখ জ্বলে ওঠে। ছোটো বোনের ঈর্ষা টের পায় সে। আজ অনেক বছর ধরেই নিভাকে একারণে নিচু নজরে দেখে কুহু। চৌকি ও আয়নার কাছে ছড়িয়ে থাকা উপহাররাজি দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকায় নিভা, জিজ্ঞেস করে,

 

‘তুই বেরোবি’?

 

গলায় যেন ঠেস দেওয়ার সুর। মনে মনে হাসে কুহু। উপহার পেতে শুধু বরাত নয়, আরও কিছু একটা থাকতে হয়, একধরনের এক্স ফ্যাক্টর, সেটা সবার থাকে না। যেমন ফর্সা গোলগাল চেহারার নিভা সেই ব্যক্তিত্বের অধিকারী নয়। সে কি কুহুর দোষ! শান্তভাবে উত্তর দেয় সে,

 

‘বেরবো। ফিরতে রাত হবে। ঘরটা গুছিয়ে রাখিস’।

 

‘কোথায় যাচ্ছিস’?

 

তীব্র স্বরে প্রশ্ন শানায় নিভা। উত্তর দিতে ঠোঁট বেঁকে যায় কুহুর।

 

‘উত্তর চাওয়ার আগে উত্তর পাওয়ার যোগ্য হতে হয়, জানিস’?

 

ঠিক এই সময়গুলোয় জোঁকের মুখে নুন পড়বার অবস্থা হয়, কুহু জানে। ঘুরিয়ে উত্তর দেওয়ার মতো কথার চালিয়াতি নিভা শেখেনি। ওর ভোঁতা মস্তিষ্ক এই কথার আঘাত মেনে পাশ কাটিয়ে যায়।

 

‘যেখানে যাবি, মা’কে বলে যাবি। নিত্যদিন অশান্তি ঠেলতে ভাল লাগে না’!

 

হেসে ফেলে কুহু। হাসতে হাসতে বলে,

 

‘অন্যের ব্যাপারে যেচে ঢুকবি আর অশান্তি ঠেলবি না, তা হয়’?

 

খোঁচা খেয়ে আলো না জ্বালিয়ে পর্দা ঠেলে ছিটকে বেরিয়ে গেল নিভা। যেখানে ওর সমস্ত নালিশ, সেই মায়ের কাছেও খুব একটা জায়গা পাবে না, কুহু তা জানে।

 

একটু পরে বারান্দার ক্ষীণ আলোয় পা ছড়িয়ে দেয় মালতি। কোল থেকে নামিয়ে রাখে তামাকের কুলো। আঙুলে জড়ানো সুতো খুলে রাখে, কেটে রাখা তালপাতা জড়ো করে রাখে একপাশে। ক্লান্তির আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে দেখে, ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে এক দীর্ঘাঙ্গি মেয়ে। পরনে ময়ূরকণ্ঠী রঙের সিল্কের শাড়ি। খোলা চুল, কপালে টিপ, সঙ্গে মানানসই রঙের বাছা বাছা গয়না। ধাঁধা লেগে যায় মালতির। এ কি তারই মেয়ে? সমবায়তে বিড়ি বাঁধা শ্রমিক মালতির মেয়েই কি কুহু? বহুদিন হল বড়ো মেয়ের চোখের দিকে তাকাতে পারে না মালতি। আজও চেয়ে থাকার মধ্যে একটা ক্ষীণ ভীতুভাব ছিল। কুহু মুখ তুলে বলল,

 

‘কিছু বলবে’?

 

মালতি চোখ সরিয়ে নেয়, পা মুড়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কাঁধ ঝাঁকায় কুহু, তার হিলজুতোয় ঘোড়ার ক্ষুরের মতো শব্দ হয়। বেপরোয়া কুহু বেরিয়ে যায়। মালতি জানে, আজ কুহুর ফিরতে রাত হবে!

 

         

 

 

 

 

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে পা কেঁপে গেল নিলয়ের। অস্বাভাবিক! নিজেই অবাক হল সে। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। তবু হল। কিছুদিন ধরে এমনই হচ্ছে। মুহুর্মুহু চোরা বিস্ময়ের স্রোত ওলটপালট করে দিচ্ছে তাকে। বিগত কয়েকদিন তবু দূরত্বের আড়াল ছিল, নিজেকে কিছুটা সময় দিয়েছিল, আজ আর সেটুকুও নেই। তাই নিলয়ের পা কাঁপছে। আজন্ম চেনা বাড়ি, উঠোন, দোতলার সিঁড়ি, এখানে বুড়ো, ছোটকেদের সাথে খেলে বড় হয়েছে, তবু আজ মনে হচ্ছে তার ছাব্বিশ বছরের সুঠাম দেহকে উঠিয়ে দোতলায় পৌঁছতে পারবে না। পৌঁছনো উচিত নয়। একবার পিছনে ফিরে দেখল নিলয়। সিঁড়ির নিচে খোলা দরজার বাইরে উঠোন, সেখানে সন্ধের নীল অন্ধকার। কাছে কোথাও শাঁখ বেজে উঠল। একতলায় ভাড়াটেদের ঘরে মশলা ফোঁড়নের শব্দ হল, কোথাও রেডিও বাজছে, ক্ষীণ স্বরে ভেসে আসছে ‘সংবাদ’। একবার মনে হল ফিরে যাওয়া ভাল। রাস্তার কোনও টেলিফোন বুথ থেকে না আসার খবর জানিয়ে দিলেই হল। কিন্তু আবারও কী এক চোরাটানে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল। ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে আবার ফিরে যাওয়ার কথা ভাবল নিলয়। কিন্তু ঘরের আলোয় তার মুখ দেখা গেছে, সুলতা বেরিয়ে এসেছেন, তাঁর গলায় বিস্ময় মাখা আনন্দ,

 

‘নিলু যে! তা এত দেরি করতে হয়’?

 

ছোটোমাসির দিকে প্রায় ধরা পড়ে যাওয়ার মতো চোখে তাকাল নিলয়। আর ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। নিলয়ের মনে হল চোরাটান জিতে গেল। তার ভয় হল, চোরাটান জিতে যাবে।

 

সুলতা হাসিমুখে প্রায় উড়ে গেলেন উল্টোদিকের একটা পর্দাটানা ঘরে। খবর দিলেন,

 

‘শুনছিস? নিলু এসেছে। আয়’!

 

তারপর ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন, আলতো স্পীডে পাখা চালাতে চালাতে বললেন,

 

‘আর একটু দেরি হলে কাউকে দিয়ে খবর পাঠাতাম, কখন বেরিয়েছিস তা তো জানতাম না’!

 

সুলতার ব্যস্তসমস্ত কথার তোড়ে ক্যাম্বিসের ব্যাগটা আঁকড়ে সোফার কোণে কাঠ হয়ে বসে নিলয়। তার গুমরে থাকা মুখের বিপরীতে একটা ঘর, দরজায় পর্দাটানা। সেদিকে তাকিয়ে বুকের শব্দ টের পায় সে। এখনও মন বলছে, ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু উপায় নেই।

 

পরমুহূর্তেই পর্দা সরে গেল। গোলাপি কাফতানে বেরিয়ে এল এক মেয়ে। ডিম্বাকৃতি মুখের মধ্যে নজর কাড়ে ধনুকের মতো দুই ভ্রুর মধ্যিখানে ছোট্ট কালো টিপ। দুইদিকে সদ্য বাঁধা বিনুনি, সাদাটে ফর্সা মুখে একটা হীরের নাকফুল। আর বিশেষ কোনও রূপটান নেই। বুনি! কিছুদিন হল একটা ভাবনা কিছুতেই তাড়াতে পারেনি নিলয়। আজকাল বুনিকে বুনি বলে নয়, শুধুই একটা মেয়ে বলে ভাবতে ইচ্ছে করে তার। যতবার ইচ্ছে করে ততবার অপরাধের ভারে কুঁকড়ে যায় সে। মাথার ভিতরে অদ্ভুত যন্ত্রণা টের পায়। তবে সে জানে, কাটিয়ে উঠবেই। নিজেকে আরেকটু সময় দিলে এই চোরাবালি থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেবে সে। সেজন্যই এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে ফিরে যাওয়া উচিত তার। কিন্তু পথ আগলে দাঁড়াচ্ছে ওই গোলাপি কাফতানের মেয়ে।

 

কিশোরীলালের প্রথমপক্ষের স্ত্রী ছিলেন নিলয়ের ছোটোমাসি। কিন্তু গরিব ঘরের মেধাবী নিলয় আজন্ম এই দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রীকেই ছোটোমাসি মেনে এসেছে। কারণটা আর্থিক। কিশোরীলালের আজ্ঞাবহ ছিল তার বাবা মা। এখনও। কিন্তু অসম্ভব রূপবান, মেধাবী, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অধিকারী এই মুখচোরা ছেলেটিকে এবাড়ির সবাই তার নিজগুণেই ভালবাসে। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারার কৃতজ্ঞতাবোধ নিলয়েরও আছে। মেসোমশাই কিশোরীলালকে সে খুবই শ্রদ্ধা করে, সেইসাথে এতগুলো বছরে এই বাড়ির আপনজন হয়ে উঠেছে। নিজের ছোটোমাসিকে সে দেখেনি, মনে রাখার কারণও নেই।

 

কৌতুক মেশানো চোখে এগিয়ে এল বুনি। এই সন্ধেবেলাটায় বুড়ো দা, ছোটকে কেউ থাকে না। মেসোমশাইয়ের ফিরতে দেরি আছে। সুলতা চা করছেন। একলা সুযোগে আরও বেশি প্রগলভ বুনি। ভ্রূ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,

 

‘আজ এত দেরি? রাস্তা ভুলেছিলে বুঝি?’

 

বুনি যেন টের পেয়েছে, প্রশ্রয়ের আঘাতে আঘাতে একটা দরজা খুলে গেছে। নিলয় আরও কাঠ হয়ে যায়। পাঁজরে কেউ ক্রমাগত ধাক্কাচ্ছে, তবু গম্ভীর হয়ে বলে,

 

‘অন্য কাজও তো থাকে নাকি?’

 

ফিচেল হাসি হেসে ওঠে বুনি।

 

‘এত কাজ থাকলে সময় করে আসা কেন শুনি’?

 

পাঁচ বছরের ছোট মেয়েটার এমন সব প্রশ্নে দম বন্ধ লাগে নিলয়ের। গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে,

 

‘বুড়ো দা ডেকেছিল। নতুন দোকানের ট্রেড লাইসেন্সের কাজ করে দিতে। কাল সকালে সেরে বিকেলে ফিরে যাবো’।

 

মুখটা মেঘলা হয় বুনির। তারপরে ফিসফিসিয়ে বলে,

 

‘বড়দা ট্যুরে গেছে। চারদিনের আগে ফিরবে না’। আবার খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ে, হাসতে হাসতে ডানদিকের বিনুনি পিঠে ফেলে দেয়।

 

নিলয়ের টানা চোখ দুটোয় না চাইতেও হাসির ঝিলিক এসে পড়ে। প্রাণপণে চেপে রেখে বলে,

 

‘তবে যাই, বুড়ো দা থাকলে আসবো’।

 

রান্নাঘরের প্যাসেজের দিকে এক পা এক পা পিছতে পিছতে বুনি বলে যায়,

 

‘মা যেতে দিলে তো’!

 

কাফতানের গোলাপি রং চোখের আড়াল হতেই ফের ধন্দে পড়ে যায় নিলয়। কথার তোড়ে যেটুকু দমকা বাতাস বিনিময় হয়েছিল, তা মুহূর্তে সরে যায়। বিগত কয়েকদিনের দমচাপা ভাব ফিরে আসে। কেন সে এসেছে? এই মুহূর্তে এখানে কী তার কাজ? কাজ না থাকতেও কেন আসার জন্যে অজুহাত খাড়া করেছে সে? বুনি চোখের সামনে থাকলে আনুষঙ্গিক দুশ্চিন্তা সরে যায় কেন? হিসেব মতে বুনির সাথে কী তার সমীকরণ? সবশেষে একটাই ভয়ংকর প্রশ্ন মাথায় আসে নিলয়ের। যে প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে গিয়ে একটু আগের সিঁড়ির মতোই পা কাঁপে নিলয়ের। যেভাবে এতবছর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যেমনটা সে শিখেছে, বুনি কি তার মাসতুতো বোন?

 

নভেম্বরের সন্ধেয় ধোপদুরস্ত ঘরটায় অল্প জোরে পাখা ঘুরছে। তার মধ্যেই ঘাড়ে কপালে ঘামছে নিলয়। তার মনে হচ্ছে ওই গোলাপি রং, দুই বিনুনি, ওই কালো টিপ এঘরে ফেরার আগেই পালাতে হবে। এই চেনা বাড়িটা থেকে পালাতে হবে। নিলয়ের নিজের থেকে পালাতে হবে।

 

ক্রমশ...

Tuesday, October 5, 2021

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শারদীয়া সংখ্যা, উপন্যাস প্রথম পর্ব

 

                       তার হাতে মেঘ, অন্নজল 

                                                                    (ধারাবাহিক : প্রথম পর্ব)
                        

                                      অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

                                             

খুব ঠাণ্ডা, নরম মাটিতে পা রেখে কেঁপে উঠল নিমি আলগোছে শীত আসবার খবর যেমন হয় কালীবেদির ঠাকুর ভাসান গেল গত সপ্তাহে এখন কার্তিক মাসের হিমভোরে মিটার ঘরের ভেজা রাস্তাটা বেমালুম ধোঁয়া হয়ে গেছে সেখানে দাঁড়িয়ে নিমির গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে রংজ্বলা ধুলোটে কালো ওড়নাটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে এদিক ওদিক তাকায় সে ঘন সাদা কুয়াশার ভিতর বুড়োদাদাদের বাড়িটা, তুতানদের উঠোনখানা লোপাট হয়ে আছে দুহাত দূরের জিনিসও স্পষ্ট দেখা যায় না নিমির খুব ইচ্ছে করে এই নকল মেঘের রাজ্যটাকেই এলোমেলো কেটে ফেলতে ওর মনে হয় এর ভিতরে একবার ঢুকলে হয়তো আর বেরোবার উপায় থাকে না! এর ভিতরে আর সকাল হয় না, রোদ ওঠে না, রুপাইদের টিউবওয়েলের ঘন ঘন ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ বাড়ে না, সুশানকাকা  দোকান খোলে না! এই ধোঁয়ার ভিতর শুধুমাত্র জেগে থাকে রায়বাড়ির বাগানটা রায়বাড়ির পিছনের পাড়ায় পুকুরধারের ঘেরা বাগানটাকে নিমি সবচেয়ে বেশি ভয় পায়

রায়দের বাগানের খুব দুর্নাম এই পাড়ায় ওদের বিশালাকায় চারতলা উঠোন-বাড়ির পিছনে যে একটেরে রাস্তাটা এগিয়ে গেছে মান্নাপাড়ার দিকে, সেই রাস্তার গায়ে পুকুরধারে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা নিরীহ ফুলের বাগানই ছিল সেটা তবে সেই যে বছর তিরিশ আগে কিশোরীলালের প্রথমপক্ষের বউটার লাশ মিলল বাগানে, সেদিন থেকে পাড়া-বেপাড়ায় মুখে মুখে ভয় রটে গেল বেশ 

লোকে বলে কিশোরীলালের প্রথমপক্ষ ছিল ভারী সুন্দরী ফর্সা আঁটসাঁট গড়নে সবচেয়ে বেশি চোখ টানত তার কোমর ছাপানো একঢাল কালো চুল খুব লক্ষ্মীমন্ত আর মিশুকে ছিল নাকি সে তখনও তার গা দিয়ে নতুন বউয়ের গন্ধ যায়নি, বড়ছেলে বুড়োর বয়স এক-দেড় বছর হবে, একদিন কাকভোরে রায়বাগানে ফুল তুলতে গিয়ে পায়ে বেলকাঁটা ফুটে মরে পড়ে রইল এরপর কিশোরীলালের জ্যাঠতুতো দাদা বিজন রায়ের বাগানে শোকের বশে একটিবছর কালো গ্রিলের গেটে তালা পড়ে গেল সেবছরে তো ভয়ের চোটে বেশি রাতে বাগানের পাশ দিয়েও যেত না কেউ অনেকেই নাকি লাল ডুরে শাড়ি পরা, কোমর ছাপানো খোলা চুলে কিশোরীলালের বউকে বাগানে ফুল তুলতে দেখেছে তারপর বাৎসরিক কাজ মিটে গেলে একদিন অপঘাতে মরা বউটার জন্য দুই রায়বাড়িই শোক ভুলে গেল বাগানের আগাছা কেটে ফের যত্নআত্তি শুরু করলেন বিজন রায় তার দুমাসের মাথায় দ্বিতীয়পক্ষের বউ আনল কিশোরীলাল পাড়ার মা-কাকিমাদের মুখে মুখে এখনও এসব গল্প ঘুরে বেড়ায়

ধোঁয়াটে সাদা রাস্তা পেরিয়ে জং ধরা কালো গ্রিলের গেটটার দিকে এগিয়ে গেল নিমি বাদামি কামিজের ভিতর রোগা শরীরটা বাকল তোলা গাছের মতো দেখতে লাগে শীত আটকাতে ওড়নাটা ফের গায়ে টেনে নিয়ে আঠালো লালচে চুলগুলো পিঠে ফেলে দেয় সে গ্রিলের তালা খোলা তার মানে কিছু আগেই ফুলের সাজি নিয়ে ভিতরে ঢুকেছে বিজন জ্যেঠু এখন এই সাজিভর্তি ফুল নিয়ে জেঠিমার চারতলার পুজোর ঘরে পৌঁছে দেওয়াই নিমির সকালবেলাকার প্রথম কাজ

বেশ শব্দ করেই গ্রিল খোলে নিমি ঘুম জড়ানো মফস্বলি গলিটার নিস্তব্ধতা মুহূর্তে ছিঁড়েকেটে যায় চমকে তাকান বিজন রায় তামাটে গায়ের রঙে কাটা কাটা চোখ মুখ, মাকন্দ গাল, লম্বা দোহারা চেহারার বছর বাষট্টির বিজন রায় তখন ফুল শার্ট আর নীল চেক কাটা লুঙ্গি পরে, গলায়-কানে মাফলার জড়িয়ে নতুন লাগানো ডালিয়ার পরিচর্যায় ব্যস্ত ছিলেন নিমিকে দেখে বিরক্তিভরে বললেন, “হাতমুখ ধুয়ে এসেছিস?”

সম্মতিক্রমে ডানপাশে মাথা হেলিয়ে দেয় নিমি

খুরপি দিয়ে মাটি তুলতে তুলতে ফের বিজন রায়ের প্রশ্ন, “ধোয়া জামা তো?”

এবার নিমি ভ্রু কোঁচকায়, বলেহ্যাঁ গো হ্যাঁ এবার তাড়াতাড়ি সাজি ভরে দাও দিকিনি, দেরি হলে জেঠিমা রাগ করে খুব

মুখ তুলে চোখ সরু করে তাকান বিজন রায় বলেন, “অত তাড়া কিসের অ্যাঁ? তোর জেঠিমা কখন পুজোয় বসে আমি জানিনা নাকি? যা, ঝুমকোজবা গাছটার নীচে সাজিটা আছে, নিয়ে আয়   

ভারী ক্লান্ত, অনিচ্ছাকৃত পায়ে ঝুমকোজবা গাছটার দিকে হাঁটতে থাকে নিমি বাগানটা ঘেরা হলেও খুব একটা সাজানো নয় পায়ে চলার পথ জুড়ে বড় বড় ঘাস জেগে থাকে বছরভর তিন চারটে আম, পেয়ারার গাছ সমেত রয়েছে টগর, গন্ধরাজ, স্থলপদ্ম, নয়নতারা আর শিউলি ফুলের গাছ বাগানের মধ্যিখানের কিছুটা অংশে শীতের শুরু থেকে বড় বড় বিষ্ণুপুরী টবে ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, আর গাঁদা ফুলের গাছ লাগান বিজন রায় জবা আর ঝুমকোজবার গাছ তিনটে বাগানের ভিতরে একেবারে শেষপ্রান্তে পাঁচিলখানা না থাকলে প্রায় পুকুরের গায়ে সেদিকে যেতে নিমি একযুগ কাটিয়ে দেয়

সোনার মতো চকচকে পিতলের সাজিটা অর্ধেকও ভরেনি, অবহেলায় পড়ে আছে ঝুমকোজবা গাছটার নীচে সেটা তুলে নিতে গিয়ে নিমির এক উদ্ভট ইচ্ছে হয় সামনের শক্ত প্রতিরোধ এই ছ্যাতা পড়া শ্যাওলা ধরা দেওয়ালটা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে হয় তার উঁচু পাঁচিল ভেঙে পুকুরের জলে মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় খুব তাড়াতাড়ি সাজি তুলে ফিরতে চাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেই কাঁধে শক্ত হাতের পাঞ্জা টের পায় নিমি

পালানোর উপায় নেই আজকাল কোনও ভোরেই উপায় থাকে না, নিমি তা জানে বিজন রায়ের চুনি, পান্নার আংটিশোভিত শক্ত হাতের থাবা কাঁধ থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসছে নিমির পিঠে রোজকার মতোই মুখ বিকৃত হয়ে যায় তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে সরাতে চেষ্টা করে সে ফুলের সাজি চেপে ধরে ছুটে পালাতে গেলে নিমির কোমরে বেড় পড়ে যায় হাতের গলার কাছে চেপে বসে আরেকটা শক্তিশালী হাত সবটা নিমির জানা, দাঁড়ি-কমা সমেত মুখস্থ নাড়ি উল্টে আসা বমির মতো এক শরীর ঘেন্না নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কাঁপতে থাকে সে

নিমি জানে, এইসময়েই ঘন কুয়াশা ঘনতর হয় বাগানে চারপাশের শীত আচমকা বেড়ে যায় খুব ছাইরঙা ভোর যেন ফের সেঁধিয়ে যেতে চায় অন্ধকারের পেটে যন্ত্রণায় চোখ বুজে ফেলার আগে নিমি দ্যাখে, বাগানের পশ্চিম কোণে স্পষ্ট এসে দাঁড়ায় সে তার গায়ে সাদা কুয়াশার শাড়ি, কোমর পেরোনো চুল খুলে দিয়ে চোখের সামনে অন্ধকার নামিয়ে আনে সে

মিনিটদশেক পরে ছাড়া পেয়ে ছুটতে গিয়ে নিমি টের পায়, সকালবেলার রোদ উঠছে বাগানে

সকালবেলার প্রথম রোদের সাথে জেগে উঠেছে রায়বাড়ির উঠোন একতলার ভাড়াটিয়া শর্মার বউ শান বাঁধানো উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে কলতলার বালতি ছাপিয়ে উপচে পড়ছে জল সেদিকে তাকিয়ে কোণের ঘরের শোভাদিদি বলে ওঠে, “এই নিমি, ভরা বালতিটা সরিয়ে খালিটা রেখে যা না মা আমি তুলে নেব একটু পর 

এহেন অনুরোধে ঝাঁঝিয়ে উঠতে গিয়েও পারে না নিমি হয়তো অনুরোধকারিণী শোভাদিদি বলেই পারে না বড় ক্ষীণ, ক্লান্ত স্বরে বলে, “হাতে ফুল রয়েছে গো পারবো না তারপর আর কথা না বাড়িয়ে কলতলার লাগোয়া বারান্দায় উঠে সিঁড়ির দিকে এগোয় পুরনো দিনের খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে হাঁটুর উপরে উরুর কাছে ব্যথাটা আবার টের পায় নিমি

দোতলার ছোট ছাদটা পেরিয়ে স্নানে যাচ্ছিলেন রায়গিন্নী হৈমন্তী গোলগাল পৃথুলা চেহারা, টুকটুকে রং, পান চিবোনো গাঢ় লাল ঠোঁট আর কপালে ধ্যাবড়ানো সিঁদুরের টিপ পরা এই মানুষটিকে রায়বাড়ির ভাড়াটিয়া থেকে শুরু করে, চার ছেলেমেয়ে সমেত বিজন রায় পর্যন্ত বেশ সমঝে চলেন নিমিকে সাজি হাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি ঠাণ্ডা চোখে প্রশ্ন করলেন, “এককুচি ফুল তুলে আনতে কত সময় লাগে রে মেয়ে?”

দেরি কোথায় দেখলে? এখনও তো স্নান হয়নি তোমার!” পাল্টা আক্রমণ শানায় নিমি তারপর আলগা পায়ে তিনতলায় উঠতে থাকে সে

সকাল সকাল হাঁটুর বয়সি মেয়ের সাথে ঝগড়া করতে মন চায় না রায়গিন্নির তিনি শুধু চোয়াল শক্ত করে নিমির সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওড়নায় লেগে থাকা আধভেজা মাটি চোখে পড়ে তাঁর আশ্চর্য! পড়ে টড়ে গিয়েছিল নাকি! যা হুটোপাটি স্বভাবের মেয়ে! হাতে পায়ে লক্ষ্মী একেবারে! পরে বেশ করে শাসন করে দেওয়া যাবে ভেবে স্নানঘরের দিকে এগিয়ে যান হৈমন্তী

চারতলার ছাদে ঠাকুরঘরের সদ্য বাঁধানো চকমিলানো মেঝেতে ফুলের সাজি রেখে ক্লান্তিতে বসে পড়ল নিমি সোনালি রোদ্দুরের নরম রেখা তীরের ফলার মতো জানালা দিয়ে নেমে এসেছে মেঝেতে রোদের রেখায় অগুনতি ধুলোর ওড়াউড়ি সেদিকে তাকিয়ে ছোঁয়াছুয়ির ভয় না পেয়ে দেওয়ালে মাথা এলিয়ে দেয় সে শরীরটা বড় ক্লান্ত লাগছে অদম্য এক কান্না জমছে ভিতরে উপায় থাকলে এখুনি পালাতো সে কিন্তু উপায় নেই! কোনও উপায় নেই!  

এখান থেকে অনেক দূরে নলহাটির কোন গ্রাম থেকে মা নিয়ে এসেছিল তাকে এবাড়িতেই থাকা খাওয়া পেয়ে কাজ করত মা বছর তিনেক আগে মা চলে গেল কয়েকদিনের জ্বরে তারপর থেকে জেঠিমা রায়গিন্নিই রেখে দিয়েছেন নিমিকে শুনেছে সেই যে দূরের নলহাটির গ্রামে ওর বাবা নাকি আবার বিয়ে করেছে, ওর একটা ছোট ভাইও হয়েছে শুধু ওকে আর ফেরাতে চায়নি কেউ এসব কথা ভাবলেও নিমির চোখ শুকনো, খটখটে বছর তেরোর নিমি শুধু ভাবে, কাল আবারও ভোর হবে কুয়াশা জমবে কাল আবারও বাগানে ফুল তুলতে যাবে সে এই পাড়াটায় কেন এত দেরিতে রোদ ওঠে! পাড়াটায় কেন সবার এত দেরিতে ঘুম ভাঙে!   

 

                              

রাস্তা চিনতে পারাটাই আসল মগজের ভিতর বয়ে বেড়ানো আজন্ম চেনা যে মানচিত্র, তা সঠিকভাবে চিনে চিনে ঘরে ফিরতে পারাটাই বড় কথা বাবার বলা এই কথা দুটো অনেককিছুর মতোই এখনও ভুলে যায়নি রূপম আজ সকাল থেকেই বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে কথাটা তাজা রোদের গায়ে শীত শীতভাব এখন অনেকটা কম এতদিন শুনে এসেছে, রেলস্টেশন থেকে দশ-বারো মিনিটের হাঁটাপথ আজকাল রূপমের নিজস্ব সময় আন্দাজ মাঝেমধ্যেই গুলিয়ে যায় তবু মাথাটা স্থির রেখে এগোতে হবে তাকে  

এতক্ষণ বেশ চিন্তা হচ্ছিল তার যদি ঠিকঠাক চিনতে না পারে! তখন তো ঘুরে বেড়ানোই সার! ঠিক রাস্তাটা খুঁজে পৌঁছতেই হবে তাকে একবার পৌঁছতে পারলেই নিশ্চিন্তি খুব সাবধানে, মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভেবে রাখা রাস্তায় এগিয়ে গিয়েছে রূপম পথচলতি অনেককেই জিজ্ঞাসা করে নিতে চেয়েও করেনি কারণ সেটা করতে গেলে সে নিজের কাছে নিজেই হেরে যাবে হারলে চলবে না এতটা যখন পেরেছে, আরও একটু সে ঠিক পারবে

রাজেশ্বরীতলার কাছে এসে বেশ খানিকটা স্বস্তি পেল রূপম চেনা চাতাল, চেনা মাঠ এতক্ষণ শুধু শুধু দুশ্চিন্তায় পড়েছিল সে এখনও সবটা ভুলে যায়নি এখনও তবে অনেকটা বাকি রয়ে গেছে, ভেবে চোরা আত্মপ্রসাদ লাভ করে সে  

রাজেশ্বরিতলার মাঠ ছাড়িয়ে ঘোষালবাড়ির ঠাকুরদালান স্পষ্ট দেখা যায় ঘোষালবাড়ির পাশের সবুজ ঢিপি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরে মান্নাপাড়া যাওয়ার পথে পড়ে রায়বাগানের গলি সে গলির বাঁ কোণ ঘেঁষা হলুদ রঙের দোতলা বাড়িটার গেটে এসে দাঁড়ায় রূপম হাটখোলা গেটটার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একমনে সকাল দেখে সে

কিশোরীলাল রায়ের উঠোনখানা শুকনো মাটির মূল গেটের পাশ দিয়ে ঈষৎ বাঁক নিয়ে সোজা উঠে গেছে মোটা গুঁড়ির নারকেলগাছটা আলগা শীতল হাওয়ায় পাতাগুলি ঝিরঝির করে দুলছে খানিক দূরে কোথাও একটা ঘুঘু পাখি ডাকছে একটানা ঢিমেতালে বেলা বাড়ছে একটু একটু করে উঠোনের ধারে কলঘর থেকে স্নান সেরে বড় শান্ত মনে ভেজা শাড়ি মেলতে এগিয়ে আসছিলেন অনিমা তড়িঘড়িতেও অজান্তেই গুনগুন করছিলেন বহু এলোমেলো একটা সুর হঠাৎ তাল কাটল তাঁর ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন তিনি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে রূপম! তার চুল বড় হয়ে ঘাড় অব্দি নেমে এসেছে, ফর্সা মুখটায় দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল চেহারাটা একটু ভারী হয়েছে নস্যি রঙের ফুল প্যান্ট আর ছাই ছাই জামার গায়ে জড়ানো অনিমারই একটি বহু পুরনো রোঁয়া ওঠা কালো শাল কাপড়ের ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে তাঁর দিকে তাকিয়ে স্বল্প পরিচিতের মতো হাসছে বড়ো ছেলে রূপম!

আজ প্রায় সাত-আট মাস পর রূপমকে দেখলেন অনিমা শেষবার যখন দেখেছিলেন তখন ঘুমের অতলে তলিয়ে ছিল সে আজ এমনভাবে চোখের সামনে এগিয়ে এসে বারান্দায় উঠে ঘরে ঢুকল যে তাকে দেখে আনন্দে বুকের ভিতরটা ঈষৎ দুলে উঠল তাঁর আবার পরমুহূর্তেই সম্ভাব্য কারণগুলো ভেবে ভ্রু কুঁচকে গেল অনিমার খুব সাবধানে কথা বলতে হবে তাঁকে চোখ তুলে খুব সাবধানে দোতলাটা দেখে নিলেন একবার বাড়িওয়ালা কিশোরীলাল জানতে পারলে এখুনি এসে দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে যাবে আর করবে নাই বা কেন! কম অত্যাচার তো করে যায়নি রূপম! তাই হঠাৎ খুশির ভাব কাটিয়ে তেতোমুখে ঘরে ঢুকলেন তিনি

নীচতলার এই ঘরটা বড় অনিমার বিয়ের পালঙ্কটা বাদ দিলেও আলাদা একটা ক্যাম্পখাট পাতা আছে বইখাতার চেয়ার টেবিল, আলমারি, আলনা আর চেরাই কাঠের শোকেসটা বাদ দিয়েও পাত পেড়ে বসার জন্যে মেঝেয় খানিক জায়গা বাঁচে রান্নার খুপরিটা নীচতলার বারান্দার একপাশে এটুকুরই ভাড়া এখন দাঁড়িয়েছে চারশো আগামী বছর আরও বাড়াবে বলেও রেখেছে কিন্তু সেটা এখনই চিন্তার বিষয় নয় অনিমার কাছে এই মুহূর্তে আরও বড় চিন্তার বিষয় উপস্থিত বড় পালঙ্কে কাপড়ের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে ক্যাম্পখাটেই লম্বা হয়েছে রূপম দুটো হাত বুকের কাছে জড়ো করে, পায়ের উপর পা রেখে বেশ আরামের ভঙ্গিতে চুনকাম করা সিলিঙের দিকে চেয়ে রয়েছে সে দেখে কর্কশস্বরে তেড়ে আসেন অনিমা বলে উঠলেন, “তুই এখন! কীকরে এলি?”  

সিলিং থেকে চোখ না সরিয়েই খুব নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে রূপম বলল, “ছেড়ে দিল

এবার মেজাজ হারান অনিমা চোখ পাকিয়ে হিসহিসে স্বরে বললেন, “ছেড়ে দিল? বোকা পেয়েছিস আমায়? সত্যি করে বল! পালিয়ে এসেছিস তো?”

অনিমার চেয়ে উঁচু তারে দাঁত খিচিয়ে রূপম বলল, “আঃ! জ্বালিও না তো! ভালো হয়েছি তাই ছেড়ে দিল তারপর ধীরে ধীরে চোখ বুজে ফেলে সে

আসন্ন অশান্তির চিন্তায় বুক ভার হয়ে আসে অনিমার এখনও বাড়িতে কেউ জানে না কেউ দেখেছে কি না তাও জানেন না রবিন বাজারে গেছে ফিরে এসে দেখলে কী হবে ভাবতে পারছেন না বাড়িওয়ালাও জবাব দিতে ছাড়বে না তখন আর হবেই তো! গতবছর যাওয়ার আগে অত্যাচারের শেষ করেছিল রূপম কাউকে মানত না এখনও এই একা ঘরে বেশি কিছু বলতে যাওয়া ঠিক হবে না এই ছেলেকে বেশি ঘাঁটাতে গেলে তাঁর দিকেই তেড়ে আসবে ভাবতে ভাবতে কপালের রগে হাত রেখে বসে পড়েন অনিমা তবু আত্মজর মুখ থেকে চোখ সরান না

খুব কায়দা করে জিভের নীচে যেটা রেখে দিয়েছিল রূপম, সেই ছোট্ট গোলাপি ট্যাবলেটটা একটা টিপের মতো চোখের সামনে ভাসছে এখন তারপর বেলাদি পাশের বেডে এগিয়ে যেতেই মুখ থেকে বের করে একনিমেষে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলেছিল সে কাল রাতটা ঘুমিয়ে পড়লে কিছুতেই চলত না তার বেশ কয়েকদিনের চেষ্টায় কায়দাটা রপ্ত হতেই একা একা খুব একচোট হেসেছিল রূপম এরা সব মনের কারবারি, আর মন বুঝতে পারে না! মজা লেগেছিল বেশ আগে মুখ থেকে বের করে ছোট্ট ট্যাবলেটটাও খাটের নিচের ঝুড়িতে ফেলত না সে সাবধানের মার নেই! তারপর রেললাইনের ধারে ওই সাহেবি ধাঁচের বাংলোতে আঁটঘাট জেনেছে অল্প অল্প করে বেশ কয়েকটা রাত জেগেই কাটিয়েছে ফার্স্ট ট্রেনের সময় মুখস্থ করেছে ঠিক কখন রামেশ্বর ওই লজঝড়ে মেন দরজায় বেহুঁশের মতো ঘুমোয়, নিচু পাঁচিল ঠিক কোথায় কোথায় ভাঙা পড়ে আছে, সবটা জেনেছে একটু একটু করে রেলস্টেশনের গায়েই ছিল পানাপুকুর আর একটুকরো খোলা জমিসমেত ওই সরকারি মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র চারদিকে কলাবাগান দিয়ে ঘেরা গার্ড ওয়ালের ব্যবস্থাও তথৈবচ বলতে গেলে ওই ঘিরে থাকা কলাবাগানটাই রেলের জানলায় কৌতূহলী মুখগুলো থেকে বাংলোর বাসিন্দাদের একটু আড়াল দেওয়ার চেষ্টা করে যায় অনুদান আসে না প্রায়ই বন্ধ হয়ে যাওয়ার হুমকিতে দুজন নার্স আর তিনজন মেডিক্যাল স্টাফ নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে চলে বহু পুরনো ওই সাহেবি বাংলো

একতলা ওই বাড়িটায় রূপমের নাম ছিলসাত নম্বর প্রথম প্রথম ঘুমের মধ্যে ডুবে থাকত ঘুম ভাঙলে একটু জলের মতো পানসে খাবার আর ওষুধ ফের হাত-পা শিথিল হয়ে আসতো মাথা ফাঁকা হয়ে পালকের মতো হালকা শরীর উড়ে যেতে চাইত যেন সবুজ চাদর খামচে ধরে ফের কুঁকড়ে ঘুমিয়ে পড়ত রূপম

আজ দুতিন মাস সেই অবস্থা পাল্টেছে আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ এখন সে আগের মতোই একটু আধটু খবরের কাগজ পড়ে বাড়ির কথা মনে পড়ে চোখ বুজলে বাড়ির গলি মানচিত্রের মতো চোখের সামনে আঁকে স্কুলজীবনের মহারাজজী বা মৃত বাবার মুখ, সবটা এখন চোখে ভাসে রাগের পারা বেশ অনেকটা কমে এসেছে ডাক্তারদা এলে মাঝেমধ্যেই খোশগল্প জুড়ে দেয় তাঁর কাছে নানানরকম বই চায় কখনো চায় অলীক মানুষ’, কখনোতিথিডোরএনে দিতে বিশেষ করে বলে রাখে বই আর আসে না অপেক্ষা করে করে হেজে যায় ডাক্তারদার সময় কম হাজারটা জায়গায় ঘোরে প্রায়ই রূপমের কথা ভুলে যায় রূপম বারবার মনে করিয়ে দেয়

তবে আজ কিন্তু বেশ মনে করেই বই আর খবরের কাগজের পাহাড় এনেছে ডাক্তারদা সেটা কি রূপম শেষ রাতে কাউকে কিছু না বলে ট্রেনে চেপে বাড়ি চলে এসেছে বলে? তা জানে না সে কিন্তু এই যে খোঁজ না পেয়েই ডাক্তারদা এত দূর এসেছে দেখা করতে, সেটা ভালো লাগছে তার টেবিলের গায়ে রাখা চেয়ারটায় বসেছে ডাক্তারদা রূপমকে প্রশ্ন করছে, “চলে এলি কেন?”

রূপম হাসিমুখে বলে, “ভালো হয়ে গেছি, তাই

ডাক্তারদা প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে বলে, “তোর বইপত্তর কাগজের কী হবে তাহলে?”

রূপম পাশ ফিরে শুয়ে বলে, “ওসব রেখে যাও, পড়ব

ডাক্তারদা স্বভাবতই স্মিত হেসে বলল, “এখন বাড়ি ফিরেছিস, এসব নিয়ে পড়ে থাকার সময় হবে তোর?”

দুই হাতের পাঞ্জা মাথার পিছনে রেখে চিন্তামুক্ত ভঙ্গিতে রূপম বলে, “এখন আমার হাতে শুধু সময় আর সময়! সব পড়ে ফেলব

ভীষণ শব্দ করে চেয়ার সরিয়ে ক্যাম্প খাটটার দিকে এগিয়ে এল ডাক্তারদা তারপর রূপমের দিকে ঝুঁকে বলল, “তুই যে এভাবে পালালি, কত ক্ষতি হল আমাদের, কত বদনাম হল আমাদের! সে খেয়াল আছে?”

বলতে বলতে চোখ মুখ হিংস্র হয়ে উঠল ডাক্তারদার কলার ধরে একঝটকায় রূপমের মাথাটা তুলে এনে বলল, “বল শালা, এভাবে আসতে কে বলেছে তোকে? শান্তি দিবি না আমাদের? পালানো হয়েছে! পাগলের বাচ্চার আবার পালানো হয়েছে!”

চটকা ভেঙে ডাক্তারদার জায়গায় রবিনকে দেখে কয়েক মুহূর্ত হকচকিয়ে গেল রূপম কলার টেনে ধরে উঠিয়ে চোখ মুখ বিকৃত করে চিলচিৎকার করছে রবিন মা ওকে ছাড়াতে পারছে না ঘরের দরজা দিয়ে পর্দা সরিয়ে উঁকি মারছে বাড়িওয়ালার ছোট ছেলে ছোটকা আর মেয়ে বুনি আচমকা মাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল রবিন আলনার গায়ে গিয়ে পড়লেন অনিমা তারপর রূপমকে হিড়হিড় করে টানতে লাগলো দরজার দিকে

সবটা বুঝে উঠতে একটু সময় লেগে যায় রূপমের তারপর আচমকা গা ঝাড়া দিয়ে উঠল সে এক ধাক্কায় রবিনকে মেঝেয় ফেলে দিল সে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না মাথার ভিতর একশ-হাজার সূচ ফুটছে যেন যেকোনো মুহূর্তে কপালের শিরা ফেটে যেতে পারে তার দানবের মতো চেঁচিয়ে উঠল রূপম, “বেশ করেছি রে শুয়োরের বাচ্চা তোর একার ঘর? তোর একার মা? আরেকবার গায়ে হাত দিবি তো খুন করে পুঁতে ফেলব তোকে!”

মারের প্রথম অভিঘাত সামলে উঠে তেড়ে এল রবিন মুহুর্মুহু ঘুষি আছড়ে পড়লো রূপমের মুখে, বুকে ছোটকা এসে তড়িঘড়ি রূপমকে বারান্দায় সরিয়ে নিয়ে যেতে চায় অনিমা কাঁদতে কাঁদতে মিনতি করে বলতে থাকেন, “ছেড়ে দে, ওরে ছেড়ে দে, বড় ভাই হয় ওর মাথার ঠিক নেই, ওকে ছেড়ে দে

একধমকে ঝাঁঝিয়ে ওঠে রবিন, মায়ের দিকে চোখ পাকিয়ে বলে ওঠে, “তুমি থামো! অত দরদ থাকলে আদরের ছেলেকে নিয়ে রাস্তায় থাকো!” তারপর ধড়াম শব্দে দরজা বন্ধ করে ছোটকাকে ছাড়িয়ে ফের দুমাদুম করে দরজায় এলোপাথাড়ি লাথি মারতে থাকে রূপম এই সময়ে দোতলা থেকে নেমে আসেন বাড়িওয়ালা কিশোরীলাল চুপ করে শান্ত হাতে রূপমের ঘাড় চেপে ধরে টানতে টানতে উঠোন পেরিয়ে মেন দরজার দিকে নিয়ে যান হ্যাঁচড়প্যাঁচড় করে তীব্র ছটফট করতে থাকে রূপম তবু ছাড়াতে পারে না সেই হাত অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে সে ঘাড়ের উপর কেটে বসে যাওয়া শক্ত হাতটা তবু ছাড়েন না কিশোরীলাল মেন দরজার বাইরে ইটের রাস্তায় রূপমকে  ঠেলে দিয়ে তেমনি শান্ত মুখে কালো কাঠের ভারী দরজাটা বন্ধ করে দিলেন কিশোরীলাল

সময় খুবই আজব একটি ব্যাপার অনেকটা জাদুর মতো খুবই অল্প কিছু সময়ের পার্থক্যে আবার আগের রূপে ফিরে গেলভালহয়ে যাওয়া রূপম তার গায়ে অসুরের শক্তি বোধ করে সে মাথাটা অসহ্য রাগে ফেটে পড়তে চায় কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র ঘুরে দাঁড়িয়ে কিশোরীলালের উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য ভাষায় চিৎকার করে ওঠে রূপম আর ঠিক তখুনি তার চোখ পড়ে বাঁ পাশে মিতুনদের বাড়ির ছাদে রেলিং ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে মিতুনের বোন মলি তার কপালে মিতুনের মতোই গোলাপি একটা টিপ   

 

                                

ছায়ারোদ্দুর মেঝেতে পিঠ এলিয়ে বসে ঘুম ঘুম পেল রুপাইয়ের চোখের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে তার ভাঙা সংসার মাটির হাঁড়ির কানা ভেঙেছে কড়াইটা দুভাগ হয়েছে থালা, বাটি যা ছিল সব ওলটপালট হয়ে আছে একপাশে মুণ্ডু ছিঁড়ে, হাত খুলে উল্টে পড়ে আছে মুন্নি এই ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে আরো একবার ফুঁপিয়ে ওঠে রুপাই এতক্ষণ ধরে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলের শুকনো রেখায় চামড়া টানছে তার

একটু আগেই মা উদোম পিটিয়েছে সাথে তার সাজানো সংসারটাও রাগের মাথায় ভেঙে দিয়ে গেছে এখন খুড়তুতো ভাই রাজু এসে রুপাইয়ের ফ্রকের খোলা বেল্ট ধরে টানছে একঝটকায় তিনবছরের ভাইটার হাত সরিয়ে দেয় সে তারপর ঘরের দেওয়ালে মুখ ফিরিয়ে গোঁজ হয়ে বসে থাকে ঘরের উল্টো কোণে বড় চৌকিটা থেকে একটাউঃ, আঃশব্দ ভেসে আসছে শব্দটা খুবই ক্ষীণ তবুও রুপাই জানে, রিনাপিসি এখন গোঙাচ্ছে রিনাপিসির এখন ব্যথা হচ্ছে ভাঙা সংসারের শোক ভুলে চকিতে সেদিকে মুখ তুলে তাকায় রুপাই

রাজু এই আলো আঁধারি ঘরে খুব একটা ঢোকে না আজ শুধু তার দুঃখী দিদিভাইয়ের খোঁজে এসেছিল পিসির আওয়াজ পেয়ে ভয়ে একছুটে পালিয়ে গেল কিন্তু পিসি আবার গোঙাচ্ছে কেন! দাদুকে একবার ডাকবে কি! ভেবে পায় না রুপাই গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় চৌকির দিকে এদিকটায় বড় একটা রোদ ঢোকে না পিসির মুখটা অন্ধকার হাত, পা গুলো ভীষণ রোগা সেই হাতে একটা করে সাদা আর লাল চুড়ি পরে থাকে পিসি মায়ের মতো, কাকিমার মতো পিসির গাল দুটো ভাঙা মাটির কড়াইটার মতো মাথাটা কেমন বড় হয়ে গেছে অনেক বড়ো অসুখ করেছে তাই রুপাই জানে সবাই রুপাইকে ছোট ভাবলেও সে আর ছোট নেই সে জানে, কানাঘুষো শুনেছে, রিনা পিসির এমন অসুখ করেছে বলেই তো পিসেমশাই আর এবাড়িতে আসে না দাদাভাইকেও আসতে দেয় না বাবা, কাকা, এমনকি মাও বারণ করেছিল দাদুকে তবু দাদু কারোর কথা শোনেনি সবার সাথে ঝগড়া করে পিসিকে এনে রেখে দিয়েছে সারাদিন সেবা করে

ওই ভেঙে যাওয়া গালদুটোয় খুব নরমভাবে ছোট্ট দুটো হাত রাখল রুপাই তারপর ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল, “পিসিমনি, পিসিমনি, তোমার কষ্ট হচ্ছে?”

আধো ঘুমের মতো আধবোজা চোখ দিয়ে জাগল রিনা বলল, “উঁ? রুপাই?”

রুপাই বলল, “হ্যাঁ গো, তোমার কষ্ট হচ্ছে?”

আধবোজা চোখে মাথা নাড়ল রিনা, বললএই একটু মা

পিসির কষ্ট হচ্ছে শুনলে একজনকেই ভরসা করে রুপাই তড়িঘড়ি বলল, “তোমার কোথায় ব্যথা হচ্ছে? দাদুকে ডেকে আনব?”

যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসা গলায় রিনা বলে, “না মা দাদুকে ডেকো না একটু ব্যথা, এখুনি সেরে যাবে

এখুনি সেরে যাওয়ার কথাটা রুপাই ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না তো অনেক বড় অসুখ এখুনি এখুনি সারবে কীকরে! তবু দাদুকেও ডাকে না সে বরং ঠায় বসে থাকে আস্তে আস্তে পিসির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় মনে মনে তার পিসির জন্য মায়া হয় দাদুর জন্যও মায়া হয় দাদু লোকটাকে ভীষণ ভালবাসে রুপাই ওর মনে হয় ওর বাবা কেন দাদুর মতো নয়! এই যেমন আজ, বাবার জন্যই তো এত মার খেতে হল ওকে! ভাবলে আরেকবার বুকটা হু হু করে ওঠে

রুপাইয়ের বাবা গজেন ঘোষ পুলিশের হেড কনস্টেবল প্রায়ই নাইট ডিউটি পড়ে তার যেদিন যেদিন নাইট ডিউটি পড়ে, তার পরের সকালগুলোয় সবাই এবাড়িতে তটস্থ হয়ে থাকে এমনিতেই গজেন যথেষ্ট মেজাজি, তায় রোজগার নেহাত মন্দ না তাই বাড়িতে দাপট আছে ফলে তার নাইট ডিউটির পরের সকালগুলোতে এবাড়িতে কাক, চিল ডাকাও বারণ সকালবেলা ভারী হারকিউলিস সাইকেলটা চালিয়ে বাড়ি ফিরেই হাঁকডাক জুড়ে দেয় গজেন তারপর স্নান সেরে, ভাত খেয়েই শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় খুব সাবধানে ঢুকলে রুপাই দেখেছে, ঘরটায় তখন রাতের মতোই পর্দাটানা অন্ধকার বাবার নাক ডাকার শব্দসমেত একটা ভারী ভয়ের পরিবেশ তাই তখন বাড়ির সবাই টুঁ শব্দও করে ভেবেচিন্তে মা, কাকিমা কথা বলে ফিসফিসিয়ে, সামনের টানা বারান্দায় হাঁটে পা টিপে টিপে রাজুকে ঘরে শাসন করে আটকে রাখা হয় দাদু বেশিরভাগ সময়টাই পুকুরপাড়ে বসে কাটিয়ে দেয় রুপাই দেখেছে এই সকালগুলোয় বাড়িতে ভীষণ মনখারাপি হাওয়া তৈরি হয়

সবচেয়ে মুশকিল হয় গোরাকে নিয়ে গোরার বয়স মোটে চারমাস সে বাবার ডিউটি চার্টের খবর রাখে না সারা সকাল খাটে ঘুমোতেও পারে না বাবাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় মা তাই গোরাকে কখনো কাকিমার ঘরে, কখনো বারান্দায় বিছানা করে শুইয়ে রাখে বারংবার খাইয়ে আর ঘুম পাড়িয়ে সে যেন সময়ে অসময়ে কেঁদে না ওঠে সেই চেষ্টা করে

আজও বারান্দার রোদ্দুরে নিজের ছোট্ট বিছানায় শুয়েছিল গোরা খিদে পেয়েছিল কি না জানে না রুপাই, কিন্তু কেঁদে ওঠে তখন রান্নাঘরে মায়ের হাত আটকা রাজুকে স্কুল থেকে আনতে গেছে কাকিমা আর দোষের মধ্যে সবচেয়ে বড়, রুপাইয়ের বাবার সবেমাত্র তন্দ্রাভাব এসেছিল সেটা কেটে যেতেই হুঙ্কার ছাড়ে গজেন বলে, “সব মরলে নাকি? শালা মুখে রক্ত তুলে খেটে মরবো আর এনারা সব ছেলে বিইয়ে চড়ে বেড়াবেন!”

বাবার বাক্যবাণ রুপাইয়ের কানে গেছে রুপাইয়ের মায়ের কানেও গেছে গোরা তখনও একসুরে কান্নার পারদ আরও চড়াচ্ছে কোণাকুণি রান্নাঘরে মা বেচারি তরকারির কড়াই নামিয়ে বারান্দায় আসতে গিয়ে পিঁড়ি উল্টে আঙুলে ধাক্কা খেয়েছে মায়ের এমন অবস্থা দেখে আর থাকতে পারেনি রুপাই দাদুর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কান্নার আওয়াজ থামাতে তড়িঘড়ি গোরার নাক মুখ চেপে ধরেছে আর তাতেই অগ্নিশর্মা হয়েছে রুপাইয়ের মা একে গজেনের সূচ বিঁধনো কথা, তার উপর বোকা মেয়েটার যত রাজ্যের বিপজ্জনক কাজ! ভিতরের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে চুলের মুঠি ধরে টেনে রুপাইয়ের পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে দিল তারপর গোরাকে খাইয়ে এসে ফের ঠাস ঠাস করে চড়িয়ে দিল রুপাইকে রান্নাবাটি সব ভেঙে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল মা

রুপাই জানে এখন এবাড়িতে শব্দ করে কাঁদা মানা সে গোরা নয় কেঁদে উঠলে বাবা আরও নির্মমভাবে পিঠে দরজার খিল ভাঙতে পারে কারণ বাবা তো আর দাদু নয়! দাদুর মতন একটুও নয় তাই কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছিল সে ইতিমধ্যেই কাকিমা রাজুকে নিয়ে ফিরে এসেছে ভাইটা তাকে ডেকেও গেছে গোরা তার খাওয়ার পর্ব সেরে আবার ঘুমিয়েও পড়েছে কিন্তু মা একবারও এঘরে তাকে ডাকতে এল না কেন? অভিমানে মুখ ফুলে যায় রুপাইয়ের  

সে পিসির পাশে বসে একটু একটু মাথায় হাত বোলায় আর ভাবে তার বাবা যেন কেমন! সবাইকে বকে সবচেয়ে বেশি বকে ওর মাকে রুপাইকেও চোখ রাঙিয়ে কথা বলে আদর করে না, কাছে ডাকে না শুধু বকে মাঝে মাঝে মারেও আর বাবা মাকে বকলে, খুব চেঁচিয়ে বকলে মা এসে ওকে মারে কেন যে মারধোর করে বোঝে না রুপাই

তবে হ্যাঁ, বাবা গোরাকে আদর করে, গোরা কাঁদলে গোরাকে ছাড়া বাকি সবাইকে শাসন করে রুপাইয়ের ইচ্ছে হয় গোরার মতোই ছোট্টটি হয়ে যেতে সেই জীবনটা খুব সুন্দর হবে বলে ধারণা তার অনেকটা আদর পাবে বলে ধারণা তার

নয়তো আরও একটা গভীর ইচ্ছে ভিতর ভিতর পুষে রেখছে রুপাই কাউকে বলেনি সে কথা রাজুকেও না সে চায় পিসির মতোই কোনও খুব বড় নাম না জানা অসুখ করবে তার সেই অসুখে এমনভাবে কাঠির মতো রোগা হয়ে যাবে সে, মাথাটা ফুলে যাবে খুব বাবা এসে দাদুর মতোই মাথার কাছে বসবে সময়ে সময়ে ওষুধ খাওয়াবে, ধরে ধরে উঠিয়ে বসাবে, একেকদিন বিকেলবেলা পুকুরপাড়ে হাঁটতে নিয়ে যেতে চাইবে আর রুপাইয়ের অসুখ খুব বাড়লে বেশি রাত্তিরে একা একা লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল ফেলবে বাবা ঠিক দাদুর মতো! ভাবলেই আনন্দে বুক ভরে ওঠে তার মা তখন আর শাসন করবে না কোলপোছা করে রাখবে ভাঙা রান্নাবাটি আবার বানিয়ে দেবে যদিও এসব কথা কাউকে বলা যায় না তবু রোজ এমন একটা স্বপ্ন বুনতে থাকে রুপাই

এক ডেকচি গরম জল খুব সাবধানে এনে ঘরে ঢুকল দাদু দাদুর কাঁধে একটা ধোয়া গামছা রুপাই জানে এখন গরম জলে গামছাটা ভিজিয়ে পিসিমনির গা হাত পা মুছে দেবে দাদু বাবা আর কাকাই বলেছে লোক রাখতে অনেক খরচ তাই দাদুই করে এসব দাদুর হাতের শিরা ওঠা, চামড়ায় অনেক কাটাকুটি দাগ খালের মতন এদিক, ওদিক চলে গেছে দাদুর হাত কাঁপে ফের একবার মায়া হয় রুপাইয়ের সে চৌকির এপাশে ছুটে আসে বলে, “আমি করব দাদু? আমি শিখে গেছি এখন  

সামনে রাখা টুলটায় ধীরে ধীরে গরম জলের ডেকচি রেখে দাদু বলে, “না রুপাই, তুমি এখনও বড় হওনি তো, পারবে না

দ্বিগুণ উৎসাহে রুপাই বলে, “আমি তো দেখে দেখে শিখে গেছি, আজকে আমি করি?”

রুপাইয়ের কথা শুনে রিনা এবার ভরা চোখে হাসে, রুপাইয়ের দাদুও হাসে, বলেশিখে গেছ? আচ্ছা তবে কাল কোরো আজ আমি করি?”

শেষ চেষ্টা করে রুপাই বলে, “কিন্তু তোমার তো কষ্ট হয় দাদু!”

দাদু এবারও হাসে, বলে, “কষ্ট কিসের মা, মুন্নি যেমন তোমার মেয়ে, তোমার পিসিও তেমন আমার মেয়ে তো তোমার কি মুন্নিকে যত্নআত্তি করতে কষ্ট হয়?”

ভারী অবাক হয় রুপাই মুন্নির সাথে পিসিমনির তুলনা! তা কীভাবে হয়! সে বলে ওঠে, “কিন্তু মুন্নি তো ছোট্ট পিসিমনি তো কত বড় মানুষ!”

রিনার মাথাটা তুলে পিঠের কাছে বালিশ দুটো রাখতে রাখতে রুপাইয়ের দাদু বলে, “তাতে কী? তোমার পিসিমনি আমার পুতুল তো, আমার নিজের পুতুল তুমি আর দাঁড়িয়ে থেকে দেরি কোরো না মা যাও স্নানে যাও, নয়তো মা পিটবে

মা যে রেগে আছে, মা যে যখন তখন পিঠে দুঘা বসিয়ে দেবে তা রুপাই জানে সেই ভয়টাও তার আছে তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাদুর ঘর ছেড়ে বারান্দায় বের হয় যাওয়ার আগে ফের একবার দেখে নেয়, কাঁপা কাঁপা হাতে পিসিমনির গলায়, হাতে ভেজা গামছা মুছিয়ে দিচ্ছে দাদু ঠিক পুতুল খেলার মতোই আবারও স্বপ্ন বোনে রুপাই আবারও সে ভাবে, বাবা কেন দাদুর মতো নয়!

 

                                                   ক্রমশ