তার হাতে মেঘ, অন্নজল (তৃতীয় পর্ব)
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৭
অবশেষে আলোর বিন্দু দেখা গেল। বিন্দু থেকে বৃত্ত, বৃত্ত থেকে তা ধীরে ধীরে আগুনের গোলা হয়ে উঠছে যেন। আলোটা এগিয়ে আসছে। আসতে আসতে সিগন্যালের সবুজ আলোটা ঢেকে দিল সেই আলো। প্রায় কুড়ি মিনিট পরে আপ লাইনে ট্রেন ঢুকছে। মুখ বাড়িয়ে দেখল দেবল। সরে এল। সদ্য ধরানো চারমিনারটা ফেলে দিয়ে সিমেন্টের বেদির সামনে, জোরালো টিউবের নিচে এসে দাঁড়াল।
রং ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না দেবলের।
খয়েরি, কালো, লাল শাড়ি, কারোর নীল ওড়না, কারোর জংলা প্রিন্টের শার্ট, কেউ সাদা খোলের
তাঁত। আধেক মিনিট সজাগ দৃষ্টি দ্রুত এদিক ওদিক ঘোরে।
ট্রেন ছেড়ে দিল। নয় কামরার দানবীয়
শুঁয়োপোকার মতো যান ফের ধীরে ধীরে বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল। একটা জটলা শ্রান্ত পায়ে একযোগে
সামনের ঢাল বরাবর নেমে যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে লোক কমে আসছে। পাথরের গায়ে ঠুকঠাক আওয়াজ
তুলে একরাশ মানুষ রেললাইন পার হয়ে যাচ্ছে। একটা ভিড় মুহূর্তে তৈরি হল, মুহূর্তে আবছা
হল, এখন ছত্রখান হয়ে দু’ধারে ভাগাভাগি মফস্বলের কোণায় কোণায় সেঁধিয়ে যাবে। দেবলের পরিচিত
আকাশি শাড়িটা ভিড়ের মধ্যে নেই।
হালকা চিন্তার ধোঁয়ায় মাথাটা ভরে গেল
দেবলের। পরের ট্রেনে আসছে কি? অপেক্ষা করে যাবে? এত দেরি তো হয় না কখনও! প্রায় ফাঁকা
হয়ে আসা দু’নম্বর প্ল্যাটফর্ম ধরে ডাউন লাইনের দিকে এগিয়ে গেল দেবল। সামনে একটি কাঁচা
রঙের গন্ধ মাখা সিমেন্টের চৌকোণা থাম। থামের গায়ে হলুদ রঙের টাইম-টেবিল ঝোলানো। পরের
আপ লোকাল ষোলো মিনিট পরে। অপেক্ষা করে যাওয়াই যায়। ফিরে এসে নির্দিষ্ট সিমেন্টের বেদিতে
বসল দেবল। তিন নম্বর সিগারেটটা ধরাবে কিনা ভাবছে, পাশ থেকে অজয়দা ডাকল।
‘চা দেব নাকি এক কাপ?’
কালচে হয়ে আসা থার্মোকলের বেঁটে দেওয়ালে
তিনদিক ঘেরা একটা পাম্পস্টোভ নিয়ে বেদির পাশে টিনের টেবিলে দাঁড়িয়ে থাকে অজয়দা। দেবলকে
চেনে। নিত্য অফিসযাত্রীদের সবার মুখ চেনে।
অজয়দা সব খবর রাখে। ক্রিকেটের স্কোর
থেকে মহাভারত সিরিয়াল, সব বিষয়ে সমান উৎসাহ তার। মনের মতো লোক পেলে একবার কথা শুরু
হলে আর থামতে চায় না। আজ চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট ধরে অপেক্ষারত দেবলকে দেখছে। একের পর
এক ট্রেন আসছে। বেদিটা থেকে উঠে বারবার মুখ বাড়িয়ে দেখছে, ফের প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হচ্ছে,
সিগারেটের প্যাকেট শেষ হচ্ছে, দেবল ঠায় দাঁড়িয়ে। তা দেখেই একটু বুঝি মায়া হল তার। বলল,
‘কতক্ষণ বসে আছো দেখছি, একটু চা দিই?
পরের ট্রেন আসতে আসতে এক কাপ হবে নাকি?’
আজ সন্ধের চা-টা হয়নি। পরের ট্রেনটা
দেখেই যাবে যদি, চা নিয়ে বসাই ভাল ভেবে দেবল বলল,
‘দাও একটা ছোটো’।
এর আগে অন্তত আঠেরোবার ফোটানো চায়ের
পাতাসমেত কেটলিটা স্টোভে বসিয়ে পাম্প করতে শুরু করল অজয়দা।
হিম পড়ছে। দুদিকের ছোট প্ল্যাটফর্ম
প্রায় জনশূন্য। রেললাইনের দিকে দূরে তাকালে সাদাটে ধোঁয়ার মতো মিহি কুয়াশা বোঝা যায়।
শীত এখনও জাঁকিয়ে পড়েনি ঠিকই, তবে শীত আসবার আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। এমন নিস্তব্ধতায়
আচমকা পাম্প স্টোভের ঘরঘর শব্দটা দেবলের হালকা দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিল। এতক্ষণ গা করেনি
যা, সেই অস্বস্তিটা বাড়িয়ে তুলল।
টিনের টেবিলের সামনে সাজানো চার পাঁচটা
বয়াম। তার মধ্যের একটা থেকে দুটো সন্দেশ বিস্কুট তুলে খবরের কাগজে মুড়ে দেবলের দিকে
বাড়িয়ে দিল অজয়দা। এতক্ষণে খিদে টের পেল দেবল। একটাও কথা খরচ না করে কাগজের মোড়কটা
হাতে তুলে নিল।
বিস্কুট দুটোর সদ্ব্যবহার সেরে মানিব্যাগ
থেকে একটা পাঁচটাকার কয়েন বের করে বয়ামের ঢাকনায় রেখে দিল দেবল। চায়ের ভাঁড়টা নিয়ে
বেদিতে ফিরে আসার আগে অজয়দা আবার ডাকল,
‘আজ খুব দেরি হয়ে গেল না? ট্রেনের
কোনো গণ্ডগোল তো শুনিনি!’
কথা বললে মাথার ভিতরে পাক খেয়ে ওঠা
চিন্তাটা সাময়িক কমে। কিন্তু, এখন এই লোকটার কৌতূহল কমানোর দায় নিতে ভাল লাগছে না দেবলের।
অন্য সময়ে সে নিজেও অজয়দার জ্ঞানের কথায় কৌতুকবশত তাল ঠুকে দেয়, কখনোসখনো আড্ডার চালে
বাজারের হাল-হকিকত জানতে চায়, কিন্তু আজ ভাল লাগছে না। মনের গভীর কোনও স্তর থেকে একটা
দুশ্চিন্তা ঠেলে উপরিতলে আসতে চাইছে। এত দেরি তো হয় না কখনো!
‘হুঁ’ বলে চায়ের ভাঁড়টা নিয়ে বেদিতে
এসে বসে, চা খেতে খেতে দুপুরবেলাকার কথা ভাবে দেবল। সরকারদার টেবিল থেকে ফোন করার সময়ে
অর্চনাদি ফোন তুলেছিল। কাঙ্ক্ষিত গলার আওয়াজ না পেয়ে ‘ও.টিতে আছে’ জেনে ফোন রেখে দিতে
হয়েছিল। তখন থেকেই মন দমে গিয়েছিল। তবু রোজকার একই সময়ের ট্রেন থেকে নামবে জেনে অপেক্ষা
করে গেছে দেবল। এখন সাড়ে দশটা বাজতে যায়, চেনা মুখটার দেখা নেই।
একটা ঘোষণা শুরু হল। পিঠ টানটান করে
বসল দেবল। কয়েক মুহূর্ত পড়েই বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকে গেল তার। ডাউন লাইনের ট্রেন আসছে।
বিরক্তিতে আধখাওয়া চায়ের ভাঁড়টা সামনের লাইনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। অজয়দা দেখল। অলক্ষ্যে
মুখ টিপে হাসল। তারপর গুনগুন করতে করতে স্টোভ পরিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ফুটব্রিজের
সিঁড়ির নিচে কম্বল জড়িয়ে শুতে আসা পাগলিটা ভাঁড় ভাঙার আওয়াজে শেডের আলোয় তাকিয়ে দেখল।
তারপর কুটকুটে কম্বল টেনে নিয়ে নির্বিকার মুখে পাশ ফিরে শুলো।
রাত বাড়ছে। উল্টোদিকের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে
একটামাত্র খাবারের দোকান ঝাঁপ বন্ধ করছে। দোকানের দেওয়াল বরাবর আড়াআড়ি চলে যাওয়া ইস্পাতের
বেড়ার ওধারে অনেকগুলি বাল্বের ক্ষীণ রেখা প্রভাব ফেলতে না পারার ভঙ্গিমায় চোখে খেলে
যাচ্ছে। রেলবাজার গুটিয়ে আসছে। সেখান থেকে কেউ কেউ চটের গাদা, বেঁচে যাওয়া আনাজ নিয়ে
প্ল্যাটফর্মে উঠে আসছে। এমন সময়ে আরেকটা ঘোষণা শুরু হল।
একইভাবে ধাতব পাতের গায়ে আলোর ছটা
দেখা গেল। সবুজ রঙের বিশালাকায় শুঁয়োপোকার মতো দেখতে ট্রেনটা আপ লাইনে ঢুকল। দেবলের
মন হল তীক্ষ্ণ হুইসলের শব্দেও সে নিজের হৃদপিণ্ডের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ট্রেন থামল।
নির্দিষ্ট লেডিস কম্পার্টমেন্টের খোলা দরজা থেকে একটা, দুটো, তিনটে অপরিচিত মুখ নামছে।
তারপর নেমে এল আকাশি শাড়ি পরা একটা চেনা মুখ। উঠে দাঁড়াল দেবল।
শাড়ির কুচি সামলে কালো ব্যাগটা আরও
একবার কাঁধে টেনে নিয়ে দ্রুত পায়ে এগোচ্ছিল শোভা। হালকা চাদরটা সঙ্গে নিতে ভুলে গিয়েছিল
সকালে, এখন শীত শীত করছে। নিকষ কালো অন্ধকার রেললাইন থেকে একটা মিহি শীতল হাওয়া দিচ্ছে।
ক্লিপ থেকে আলুথালু বেরিয়ে আসা চুলের গোছা হাওয়ায় উড়ছে, মুখে পড়ছে। চুল সরিয়ে সামনে
বেদির কাছে চোখ যেতেই মুখ আলো হয়ে গেল শোভার। এত রাতে স্টেশনে দেবলকে আশা করেনি সে।
ট্রেন থেকে নামা গুটিকয়েক লোক সরে
যেতেই এগিয়ে গেল শোভা। প্যাকিং বাক্সে বয়ামগুলো ভরে ফেলতে ফেলতে সেদিকে তাকিয়ে আরও
একবার মুখ টিপে হাসল অজয়দা।
এতক্ষণের অপেক্ষা, উৎকণ্ঠা মুছে যাওয়ার
পরে চোরাস্বস্তি উপভোগ করছে দেবল। কিন্তু তার প্রকাশ কম। যেকোনো আবেগ প্রকাশের ভাষা
কম জানে সে। দেবলের সৌভাগ্য, সেইসকল চুপকথা শোভা বুঝতে পারে।
‘ইসস অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছো?’ করুণ
চোখে মুখ তুলল শোভা।
‘ভাবলাম ট্রেনের কোনও গণ্ডগোল কিনা!’
‘আর বোলো না, নাইট শিফটের রেখা আসেনি,
লাস্ট মিনিটে আমাকেই ওটি করতে হল!’
‘দুপুরে ফোন করেছিলাম, অর্চনাদি ধরেছিল’।
‘তখনও ওটি চলছিল। একদিনে দু-দুটো ওটি।
শরীরে আর কিছু থাকে!’
‘কালকে অফ ডে?’
‘অর্চনা দি বলল বটে, তবে ওই মেট্রনকে
বিশ্বাস নেই। কখন ডেকে নেবে কে জানে!’
‘আজ বিকেলে সরকারদার টেবিলে বাপি ফোন
করেছিল। আসতে চায়। কাল যদি ছুটি থাকে একবার ডেকে নিতে…’
মুহূর্তে খরচোখে তাকায় শোভা। কথা বলতে
বলতে রেললাইন পেরিয়ে ইস্পাতের বেড়া থেকে বেরিয়ে আসছে ওরা। বন্ধ হয়ে আসা মার্কেটের ভিতর
দিয়ে হাঁটছে। শেষ হেমন্তের নীরব রাত্রি চারপাশ ঘিরে রেখেছে। একটা দুটো শাটার নামানোর
আওয়াজ মাঝেমধ্যে সেই নিস্তব্ধতা খানখান করে দিচ্ছে। জামাকাপড়ের ছোটো ছোটো দোকানে, প্রসাধনীর
কাচ ঘেরা খুপরির আলো নিভে আসছে। কালভার্টের সামনেটায় বড় ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোর
গায়ে ধোঁয়াটে কুয়াশা। সেই আলোয় শোভার মুখে অভিব্যক্তির দ্রুত পাল্টে যাওয়া দেখল দেবল।
সামাল দিতে বলল,
‘আসতে যখন চাইছে একবার কথা বলেই দেখো
না’।
তীব্র স্বরে শোভা বলল,
‘গতমাসে কত নিয়ে গিয়েছিল মনে নেই তোমার?’
‘মনে আছে। কিন্তু এবারে তো একই কারণ
না’ও হতে পারে!’
‘এবারে কারণ আরও গুরুতর। তিন-চারদিন
আগে দুপুরবেলায় নার্সিংহোমে ফোন করেছিল মা। যা বলল তাতে বুঝলাম বাপি গাড়ি কিনবে। সেকেন্ডহ্যান্ড
মারুতি ভ্যান। রোজগেরে দিদি হিসেবে তার অর্ধেক দামটা অন্তত আমার দেওয়া উচিত!’
একথায় হো হো করে হেসে উঠতে ইচ্ছে হল
দেবলের। শোভা বা দেবলের অবস্থা কারোর অজানা নয়। তারপরেও এই অসম্ভব কথা বললে হাসি পায়
বৈ কি! তবু সংযত থেকে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিমায় বলল,
‘তুমি? তুমি কোত্থেকে…? উনি এক বলেছেন
আর তুমি আরেক বুঝেছ!’
‘মা’কে, বাপি’কে আমি তোমার থেকে বেশি
চিনি দেবল। বাপি’কে মা’ই পাঠাচ্ছে। দিনকে দিন এই পাঠিয়ে দেওয়া বাড়ছে’।
শোভার পরিবারের এই বিরক্তিকর অধ্যায়
নিয়ে বেশি কথা বাড়াতে চায় না দেবল। ওদের বিয়ের বয়স মাত্র সাত-আট মাস। এর মধ্যে বাপিকে
প্রায়ই আসতে দেখেছে। কখনো শোভার কাছে, কখনো দেবলের কাছে অর্থসাহায্য চেয়েছে। চাইতে
চাইতে চাওয়াটাকেই একটা জোরের জায়গায় পরিণত করতে চেয়েছে। দেবল সবটা টের পেয়েও কিছু বলেনি।
বলাটা ভাল দেখায় না বলে বলেনি। তাছাড়া শোভার ভাঙাচোরা শৈশব ও কৈশোরের গল্প শুনে মায়া
হয়েছে। ঝাড়া হাত পা একা মানুষ হলেও সম্পর্কের রাজনীতি দেবল বোঝে। তাই বাধা দিয়ে অতিরিক্ত
চাপ সৃষ্টি করতে চায়নি। কিন্তু এখন দিনের পর দিন শোভা নিজেই রেগে উঠছে। এই অদ্ভুত সমস্যার
সমাধান খুঁজে পায় না সদ্য বন্ধু হওয়া দুটো মানুষ।
সদ্য বন্ধুই বটে! মা মারা যাওয়ার পর
বেশ কিছু বছর একাই গুছিয়ে নিয়েছিল দেবল। রোজগার বলতে ডালহৌসির পুরনো মার্চেন্ট অফিসে
স্বল্প মাইনের কাজ, আর বাকি সময়টায় বিনোদন বলতে অফিস সেরে পুরনো পাড়ায় আড্ডা। সকালবেলার
খবরের কাগজ আর দু’চারটে গানের ক্যাসেট ছাড়া আর কিছুর প্রতি তেমন মোহ ছিল না। কালেভদ্রে
বড়দি বা ছোড়দির বাড়ি যাওয়া, কুটুম্বিতা বলতে ওইটুকুই বুঝত সে।
কিন্তু দিদিরাই উঠে পড়ে লাগল বিয়ে
দিতে। বাপ মা মরা, ভাড়ায় থাকা স্বল্প মাইনের এমন পাত্রের জন্যে বাংলায় মেয়ে কম নেই,
কিন্তু দিদি-জামাইবাবুর সাথে শোভা নামের যে পাত্রীকে দেখতে গিয়েছিল দেবল, সে ছিল অন্যরকম।
একেবারেই অন্যরকম।
সেই সন্ধেটা মাঝেমাঝে মনে পড়ে দেবলের।
শোভাকে মনে করিয়ে দিয়ে দু’জনে বেজায় হাসাহাসি করে। সেদিন তখনও সন্ধেটা আকাশের সবটুকু
গ্রাস করেনি। নীল অন্ধকারের মাঝে বিকেলবেলার ঘোলাটে মায়া অল্প লেগে রয়েছে। ছিটে বেড়ার
দরজা পেরিয়ে সামনে কয়েকটা জোড়া ইট পাতা। বর্ষাটা যাবে যাবে করেও যাচ্ছে না। আবার রাতেও
শরতের আকাশ বোঝা যায় বেশ। ইটের গায়ে সাবধানে পা রেখে এগোচ্ছিল দেবলরা। সামনে সদর দরজার
সিঁড়িতে দেখে একটি মেয়ে। মেয়েটির পরনে কালো পাড়ের সাদা শাড়ি। বাড়িতে থাকা বয়স্কা বিধবা
মা-ঠাকুমার শাড়ি যেমন হয়। চুলটা খোলা, মেয়েটি মুখ নিচু করে হাঁটুর উপর রাখা একটি আংটি
খুব মন দিয়ে পরিষ্কার করছে, ফলে চুলের গোছা দু’কাঁধ বেয়ে সামনের দিকে নেমে এসে আংশিক
আড়াল করেছে মুখ। পায়ের আওয়াজে মুখ তুলল সে। দেবল দেখল মেয়েটির কপালে কালো সোয়েটের টিপ।
চোখদুটি ভারি উজ্জ্বল। আর থুতনির ডানদিকে একটি তিল। প্রসাধনহীন জলধোয়া লাবণ্যময় একটি
মুখ। বাড়ির কর্তার নামটা বলতে মেয়েটা উত্তর দিল না। উল্টে ওদের চমকে দিয়ে সহসা এক লাফে
উঠোনে নেমে এল। তারপর তড়িৎপায়ে ছুটে পাশের একটি বাড়িতে ঢুকে গেল। এমন ঘটনায় দিদি-জামাইবাবু
স্তম্ভিত। দেবল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভরসন্ধেয় অচেনা বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আর কাউকে ডাকবে
কিনা ভাবছে, এমন সময়ে কাঠের দরজা খুলে বেরিয়ে এল দেবলের চেয়ে বয়সে খানিক ছোট এক যুবক।
বাপির আগমনে জীবনে প্রথমবার পাত্রী দেখতে যাওয়ার কাজটা সফল হয়েছিল।
অল্পক্ষণ পরে যখন পাশের বাড়ি থেকে
কোনও এক জাদুবলে রঙচঙে শাড়ি পরে থুতনির তিল ও কালোর জায়গায় নীল টিপ সমেত ওই মেয়েটি
এসে শান্তভাবে বসল, তখন তাকে দেখেই অন্তত নিজের সিদ্ধান্তটুকু ভেবে নিয়েছিল দেবল। মেয়েটি
নার্সিং কলেজ থেকে পাশ করে একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে ইন্টার্নশিপ করে, সেই টাকাতে
ছোটভাইকে পড়াচ্ছে, বাবা মারা গেছে অনেক বছর আগে, আর নিজের, সম্পূর্ণ নিজের একটি বাড়ি
তৈরির স্বপ্ন দেখে। এইসব দেবল পরে জেনেছে। তারও পরে জেনেছে মেয়েটাকে ঘিরে তার মা-ভাইদের
সম্পর্কের কূটনীতি, আর্থিক চাপসৃষ্টি, আর অবহেলার আখ্যান। মাঝেমাঝে উচ্ছল মেয়েটাকে
অসহায় লেগেছে। মাঝেমাঝে বড্ড হিসেবি, গোছানো, শান্ত, গৃহলক্ষ্মী মনে হয়েছে।
দিদি-জামাইবাবু সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল
পরে। তারপরে দুর্গাপুজো এল। নবমীর দিন একবেলা ছুটি পেয়ে শোভা এসেছিল কলেজ স্কোয়ারের
সামনে। সেদিন খুবই কুন্ঠিত হলেও কী মনে করে দেবল নিয়ে গিয়েছিল একটি জামরঙা শাড়ি। শাড়ি
চেনে না সে। দোকানদার বলল জর্জেট, দামে কুলিয়ে গেল, তাই সাত পাঁচ না ভেবে কিনে ফেলল।
তারপর বসন্তে বিয়ে। কোনও দাবিদাওয়া
ছাড়া বিয়ে করতে চেয়েছিল দেবল। কিন্তু বিয়ের পরে একটি বিষয় দেখে হতবাক না হয়ে পারেনি।
একে একে সমস্ত তৈজসপত্র, দামী শাড়ি, উপহার যখন মা-ভাইরা সরিয়ে রাখছে, কী এক অদ্ভুত
ভাবনায় তা টের পেয়ে আগে থেকেই মাইনের স্বল্প জমানো টাকায় নিজের জন্যে, দেবলের সাথে
সংসারের জন্যে কিছু কিছু কিনে রেখেছিল শোভা। তা খুবই সামান্য হলেও সম্পর্ক গাঢ় হওয়ার
জন্যে যথেষ্ট ছিল।
গত সাত-আটমাসে অল্প অল্প জমিয়ে ঘরের
টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনেছে ওরা। কোথাও যাওয়া হয়নি। কাছেপিঠে সমুদ্রে যাওয়ার কথা এক-আধবার
তুলেছিল দেবল। শোভাই বাধা দিয়েছে। আগে ঘর গোছাতে চেয়েছে। যাওয়ার সময় তো পড়েই রয়েছে।
মাঝেমধ্যে বাপি এসেছে, মা এসেছেন, ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কথা বলেছেন, অর্থের জন্যে শোভাকে
চাপ দিয়েছেন, পরোক্ষে দেবলকেও, কিন্তু তা দু’জনের গড়ে ওঠা বন্ধুত্বের মাঝে বাধা হয়ে
যায়নি। আসলে যখন দুটো একা মানুষ, ভাঙা মানুষ একে অপরকে আঁকড়ায়, তখন বোধহয় এমনটাই হয়।
প্লাস্টিকের ছোট্ট প্যাকেটে সয়াবিনের
ঝোল পুরে আঙুলের কায়দায় গিঁট বেঁধে দিল ছেলেটা। সাথে খবরের কাগজে রোল করা কয়েকটা হাতরুটি।
দোকানটা বন্ধ হবার আগে শেষ খদ্দের দেবল আর শোভা। এত রাতে আর কিছু পাওয়া গেল না। দাম
মিটিয়ে মন্দিরের পাশের আলো-আঁধারি রাস্তায় মিলিয়ে গেল দুই মানব মানবী।
ক্যাম্পের রাস্তাটা শুনশান। বড় মুদির
দোকানটার কাঠের পাল্লা বন্ধ। দুয়েকটা কুকুর কুণ্ডলী পকিয়ে শুয়েছিল। ওদের দেখে গা ঝাড়া
দিয়ে উঠে ডেকে উঠল। ভয়ে দেবলের হাত ধরল শোভা। গা ঘেঁষে সরে এল। সামনেই নতুন তৈরি হাউসিং-এর
বিশাল চওড়া টিনের গেট। সেখানে মাফলার জড়িয়ে টুলে বসে আছে এক উর্দিধারী গার্ড। বাদামি
চামড়ার খোলে ভরা একটা চৌকো রেডিও তার পায়ের কাছে রাখা। রেডিওয় একটা গান বাজছে। কিছুটা
পুরনো। টুল থেকে কয়েক পা দূরে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাসুর দোকানের চাতালে পা ছড়িয়ে আরও একজন
বসে আছে। রূপম।
দেখে মায়া হয় ওদের। পাড়ার ছেলে। শুনেছে
খুব মেধাবী ছিল। কীভাবে যে এমনটা…! যদিও পাড়ায় কানাঘুষো অনেক খবরই ঘোরে।
রূপম আজ রাতে ঘরে ঢুকতে পারেনি। শেষ
নভেম্বরের রাত। তাকে কেউ খুঁজতে আসেনি। এক পায়ে চটি নেই, মায়ের রোঁয়া ওঠা কালো শালটা
এখন মাথা আর গলায় পেঁচিয়ে অদৃশ্য কাউকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করে চলেছে সে। একটানা গালাগালি
করতে করতে কেঁদে ফেলছে সে। তার ক্ষোভ, তার অভিমান, তার কান্না ভাসছে, ভেসে যাচ্ছে নিস্তব্ধ
হিম হাওয়ায়। তার সাথে মিশে যাচ্ছে বেতার তরঙ্গে ভেসে আসা একটি সুর… “ইয়ে রুত কি রংরলিয়া,
ইয়ে ফুলো কি গলিয়া রো পড়ি, মেরা হাল সুনা তো মেরে সাথ ইয়ে কলিয়া রো পড়ি, এক নেহি তু
দুনিয়া আসু বরসা রাহি হ্যায়… ইয়াদ আ রাহি হ্যায়, তেরি ইয়াদ আ রাহি হ্যায়, ইয়াদ আনে
সে তেরে যানে সে জান যা রাহি হ্যায়…”
সোজা রাস্তাটা থেকে ডানদিকের গলিতে
বাঁক নিলে হলুদ রঙের চারতলা বাড়ি। গলির মুখে ঢুকতে দেবলের হাত ছেড়ে দেয় শোভা। সদ্য
দরজা বন্ধ হয়েছে বিজন রায়ের বাড়ির। দরজায় টোকা দিতে হাত কেঁপে যায় দেবলের।
৮
ছাদের ঘরে আলো জ্বলে। সারারাত।
মধ্যরাত ঘন হয়। একে একে সমস্ত বাড়ির
আলো নিভে যায়। কেবল ঘোষালদের তেতলায় ছাদের ঘরে আলো জ্বলে সারারাত। বিভা ঘুমিয়ে পড়েন
না। সারারাত ঘরে আলো জ্বেলে রেখে বিছানায় বসে থাকেন। প্রায় শেষ রাতের দিকে চোখ লেগে
গেলে কিছুক্ষণ ঢুলতে থাকেন। ভোরের প্রথম পাখিটি ডেকে ওঠে, বিভা তখন সফেদ বালিশের গায়ে
একটি বাহু রেখে মাথা এলিয়ে দেন। কালো আকাশে ফিকে রং ধরে, একটা দুটো প্রাণ জেগে ওঠে,
জেগে ওঠার শব্দ হয়, শব্দ বাড়ে, ঘরে জ্বলতে থাকা মেকি আলো সর্বশক্তিমানের কাছে মাথা
নোয়ায়, গুরুত্ব হারায়, আর রোদের প্রথম রেখা দেখা গেলে বিভা উঠে পড়েন। দীর্ঘদিন ধরে
তাঁকে দেখে মনে হয় কতকাল ওই চোখ দুটোয় ঘুম নেই।
উঁচু নিচু অন্ধকার ছাদ পেরিয়ে মাঝখান
দিয়ে ভাঙা পিচের রাস্তাটা অল্প দূরে জি.টি রোডে মিশেছে। ফাঁকা জি.টি রোডে মাঝরাতের
দু’চারটে ভিনদেশী লরির যাতায়াত। চোখের নিমেষে সেগুলি আসে যায়। ভারী চাকার কম্পন টের
পাওয়া যায় না, হুশ-হাশ শব্দ কানে আসে। তার ওধারে নদী, বাঁধানো ঘাট। ভাগীরথী-হুগলী।
এলাকার সবার কাছে গঙ্গা। গঙ্গার ঘাটে শিবমন্দির। সেখানেও সারারাত আলো জ্বলে। ঘোলাটে
জলের উপর থেকে মিঠে হাওয়া উঠে আসে। ঘোষাল বাড়ির তেতলার ছাদে সেই হাওয়া ঢোকে না। তবু
রাত বারোটার কাঁটা এগিয়ে গেলে ছাদের দরজায় খুট শব্দ হয়। এমন শীতল রাতেও তার অন্যথা
হয় না। দরজা খুলে যায়। বিভার ঘরের জানালায় উঁকি দেয় দুটো চোখ। প্রথম প্রথম সেই নজর
ছিল সতর্ক, সমীহপূর্ণ, ভয়মিশ্রিত। বছরখানেক হল সেই দৃষ্টি থেকে ভয় উবে গেছে। এখন সেই
নজরে খানিক গা-সওয়া ভাব। যেন পরোয়াহীন। কিছুটা তাচ্ছিল্যও কি? বুঝে ওঠেন না বিভা। শুধু
ওই তরতাজা যুবকের মুখের দিকে তাকালে তিনি শিউরে ওঠেন, তাঁর বিবমিষা জাগে! তুষারের মুখের
আদলে চেপে বসেছে ওর বড়কাকার মুখের আদল। এই আদল বিভা সহ্য করতে পারেন না।
তুষার লক্ষ্য করে না। বড়োকাকিমা এই
ঘরে প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে নিজেকে বন্দি করে রেখেছেন। কালেভদ্রে নিচে নামেন।
সারারাত ঘুমোন না, আর যত দিন গেছে ততই নিজেকে এক নির্বাক মূর্তি বানিয়ে তুলেছেন।
তুষারের বড়োকাকাকে খুব একটা মনে পড়ে
না। খুব যে কাছের কেউ ছিলেন তা’ও নয়। বছর কুড়ি আগে, যখন এই ঘোষাল বাড়ির পূব দিকটা সম্পূর্ণ
ধসে পড়েনি, যখন এইদিকের মেঝে এমন জায়গায় জায়গায় ক্ষয়ে যায়নি, তারও তিরিশ বছর আগে জমিদারি
উঠে গেলেও যখন কাটা কাপড়ের ব্যবসাটা ভালই চলছে, দালানের পলেস্তারা সবটা খসে যায়নি,
যখন পশ্চিমদিকে নিয়মিত চুনকাম পড়ে, যখন ঠাকুমা বেঁচে, সেই তখন, চার বছর বয়সে বড়োকাকাকে
শেষবারের মতো দেখেছিল তুষার। খুব একটা স্নেহশীল ছিলেন না। তুষারের শিশুমন স্নেহ টের
পায়নি। তারপর একদিন জিপে করে উধাও হয়ে গেলেন। বড় হতে হতে তুষার দেখল প্রতিপত্তি আগেই
ছিল না, কিন্তু এখন কেমন বাঁকা চোখে তাদের বাড়ির দিকে সবাই দেখে। একটি উধাও হওয়া বাড়ির
মানুষগুলোকে পাল্টে দিল। তাদের স্বপ্ন মরে গেল। সম্মানের আশা মরে গেল। গৃহকর্ত্রী ঠাকুমার
আচমকা মৃত্যু ঘটল। সবশেষে চালু ব্যবসাটা কেমন জীর্ণ টিমটিমে চেহারা ধারণ করে কোনোরকমে
বেঁচেবর্তে রইল।
আর ছিলেন এই বড়ো কাকিমা। শ্রীমতী বিভারানি
ঘোষাল। জ্ঞান হওয়ার বয়স থেকে তাঁকে একটি পাথরের মূর্তি ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। আবেগহীন,
কঠোর, ঘেন্নামাখা দৃষ্টির এক মধ্যবয়সী নারী। বর্তমানে প্রৌঢ়া এই নারীর দৃষ্টি উপেক্ষা
করতে শিখেছে তুষার।
একদিন, ক্লাস ইলেভেনের বন্ধু রাজনকে
মেরে রক্তারক্তি করে বাড়ি ফিরেছিল তুষার। তখনও সে রাগে কাঁপছে। তার সতেরো বছর বয়স তীব্র
ক্ষোভে ফেটে পড়তে চাইছে। মা তাকে শান্ত করেছিলেন। বিকেলবেলার অন্ধকার মাখা ঘরে নিয়ে
গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তারপর যখন তুষার জানলো রাজন যা বলেছে সব সত্যি, এবং
এই সত্যি যে সে জানে, সেকথা বাড়ির কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায়, তখন লজ্জায়, অভিমানে
মায়ের আঁচলে মুখ ডুবিয়ে কেঁদেছিল তুষার। বহুদিন রাজনের চোখে চোখ রাখতে পারেনি। মিটমাট
করে নেওয়া তো দূরের কথা, দেখতে পেলে এড়িয়ে গেছে। এখনও এড়িয়ে যেতে চায়, রাস্তায় দেখা
হলে সামান্য কুশল বিনিময়ের পরেই এড়িয়ে যায়। তুষারের মনে হয় এই একটি ছেলে তার দুর্বলতা
জানে। পরমুহূর্তে ভাবে, এলাকার প্রতিটা মানুষ তার ও তাদের দুর্বলতা জানে! আজও কখনো
কখনো ক্ষোভে লজ্জায় মাথাটা নুয়ে পড়তে চায়।
ক্লাস ইলেভেনের সেই দিনটা থেকে তুষার
তার বড়োকাকিমাকে কিছুটা সহানুভূতির চোখে দেখে। কিন্তু ওই কঠোর, শাপগ্রস্ত চোখ দুটোর
সামনে দাঁড়ালে তার সমস্ত সহানুভূতি মরে যায়। তাই পরিবারের বাকি সবার মতো উপেক্ষা বেছে
নিয়েছে সে।
মধ্যরাতে ছাদে উঠে আসে যে কারণে, সেই
কারণ বড়োকাকিমা বোঝেন। কোমায় থাকা মানুষ তো নন। মস্তিষ্ক সজাগ, সতর্ক, অবিশ্বাসী। কেন
বুঝবেন না? কিন্তু পরিবারের প্রায় বোঝা এই মানুষটিকে নিয়ে বেশি ভাবে না তুষার। সে এখন
ছাদের ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া নোনা ধরা কার্নিশের গায়ে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে।
একটু পরে একটা গাড়ি ঢুকবে এই রাস্তায়।
মারুতি ৮০০। শ্যাওলা শ্যাওলা রং। গাড়ির ভিতরের লোকটাকে চেনে না তুষার। বছরখানেক ধরে
কোনোদিনও দেখেনি। শুধু পাশ থেকে নেমে আসবে যে, তাকে দেখার জন্যে, সে ফিরেছে, এটুকু
জানার জন্যে শীতেও তুষার ছাদে উঠে আসে। ডলিদি নেমে আসবে। সশব্দে গাড়ির দরজা বন্ধ করবে।
গ্রীষ্মকাল হলে কেউ কেউ সেই শব্দে জানালার পর্দা তুলে দেখবে, তারপর চেনা দৃশ্য দেখে
ঝপ করে পর্দা ফেলে দেবে। পর্দার তীব্র আপত্তি ডলিদির পিছু নেবে। তবু সে ভ্রুক্ষেপ না
করে উল্টোদিকে ন্যাড়া ছাদের সিমেন্ট রঙের বাড়িটায় ঢুকে যাবে।
আজ গাড়িটা এল বারোটা কুড়ির পর। কালো
রাজস্থানি ওড়না টেনে ডলিদি নামলো। স্টার্ট দিয়ে গাড়িটা পিছোতে শুরু করল। ছাদের কোণের
অব্ধকারে মিশে তুষার মুখ বাড়িয়ে রইল। বেঁটে আর নিচের দিকে ক্ষয়ে আসা জীর্ণ গ্রিলের
গেট খুলছে ডলিদি। যতক্ষণ না ঘরে ঢুকছে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে তুষার। কিন্তু, আজ আচমকা
পিছন ফিরে উপরে তাকালো ডলিদি। যেন একটা মুখ খুঁজছে।
বড়োকাকিমার বিদ্বেষমাখা দৃষ্টির দিকে
পরোয়াহীন দাঁড়াতে পারে তুষার। কিন্তু এই ছাদের দিকে মুখ তুলে থাকা চাহনির সামনে দাঁড়ানোর
ক্ষমতা নেই তার। সে ঝটিতি সরে আসে।
ছেলেবেলার খেলার সাথী ডলিদি। বড় হয়ে
ওঠা থেকে ছাড়াছাড়ি। এখন সম্পর্কের সমীকরণ পাল্টে গেছে, দু’জনের জীবন পাল্টে গেছে। তবু
আজ প্রথমবার ডলিদি তাকিয়েছে। বছরের পর বছর ঘুরে গেছে, তুষারের প্রতিদিনের উপস্থিতি
টের পেয়ে আজ ডলিদি তাকিয়েছে। হালকা একটি শরীর নিয়ে পায়ে পায়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে
গেল তুষার। নিচে নেমে যাওয়ার আগে বড়োকাকিমার ঘরের জানালায় চোখ পড়তে চমকে উঠল সে।
খাট থেকে নেমে এসে জানালার গরাদ ধরে
শিকের গায়ে মুখ ঠেকিয়ে তীব্র ক্রোধের এক বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বড়োকাকিমা।
মুহূর্তে নিজেকে সামলে উপেক্ষার ওষুধ প্রয়োগ করল সে। ছাদের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ পেলেন
বিভা।
নিজের বড়োকাকার মুখের আদল পেয়েছে তুষার।
বড়োকাকা যে কাজ করে গেছে, তুষারও সেই কাজ করবে! ভাবলে অবদমিত ঘেন্না জেগে ওঠে বিভার।
ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে মাথায়। নিদ্রাহীন দুটো চোখ একলা বিষাদে নেমে যায়, শ্বাসের বেগ
বেড়ে যায়, দাঁতের উপর দাঁত চেপে যায় তাঁর।
জমাট অন্ধকারে ডুবে সারারাত ঘরে আলো
জ্বেলে রাখেন বিভা।
ক্রমশ...