লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Sunday, January 12, 2025

কিঞ্জল রায়চৌধুরীর ছোটোগল্প, ছায়ারোদ নতুন সংখ্যা

টিকটকার্‌স

কিঞ্জল রায়চৌধুরী

 

শট ওয়ান। লোকেশন মোহরকুঞ্জ। ‘কুঞ্জে কুঞ্জে গুঞ্জে অলি...’ ওইখানে। ভিডিয়ো হবে। টিকটক। শেয়ার করলে দেখবে সবাই। লাইকের পর লাইক কমেন্টস অউসাম! লাভলি! বিউটিফুল! মোহরকুঞ্জে বিউটিফুল সব ফুলগাছের ঝাড়ি। ন্যান্সি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পাবলোর হাতে ফোনের ক্যামেরা। ব্যাকগ্রাউন্ডে নানারকম মিউজিক-থিম। তোলা ভিডিয়ো ওগুলোর সাথে জুড়ে দিলেই শট 'ওকে'।

ন্যান্সি আঠেরো, পাবলো উনিশ। পারফেক্ট কাপল্। ন্যান্সি পোজ দেয়, পাবলো ছবি তোলে। টিকটকে ভিডিয়ো করে  দেয়।

আঙুলে লিপস্টিক লাগিয়ে গালে  আর  নাকে অল্প  করে  ঘষে নিয়েছে ন্যান্সি, খানিকটা চোখের পাতায় আর একটুখানি গ্লিসারিন। জল কাটছে। ঘন ঘন নাক টানছে ফুটফুটে মিষ্টি মেয়েটা। কান্না কান্না মুখ। শট রেডি। পাবলো ক্যামেরা তাক করেছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে কে যেন প্রশ্ন করল ‘আরে তুনে উসকো কেয়া দিয়া?’

ন্যান্সি  মুখের কাছে দু-হাতের সবকটা আঙুল জুড়ে হার্ট সাইন তৈরি করে। মানে দিল। ‘অউর ফির উসনে কেয়া কিয়া?’ এবার হার্ট সাইনের ভেতর দিয়ে ন্যান্সি চুমুর ভঙ্গিতে ঠোঁট বাড়িয়ে দেয়। আলতো  একটু হাসি চোখের কোল  বেয়ে দু-এক বিন্দু জল গড়িয়ে যায় টপাক টপাক সাথে সাথে ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক বেজে ওঠে, আর অনেকগুলো প্রজাপতি উড়ে যায় মুখের সামনে দিয়ে ওটা বাই ডিফল্ট।

মোহরকুঞ্জে বসা গোটা পাঁচেক কাপল থমকে গিয়েছে ওদের কাণ্ড দেখে। চুমু খেতে ভুলে গিয়েছে দু-একজন। পাবলোর ভুরুতে ভাঁজ। একবার ভিডিয়ো দেখছে, আর-একবার ন্যান্সিকে। ও কি সত্যিই কাঁদছিল! এখনও যে মুখ থমথমে, চোখে জল! না না যাঃ! ওই তো হাসছে... কাট!

 

শট টু। আজ লোকেশন বিধাননগর রোডের স্টেশন-প্ল্যাটফর্ম। আজকের থিম ‘জান তেরে নাম’। ব্যাকগ্রাউন্ডে বুক ঢিবঢিব হার্টবিট। একেবারে শেষপ্রান্তে শিয়ালদাগামী ট্রেন ঢুকতেই লাফ দিয়ে প্ল্যাটফর্মের কিনারায় চলে গেল ন্যান্সি। কেউ কিছু বোঝার আগে, অতর্কিতেই। পাবলো ফোন তুলে রেডি। ন্যান্সি দু-হাত মেলে দিয়েছে যেন পাখির ডানা, ওর পোকেমন আঁকা হলুদ গেঞ্জি ছুটে-আসা গোটা ট্রেনটাকে আড়াল করে ফেলেছে। হাওয়ায় উড়ছে চুল।

ট্রেনের হুইসিল আর হার্টবিট মিশে একাকার। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। হঠাৎ পা ফসকায়... পাবলোর হাতের ফোন ক্যামেরা  তখন  শূন্যে। খুঁজে  পাচ্ছে না ন্যান্সিকে!  ওর পোকেমন গেঞ্জিও উধাও! তার বদলে হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসছে শুধুই একটা চলন্ত ট্রেন...

একটু দূরেই ধাক্কাধাক্কি। লোকের ভিড়। লাইনের ধার থেকে সেখানে ঝুঁকে পড়েছে একগাদা মেয়ে-পুরুষ। কেউ বুঝতে পারছে না কেন এমন হল! পাবলোও বুঝতে পারছে না। ভিডিয়োটা টিকটকে চট করে আপলোড হয়ে গেছে। শেয়ারও হয়ে গেছে ফেসবুকে। ফোন হাতে দাঁড়িয়ে সে কেমন যেন হতভম্ব। অসহায়! শট ওকে হয়নি। থিমের মধ্যে সত্যি এমন কিছু তো ছিল না! বার বার ভিডিয়োর রিপ্লে ঘেঁটে ঘেঁটে সে ন্যান্সিকে খুঁজে চলেছে সমানে...

ঠিক তখনই  চারপাশের ভিড়ের ভেতর থেকে আলাদা হয়ে দাঁড়ায় কিছু মানুষ, অদ্ভুত তাদের চোখের ঠান্ডা চাহনি, ঠোঁটে অনুভূতিহীন হাসি...  যেন  গ্রহান্তর  থেকে  নেমে  এসেছে। সবাই ফোন তাক করে পাবলোর দিকে গোটা ঘটনাটা ওরা সব লাইভ ভিডিয়ো করে টিকটক-এ ছেড়ে দিতে চাইছে এক্ষুনি, তারপর শেয়ার হবে, লাইক পড়বে, কমেন্টস

 

ন্যান্সির মা দুশ্চিন্তায়। সন্ধে হতে চলল, মেয়ের ফেরার নাম নেই। আজ তো কোচিং অফ! ফিরে আসবে বলেছিল বিকেলের আগে। এখন ফোন করলে ফোনটাও ধরবে না। ধরলেই “আসছি তো মা! —কেন ফোন করছ বারবার?— আচ্ছা রাখছিএসব বলেই কুটুস করে কেটে দেবে ভালো করেই এটা জানে ন্যান্সির মা। বিরক্তি আসে। এই হয়েছে এক টিকটকার জেনারেশন! দিনারাত্তির আদাড়বাদাড়ে, জলের ধারে নেচে-গেয়ে-হেসে-কেঁদে ভিডিয়ো কী জানি বলে? রিল, রিলের পর রিল বানিয়ে চলেছে! আপনমনে হাসে আয়নাকে হাসায় সেলফি! সময় অসময় নেই, বিড়বিড়িয়ে চলেছে কানে তার গুঁজে। কে যে কার সেই ফিশফিশ শোনে, বোঝা দায়! আজও নির্ঘাত সেই ছেলেটাকে নিয়ে ছবি তুলতে মেতে উঠেছে!

সদ্য অভ্যস্ত হাতে স্মার্টফোন তুলে নেয় স্মার্ট ন্যান্সির উদ্‌বিগ্ন মা। আঙুল চলে যায় ফেসবুকে বোঝা যাবে অন্তত মেয়ের এই মুহূর্তের স্ট্যাটাসটা কী!

এই তো, পোস্ট দিয়েছিল পাবলো, ওই ছেলেটা, কী একটা ভিডিয়ো শেয়ার করেছে ঘণ্টা দুই আগে। মেয়ের ক্যাটকেটে লাল ঠোঁটের ওপর ভিজে চোখের নোনাজল চিকচিক, আর কত কত উড়ে যাওয়া প্রজাপতি! ‘দিল দিয়া, দিল লিয়া চলছে... আসুক আজ বাড়িতে!  অঙ্ক খাতায় মাঙ্কি এঁকে ক্লাসে জমা দেওয়া বার করে ছাড়বে... এই যে, এই তো আরেকটা ভিডিয়ো এটা আবার কোথায়? কে জানে কোন স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম! নাম দেখা যাচ্ছে না দেখে তো উলটোডাঙাই মনে হচ্ছে। দুঃসাহী মেয়ে তার ছুটে-আসা দুরন্ত ট্রেনের হাওয়ায় উড়ন্ত চুল ঝাঁকিয়ে, দু-হাত ছড়িয়ে যেন ট্রেনটাকেই জড়িয়ে ধরতে চাইছে!

ন্যান্সির মা টাইম মিলিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, ভিডিয়োটা শেয়ার হয়েছে পঁয়তাল্লিশ  মিনিট আগে। তার মানে তখন উলটোডাঙাতেই ছিল, এখনও কি ওখানেই... “কৃপয়া সুরক্সিট দূরি বর্‌কারার রাখিয়ে...তিন নাম্বার প্ল্যাটফর্ম সে থ্রু ট্রেন...” বলতে বলতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ট্রেনটা!... এরপর... ভিডিয়োটা কেমন যেন হিজিবিজি ঝাপসা...

ভিডিয়োটা ভাইরাল হয়েছে, প্রাণের খুশিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে এর ওর টাইমলাইনে। ন্যান্সির মা সব ভিডওয়োগুলোই ফরোয়ার্ড করে খুঁজতে থাকে মেয়েকে, পাচ্ছে না... হঠাৎ ফোন! রিংটোন ঘনঘন বাজছে। এমন প্রতিদিনই উড়োফোন আসে, প্র্যাংক কল! ধরা যায় না, অচেনা নাম্বার। টিরিক করে মেসেজ ঢুকল মেসেঞ্জারে ‘মনীশ কলিং! আর্জেন্ট। প্লিজ্ রিসিভ!’ ন্যান্সির বাবা! এইসময় হঠাৎ অন্যের ফোন থেকে? ঘুরিয়ে কল করার আগেই প্লপ্ করে একটা ভিডিয়োর লিঙ্ক ঢুকল হোয়্যাটসঅ্যাপে... দ্রুত ক্লিক! সার্ভার ডাউন, ঘুরছে, খুলল অবশেষে

কাঁদোকাঁদো গলায় প্রলাপের মতো লাইভ বকে চলেছে ওই ছেলেটা, পাবলো। “আমি কান্না রুখতে পারসি না বন্ধুরা... আমি এইখানে এই প্লাটফরমে আমার বান্ধবীকে নিয়ে ভিডিয়ো করসিলাম! এই রেলওয়ে ট্র্যাকে ভীষণ বড়ো একটা ট্রেন... তারপর থেকেই ন্যান্সিকে আর খুঁজে পাস্‌সি না! আমি যে কী করি! তোমরা কমেন্টে সাজেশন দাও বন্ধুরা! ভিডিয়োখানা প্রচুর প্রচুর শেয়ার করো!... এইখানে অনেক লোক, আমি কী করি, আমায় কমেন্টে জানাও...”

ন্যান্সির মা চারবার ভিডিয়োটা দেখল। বুঝতে পারছে না এটা কি রিল? না আসল? মনীশকে হোয়্যাটসঅ্যাপে ধরে ‘মনটা বড়ো আনচান করছে গো?’

ইতিমধ্যেই মনীশের অফিস কলিগ সুব্রত একটা হোয়্যাটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে ফেলেছে, টকাটক অ্যাড করে ফেলল অনেক চেনা অচেনা নাম্বারকে। গ্রুপ চ্যাটিংয়ে আলোচনা চলছে ‘ন্যান্সি মিসিং ফ্রম হার ভিডিয়ো টুডে! বাট হাউ অ্যান্ড হোয়াই?’ সবাই কিছু না কিছু বলছে, সবাই চিন্তিত! ভাবনা ভাইরাল হচ্ছে! নোটিফিকেশনের বন্যা... কেউ একজন মুসৌরি ভ্রমণের এস্টিমেট পাঠিয়ে দিল, সব গ্রুপেই হয়তো এমনই পাঠায়!   আরেকজন কেউ আরও একটা গ্রুপ ক্রিয়েট করেছে, তাতে ন্যান্সিকেও অ্যাড করে দিল! আর সবচেয়ে আশ্চর্যের, ন্যান্সি নিজেও ওখানে রিপ্লাই করছে! — “আয়াম ফাইন নাউ, এনজয়িং মাই টিকটকার্‌স ডে!..”

এটা কী করে হল মনীশ? ন্যান্সির ফোন কি তাহলে চুরি গেল?’ গ্রুপ ডিসকাশন শুরুর আগেই কে যেন ততক্ষণে  আরও একটা গ্রুপ বানিয়ে ফেলল ‘ন্যান্সিসেলফোন মিসিং গ্রুপ

কলিং বেল বাজল। ন্যান্সির মা দৌড়ে যায় দরজা খুলতে। হয়তো দরজা খুললেই রোজকার মতো মেয়েটা বলবে “মা খেতে দাও, ভীষণ খিদে পেয়েছে!’

No comments:

Post a Comment