লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Sunday, September 25, 2022

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শারদ সংখ্যা

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটোগল্প


জিলিপি

 

সন্ধে হচ্ছে। যদিও ঘুরঘুট্টি অন্ধকার নামতে দেরি আছে। এখন চারপাশে বিকেলমরা ছাই ছাই রঙের আলো। খানিকটা কুয়াশার মতো। তেতে ওঠা দিনের শেষটুকু চেটেপুটে নিচ্ছে বাতাস। অজস্র কিচিরমিচিরের মধ্যে বড়ো রাস্তার ধারে জেগে উঠছে সান্ধ্যকালীন বাজার।

এধারে মাঠ। মাঠের শেষে কালীমন্দির থেকে কাঁসরের শব্দ ভেসে যাচ্ছে ওধারের ক্ষেতে। মন্দিরের পাশ দিয়ে যে ইটের রাস্তাটা হরিপুরা গঞ্জের দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তায় বৈশাখী অমাবস্যার মেলা বসেছে। একে একে কাঠিভাজা, গজা, জিলিপির দোকানগুলি বাঁশের ঠেকনা ওঠাচ্ছে। হুক করে আনা আলোয় বিশাল স্টোভে রসে জাল দেওয়া চলছে। কড়া মিঠে আর ভাজার গন্ধ ধোঁয়া হয়ে উঠে যাচ্ছে।

বড়ো রাস্তার ওধারে দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেতের ঢাল বেয়ে শেষ গোধূলির আলোয় উঠে আসছে একটা মুখ। প্রথমে উঠে এল রুক্ষ কোঁকড়ানো চুল, ঘোলাটে দুটো চোখ, আর উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ডিম্বাকৃতি মুখমণ্ডলে নরম দাড়ি-গোঁফের মাঝমধ্যিখানে জেগে থাকা অল্প কালচে ঠোঁট। তারপর ঈষৎ ঝুঁকে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এল নস্যি রঙের হাফশার্ট আর কালো প্যান্ট পরা রোগাটে একটা শরীর। বেঁটেখাটো ছেলেটা বড়ো রাস্তায় উঠে দুই হাত ঘষে ঘষে ঝাড়লো। তারপর টলতে টলতে কালীমন্দিরের পাশের রাস্তায় এগিয়ে গেল সে।

আজ শুধু চুমকি বিবি জানে, ইমরোজ গঞ্জে ঢুকেছে।

দুই হাত মুঠো করে প্রাণপণ চাপ দিল চুমকি। নলকূপ ককিয়ে উঠল। লোহার বালতিটায় লালচে জল নেমে এল। ভরা বালতিটা উঠোনের ধারে বয়ে নিয়ে গেল। কলঘরের টিনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। জাফরিকাটা খোপের ফাঁক বেয়ে শেষ বিকেলের লাল আলো এসে পড়েছে প্রায়ান্ধকার চৌখুপিতে। অনেকটা সময় নিয়ে যত্নে গা ধুয়ে নিল চুমকি।

ঘরে ঢুকে আলো জ্বালালো সে। ঘরটা একটেরে। জোরালো ডুমলাইটে সবুজ দেওয়াল দৃশ্যমান হল। সবুজ রংটা একবছর আগে নিকাহর সময়ে করিয়েছিল রহমত। তার জন্য চুমকির আব্বার থেকে টাকা আদায় করেছিল, সে জানে। টাকা দিতে ভ্যানরিকশাটা বেচে দিয়েছিল চুমকির আব্বা। এখন মালপত্তর নিয়ে হেঁটে বড়ো রাস্তার বাজারে যায়। শীতের সময় গায়ে লাগে না। ভরা গ্রীষ্মে কষ্ট হয়। সবুজ রং চোখে লাগে বলে চুমকি প্লাস্টিকের কালো কালো প্রজাপতি এনে দেওয়াল সাজায়।

মেটে রঙের ছাপা শাড়িটা ফুলে আছে। আয়নার তাক থেকে কুমকুমের বাটিটা পেড়ে এনেও আবার রেখে দিল চুমকি। কড়কড়ে মাড় দেওয়া শাড়িটার ভাঁজে ভাঁজে হাত চালিয়ে ফুলে ওঠা শাড়িটা বাগে আনলো। যত্ন করে হলুদ টিপের ফোঁটা দিল কপালে। আলতো আলতো আঙুল চালিয়ে হাতখোঁপার কাঁটাগুলো পরীক্ষা করে নিল। তারপর চৌকির তলা থেকে বের করে আনলো একটা জুতোর বাক্স। জুতো নেই। ভিতরে একটা ছেনি, দুটো ছোটো ছোটো হাতুড়ি, দিঘা থেকে কুড়নো কিছু ঝিনুক আর এক আঙুল লম্বা একটা শিশি। আতরের। রহমতের। লুকিয়ে রাখে। রহমতের না ফেরার দিনগুলোতে চুমকি লুকিয়ে লুকিয়ে আতর মাখে।

গলায় আর কাঁধের মাঝে আতর ঘষে নেয়। কব্জিতেও আতর দেয়। তারপর পয়সা ক’টা গুনে নিয়ে হাতব্যাগটা মুড়ে ফেলে বুকের ভাঁজে চালান করে। আলো নিভিয়ে ঘর বন্ধ করে চারপাশটা দেখে নেয়। সাবধানের মার নেই। বাড়ির পিছনে একটা মজা খাল। লোকে বলে সোনাই খাল। সেদিকটা দেখে এসে নিশ্চিন্ত হয়। সন্তর্পণে বেরিয়ে যায় চুমকি।

ঘন আলোয় ঢুকে কপালের ঘাম মুছে নিল ইমরোজ। গুমোট গরমে ভিড় বাড়ছে মেলায়। এদিকটা আগে ফাঁকা ফাঁকা ছিল। এখন দুয়েকটা বাইরের লোকের দোকান বসছে। হরিপুরা গঞ্জ খুব তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে। ছেলেপুলেরা শহরে চলে যাচ্ছে। শহরের পয়সা নিয়ে এসে বাড়ি-ঘর পাকা করছে। ক্ষেতখামার এখনও কিছু বেঁচে আছে বটে, কিন্তু মানুষের বুকের ভিতর থেকে ক্ষেতখামার উঠে যাচ্ছে। সরে যাচ্ছে। বদলে ইটের রাস্তা বসছে। পাঁচিল উঠছে। বুকের ভিতর থেকে ঢালাইয়ের একটানা আওয়াজ আসছে।

ইটের রাস্তাটার একধারে বাদামি কাপড়ে ঘেরা জায়গা। বাইরে টুনিবাল্ব জ্বলা গায়ে একটা রোবট দুই হাত ওঠাচ্ছে নামাচ্ছে। রোবটটার হাতে ধরা একটা গ্লোসাইন বোর্ড। তাতে লেখা- ‘ভিডিও নাইট’। ‘ভিডিও নাইট’ উঠছে, নামছে। ভিডিও নাইটের তাঁবুর পাশে একটা ভাজা মিষ্টির দোকান। অস্থায়ী। ভাজা মিষ্টির গন্ধে ইমরোজের পেটের খিদেটা ঘুলিয়ে উঠল। কাঠের বারকোশে থরে থরে সাজানো জিবেগজা, কাঠিভাজা, জিলিপি, খাজা। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দুটো নোট বের করে আনলো। একঠোঙা জিলিপি কিনে একটুকরো ভেঙে ঠোঁটের ভিতর দিতেই সকাল থেকে উপোসি পেট চনমনিয়ে উঠল। ইমরোজ এগিয়ে চলল।

মেলার আলো পেরিয়ে গেলে বাকি পাড়াটা অন্ধকার। অন্ধকারে দূরে দূরে একটা দুটো দোকান। দোকানের ভিতর টিমটিমে আলো। নিভু নিভু টিউবলাইট। এই এলাকায় বিদ্যুতের সমস্যা খুব। কয়েকটা পেটোয়া লোক অবশ্য নিজেদের ঘরে আলোর ব্যবস্থা করেছে। তাদের ঘরে বাকিরা চোখ টেরিয়ে তাকায়। সমীহ করে। সোনাইয়ের খাল বুজিয়ে সেখানে চিনিকল বসবে। তখন সঠিকভাবে আলো আসবে। ইমরোজ শুনেছে।

পালপাড়ায় ঢোকার মুখে ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আলো। হলুদ হলুদ আলোয় ইমরোজের চোখে হাসি দেখা দিল। দূর থেকে মুখোমুখি এগিয়ে আসছেন একজন। বাদামি পাঞ্জাবি আর সাদা ধুতি পরে এগিয়ে আসছেন জগৎজ্যোতি ভট্টাচার্য। হরিপুরা উচ্চবিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক। জগৎ স্যারকে দেখে ইমরোজ মাথা ঝুঁকিয়ে হেসে দাঁড়িয়ে পড়ল। 

‘তুই ইমরোজ না?’ ক্লাসে প্রথম হওয়া ছাত্রকে চিনতে পারলেন জগৎ স্যার।

‘হ্যাঁ স্যার। ভাল আছেন?’

‘ওই আর কী? যেমন থাকি। তা তুই আজকাল এখানে থাকিস না?’

‘না স্যার। মাঝেমাঝে আসি’।

‘থাকিস কোথায়? কী করিস’?

‘কলকাতার দিকে থাকি। বড়বাজারে একটা মশলা কারখানায় কাজ করি’। নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিতে দিতে ভিতরে আত্মবিশ্বাসের ঢেউ টের পাচ্ছে ইমরোজ।

‘আর পড়লি না কেন? ভাল ছাত্র ছিলিস। এভাবে ছেড়ে দিলি?’

‘আব্বা হুট করে মরে গেল। জমিজমা নেই, খাওয়ানোর কেউ নেই। কাজ খুঁজতে গিয়ে আর পড়া হল না’। ইমরোজের স্বরে ঈষৎ তাচ্ছিল্য লেগে রইল।

‘আজকাল তো কত নাইট কলেজ হয়েছে শুনেছি। সেখানে যেতে পারিস না?’

‘রাতে অন্য কাজ করি’। রোয়াব চেপে জবাব দিল ইমরোজ। ভিতরটা তার ফেটে যাচ্ছে।

হাল ছেড়ে দিলেন জগৎ স্যার। ‘অ! যা ভাল বুঝিস কর। ভাল থাক! ভাল থাক!’ বলে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। ইমরোজ এগিয়ে গেল।

খানিক এগিয়ে পিছনে ফিরতেই অবাক হল সে। জগৎ স্যার দাঁড়িয়ে পড়েছেন। পিছু ফিরে তাকে দেখছেন। চোখাচোখি হতে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। কাছে গেল ইমরোজ। মাথাটা ঝুঁকিয়ে জরুরি ভঙ্গিমায় জগৎ স্যার বললেন, ‘যা করবি ভেবে করবি বাবা। মনে নেই? ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না! 

পালপাড়ার মোড় থেকে অল্প দুলে দুলে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন স্যার। ডানদিকে ঘাড় হেলিয়ে দিল ইমরোজ। ঠোঙা থেকে আরেকটা জিলিপি তুলে কামড় বসালো সে। এগিয়ে গেল খানপাড়ায়, নিজের ভিটের দিকে।স্কুলবাড়ির সামনে খোলা জমি। হাল আমলে জমিটার গায়ে রাস্তাটা পিচের হয়েছে। ইমরোজদের সময় ঘাস উঠে মাটির পায়ে চলা পথ ছিল। পথটা উঠে গেছিল সোজা এক তলার করিডোরে। দুটো সিঁড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে ক্লাসের আগে ঘন্টা বাজায় গোবিন্দদা। ইমরোজ ভাবে, কতকাল দেখা হয়নি।

হলুদ স্কুলবাড়ি ছাড়ালেই বাঁশবাগান। এখন সেখানে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। এখান থেকে খানপাড়া অবধি আলোর ব্যবস্থা নেই। কবে হবে জানা নেই। রাগে একটা গালাগালি বেরিয়ে আসে মুখ থেকে। মাথাচাড়া দেওয়া রাগটা থামাতেই ঠোঙা থেকে আরেকটা জিলিপি তুলে মুখে পুরে দেয় ইমরোজ। পেটের ছুঁচোটা আপাতত শান্ত হয়েছে। আরও দুটো জিলিপি পড়ে আছে ঠোঙায়। ঠোঙাটা মুড়িয়ে রাখে সে।

শিকদারদের উঠোন পেরোলে পুকুর ধারের পথ দিয়ে ভিটেয় ঢোকা যায়। না হলে কসাইপাড়া দিয়ে যেতে অনেকটা ঘুরপথ হয়। শিকদাররা এপাড়ার সম্পন্ন পরিবার। দোতলার ঘরে লো ভোল্টেজে টিউব জ্বলে। ক্ষীণ আকাশি দেওয়াল দেখা যায়। খোলা জানালার বাইরেটা আলো হয় না। শুধু ঘরটুকু দেখা যায়। বাড়ির পিছনেই শিকদারদের বাগান। পাঁচিলের অনেকটা ভাঙা। ভাঙা পাঁচিল দিয়ে ঢুকলেই ইমরোজের ভিটে। আব্বার ভিটে। টালি চালের নিচে দুটো পাকা ঘর। বন্ধ পড়ে থাকে। প্রায় ভগ্নদশা। সাপখোপের রাজ্য হয়েছে শুকনো কুয়োতলা। পিছনে বয়ে গেছে খাল। লোকে বলে সোনাই খাল।

অনেকক্ষণ গুমোটের পরে পুকুরধারে হাওয়া দিচ্ছে। হয়ত দূরে কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। সেদিক থেকে বাতাস আসছে জলের গন্ধ মেখে। ইমরোজের শরীর জুড়িয়ে যায়। হাওয়া খেতে বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে বসে পড়ে সে। এই ঘাটে খেলতে আসত সে। মা মরা ছেলে, বাপটা সারাক্ষণ লোকের জমিতে মুনিষ খাটে, তবে লেখাপড়ায় মাথা ছিল। তাই দুয়েকজনের সমীহ জুটে যেত। সম্পন্ন শিকদাররা খানপাড়ার অন্য বাচ্চাদের দূর দূর করলেও ইমরোজ ঘাটে বসার নীরব অনুমতি পেয়েছিল। এই ঘাটে বসে ভরা দুপুরে সে ভাবত, সে কে? কোন ধুলোমাটি থেকে সৃষ্টি হল? এই বিপুল পৃথিবীতে তার নিজস্ব অস্তিত্বের প্রমাণ কী? একটা শরীর? এই-ই প্রমাণ? এর বাইরে কিছু নেই? এর বাইরে যদি কিছু থাকে তবে কী সেই অদৃশ্য যোগ যা তার অস্তিত্বের প্রমাণ?

‘কে রে? কে ওখানে? ওখানে কে বসে?’

   হাতে জিলিপির ঠোঙাটা একমনে দেখছিল ইমরোজ। আচমকা আরেকজনের উপস্থিতি জেনে মুখ তুলল সে।

ওহ! এ তো মিনতি চাচির গলা। রাগত কন্ঠস্বর। ইমরোজ টের পেল। ফের ভিতরের আত্মবিশ্বাস ঢেউ খেলে গেল যেন। ঘাড় ফিরিয়ে বলল, ‘আমি। ইমরোজ। বাগানধারে সৈয়দের ছেলে। মনে পড়ে?’

গোলাপি শাড়ি পরে মিনতি চাচি এগিয়ে এলেন। আধখানা চাঁদের আলোয় ভাল করে ঠাহর করে নিশ্চিন্ত হলেন। খুশিও হলেন। মুনিষের ছেলেটাকে ছোটবেলায় খেতে দিতেন। শুকনো মুখে পুকুরঘাটে এলে দোতলার জানালা বা ছাদ থেকে ডেকে নিতেন। ডাকখোঁজ ছিল অনেকদিন। তারপর সৈয়দ মুনিষ মরল, ছেলেটা শহরের দিকে কোথায় যে চলে গেল! এতদিন পরে দেখা।

‘ছিলিস কোথায় তুই? ভিটেয় তো ঘুঘু চড়ে! কোথায় পড়ে থাকিস?’

‘কলকাতায় থাকি গো চাচি। একটা মশলা কারখানায় কাজ করি’।

‘এখানে বাপ-ঠাকুরদার গেরাম ছেড়ে অতদূরে অনাথের মতন পড়ে থাকা কি ভাল? লেখাপড়া করিস আর?

‘ছেড়ে দিয়েছি’। হাসিমুখে জানায় ইমরোজ।

‘এখেনে জমির কাজ করতে পারিস না?’

‘পারি না। শিখিনি কিছু’।

‘থাকবি ক’দিন? 

‘আজ রাতেই ফিরে যাবো’।

‘সে কি! এতকাল পরে বুড়ি ছুঁতে ভিটেয় ফিরলি?’

‘একটা কাজ আছে’। ইমরোজ টের পায় উত্তেজনায় মাথার ভিতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। তবু নম্রস্বরে উত্তর দেয়। মিনতি চাচি ছেলেবেলায় তাকে খেতে দিয়েছে। মায়াটান ছিল।

চাচি কী বুঝলেন কে জানে, ‘দেখিস ব্যাটা, কুসঙ্গে পড়িস না! অভাবে স্বভাব নষ্ট করিস না!’ বলে শিকদারদের উঠোনের দিকে হাঁটা লাগালেন।

আরেকটা জিলিপি খেতে গিয়ে থেমে গেল ইমরোজ। ঘাট থেকে উঠে পড়ল। বাগানের ভাঙা পাঁচিলের দিকে হাঁটতে শুরু করল। অনেকক্ষণ পর টের পেল, সে অল্প অল্প জেগে উঠছে!

ভিটের ধারে পাঁচিলের গা ঘেঁষে অন্ধকারে মিশে দাঁড়িয়ে ছিল চুমকি। এখন চুমকি বিবি। ইমরোজকে টের পেয়ে আঁকড়ে ধরল। খয়াটে বুকের মধ্যে টেনে নিল। কথা বলার সুযোগ পেল না ইমরোজ। তার জিভে মিশে যাচ্ছে চুমকির জিভ। নাকে আসছে আতরের কড়া গন্ধ… 

এখন ভোর। ঠিক ভোর নয়। শেষ রাত শেষ হওয়া ভোর। ক্ষেত থেকে যেমনভাবে সূর্য বিদায় নিয়েছিল, তেমনভাবে ফিরে আসছে সে। একই রং ছড়িয়ে। একই প্রগলভতায়। ক্ষেতের শেষ প্রান্তে উঁচু ঢিবিটায় ঘাসের ওপর বসে আছে ইমরোজ। শরীর ক্লান্ত। চুমকি, তার ছেলেবেলার চুমকি, অন্যের হয়ে যাওয়া চুমকি তাকে নিঃশেষ করেছে কাল। সে খুব ভালবাসে এই মেয়েটাকে। তার চেয়েও বেশি ভালবাসে আলি সাহেবকে। হিসেবমতে আলি সাহেবের সব কথা মিলে গেছে! বাধা আসবে। আলি সাহেব বলেছিল বাধা এলেও সে যেন না ডরায়।

সেই দুপুরটা আজও মনে করতে পারে ইমরোজ। তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। সবাই ভিড় করে এসেছিল বড়ো রাস্তার ধারে। জায়গাটা ঘিরে রেখেছিল পুলিশ। একইরকম দুলে দুলে রাস্তা পার হচ্ছিলেন জগৎ স্যার। ব্রেক ফেল করেছিল পাঞ্জাব লরির। স্পটডেড।

বছর খানেক পরে একদিন রাতের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ইমরোজের। তখন আব্বা বেঁচে ছিল। এমন চিৎকার প্রায়ই আসে। তবু সেদিনকার চিৎকারে অন্য কিছু ছিল। আকাশ ফাটিয়ে ফেলার মতন কিছু। ‘চল তো দেখি!’ বলে উঠে বেরিয়ে গিয়েছিল আব্বা। শেষমেশ শিকদারদের উঠোনে পৌঁছে ভয়ংকর দৃশ্য দেখেছিল ইমরোজ। শিকদারদের ছোটো চাচা মদ খেয়ে এসে বাড়াবাড়ি রকমের অশান্তি করছিলেন। মিনতি চাচির ধৈর্য ভাঙতে তেড়ে গিয়েছিলেন। তাতেই উঠোনের ধারে পড়ে থাকা বাঁশ নিয়ে এসে স্ত্রীর মাথায় সজোরে বসিয়ে দিয়েছেন শিকদার চাচা। স্পটডেড।

আলি সাহেবের সবকটা কথা মিলে যায়। আলি সাহেব তার প্রাণের বন্ধু, পথপ্রদর্শক। ইমরোজ তার কালো প্যান্টের পকেট থেকে বের করে আনলো পিতলের কৌটো। প্যাঁচ কষে আটকানো। আলি সাহেবের দেওয়া। ঢাকনা খুলে দেখে নিল। ভিতরে কিছুটা লাল ভরেছে সে। কালচে। শুকিয়ে এসেছে। আকাশের রঙের সাথে মিল নেই।

প্যাঁচ বন্ধ করে পকেটে পুরে উঠে পড়ল ইমরোজ। খাল পেরিয়ে ট্রেন ধরবে সে। খিদিরপুরের গুমটিতে আলি সাহেবের কাছে যেতে হবে। 

ভোর কেটে এখন সকাল। সাতসকাল। শিকদারদের বাগানে বছর কয়েক আগে মিনতি চাচির মতন চেঁচিয়ে উঠল কেউ। মেটেরঙের শাড়ি জড়ানো মেয়েটা চিত হয়ে পড়ে। মুখটা চেনা চেনা লাগে। পাশের পাড়ার মেয়ে। চোখদুটো আধবোজা। মাথাটা বাঁ দিকে ফেরানো। ঠোঁটের চারপাশে জিলিপির মতো কিছু গুঁড়ো হয়ে লেগে আছে। বাঁ দিকের কষ বেয়ে গ্যাঁজলা নেমে গেছে। সাথে ডান পায়ের গোছে শাড়িটা উঠে গেছে। সেখানে বেশ কিছুটা জায়গা কাটা। রক্ত শুকিয়ে গেছে। মাছি ঘুরছে।

ভিড় বাড়ছে। ঘিরে থাকা ভিড় থেকে বেরিয়ে এল কেউ কেউ। তড়িঘড়ি পাশের গ্রামে রহমতের দ্বিতীয় সংসারে ছুটে গেল কেউ কেউ।

‘ওরে রহমত! ঘরে আছিস? শিগগির চ! তোর বিবি বিষ খেয়েছে!’

 

                        সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment