লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Sunday, September 25, 2022

কিঞ্জল রায়চৌধুরী, শারদ সংখ্যা

কিঞ্জল রায়চৌধুরী'র ছোটোগল্প 

 নষ্টনীড়

নিজের নাম থেকে আ-কারটা ঘষে ঘষে তোলবার চেষ্টা করে চলেছে মিতা। ওরকম প্রতিবারেই করে। বিশেষ করে রাস্তায় অন্বেষাকে মুখোমুখি দেখলেই তার না-পাওয়া ইচ্ছেগুলো রক্তের ভেতর খলখলিয়ে ওঠে। তখন যেন আরও বেশি করেই সে তার মেয়ে-জন্মটাকে গায়ের জোরে অস্বীকার করতে চায়।

ক্লাস এইটে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারপর থেকেই মায়ের সুখ শান্তি গেছে উবে। মা, নীলিমা, এমন একটা সন্তান পেটে ধরবার আক্ষেপে দগ্ধ হতে হতে এখন কেবলমাত্র পোড়া ছাই হয়ে ধিকিধিকি জ্বলছেন। মায়ের জ্বলনে মিতার অবশ্য ভ্রূক্ষেপটুকুও নেই। সারাক্ষণ এক মর্দানি গরমে তার অন্তর বাহির টগবগ করে ফুটছে।

প্রথমটায়, বড় হওয়ার সন্ধিমুহূর্তে সে নিজেও নিজেকে নিয়ে বিস্মিত হয়েছিল। ছোটো করে ছাঁটা বয়কাট চুলে, দাড়িগোঁফ না গজানো আপাত মসৃণ গালের ওপর একপরত কাঠিন্য দেখে অবাক হত ঠিকই, কিন্তু নিজেকে কখনোই বেমানান মনে হয়নি তার। ব্রণ খুঁটে খুঁটে মুখে ইচ্ছাকৃত দাগ ফেলে তার মজা বেড়ে যেত তিনগুণ। বার-দুয়েক রেজারও চালিয়েছে গালে। দাড়ি-গোঁফ গজায়নি, গাল কেটে রক্তাক্ত হয়েছে। ব্লেডের সেই দাগ এখনও পুরোপুরি মেলায়নি, যত দিন গেছে, প্রথম রক্তক্ষরণের সেই আনন্দ তাকে শিহরিত করেছে! তাই সাইকেল থেকে নামার সময় প্রথম যেদিন রায়ান তার হাফ প্যান্টের নিচে তাকিয়ে চমকে উঠেছিল, বুঝিবা অ্যাক্সিডেন্টালি রক্তপাত ঘটেছে ভেবে— তার গালে আলতো চাপড় মেরে মিতা বলেছিল--‘হোতা হ্যায় বস্!’ সেই থেকে রায়ান তার বেস্টি। শুধুই বেস্ট ফ্রেন্ড, একটা ছেলে যেমন আরেকটা ছেলের ভালো বন্ধু হয়। কী আর করে বেচারা রায়ান! সে তো আর চাইলেও বান্ধবী হতে পারবে না!

তাই বলে নীলিমা, নিজের মা হয়ে এসব মানবেন কেন? সোমত্থ মেয়েটা গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি চাপিয়ে, হাফপ্যান্ট পরে, সাইকেল চড়ে চৌপ্রহর চারিদিকে টো-টো। দিন নেই রাত নেই, রাজ্যের রকবাজ ছেলেবন্ধু জুটিয়ে পাড়ার মোড়ে আড্ডা। তবু যদি তাদের কাউকে নিয়ে লটরপটরের কেচ্ছা রটত, কলঙ্ক হলেও সেটা বুঝিবা সহ্য করে নেওয়া সহজ হত। কিন্তু না, এ মেয়ে যেন সাক্ষাৎ অভিশাপ— এরকমটাই মনে হয় নীলিমার। একদিন তুমুল ঝগড়ার পর সটান মায়ের সামনে এসে শার্ট ছিঁড়ে খালি গায়ে বুক খুলে দাঁড়িয়েছিল মিতা। ‘মর আবাগি! মর মর …দিদিটা শ্বশুরবাড়ির মুখ পুড়িয়ে বাপের ঘর জ্বালাতে ফিরে এসেছে, গলায় দড়ি জোটেনি… এবার তুই অন্তত মরে আমাদের শান্তি দে!...’ বলতে বলতে মায়ের কন্ঠস্বর ক্রমশ বিলাপের মতো ঘ্যানঘ্যান করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে থেমে গিয়েছিল। এখন আর মেয়েকে কিছু বলেন না নীলিমা। ক্ষয়াটে চেহারা নিয়ে, রক্তশূন্যের মতো সাদাটে চাহনি চোখে মেখে ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকেন।

রবীন্দ্রনাথ অতশত বোঝেন না। শুধু বোঝেন তাঁর ছোটো মেয়েটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। প্লাম্বার রবীন্দ্রনাথ সারাটাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি সেরে ফিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলবার অবকাশটুকু পান না। ছোটো মেয়ে যে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে সেটা বুঝেও বোঝেন না করনীয় কী! অবশ্য বড়োটাকে নিয়েও যে মনে খুব উচ্চ আশা কোনোদিন পুষেছিলেন তা নয়; তবু বয়সযোগ্যা মেয়েকে ভালো ঘরে পাত্রস্থ করে সুখী দেখতে কোন বাবা-মা না চায়!

রবীন্দ্রনাথ দেখেশুনেই বড়ো মেয়ে গীতার বিয়ে দিয়েছিলেন। সে বিয়ে টেকেনি। মাস-ছয় গড়াতে না গড়াতেই শ্বশুরবাড়ি থেকে পাহাড়প্রমাণ অভিযোগ। ক্রমে সেসব অভিযোগের কথা হাওয়ায় মিশে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে ফিরে আসতে লাগল রবীন্দ্রনাথের কানে।

প্লাম্বার রবীন্দ্রনাথের দুই মেয়ের কেচ্ছা পাড়াশুদ্ধু লোকের জানা। 

মেয়েটা যে তোমার দেখতে হতকুচ্ছিত, সেটা তো আর মিথ্যে নয় রবীন! ...তার ওপর যদি ঘরের কাজকম্মো রান্নাবান্নাটাও ঠিকঠাক না করতে পারে— সে ভারি লজ্জার কথা…

নটুদার চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে পাড়ার বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ লোকেদের মুখে মাঝেমধ্যেই এইসব শুনতে হত। রবীন্দ্রনাথ রা কাড়তেন না। চুপচাপ শুনতেন। ভিজে সপসপে হাফশার্ট আরও ভিজে যেত ঘামে। কাঁধের ওপর ফেলা গামছা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কপালের ঘাম মুছতেন।

এ-ও না হয় একরকম মেনে নেওয়া, সয়ে নেওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু ছোটো মেয়ে মিতা তার বাবার মানসম্মানের তলানিটুকুও যেন ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চায়! কলমিস্তিরি হলেও রবীন্দ্রনাথের একটা ইজ্জত তো আছে। তাকে এলাকাতেই করে খেতে হয়।

ফ্ল্যাটবাড়ির এক বাবুর ছেলে লন্ডন না কোথা থেকে কীসব কোর্সটোর্স করে এসেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বললেন, মিতাকে ভালো ডাক্তার বা সাইকি দেখান রবি কাকু। বললেন, অনেকের মধ্যেই এমন দোগলা লক্ষণ দেখা যায়। আদিমকাল থেকে পশুপাখিদের মধ্যেও এমন দেখা গিয়েছে! রবীন্দ্রনাথ এতসব জটিল ব্যাপার বোঝেন না। এমনও হয়! কই আমাদের বেলায় তো কারওর মধ্যে এমন কোনোদিন দেখিনি! দেখেছি কি! সংশয় দানা বাধে মনে। তুই এমন কেন হলি মা!...

আজ ঘরদোরের জিনিসপত্র ঘেঁটে তছনছ করে ফেলেছে মিতা। পুরোনো বাক্সপ্যাঁটরা খুঁজে খুঁজে বের করে এনেছে তার বার্থ সার্টিফিকেট। মেঝেয় ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে সার্টিফিকেটের নাম থেকে আ-কারটা চিরতরে মুছে ফেলতে চাইছে। সে মিতা থেকে ‘মিত’ হতে চায়। তারপর অন্বেষাকে ভালোমতো টের পাইয়ে দেবে তাকে রিফিউজ্ করার খেসারত কেমন করে দিতে হয়। ইরেজার ঘষে ঘষে কালো করে ফেলেছে নামের আ-কার। আ-কার তো নয়, এ যেন জন্মদাগ।

মিতার দিদি গীতা, হতকুচ্ছিত কালো মেয়ে গীতা--শ্বশুরবাড়ির কালি মেখে যেন আরও কালো হয়ে উঠেছে। মা কিছু বলছে না দেখে তাকেই এগিয়ে আসতে হল। কী করছিস তুই মিতা? পাগল হয়ে গেলি?

তুই থাম! —মিতা মুখঝামটা দিয়ে ওঠে। নিজের তো মুরোদ ছিল না একটা প্রেম করবার। সলমানকে মুখ ফুটে বলতে গিয়ে অপমানিত হয়ে কেঁচোর মতো গুটিয়ে গেলি! তারপর বাবা-মা যেখা‌নে হাতপা বেঁধে ফেলে দিল, সেখানে গিয়ে লাথি ঝাঁটা খেয়ে ফিরেও এলি মাথা নীচূ করে। তোকে সাফ বলে রাখছি দিদি, আমার ব্যাপারে একদম নাক গলাতে আসবি না! শুধু এটুকু জেনে রাখ, সলমানকে আমি ছাড়ব না।

নীলিমা দু-মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে মেরে যান। পুরোনো ড্রেসিংটেবিলের পারা-চটা আয়নায় তাঁর প্রতিবিম্ব ভারি বিচ্ছিরি দেখায়।

সলমানের অভিনয় একবারই দেখেছিল মিতার দিদি গীতা। পাড়ার ক্লাবের ‘নষ্টনীড়’ নাটকে। বইটা সে পড়েনি, তবে সিনেমার সৌমিত্রর সাথে মিলিয়ে দেখে মনে হয়েছিল সলমানই সেরা কিন্তু মনের সেই অভিজ্ঞতা সে কি জানাতে পারবে সলমানকে? সলমান গরিব কিন্তু শিক্ষিত ছেলে। ফর্সা, হালকা দাড়িগোঁফ। দেখতে ভারি মিষ্টি। নাটক করা ছেলে হলেও তার কোনো অহংকার নেই। খদ্দরের গোলাপি শার্ট পরে সাউথ সিঁথির মোড়ে টেবিল পেতে দিনেরবেলায় চা-বিস্কুট বিক্রি করে। কলেজের ছেলেমেয়েরা ঝাঁক বেঁধে ভিড় জমায় সলমানের চায়ের দোকানে। সলমানের চায়ের বিশাল চাহিদা। এতসব জেনেও গীতা একদিন তার অফুরান ভালো লাগা বুকে নিয়ে সলমানের দোকানে গিয়ে সাহস করে বলেছিল, আমি আপনার অভিনয় দেখেছি। একদম প্রথম লাইনের চেয়ারেই বসেছিলাম। আপনি আমাকে দেখেননি?

কই না-তো! ঠিক খেয়াল করিনি। যাই হোক, আমার অভিনয় ভালো লেগেছে, জানানোর জন্য ধন্যবাদ।

আর কিছু বলেনি সলমান। একবারের জন্যেও ফিরে তাকায়নি তার দিকে। কলেজের মেয়েগুলোর দুধ কম, চিনি বেশি এসব নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এক ভাঁড় চা-ও কি তার প্রাপ্য ছিল না! সে না হয় পয়সা দিয়েই খেত। যেন তার কোনো অস্তিত্বই সলমানের চোখে পড়ছিল না সেদিন! গীতা আর দাঁড়ায়নি। সেই প্রথম, সেই শেষ।

কিন্তু এইমাত্র কী বলল মিতা? সলমানের ওপর ওরই বা এত রাগ কিসের? দিদির ওপর দরদ থেকে নিশ্চয়ই নয়!

কী হয়েছে, আমায় খুলে বলনা বোন!

মিতা ঝট করে ঘাড় তোলে যেন ফণাওঠা সাপ। তার জলভরা চোখ আরও বেশি লালচে দেখায়। দু’হাত দুপাশে ছিটিয়ে চিৎকার করে ওঠে –‘অন্বেষা আমার! শুধু আমার আমার আমার!...তোর সলমান আমার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি শেষ করে দেব সলমানকে…’

শান্ত হ বোন!

চুপ থাক তুই! আর হ্যাঁ, আমি কারও বোন-টোন নই।

আবার বার্থ সার্টিফিকেটের ওপর ঝুঁকে পড়ল মিতা। এবার আর ইরেজার নয়। আ-কারটাকে ব্লেড দিয়ে ঘষটে তোলার চেষ্টা করছে। চোখ থেকে টপটপ করে দু’বার নোনা জল পড়ল বার্থ সার্টিফিকেটে। মনে পড়ছে স্কুল ছাড়ার আগের দিন অন্বেষার গালে চুমু খাওয়ার কথা।

ক্লাসে দুজনে একসঙ্গেই থার্ড বেঞ্চে বসত। পড়ার নোটস ভাগাভাগি করত, টিফিন ভাগ করে খেত। আর সুযোগ পেলেই অন্বেষার হাতটা মুঠোয় চেপে ধরত। মেয়েদের অমন সহচরী খেলা হয়। কিন্তু এই সাধারণ ব্যাপারটা ক্রমশ বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। হাত ছাড়িয়ে নিতে শুরু করল অন্বেষা। দূরে সরে যেতে লাগল…

স্কুল ছেড়ে পুরোপুরি বখে গিয়েছিল মিতা। অন্বেষা দূর থেকে দেখলেও পাত্তা দিত না। মিতা ইলেক্ট্রিকের কাজ জানত, টুকটাক কাজ করত। কনস্ট্রাকশনের ইটবালি সাপ্লাইয়ের কাজ ধরল। লোন করে স্কুটার কিনেছে। সেই স্কুটারে ‘উড়তি ফিরুঁ’ ‘উড়তি ফিরুঁ’ করে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। আজ সিগারেটের দোকানে স্কুটার থামিয়ে গুটখা কিনছিল। তখনই হঠাৎ অন্বেষার সাথে দেখা। মিতা কথা বলতে যাবে…মুখ ফিরিয়ে নিল অন্বেষা। বয়ফ্রেন্ড ছিল। সে-ও চেনা। দিদির নষ্টনীড়ের নায়ক গোলাপি শার্ট পরা সলমান মন্ডল। তারই হাত মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাস্তা পারাপার হয়ে গেল অন্বেষা! দৃশ্যটা ভাবলেই মিতার চোখ জ্বালা করে উঠছে…পণ করেছে নামের শেষে আ-কার এবার কিছুতেই আর রাখবে না…

রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রপাতির থলে-হাতে বাড়ি ফিরছিলেন সাইকেলটা হাঁটিয়ে। পা চলছে না। প্যাডেল মারতেও ইচ্ছে করছে না আজ। এমনিতেই কলমিস্তিরির কাজ ভারি ঝামেলার। তার ওপর আজ পয়সাকড়ি পাননি। কাজটাই যে হল না পুরোপুরি। ফ্ল্যাটবাড়ির এক বাবুর বাথরুমে জল পাস হচ্ছে না। নালি জাম। জলভারা বাথরুমে উপুড় হয়ে পাইপ লাইনে এক হাত ঢুকিয়েও কিচ্ছু খুঁজে পাচ্ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। শার্ট প্যান্ট জলে ভিজে ঘেমেনেয়ে একাকার। নালির ভেতর যতদূর হাত যায়, সেঁধিয়ে দিচ্ছিলেন…নাহ্! কিচ্ছু নেই। নাকি চেষ্টা করেও পেরে উঠছেন না রহস্যটা জানতে। মাথায় ঘুরছে একটাই প্রশ্ন, ‘তুই এমন কেন হলি মা?’

No comments:

Post a Comment