Tuesday, October 5, 2021
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শারদীয়া সংখ্যা, উপন্যাস প্রথম পর্ব
তার হাতে মেঘ, অন্নজল
(ধারাবাহিক : প্রথম পর্ব)
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১
খুব ঠাণ্ডা, নরম মাটিতে পা রেখে কেঁপে উঠল নিমি। আলগোছে শীত আসবার খবর যেমন হয়। কালীবেদির ঠাকুর ভাসান গেল গত সপ্তাহে। এখন কার্তিক মাসের হিমভোরে মিটার ঘরের ভেজা রাস্তাটা বেমালুম ধোঁয়া হয়ে গেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে নিমির গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। রংজ্বলা ধুলোটে কালো ওড়নাটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে এদিক ওদিক তাকায় সে। ঘন সাদা কুয়াশার ভিতর বুড়োদাদাদের বাড়িটা, তুতানদের উঠোনখানা লোপাট হয়ে আছে। দু’হাত দূরের জিনিসও স্পষ্ট দেখা যায় না। নিমির খুব ইচ্ছে করে এই নকল মেঘের রাজ্যটাকেই এলোমেলো কেটে ফেলতে। ওর মনে হয় এর ভিতরে একবার ঢুকলে হয়তো আর বেরোবার উপায় থাকে না! এর ভিতরে আর সকাল হয় না, রোদ ওঠে না, রুপাইদের টিউবওয়েলের ঘন ঘন ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ বাড়ে না, সুশানকাকা দোকান খোলে না! এই ধোঁয়ার ভিতর শুধুমাত্র জেগে থাকে রায়বাড়ির বাগানটা। রায়বাড়ির পিছনের পাড়ায় পুকুরধারের ঘেরা বাগানটাকে নিমি সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।
রায়দের বাগানের খুব দুর্নাম এই পাড়ায়। ওদের বিশালাকায় চারতলা উঠোন-বাড়ির পিছনে যে একটেরে রাস্তাটা এগিয়ে গেছে মান্নাপাড়ার দিকে, সেই রাস্তার গায়ে পুকুরধারে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা নিরীহ ফুলের বাগানই ছিল সেটা। তবে সেই যে বছর তিরিশ আগে কিশোরীলালের প্রথমপক্ষের বউটার লাশ মিলল বাগানে, সেদিন থেকে পাড়া-বেপাড়ায় মুখে মুখে ভয় রটে গেল বেশ।
লোকে বলে কিশোরীলালের প্রথমপক্ষ ছিল ভারী সুন্দরী। ফর্সা আঁটসাঁট গড়নে সবচেয়ে বেশি চোখ টানত তার কোমর ছাপানো একঢাল কালো চুল। খুব লক্ষ্মীমন্ত আর মিশুকে ছিল নাকি সে। তখনও তার গা দিয়ে নতুন বউয়ের গন্ধ যায়নি, বড়ছেলে বুড়োর বয়স এক-দেড় বছর হবে, একদিন কাকভোরে রায়বাগানে ফুল তুলতে গিয়ে পায়ে বেলকাঁটা ফুটে মরে পড়ে রইল। এরপর কিশোরীলালের জ্যাঠতুতো দাদা বিজন রায়ের বাগানে শোকের বশে একটিবছর কালো গ্রিলের গেটে তালা পড়ে গেল। সেবছরে তো ভয়ের চোটে বেশি রাতে বাগানের পাশ দিয়েও যেত না কেউ। অনেকেই নাকি লাল ডুরে শাড়ি পরা, কোমর ছাপানো খোলা চুলে কিশোরীলালের বউকে বাগানে ফুল তুলতে দেখেছে। তারপর বাৎসরিক কাজ মিটে গেলে একদিন অপঘাতে মরা বউটার জন্য দুই রায়বাড়িই শোক ভুলে গেল। বাগানের আগাছা কেটে ফের যত্নআত্তি শুরু করলেন বিজন রায়। তার দু’মাসের মাথায় দ্বিতীয়পক্ষের বউ আনল কিশোরীলাল। পাড়ার মা-কাকিমাদের মুখে মুখে এখনও এসব গল্প ঘুরে বেড়ায়।
ধোঁয়াটে সাদা রাস্তা পেরিয়ে জং ধরা কালো গ্রিলের গেটটার দিকে এগিয়ে গেল নিমি। বাদামি কামিজের ভিতর রোগা শরীরটা বাকল তোলা গাছের মতো দেখতে লাগে। শীত আটকাতে ওড়নাটা ফের গায়ে টেনে নিয়ে আঠালো লালচে চুলগুলো পিঠে ফেলে দেয় সে। গ্রিলের তালা খোলা। তার মানে কিছু আগেই ফুলের সাজি নিয়ে ভিতরে ঢুকেছে বিজন জ্যেঠু। এখন এই সাজিভর্তি ফুল নিয়ে জেঠিমার চারতলার পুজোর ঘরে পৌঁছে দেওয়াই নিমির সকালবেলাকার প্রথম কাজ।
বেশ শব্দ করেই গ্রিল খোলে নিমি। ঘুম জড়ানো মফস্বলি গলিটার নিস্তব্ধতা মুহূর্তে ছিঁড়েকেটে যায়। চমকে তাকান বিজন রায়। তামাটে গায়ের রঙে কাটা কাটা চোখ মুখ, মাকন্দ গাল, লম্বা দোহারা চেহারার বছর বাষট্টির বিজন রায় তখন ফুল শার্ট আর নীল চেক কাটা লুঙ্গি পরে, গলায়-কানে মাফলার জড়িয়ে নতুন লাগানো ডালিয়ার পরিচর্যায় ব্যস্ত ছিলেন। নিমিকে দেখে বিরক্তিভরে বললেন, “হাতমুখ ধুয়ে এসেছিস?”
সম্মতিক্রমে ডানপাশে মাথা হেলিয়ে দেয় নিমি।
খুরপি দিয়ে মাটি তুলতে তুলতে ফের বিজন রায়ের প্রশ্ন, “ধোয়া জামা তো?”
এবার নিমি ভ্রু কোঁচকায়, বলে “হ্যাঁ গো হ্যাঁ। এবার তাড়াতাড়ি সাজি ভরে দাও দিকিনি, দেরি হলে জেঠিমা রাগ করে খুব”।
মুখ তুলে চোখ সরু করে তাকান বিজন রায়। বলেন, “অত তাড়া কিসের অ্যাঁ? তোর জেঠিমা কখন পুজোয় বসে আমি জানিনা নাকি? যা, ঝুমকোজবা গাছটার নীচে সাজিটা আছে, নিয়ে আয়”।
ভারী ক্লান্ত, অনিচ্ছাকৃত পায়ে ঝুমকোজবা গাছটার দিকে হাঁটতে থাকে নিমি। বাগানটা ঘেরা হলেও খুব একটা সাজানো নয়। পায়ে চলার পথ জুড়ে বড় বড় ঘাস জেগে থাকে বছরভর। তিন চারটে আম, পেয়ারার গাছ সমেত রয়েছে টগর, গন্ধরাজ, স্থলপদ্ম, নয়নতারা আর শিউলি ফুলের গাছ। বাগানের মধ্যিখানের কিছুটা অংশে শীতের শুরু থেকে বড় বড় বিষ্ণুপুরী টবে ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, আর গাঁদা ফুলের গাছ লাগান বিজন রায়। জবা আর ঝুমকোজবার গাছ তিনটে বাগানের ভিতরে একেবারে শেষপ্রান্তে। পাঁচিলখানা না থাকলে প্রায় পুকুরের গায়ে। সেদিকে যেতে নিমি একযুগ কাটিয়ে দেয়।
সোনার মতো চকচকে পিতলের সাজিটা অর্ধেকও ভরেনি, অবহেলায় পড়ে আছে ঝুমকোজবা গাছটার নীচে। সেটা তুলে নিতে গিয়ে নিমির এক উদ্ভট ইচ্ছে হয়। সামনের শক্ত প্রতিরোধ এই ছ্যাতা পড়া শ্যাওলা ধরা দেওয়ালটা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে হয় তার। উঁচু পাঁচিল ভেঙে পুকুরের জলে মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় খুব। তাড়াতাড়ি সাজি তুলে ফিরতে চাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেই কাঁধে শক্ত হাতের পাঞ্জা টের পায় নিমি।
পালানোর উপায় নেই। আজকাল কোনও ভোরেই উপায় থাকে না, নিমি তা জানে। বিজন রায়ের চুনি, পান্নার আংটিশোভিত শক্ত হাতের থাবা কাঁধ থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসছে নিমির পিঠে। রোজকার মতোই মুখ বিকৃত হয়ে যায় তার। কাঁধ ঝাঁকিয়ে সরাতে চেষ্টা করে সে। ফুলের সাজি চেপে ধরে ছুটে পালাতে গেলে নিমির কোমরে বেড় পড়ে যায় হাতের। গলার কাছে চেপে বসে আরেকটা শক্তিশালী হাত। সবটা নিমির জানা, দাঁড়ি-কমা সমেত মুখস্থ। নাড়ি উল্টে আসা বমির মতো এক শরীর ঘেন্না নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কাঁপতে থাকে সে।
নিমি জানে, এইসময়েই ঘন কুয়াশা ঘনতর হয় বাগানে। চারপাশের শীত আচমকা বেড়ে যায় খুব। ছাইরঙা ভোর যেন ফের সেঁধিয়ে যেতে চায় অন্ধকারের পেটে। যন্ত্রণায় চোখ বুজে ফেলার আগে নিমি দ্যাখে, বাগানের পশ্চিম কোণে স্পষ্ট এসে দাঁড়ায় সে। তার গায়ে সাদা কুয়াশার শাড়ি, কোমর পেরোনো চুল খুলে দিয়ে চোখের সামনে অন্ধকার নামিয়ে আনে সে।
মিনিটদশেক পরে ছাড়া পেয়ে ছুটতে গিয়ে নিমি টের পায়, সকালবেলার রোদ উঠছে বাগানে।
সকালবেলার প্রথম রোদের সাথে জেগে উঠেছে রায়বাড়ির উঠোন। একতলার ভাড়াটিয়া শর্মার বউ শান বাঁধানো উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। কলতলার বালতি ছাপিয়ে উপচে পড়ছে জল। সেদিকে তাকিয়ে কোণের ঘরের শোভাদিদি বলে ওঠে, “এই নিমি, ভরা বালতিটা সরিয়ে খালিটা রেখে যা না মা। আমি তুলে নেব একটু পর”।
এহেন অনুরোধে ঝাঁঝিয়ে উঠতে গিয়েও পারে না নিমি। হয়তো অনুরোধকারিণী শোভাদিদি বলেই পারে না। বড় ক্ষীণ, ক্লান্ত স্বরে বলে, “হাতে ফুল রয়েছে গো। পারবো না”। তারপর আর কথা না বাড়িয়ে কলতলার লাগোয়া বারান্দায় উঠে সিঁড়ির দিকে এগোয়। পুরনো দিনের খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে হাঁটুর উপরে উরুর কাছে ব্যথাটা আবার টের পায় নিমি।
দোতলার ছোট ছাদটা পেরিয়ে স্নানে যাচ্ছিলেন রায়গিন্নী হৈমন্তী। গোলগাল পৃথুলা চেহারা, টুকটুকে রং, পান চিবোনো গাঢ় লাল ঠোঁট আর কপালে ধ্যাবড়ানো সিঁদুরের টিপ পরা এই মানুষটিকে রায়বাড়ির ভাড়াটিয়া থেকে শুরু করে, চার ছেলেমেয়ে সমেত বিজন রায় পর্যন্ত বেশ সমঝে চলেন। নিমিকে সাজি হাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। ঠাণ্ডা চোখে প্রশ্ন করলেন, “এককুচি ফুল তুলে আনতে কত সময় লাগে রে মেয়ে?”
“দেরি কোথায় দেখলে? এখনও তো স্নান হয়নি তোমার!” পাল্টা আক্রমণ শানায় নিমি। তারপর আলগা পায়ে তিনতলায় উঠতে থাকে সে।
সকাল সকাল হাঁটুর বয়সি মেয়ের সাথে ঝগড়া করতে মন চায় না রায়গিন্নির। তিনি শুধু চোয়াল শক্ত করে নিমির সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওড়নায় লেগে থাকা আধভেজা মাটি চোখে পড়ে তাঁর। আশ্চর্য! পড়ে টড়ে গিয়েছিল নাকি! যা হুটোপাটি স্বভাবের মেয়ে! হাতে পায়ে লক্ষ্মী একেবারে! পরে বেশ করে শাসন করে দেওয়া যাবে ভেবে স্নানঘরের দিকে এগিয়ে যান হৈমন্তী।
চারতলার ছাদে ঠাকুরঘরের সদ্য বাঁধানো চকমিলানো মেঝেতে ফুলের সাজি রেখে ক্লান্তিতে বসে পড়ল নিমি। সোনালি রোদ্দুরের নরম রেখা তীরের ফলার মতো জানালা দিয়ে নেমে এসেছে মেঝেতে। রোদের রেখায় অগুনতি ধুলোর ওড়াউড়ি। সেদিকে তাকিয়ে ছোঁয়াছুয়ির ভয় না পেয়ে দেওয়ালে মাথা এলিয়ে দেয় সে। শরীরটা বড় ক্লান্ত লাগছে। অদম্য এক কান্না জমছে ভিতরে। উপায় থাকলে এখুনি পালাতো সে। কিন্তু উপায় নেই! কোনও উপায় নেই!
এখান থেকে অনেক দূরে নলহাটির কোন গ্রাম থেকে মা নিয়ে এসেছিল তাকে। এবাড়িতেই থাকা খাওয়া পেয়ে কাজ করত মা। বছর তিনেক আগে মা চলে গেল কয়েকদিনের জ্বরে। তারপর থেকে জেঠিমা রায়গিন্নিই রেখে দিয়েছেন নিমিকে। শুনেছে সেই যে দূরের নলহাটির গ্রামে ওর বাবা নাকি আবার বিয়ে করেছে, ওর একটা ছোট ভাইও হয়েছে। শুধু ওকে আর ফেরাতে চায়নি কেউ। এসব কথা ভাবলেও নিমির চোখ শুকনো, খটখটে। বছর তেরোর নিমি শুধু ভাবে, কাল আবারও ভোর হবে। কুয়াশা জমবে। কাল আবারও বাগানে ফুল তুলতে যাবে সে। এই পাড়াটায় কেন এত দেরিতে রোদ ওঠে! পাড়াটায় কেন সবার এত দেরিতে ঘুম ভাঙে!
২
রাস্তা চিনতে পারাটাই আসল। মগজের ভিতর বয়ে বেড়ানো আজন্ম চেনা যে মানচিত্র, তা সঠিকভাবে চিনে চিনে ঘরে ফিরতে পারাটাই বড় কথা। বাবার বলা এই কথা দুটো অনেককিছুর মতোই এখনও ভুলে যায়নি রূপম। আজ সকাল থেকেই বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে কথাটা। তাজা রোদের গায়ে শীত শীতভাব এখন অনেকটা কম। এতদিন শুনে এসেছে, রেলস্টেশন থেকে দশ-বারো মিনিটের হাঁটাপথ। আজকাল রূপমের নিজস্ব সময় আন্দাজ মাঝেমধ্যেই গুলিয়ে যায়। তবু মাথাটা স্থির রেখে এগোতে হবে তাকে।
এতক্ষণ বেশ চিন্তা হচ্ছিল তার। যদি ঠিকঠাক চিনতে না পারে! তখন তো ঘুরে বেড়ানোই সার! ঠিক রাস্তাটা খুঁজে পৌঁছতেই হবে তাকে। একবার পৌঁছতে পারলেই নিশ্চিন্তি। খুব সাবধানে, মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভেবে রাখা রাস্তায় এগিয়ে গিয়েছে রূপম। পথচলতি অনেককেই জিজ্ঞাসা করে নিতে চেয়েও করেনি। কারণ সেটা করতে গেলে সে নিজের কাছে নিজেই হেরে যাবে। হারলে চলবে না। এতটা যখন পেরেছে, আরও একটু সে ঠিক পারবে।
রাজেশ্বরীতলার কাছে এসে বেশ খানিকটা স্বস্তি পেল রূপম। চেনা চাতাল, চেনা মাঠ। এতক্ষণ শুধু শুধু দুশ্চিন্তায় পড়েছিল সে। এখনও সবটা ভুলে যায়নি। এখনও তবে অনেকটা বাকি রয়ে গেছে, ভেবে চোরা আত্মপ্রসাদ লাভ করে সে।
রাজেশ্বরিতলার মাঠ ছাড়িয়ে ঘোষালবাড়ির ঠাকুরদালান স্পষ্ট দেখা যায়। ঘোষালবাড়ির পাশের সবুজ ঢিপি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরে মান্নাপাড়া যাওয়ার পথে পড়ে রায়বাগানের গলি। সে গলির বাঁ কোণ ঘেঁষা হলুদ রঙের দোতলা বাড়িটার গেটে এসে দাঁড়ায় রূপম। হাটখোলা গেটটার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একমনে সকাল দেখে সে।
কিশোরীলাল রায়ের উঠোনখানা শুকনো মাটির। মূল গেটের পাশ দিয়ে ঈষৎ বাঁক নিয়ে সোজা উঠে গেছে মোটা গুঁড়ির নারকেলগাছটা। আলগা শীতল হাওয়ায় পাতাগুলি ঝিরঝির করে দুলছে। খানিক দূরে কোথাও একটা ঘুঘু পাখি ডাকছে একটানা। ঢিমেতালে বেলা বাড়ছে একটু একটু করে। উঠোনের ধারে কলঘর থেকে স্নান সেরে বড় শান্ত মনে ভেজা শাড়ি মেলতে এগিয়ে আসছিলেন অনিমা। তড়িঘড়িতেও অজান্তেই গুনগুন করছিলেন বহু এলোমেলো একটা সুর। হঠাৎ তাল কাটল তাঁর। ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন তিনি। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে রূপম! তার চুল বড় হয়ে ঘাড় অব্দি নেমে এসেছে, ফর্সা মুখটায় দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। চেহারাটা একটু ভারী হয়েছে। নস্যি রঙের ফুল প্যান্ট আর ছাই ছাই জামার গায়ে জড়ানো অনিমারই একটি বহু পুরনো রোঁয়া ওঠা কালো শাল। কাপড়ের ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে তাঁর দিকে তাকিয়ে স্বল্প পরিচিতের মতো হাসছে বড়ো ছেলে রূপম!
আজ প্রায় সাত-আট মাস পর রূপমকে দেখলেন অনিমা। শেষবার যখন দেখেছিলেন তখন ঘুমের অতলে তলিয়ে ছিল সে। আজ এমনভাবে চোখের সামনে এগিয়ে এসে বারান্দায় উঠে ঘরে ঢুকল যে তাকে দেখে আনন্দে বুকের ভিতরটা ঈষৎ দুলে উঠল তাঁর। আবার পরমুহূর্তেই সম্ভাব্য কারণগুলো ভেবে ভ্রু কুঁচকে গেল অনিমার। খুব সাবধানে কথা বলতে হবে তাঁকে। চোখ তুলে খুব সাবধানে দোতলাটা দেখে নিলেন একবার। বাড়িওয়ালা কিশোরীলাল জানতে পারলে এখুনি এসে দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে যাবে। আর করবে নাই বা কেন! কম অত্যাচার তো করে যায়নি রূপম! তাই হঠাৎ খুশির ভাব কাটিয়ে তেতোমুখে ঘরে ঢুকলেন তিনি।
নীচতলার এই ঘরটা বড়। অনিমার বিয়ের পালঙ্কটা বাদ দিলেও আলাদা একটা ক্যাম্পখাট পাতা আছে। বইখাতার চেয়ার টেবিল, আলমারি, আলনা আর চেরাই কাঠের শোকেসটা বাদ দিয়েও পাত পেড়ে বসার জন্যে মেঝেয় খানিক জায়গা বাঁচে। রান্নার খুপরিটা নীচতলার বারান্দার একপাশে। এটুকুরই ভাড়া এখন দাঁড়িয়েছে চারশো। আগামী বছর আরও বাড়াবে বলেও রেখেছে। কিন্তু সেটা এখনই চিন্তার বিষয় নয়। অনিমার কাছে এই মুহূর্তে আরও বড় চিন্তার বিষয় উপস্থিত। বড় পালঙ্কে কাপড়ের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে ক্যাম্পখাটেই লম্বা হয়েছে রূপম। দুটো হাত বুকের কাছে জড়ো করে, পায়ের উপর পা রেখে বেশ আরামের ভঙ্গিতে চুনকাম করা সিলিঙের দিকে চেয়ে রয়েছে সে। দেখে কর্কশস্বরে তেড়ে আসেন অনিমা। বলে উঠলেন, “তুই এখন! কীকরে এলি?”
সিলিং থেকে চোখ না সরিয়েই খুব নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে রূপম বলল, “ছেড়ে দিল”।
এবার মেজাজ হারান অনিমা। চোখ পাকিয়ে হিসহিসে স্বরে বললেন, “ছেড়ে দিল? বোকা পেয়েছিস আমায়? সত্যি করে বল! পালিয়ে এসেছিস তো?”
অনিমার চেয়ে উঁচু তারে দাঁত খিচিয়ে রূপম বলল, “আঃ! জ্বালিও না তো! ভালো হয়েছি তাই ছেড়ে দিল”। তারপর ধীরে ধীরে চোখ বুজে ফেলে সে।
আসন্ন অশান্তির চিন্তায় বুক ভার হয়ে আসে অনিমার। এখনও বাড়িতে কেউ জানে না। কেউ দেখেছে কি না তাও জানেন না। রবিন বাজারে গেছে। ফিরে এসে দেখলে কী হবে ভাবতে পারছেন না। বাড়িওয়ালাও জবাব দিতে ছাড়বে না তখন। আর হবেই তো! গতবছর যাওয়ার আগে অত্যাচারের শেষ করেছিল রূপম। কাউকে মানত না। এখনও এই একা ঘরে বেশি কিছু বলতে যাওয়া ঠিক হবে না। এই ছেলেকে বেশি ঘাঁটাতে গেলে তাঁর দিকেই তেড়ে আসবে। ভাবতে ভাবতে কপালের রগে হাত রেখে বসে পড়েন অনিমা। তবু আত্মজর মুখ থেকে চোখ সরান না।
খুব কায়দা করে জিভের নীচে যেটা রেখে দিয়েছিল রূপম, সেই ছোট্ট গোলাপি ট্যাবলেটটা একটা টিপের মতো চোখের সামনে ভাসছে এখন। তারপর বেলাদি পাশের বেডে এগিয়ে যেতেই মুখ থেকে বের করে একনিমেষে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলেছিল সে। কাল রাতটা ঘুমিয়ে পড়লে কিছুতেই চলত না তার। বেশ কয়েকদিনের চেষ্টায় কায়দাটা রপ্ত হতেই একা একা খুব একচোট হেসেছিল রূপম। এরা সব মনের কারবারি, আর মন বুঝতে পারে না! মজা লেগেছিল বেশ। আগে মুখ থেকে বের করে ছোট্ট ট্যাবলেটটাও খাটের নিচের ঝুড়িতে ফেলত না সে। সাবধানের মার নেই! তারপর রেললাইনের ধারে ওই সাহেবি ধাঁচের বাংলোতে আঁটঘাট জেনেছে অল্প অল্প করে। বেশ কয়েকটা রাত জেগেই কাটিয়েছে। ফার্স্ট ট্রেনের সময় মুখস্থ করেছে। ঠিক কখন রামেশ্বর ওই লজঝড়ে মেন দরজায় বেহুঁশের মতো ঘুমোয়, নিচু পাঁচিল ঠিক কোথায় কোথায় ভাঙা পড়ে আছে, সবটা জেনেছে একটু একটু করে। রেলস্টেশনের গায়েই ছিল পানাপুকুর আর একটুকরো খোলা জমিসমেত ওই সরকারি মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। চারদিকে কলাবাগান দিয়ে ঘেরা। গার্ড ওয়ালের ব্যবস্থাও তথৈবচ। বলতে গেলে ওই ঘিরে থাকা কলাবাগানটাই রেলের জানলায় কৌতূহলী মুখগুলো থেকে বাংলোর বাসিন্দাদের একটু আড়াল দেওয়ার চেষ্টা করে যায়। অনুদান আসে না। প্রায়ই বন্ধ হয়ে যাওয়ার হুমকিতে দু’জন নার্স আর তিনজন মেডিক্যাল স্টাফ নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে চলে বহু পুরনো ওই সাহেবি বাংলো।
একতলা ওই বাড়িটায় রূপমের নাম ছিল ‘সাত নম্বর’। প্রথম প্রথম ঘুমের মধ্যে ডুবে থাকত। ঘুম ভাঙলে একটু জলের মতো পানসে খাবার আর ওষুধ। ফের হাত-পা শিথিল হয়ে আসতো। মাথা ফাঁকা হয়ে পালকের মতো হালকা শরীর উড়ে যেতে চাইত যেন। সবুজ চাদর খামচে ধরে ফের কুঁকড়ে ঘুমিয়ে পড়ত রূপম।
আজ দু’তিন মাস সেই অবস্থা পাল্টেছে। আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ এখন সে। আগের মতোই একটু আধটু খবরের কাগজ পড়ে। বাড়ির কথা মনে পড়ে। চোখ বুজলে বাড়ির গলি মানচিত্রের মতো চোখের সামনে আঁকে। স্কুলজীবনের মহারাজজী বা মৃত বাবার মুখ, সবটা এখন চোখে ভাসে। রাগের পারা বেশ অনেকটা কমে এসেছে। ডাক্তারদা এলে মাঝেমধ্যেই খোশগল্প জুড়ে দেয়। তাঁর কাছে নানানরকম বই চায়। কখনো চায় ‘অলীক মানুষ’, কখনো ‘তিথিডোর’ এনে দিতে বিশেষ করে বলে রাখে। বই আর আসে না। অপেক্ষা করে করে হেজে যায়। ডাক্তারদার সময় কম। হাজারটা জায়গায় ঘোরে। প্রায়ই রূপমের কথা ভুলে যায়। রূপম বারবার মনে করিয়ে দেয়।
তবে আজ কিন্তু বেশ মনে করেই বই আর খবরের কাগজের পাহাড় এনেছে ডাক্তারদা। সেটা কি রূপম শেষ রাতে কাউকে কিছু না বলে ট্রেনে চেপে বাড়ি চলে এসেছে বলে? তা জানে না সে। কিন্তু এই যে খোঁজ না পেয়েই ডাক্তারদা এত দূর এসেছে দেখা করতে, সেটা ভালো লাগছে তার। টেবিলের গায়ে রাখা চেয়ারটায় বসেছে ডাক্তারদা। রূপমকে প্রশ্ন করছে, “চলে এলি কেন?”
রূপম হাসিমুখে বলে, “ভালো হয়ে গেছি, তাই”।
ডাক্তারদা প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে বলে, “তোর বইপত্তর কাগজের কী হবে তাহলে?”
রূপম পাশ ফিরে শুয়ে বলে, “ওসব রেখে যাও, পড়ব”।
ডাক্তারদা স্বভাবতই স্মিত হেসে বলল, “এখন বাড়ি ফিরেছিস, এসব নিয়ে পড়ে থাকার সময় হবে তোর?”
দুই হাতের পাঞ্জা মাথার পিছনে রেখে চিন্তামুক্ত ভঙ্গিতে রূপম বলে, “এখন আমার হাতে শুধু সময় আর সময়! সব পড়ে ফেলব”।
ভীষণ শব্দ করে চেয়ার সরিয়ে ক্যাম্প খাটটার দিকে এগিয়ে এল ডাক্তারদা। তারপর রূপমের দিকে ঝুঁকে বলল, “তুই যে এভাবে পালালি, কত ক্ষতি হল আমাদের, কত বদনাম হল আমাদের! সে খেয়াল আছে?”
বলতে বলতে চোখ মুখ হিংস্র হয়ে উঠল ডাক্তারদার। কলার ধরে একঝটকায় রূপমের মাথাটা তুলে এনে বলল, “বল শালা, এভাবে আসতে কে বলেছে তোকে? শান্তি দিবি না আমাদের? পালানো হয়েছে! পাগলের বাচ্চার আবার পালানো হয়েছে!”
চটকা ভেঙে ডাক্তারদার জায়গায় রবিনকে দেখে কয়েক মুহূর্ত হকচকিয়ে গেল রূপম। কলার টেনে ধরে উঠিয়ে চোখ মুখ বিকৃত করে চিলচিৎকার করছে রবিন। মা ওকে ছাড়াতে পারছে না। ঘরের দরজা দিয়ে পর্দা সরিয়ে উঁকি মারছে বাড়িওয়ালার ছোট ছেলে ছোটকা আর মেয়ে বুনি। আচমকা মাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল রবিন। আলনার গায়ে গিয়ে পড়লেন অনিমা। তারপর রূপমকে হিড়হিড় করে টানতে লাগলো দরজার দিকে।
সবটা বুঝে উঠতে একটু সময় লেগে যায় রূপমের। তারপর আচমকা গা ঝাড়া দিয়ে উঠল সে। এক ধাক্কায় রবিনকে মেঝেয় ফেলে দিল সে। আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না। মাথার ভিতর একশ-হাজার সূচ ফুটছে যেন। যেকোনো মুহূর্তে কপালের শিরা ফেটে যেতে পারে তার। দানবের মতো চেঁচিয়ে উঠল রূপম, “বেশ করেছি রে শুয়োরের বাচ্চা। তোর একার ঘর? তোর একার মা? আরেকবার গায়ে হাত দিবি তো খুন করে পুঁতে ফেলব তোকে!”
মারের প্রথম অভিঘাত সামলে উঠে তেড়ে এল রবিন। মুহুর্মুহু ঘুষি আছড়ে পড়লো রূপমের মুখে, বুকে। ছোটকা এসে তড়িঘড়ি রূপমকে বারান্দায় সরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। অনিমা কাঁদতে কাঁদতে মিনতি করে বলতে থাকেন, “ছেড়ে দে, ওরে ছেড়ে দে, বড় ভাই হয়। ওর মাথার ঠিক নেই, ওকে ছেড়ে দে”।
একধমকে ঝাঁঝিয়ে ওঠে রবিন, মায়ের দিকে চোখ পাকিয়ে বলে ওঠে, “তুমি থামো! অত দরদ থাকলে আদরের ছেলেকে নিয়ে রাস্তায় থাকো!” তারপর ধড়াম শব্দে দরজা বন্ধ করে। ছোটকাকে ছাড়িয়ে ফের দুমাদুম করে দরজায় এলোপাথাড়ি লাথি মারতে থাকে রূপম। এই সময়ে দোতলা থেকে নেমে আসেন বাড়িওয়ালা কিশোরীলাল। চুপ করে শান্ত হাতে রূপমের ঘাড় চেপে ধরে টানতে টানতে উঠোন পেরিয়ে মেন দরজার দিকে নিয়ে যান। হ্যাঁচড়প্যাঁচড় করে তীব্র ছটফট করতে থাকে রূপম। তবু ছাড়াতে পারে না সেই হাত। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে সে। ঘাড়ের উপর কেটে বসে যাওয়া শক্ত হাতটা তবু ছাড়েন না কিশোরীলাল। মেন দরজার বাইরে ইটের রাস্তায় রূপমকে ঠেলে দিয়ে তেমনি শান্ত মুখে কালো কাঠের ভারী দরজাটা বন্ধ করে দিলেন কিশোরীলাল।
সময় খুবই আজব একটি ব্যাপার। অনেকটা জাদুর মতো। খুবই অল্প কিছু সময়ের পার্থক্যে আবার আগের রূপে ফিরে গেল ‘ভাল’ হয়ে যাওয়া রূপম। তার গায়ে অসুরের শক্তি বোধ করে সে। মাথাটা অসহ্য রাগে ফেটে পড়তে চায়। কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র। ঘুরে দাঁড়িয়ে কিশোরীলালের উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য ভাষায় চিৎকার করে ওঠে রূপম। আর ঠিক তখুনি তার চোখ পড়ে বাঁ পাশে মিতুনদের বাড়ির ছাদে। রেলিং ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে মিতুনের বোন মলি। তার কপালে মিতুনের মতোই গোলাপি একটা টিপ।
৩
ছায়ারোদ্দুর মেঝেতে পিঠ এলিয়ে বসে ঘুম ঘুম পেল রুপাইয়ের। চোখের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে তার ভাঙা সংসার। মাটির হাঁড়ির কানা ভেঙেছে। কড়াইটা দু’ভাগ হয়েছে। থালা, বাটি যা ছিল সব ওলটপালট হয়ে আছে। একপাশে মুণ্ডু ছিঁড়ে, হাত খুলে উল্টে পড়ে আছে মুন্নি। এই ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে আরো একবার ফুঁপিয়ে ওঠে রুপাই। এতক্ষণ ধরে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলের শুকনো রেখায় চামড়া টানছে তার।
একটু আগেই মা উদোম পিটিয়েছে। সাথে তার সাজানো সংসারটাও রাগের মাথায় ভেঙে দিয়ে গেছে। এখন খুড়তুতো ভাই রাজু এসে রুপাইয়ের ফ্রকের খোলা বেল্ট ধরে টানছে। একঝটকায় তিনবছরের ভাইটার হাত সরিয়ে দেয় সে। তারপর ঘরের দেওয়ালে মুখ ফিরিয়ে গোঁজ হয়ে বসে থাকে। ঘরের উল্টো কোণে বড় চৌকিটা থেকে একটা “উঃ, আঃ” শব্দ ভেসে আসছে। শব্দটা খুবই ক্ষীণ। তবুও রুপাই জানে, রিনাপিসি এখন গোঙাচ্ছে। রিনাপিসির এখন ব্যথা হচ্ছে। ভাঙা সংসারের শোক ভুলে চকিতে সেদিকে মুখ তুলে তাকায় রুপাই।
রাজু এই আলো আঁধারি ঘরে খুব একটা ঢোকে না। আজ শুধু তার দুঃখী দিদিভাইয়ের খোঁজে এসেছিল। পিসির আওয়াজ পেয়ে ভয়ে একছুটে পালিয়ে গেল। কিন্তু পিসি আবার গোঙাচ্ছে কেন! দাদুকে একবার ডাকবে কি! ভেবে পায় না রুপাই। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় চৌকির দিকে। এদিকটায় বড় একটা রোদ ঢোকে না। পিসির মুখটা অন্ধকার। হাত, পা গুলো ভীষণ রোগা। সেই হাতে একটা করে সাদা আর লাল চুড়ি পরে থাকে পিসি। মায়ের মতো, কাকিমার মতো। পিসির গাল দুটো ভাঙা। মাটির কড়াইটার মতো। মাথাটা কেমন বড় হয়ে গেছে। অনেক বড়ো অসুখ করেছে তাই। রুপাই জানে। সবাই রুপাইকে ছোট ভাবলেও সে আর ছোট নেই। সে জানে, কানাঘুষো শুনেছে, রিনা পিসির এমন অসুখ করেছে বলেই তো পিসেমশাই আর এবাড়িতে আসে না। দাদাভাইকেও আসতে দেয় না। বাবা, কাকা, এমনকি মাও বারণ করেছিল দাদুকে। তবু দাদু কারোর কথা শোনেনি। সবার সাথে ঝগড়া করে পিসিকে এনে রেখে দিয়েছে। সারাদিন সেবা করে।
ওই ভেঙে যাওয়া গালদুটোয় খুব নরমভাবে ছোট্ট দুটো হাত রাখল রুপাই। তারপর ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল, “পিসিমনি, ও পিসিমনি, তোমার কষ্ট হচ্ছে?”
আধো ঘুমের মতো আধবোজা চোখ দিয়ে জাগল রিনা। বলল, “উঁ? রুপাই?”
রুপাই বলল, “হ্যাঁ গো, তোমার কষ্ট হচ্ছে?”
আধবোজা চোখে মাথা নাড়ল রিনা, বলল “এই একটু মা”।
পিসির কষ্ট হচ্ছে শুনলে একজনকেই ভরসা করে রুপাই। তড়িঘড়ি বলল, “তোমার কোথায় ব্যথা হচ্ছে? দাদুকে ডেকে আনব?”
যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসা গলায় রিনা বলে, “না মা। দাদুকে ডেকো না। একটু ব্যথা, এখুনি সেরে যাবে”।
এখুনি সেরে যাওয়ার কথাটা রুপাই ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না। এ তো অনেক বড় অসুখ। এখুনি এখুনি সারবে কীকরে! তবু দাদুকেও ডাকে না সে। বরং ঠায় বসে থাকে। আস্তে আস্তে পিসির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মনে মনে তার পিসির জন্য মায়া হয়। দাদুর জন্যও মায়া হয়। দাদু লোকটাকে ভীষণ ভালবাসে রুপাই। ওর মনে হয় ওর বাবা কেন দাদুর মতো নয়! এই যেমন আজ, বাবার জন্যই তো এত মার খেতে হল ওকে! ভাবলে আরেকবার বুকটা হু হু করে ওঠে।
রুপাইয়ের বাবা গজেন ঘোষ পুলিশের হেড কনস্টেবল। প্রায়ই নাইট ডিউটি পড়ে তার। যেদিন যেদিন নাইট ডিউটি পড়ে, তার পরের সকালগুলোয় সবাই এবাড়িতে তটস্থ হয়ে থাকে। এমনিতেই গজেন যথেষ্ট মেজাজি, তায় রোজগার নেহাত মন্দ না। তাই বাড়িতে দাপট আছে। ফলে তার নাইট ডিউটির পরের সকালগুলোতে এবাড়িতে কাক, চিল ডাকাও বারণ। সকালবেলা ভারী হারকিউলিস সাইকেলটা চালিয়ে বাড়ি ফিরেই হাঁকডাক জুড়ে দেয় গজেন। তারপর স্নান সেরে, ভাত খেয়েই শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। খুব সাবধানে ঢুকলে রুপাই দেখেছে, ঘরটায় তখন রাতের মতোই পর্দাটানা অন্ধকার। বাবার নাক ডাকার শব্দসমেত একটা ভারী ভয়ের পরিবেশ। তাই তখন বাড়ির সবাই টুঁ শব্দও করে ভেবেচিন্তে। মা, কাকিমা কথা বলে ফিসফিসিয়ে, সামনের টানা বারান্দায় হাঁটে পা টিপে টিপে। রাজুকে ঘরে শাসন করে আটকে রাখা হয়। দাদু বেশিরভাগ সময়টাই পুকুরপাড়ে বসে কাটিয়ে দেয়। রুপাই দেখেছে এই সকালগুলোয় বাড়িতে ভীষণ মনখারাপি হাওয়া তৈরি হয়।
সবচেয়ে মুশকিল হয় গোরাকে নিয়ে। গোরার বয়স মোটে চারমাস। সে বাবার ডিউটি চার্টের খবর রাখে না। সারা সকাল খাটে ঘুমোতেও পারে না। বাবাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় মা। তাই গোরাকে কখনো কাকিমার ঘরে, কখনো বারান্দায় বিছানা করে শুইয়ে রাখে। বারংবার খাইয়ে আর ঘুম পাড়িয়ে সে যেন সময়ে অসময়ে কেঁদে না ওঠে সেই চেষ্টা করে।
আজও বারান্দার রোদ্দুরে নিজের ছোট্ট বিছানায় শুয়েছিল গোরা। খিদে পেয়েছিল কি না জানে না রুপাই, কিন্তু ও কেঁদে ওঠে। তখন রান্নাঘরে মায়ের হাত আটকা। রাজুকে স্কুল থেকে আনতে গেছে কাকিমা। আর দোষের মধ্যে সবচেয়ে বড়, রুপাইয়ের বাবার সবেমাত্র তন্দ্রাভাব এসেছিল। সেটা কেটে যেতেই হুঙ্কার ছাড়ে গজেন। বলে, “সব মরলে নাকি? শালা মুখে রক্ত তুলে খেটে মরবো আর এনারা সব ছেলে বিইয়ে চড়ে বেড়াবেন!”
বাবার বাক্যবাণ রুপাইয়ের কানে গেছে। রুপাইয়ের মায়ের কানেও গেছে। গোরা তখনও একসুরে কান্নার পারদ আরও চড়াচ্ছে। কোণাকুণি রান্নাঘরে মা বেচারি তরকারির কড়াই নামিয়ে বারান্দায় আসতে গিয়ে পিঁড়ি উল্টে আঙুলে ধাক্কা খেয়েছে। মায়ের এমন অবস্থা দেখে আর থাকতে পারেনি রুপাই। দাদুর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কান্নার আওয়াজ থামাতে তড়িঘড়ি গোরার নাক মুখ চেপে ধরেছে। আর তাতেই অগ্নিশর্মা হয়েছে রুপাইয়ের মা। একে গজেনের সূচ বিঁধনো কথা, তার উপর বোকা মেয়েটার যত রাজ্যের বিপজ্জনক কাজ! ভিতরের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে চুলের মুঠি ধরে টেনে রুপাইয়ের পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে দিল। তারপর গোরাকে খাইয়ে এসে ফের ঠাস ঠাস করে চড়িয়ে দিল রুপাইকে। রান্নাবাটি সব ভেঙে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল মা।
রুপাই জানে এখন এবাড়িতে শব্দ করে কাঁদা মানা। সে গোরা নয়। কেঁদে উঠলে বাবা আরও নির্মমভাবে পিঠে দরজার খিল ভাঙতে পারে। কারণ বাবা তো আর দাদু নয়! দাদুর মতন একটুও নয়। তাই কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছিল সে। ইতিমধ্যেই কাকিমা রাজুকে নিয়ে ফিরে এসেছে। ভাইটা তাকে ডেকেও গেছে। গোরা তার খাওয়ার পর্ব সেরে আবার ঘুমিয়েও পড়েছে। কিন্তু মা একবারও এঘরে তাকে ডাকতে এল না কেন? অভিমানে মুখ ফুলে যায় রুপাইয়ের।
সে পিসির পাশে বসে একটু একটু মাথায় হাত বোলায় আর ভাবে তার বাবা যেন কেমন! সবাইকে বকে। সবচেয়ে বেশি বকে ওর মাকে। রুপাইকেও চোখ রাঙিয়ে কথা বলে। আদর করে না, কাছে ডাকে না। শুধু বকে। মাঝে মাঝে মারেও। আর বাবা মাকে বকলে, খুব চেঁচিয়ে বকলে মা এসে ওকে মারে। কেন যে মারধোর করে বোঝে না রুপাই।
তবে হ্যাঁ, বাবা গোরাকে আদর করে, গোরা কাঁদলে গোরাকে ছাড়া বাকি সবাইকে শাসন করে। রুপাইয়ের ইচ্ছে হয় গোরার মতোই ছোট্টটি হয়ে যেতে। সেই জীবনটা খুব সুন্দর হবে বলে ধারণা তার। অনেকটা আদর পাবে বলে ধারণা তার।
নয়তো আরও একটা গভীর ইচ্ছে ভিতর ভিতর পুষে রেখছে রুপাই। কাউকে বলেনি সে কথা। রাজুকেও না। সে চায় পিসির মতোই কোনও খুব বড় নাম না জানা অসুখ করবে তার। সেই অসুখে এমনভাবে কাঠির মতো রোগা হয়ে যাবে সে, মাথাটা ফুলে যাবে খুব। বাবা এসে দাদুর মতোই মাথার কাছে বসবে। সময়ে সময়ে ওষুধ খাওয়াবে, ধরে ধরে উঠিয়ে বসাবে, একেকদিন বিকেলবেলা পুকুরপাড়ে হাঁটতে নিয়ে যেতে চাইবে। আর রুপাইয়ের অসুখ খুব বাড়লে বেশি রাত্তিরে একা একা লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল ফেলবে বাবা। ঠিক দাদুর মতো! ভাবলেই আনন্দে বুক ভরে ওঠে তার। মা ও তখন আর শাসন করবে না। কোলপোছা করে রাখবে। ভাঙা রান্নাবাটি আবার বানিয়ে দেবে। যদিও এসব কথা কাউকে বলা যায় না। তবু রোজ এমন একটা স্বপ্ন বুনতে থাকে রুপাই।
এক ডেকচি গরম জল খুব সাবধানে এনে ঘরে ঢুকল দাদু। দাদুর কাঁধে একটা ধোয়া গামছা। রুপাই জানে এখন গরম জলে গামছাটা ভিজিয়ে পিসিমনির গা হাত পা মুছে দেবে দাদু। বাবা আর কাকাই বলেছে লোক রাখতে অনেক খরচ তাই দাদুই করে এসব। দাদুর হাতের শিরা ওঠা, চামড়ায় অনেক কাটাকুটি দাগ খালের মতন এদিক, ওদিক চলে গেছে। দাদুর হাত কাঁপে। ফের একবার মায়া হয় রুপাইয়ের। সে চৌকির এপাশে ছুটে আসে। বলে, “আমি করব দাদু? আমি শিখে গেছি এখন”।
সামনে রাখা টুলটায় ধীরে ধীরে গরম জলের ডেকচি রেখে দাদু বলে, “না রুপাই, তুমি এখনও বড় হওনি তো, পারবে না”।
দ্বিগুণ উৎসাহে রুপাই বলে, “আমি তো দেখে দেখে শিখে গেছি, আজকে আমি করি?”
রুপাইয়ের কথা শুনে রিনা এবার ভরা চোখে হাসে, রুপাইয়ের দাদুও হাসে, বলে “শিখে গেছ? আচ্ছা তবে কাল কোরো। আজ আমি করি?”
শেষ চেষ্টা করে রুপাই। বলে, “কিন্তু তোমার তো কষ্ট হয় দাদু!”
দাদু এবারও হাসে, বলে, “কষ্ট কিসের মা, মুন্নি যেমন তোমার মেয়ে, তোমার পিসিও তেমন আমার মেয়ে তো। তোমার কি মুন্নিকে যত্নআত্তি করতে কষ্ট হয়?”
ভারী অবাক হয় রুপাই। মুন্নির সাথে পিসিমনির তুলনা! তা কীভাবে হয়! সে বলে ওঠে, “কিন্তু মুন্নি তো ছোট্ট। পিসিমনি তো কত বড় মানুষ!”
রিনার মাথাটা তুলে পিঠের কাছে বালিশ দুটো রাখতে রাখতে রুপাইয়ের দাদু বলে, “তাতে কী? তোমার পিসিমনি আমার পুতুল তো, আমার নিজের পুতুল। তুমি আর দাঁড়িয়ে থেকে দেরি কোরো না মা। যাও স্নানে যাও, নয়তো মা পিটবে”।
মা যে রেগে আছে, মা যে যখন তখন পিঠে দু’ঘা বসিয়ে দেবে তা রুপাই জানে। সেই ভয়টাও তার আছে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাদুর ঘর ছেড়ে বারান্দায় বের হয়। যাওয়ার আগে ফের একবার দেখে নেয়, কাঁপা কাঁপা হাতে পিসিমনির গলায়, হাতে ভেজা গামছা মুছিয়ে দিচ্ছে দাদু। ঠিক পুতুল খেলার মতোই। আবারও স্বপ্ন বোনে রুপাই। আবারও সে ভাবে, বাবা কেন দাদুর মতো নয়!
ক্রমশ…