লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Sunday, September 6, 2020

অভিজিৎ পালচৌধুরী

অভিজিৎ পালচৌধুরীর কবিতা

ময়না তদন্ত

 

আসুন স্যার আসুন। হ্যাঁ, ঠিক এইখানটায় পোঁতা আছে আমার লাশ। হ্যাঁ, ঠিক এই কংক্রিটের নীচে। বাইরে থেকে দেখুন কিচ্ছুটি বোঝার জো নেই! প্লাস্টিক ইমালসন দেওয়াল। একদিক মোড়া আছে ওয়াল পেপারে। সেখানে ফুলের বাগান। প্রজাপতি উড়ছে। হ্যাঁ স্যার, ঠিক এই জায়গাতেই আমাকে খুন করা হয়। প্রথমে পাউন্ড কেক স্লাইস করার মতো আমার হাত-পা অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো সাইজ মতো কেটে ফেলা। নইলে এই দশ ইঞ্চি গাঁথনিতে আমার ছফুটি লাশ কুলোয় কি করে বলুন দেখি।

কাটাকুটি হয়ে গেলে খুনি আমার মাথাটাকে নিয়ে সমস্যায় পড়ে। অনেক ভেবে চিন্তে সে সেটিকে ধড় থেকে আলাদা করার কথা ভাবে। আবার ভাবে এতটা নিষ্ঠুর কি হওয়া উচিত। শেষ কালে কার মাথা কার ধড় এই নিয়ে বিস্তর বিড়ম্বনা, জলঘোলা। খুনিকে বিব্রত হতে দেখে আমি বলি তুমি হলালে বিশ্বাসী না ঝটকায়। যাই করো না বাপু এখানে অযোধ্যা-বাবরি টেনো না। খুন করতে এসেছ, অত ভাবলে চলে! তুমি বরং ধড় থেকে আলাদাই করে দাও মাথাটাকে। আমি আমার অস্তিত্বের বিচ্ছিন্ন টুকরোগুলোকে নিয়ে একটা এলিজি ছকে ফেলি এই হাত ছুঁয়েছিল তোমাকে, এই হাতে কোনো পাপ-স্পর্শ নেই, এই পা-এ বালক দৌড়েছিল আল বেয়ে আদিগন্ত ধানক্ষেত রামধনু ধরবে বলে, এই বুকে কৈশোরের সেই ব্যথা নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মতো...ইত্যাদি... ইত্যাদি।

খুনিমশাই এইসব গূঢ়কথা কি বুঝেছিলেন জানি না । তিনি আমার কথামতো আমার মাথা ও ধড় আলাদা করে দেন সেটা হলালে না ঝটকায় নাই বা শুনলেন। শুধু এটুকু জেনে রাখুন তিনি যখন আমার গলদেশে ছুরি চালাতে চালাতে অদ্ভুত মায়াময় চোখে তাকিয়েছিলেন আমার দিকে, আমি বলেছিলুম কিস্যু দুঃখ পাবার নেই মশাই, আপনি চালিয়ে যান, বেশ একটা জম্পেশ যন্ত্রণা আর একটু জমিয়ে কষ্ট দিন তো ভাই। জীবনটা একেবারেই জোলো । শুধুই অম্বল, হাই তোলা আর ভোট দেওয়া। তো মিথ্যে বলব না, মৃত্যুটা আমার ষোল আনার ওপর আঠারো আনা উশুল !

তবে আরেকটা রিকয়েস্টও করেছিলাম, ফাঁসির আসামীর শেষ ইচ্ছে গোছের আর কি! বলেছিলাম ভাই চোখ দুটো আমার যেন অক্ষত থাকে। কেননা ওখানেই তো সব, এই চোখেই তো সেই নীলিমা ও নৈরাজ্য, এই চোখেই তো সেই খোলা চুলের আঁধার, চকিতে হারিয়ে যাওয়া ঝোড়ো হাওয়ায় দিশাহীন পাখির ডানা,  চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা। এই চোখেই তো সব সত্যি হয়ে যাওয়া। অথবা মিথ্যে।

আততায়ী প্রতারণা করেনি।

কি ভাবছেন? কুকুর আনবেন? পাগল না সি-, না থাক, পাজামা !

কে চায় মশাই খুনিকে ধরাতে! আপনাদের লাকি, রেখা, মিতা পুরো ডগ্ স্কোয়াডকেই আনুন না! তারা এই ওয়ালপেপারে মোড়া গেরস্থালীর আনাচ্ কানাচ্ ঘুরে তুলে আনবে ছেঁড়া চপ্পল, রক্তমাখা জামা, ব্রা, ভাঙা চশমা, স্যানিটারি ন্যাপকিন কিংবা কনডম্ সিংগল ইউজ, মাল্টিপল্ ডিজায়ার!

বরং আপনাদের সারমেয়কূলকে ছেড়ে দিন। তারা দৌড়ুক ।

দৌড়, দৌড়, দৌড়... ধানক্ষেত।

দৌড়, দৌড়, দৌড়... একা নদী।

দৌড়দৌড়, দৌড়... একা কৃষ্ণচূড়া।

দৌড়, দৌড়, দৌড়... একা আমি।

 

 

পথিক ও লাবণ্যপ্রভা

 

চওড়া অ্যাসফল্টের রাস্তার পাশে ঢালু জমিতে এক টুকরো সবুজ ঘাসের গালচে। সেই গালচের ওপর চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। একা। নাম জানি না। আমিও একা হাঁটছিলাম। কাছে যেতেই ঝলমলিয়ে হাসল। যেন অনেক কালের চেনা। দেখলাম হাসির শিহরণে তার পাতায় পাতায় এক নরম সবুজ আলোর দ্যূতি চারপাশটাকে আরো বর্ণময় করে তুলল। তার একাকিত্ব তার বিষাদ ভুলে এক অপরিচিত পথিক কে দেখে সে কেমন হেসে উঠল যার অপার লাবণ্য বিভায় দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি।

শুরু হল আমাদের নিঃশব্দ আলাপচারিতা। ফেল্টহ্যামের সকাল এক মুগ্ধ স্তব্ধতার ছবি এঁকে দিল। কাছেই হিথরোর আকাশে তখন নেমে আসছে একের পর এক রুপোলি পাখি খড়কুটো মুখে। খড়কুটো নামিয়ে আবার উড়ে যাচ্ছে কোথায়। আর সেই লাবণ্যপ্রভার কাছে আমার বিনত অবস্থান।

হঠাৎ আমার ভেতরের একাকিত্বটা দরজা খুলে বেড়িয়ে এল। বসল তার পায়ের কাছে। অমনি সহস্র ঘাসের পালক দুলে উঠতেই অজস্র ছোট ছোট নাম না জানা সাদা ফুল ফুটে উঠল নক্ষত্রের মতো আমার একাকিত্বের চারপাশে। দেখলাম আমার একাকিত্ব, লাবণ্যপ্রভা, ঘাসের পালক আর সাদা ফুলের আধফোটা নক্ষত্রদের নিয়ে ফেল্টহ্যামের সবুজ গালচে উড়ে যাচ্ছে হিথরোর আকাশ ছাড়িয়ে কোথায়, রুপোলি পাখীদের পিছু পিছু...।

 

আচ্ছন্ন পথিক ঘরে ফিরে আসে।

No comments:

Post a Comment