অন্তর চক্রবর্তীর কবিতা
বাবাকে
১
এঘরে দিদি কাঁদত
ছোট্ট খেলনা হাঁড়িটা ভেঙে গ্যাছে বলে
ওঘরে উনুনের আঁচে ঘেমেনেয়ে
গজগজ করতেন মা,
"হাড়মাস জ্বালিয়ে খেল মেয়েটা"
দুই ঘরের মাঝে
বাজারের থলে হাতে
এসে দাঁড়াতেন হাসিখুশি বাবা,
তারপর দিদিকে কোলে নিয়ে বলতেন,
"চ' বুড়ি, দেখি তোর মা কী রাঁধল"
আজ
দিদি কাঁদছে
কাঁদছেন মা'ও
মাঝে আগের মতো
দাঁড়িয়ে বাবা
খালি হাত
দরজায় চোখ
মেয়েকে
রান্নাবাটী থেকে হেঁশেল চিনিয়ে
এবেলা
কী সহজ ভাঙা হাসিতে
এগিয়ে দিচ্ছেন
দূরের লালপাড়
ঘরকন্নায়...
২
শুনেছি
একবার একটা গোটা বর্ষায়
আমার কবিতাপাগল বাবা
মা'কে একটা
চুমু অব্দি খায়নি
রোজ রাত করে
ভিজে জবজবে হয়ে বাড়ি আসত
ভাত বেড়ে দেওয়ার পর
ভাঙচুর চোখ নিয়ে
মা বাবার দিকে তাকাত
আর বাবা শুধুই আকাশে তাকিয়ে
থালায় আঙুল রেখে ভাত সরাত একমনে
যেন মেঘ সরিয়ে
নক্ষত্রটি তুলে
তক্ষুণি গড়িয়ে দেবে মায়ের নাকফুল...
(জুন, ২০২০)
কোজাগরী
তেমন ঈশ্বরবিশ্বাস ছিল না
তবে ভোগের প্রসাদ খুবই ভালোবাসত বাবা
প্রতি লক্ষ্মীপুজোয়
সারাদিন বাইরে আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরেই
বউকে বলত
"কী গো, ভোগ কোথায়? খিদে পেয়েছে"
মা কটমট করে তাকাতে তাকাতে
কলাপাতায় প্রসাদ বেড়ে
বাউন্ডুলে বরটার সামনে রাখত
তারপর অনেক কোজাগর পেরিয়েছে
সেবার বাবা খুব অসুখে পড়ল
তাই সেভাবে পুজো হয়নি
হয়নি ভোগ রান্নাও
সন্ধেয় বাবার জন্য ওষুধ কিনে
বাড়ি ফিরে দেখি
ধবধবে আলোয়
বরের কপালে জলপটি দিতে দিতে
ঠোঁট রাখল মা
কে বলেছে
ভোগ রান্না হয়নি ?
এই তো
কী সুন্দর ভোগ রেঁধে
কলাপাতায় বেড়ে
লক্ষ্মীর হাতে তুলে দিচ্ছেন মনসিজ
(নভেম্বর, ২০১৯)
অপর্ণাকে
১
আমার ধুম জ্বর এলে
মা ভেজা তেপান্তরের মতো
ঠান্ডা হয়ে যেতেন
আরো মন দিয়ে রান্না করতেন
ঝোল রেঁধে ভাত মাখতে মাখতে বলতেন
'এক্ষুনি সেরে যাবে বাবান'
গিলতে গিলতে ঘুমিয়ে পড়তাম
এখন মা'র থেকে
অনেকটা দূর
জ্বরের ভিড় কিছুটা বেশি
ঝোল চাপিয়ে নিই নিজেই
তা ফোটার শব্দে অদ্ভুত ঘুম নেমে আসে
সেই কবেকার চেনা
আর কিছু প্রশ্ন
মা যখন নিজে ধুম জ্বরে পড়তেন
টের পাইনি কেন ?
তখনও কি
ঠান্ডা হয়ে যেতেন চুপিসাড়ে ?
২
তোমার অবয়বে প্রতিটা অতীত শিশু হয়ে যায়
ওষ্ঠে লেখা থাকে বিদেহী দোয়েলের জন্মান্তর
ঘরকন্নায়
হাঘরে ইঁটকাঠ হয়ে ওঠে সাবালক দেওয়াল
পঞ্চব্যঞ্জনে
ম-ম করে অনায়াস পারিজাতসুধা
আঁচলে এক ভাঙাচোরা প্রৌঢ়কে
কিশোর হয়ে জুড়ে যেতে দেখি বারবার
লিখে ফেলতে দেখি গোটাতিন শিমুলের কবিতা
সারা দুপুর বসে শুধু এসবই ভাবছি
এমন সময় মাথায় নেমে আসে
কিছু ক্লান্ত আঙুলের স্বর,
'চানে যাবি না?'
ভাবনাভরা চোখ
তোমার স্তনে আনত হয় ফের
নীরবেই ভেঙে পড়ে ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত মৌচাক...
(নভেম্বর, ২০১৯)
তারিখ
জলে ভয় ছিল জানতাম
তবে এই তারিখে
পুকুরে বেশ অনেকটা পা ডুবিয়ে
বসে থাকেন মা
খিলখিলিয়ে হাসেন
বিড়বিড় করেন
আবার জলে তাকিয়ে থাকেন অপলক...
সকাল
দুপুর
বিকেল
কী দেখছেন, বুঝতে শেষমেশ
চানের ছলে ডুব দিলাম আমি...
দেখি,
আলতায় গজিয়ে উঠেছে পুজোমণ্ডপ
ভেতরে
অঞ্জলি
বাইরে বোকাসোকা চশমায়,
কাঠগোলাপ হাতে
এক নখ কামড়ানো মুখ
আদলে প্রায়, প্রায় আমার হুবহু...
অরণ্য
জানালায় বিঁধে আছে শীত
পোষ্যের গলায় খিদে
সহবাসে কাচ
আর বিশ্রামে আয়না
সন্তর্পণে
পালাতে গেলে
নির্ঘাত
পেরেকের মতো
পায়ে ফুটে
যাবে ঘরদোর
কেবল বিঁধেই থাকবে
ঠেলবে না
ভাঙবেও না
দেখো
এসময়
সবে
ঘুণ বিঁধে যাওয়া
আসবাব
ঠেলে
ভেঙে
যদি অরণ্যে পৌঁছে যেতে পারো
ছায়া ছাড়া
বিঁধে যাবার মতো
কিছুই নেই সেখানে...
(ডিসেম্বর, ২০১৯)
ফেরা
একটু
উঁচু বৃষ্টিতে
বাঁধা আছে
একখানা
উলবাক্স
ও শোলার শিকে
যে
সহজ শব্দেরা
হেসেখেলেই
দরজা গুঁড়িয়ে দিতে পারত
অনেকেই গুটিয়ে যাচ্ছে সেখানে
বাকিরা
অফুরন্ত সন্ধ্যায়
ফুরিয়ে আসছে
যা রেখেছ
কেবল
ভুরুর মাঝে
চুরমার হলুদ রাস্তা
তাকে ডেকে নাও
এখন
আসুক
দুটো কথা বলুক
আদরও করুক
শুধু বোলো
যেন দুম করে
কোনো আলো না জ্বালায়
(২০১৭, অ্যাসাইলামের খুঁটিনাটি থেকে)
দেখা
রেস্তোরাঁ
পার্ক
রুফটপ
বইমেলা
একটাও নয়
দু'চার কথা হলে
এবার
ভরপুর
কাগুজে অমানিশায় হোক
ঘুমের অনেকটা নীচে
যে
আহত
পত্রিকার আঁতুড়
ঠাণ্ডা
নিশ্চুপ
স্যাঁতসেঁতে
তবে
ইঁট খসার
রেওয়াজ
খসে যাচ্ছে
বারবার
একটা
কলম
ও
ডায়েরি
নিয়ো সঙ্গে
এ চত্বরে
বহুদিন
কেউ কবিতা লেখেনি
পড়েনি
শোনেওনি
(২০১৭, অ্যাসাইলামের খুঁটিনাটি থেকে)
পূর্ণিমা
বিমুখ মানুষেরা
এক হাতে সিগারেট
অন্য হাতে শ্মশান
নিয়ে দিব্যি বসে থাকেন
কেবল পূর্ণিমায়
তাঁদের
আচমকা মুখর হতে দেখা যায়
দু'হাত খুলে
ছুটে বেরিয়ে যান
জানেন
চাঁদের নীচে আসামাত্র
সিগারেট আকাশপ্রদীপ
ও
শ্মশান
ভরাট ঝলমলে ধানক্ষেত হয়ে যাবে
(২০১৭)
অ্যাসাইলামের
খুঁটিনাটি
২
এক অলীকের গুণে
ছিপছিপে বিম্বটি
বাড়তে বাড়তে
বিঁধে গেল চাঁদে
কলারে সারাদিনের প্রশস্তি চাপিয়ে
বাইরে বেরোতে না বেরোতে
এমনই দেখল কেউ
তড়িঘড়ি খামচে
ধরল তাকে
উদ্বায়ী
আজগুবি নেশায়
দেবদারু
বহুতল
মেঘ
আরেকটু উঁচুতেই
পয়মন্ত মৌসুমী বিদ্যুৎ
চুরমার হয়ে গেল
ঠুনকো সম্মোহন
সমস্ত উত্থান জলের কাছে রেখে
ধুলোর কাছে ফিরে এল
কিছু বিনীত বেলুন
ভালোবাসাবাসি
কাছাকাছি। আরো কাছাকাছি এল ওরা।
তারপর একসাথে
নকশা ভেঙেচুরে নির্যাসে।
পিঠের নীচে ঘাসজমি।
মাথার ওপর উত্তাপ। টকটকে মেঘ।
কাছাকাছি। আরো কাছাকাছি এল।
ঘাসেরা শূন্যে বেড়ে উঠল।
লুঠ করল নীল। লাল। কালো।
এতকিছু হয়ে গেল।
ওদের খেয়াল নেই কোনো।
কাছাকাছি এল। আরো, আরো কাছাকাছি।
মাথা। বুক। পিঠ। ঠোঁট।
পরে নিচ্ছে অরণ্যের রাজটীকা।
টুপটাপ ভাটিয়ালি।
অবাধ্য। কিশোর। অবুঝ।
কাছে আসা, মাৎস্যন্যায়।
সবুজ। অনন্ত সবুজ...
(মার্চ,
২০১৭)
চন্দ্রাতীত
বায়ুহীন জানালায়
দুরূহ ব্রহ্মাণ্ডটি
আপেলের মতো
দু'ফালি
হয়ে যায়
গ্রহদল
ডুবে যাচ্ছে বীজে
গেঁথে যাচ্ছে
প্রজন্মমায়ায়
সৌপ্তিক প্যারাবোলা?
অস্তরাগ?
না অস্তাচল?
একচক্ষু শিবিরের
কয়েকশো ফুট
পাতাল ফুঁড়ে গ্যাছে
কোনো তুরীয় ঘূর্ণনতল
শব্দহীন আয়নায়
সহজ ঘড়িটি
মগজের মতো
দু'ভাগ
হয়ে যায়
মুহূর্তদল
ঠোকরাচ্ছে খুলি
ভেসে যাচ্ছে
ভাবালু মজ্জায়
অনীশ চান্দ্রমাস?
উন্মাদ?
না ভ্রমাতুর?
আধভাঙা জোছনার
কয়েকশো ফুট
উঁচুতে উড়ে গ্যাছে
নির্ঘুম পায়রার আঁতুড়
(জানুয়ারি,
২০২০)
সংসার
চৌকাঠে
একমনে
বসে থাকতাম আমি
উনুন থেকে
তা
কাছেই ছিল বেশ
উনুনের
কাঠ গিলে নেওয়া দেখে
কেমন
গা শিরশির করত আমার
দিদাকে তাই
উনুন ছেড়ে
উঠতে দেখিনি তেমন
রান্না শেষ হলেও
চৌকাঠে
আঁচলটি বিছিয়ে
আমায় আগলে
উনুনের দিকে
কীভাবে একটা তাকিয়ে থাকত
এখন
দিদা নেই
সেই
উনুন
চৌকাঠও
মিশে গ্যাছে
লম্বা চকচকে
মেঝেতে বসে
রান্নাবাটি খ্যালে বুবান
পাশেই
কুটনো কোটে মা
কাজ হয়ে গেলে
নাতনিকে
আঁচলে জড়িয়ে
ঠিক একইভাবে
তাকিয়ে থাকে
বঁটিটার দিকে...
(২০১৯)
বিস্তীর্ণাকে
১২
মেঘকে ধরে নাও
দূরের
বেলুন ওড়ানো
একজোড়া
ভাঙা জানালা
শ্রাবণকে
সেই
দুধসাদা বেলুনের দল
পাথরে লেগেই
ফেটে যাচ্ছে সুরে
নিজেকে ধরে নাও
ক্ষ্যাপাটে
আঠালো ছড়
আর
পাথরকে
একখানি
রোগাসোগা বেহালা
বেজেই চলেছে
বৃষ্টি বাড়ছে
আর
শ্রাবণ তোমায়
ধরে নিচ্ছে
অবসরে বাঁধা
একফালি ডিঙি
আর ক'বার
মেঘ ডাকলেই
জল ভেঙে
যা
আস্ত সেতু হয়ে বিছিয়ে পড়তে পারে
অসীম...
(জুন,
২০২০)
সহজ
কাদায় শুয়ে থাকা
লোকের কাছে
কোনোকিছুই কঠিন নয় তেমন
এই ধরা যাক
ফুরফুরে বিকেলে
কাত হয়ে
দূরের
ঝিকিমিকি বহুতলের দিকে তাকিয়ে
চট করে
তার পাশেই একরত্তি
জ্বলজ্বলে চৌকশ বিড়ি
নিখুঁত পুঁতে দেওয়া
রাশভারী ক্রেনের পাশে
একটি খোলতাই মেঠো শাবল
বা
চটুল নিয়নের হাঁটুতে
একখানি পোড়খাওয়া দেশলাই
কাদায় শুয়ে থাকা
লোকের কাছে
এসব বাঁ হাতের ক্যারিশমা
এর মধ্যে
ঝুপ করে সন্ধে নামলে
শহরের মতোই
ভরপুর লাল হয়ে ওঠে
তলপেট
লম্বা ঢেঁকুর তুলে
ফিচেল হেসে
কাদামাখা লোক
শুয়ে পড়ে ফের
বোঝে না
প্রলাপের ঠোঁটে এসে
কথারা অস্ফুটেই
উলটো তরোয়াল হয়ে গ্যাছে
কাদায় শুয়ে থাকা
পৃথিবীর কাছে
এসব একদমই সহজের মতো
(২০১৯)
No comments:
Post a Comment