নীহার লিখনের কবিতা
আমার মা
মা'কে নিয়ে অনেক
লিখেছি আমি কবিতায়
যখন
ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে লাইক পাই না, তখন খুব ব্রহ্মাস্ত্রের মতো মা'র ছবি ও কথা সামান্য
আবেগ মিশিয়ে ছেড়ে দিলেই দেখেছি, শাপলার মতো ফুটে উঠেছে যেন বিলের শোভা, আমার ওয়ালে
এভাবেই
মা হয়েছে প্রকারান্তরে এক প্রকার নির্ভেজাল আবেগের প্রডাক্ট, কম্পিটিটিভ বাজারে
আমি আর কোনো ব্যবসা করব না বলে ভেবেছি বলেই,
এই গোমরটি রাষ্ট্র করে দিচ্ছি
আর সত্যি বলছি, আমি এখন কোনো সুফিটির মতো
করে আমার মা'কে ঈশ্বর ভেবে তাঁর সাথে জীবন কাটিয়ে দেব, দেখব পৃথিবীর সমস্ত লাইকগুলো
কেন তাঁর সামান্য সাদাকালো কোনো ছবি ও কথায় উড়ে আসে!
যাতাকল
বহুদিন
আগে সেই শিশুকালে
যবের
ছাতুর খোঁজে পড়শির বাড়িতে দেখেছি যাতাকল
একটা
উপরে, ঠিক তাঁর সমানই আরেকটা নীচে
ভিতরে
পিষনে আছে কী দেখা যায়নি, শুধু মনে আছে তাঁদের গোলাকার প্রান্তের কিনার জুড়ে বেরিয়ে
আসছে আকাঙ্ক্ষার বাদামি ছাতু, শিশু বলেই হয়তো ভেবে পাইনি, যাতার কলের ভিতরে কী আছে,
কখন ঢুকেছে!
আজ বহুদিন পরে, নগরের এক সন্ধ্যা বেলায়, ফ্যাক্টরি
ফেরত শ্রমিকের লাইন দেখে মনে হল, এরা যাতাকল
থেকে বের হল, সবটা ঘাম নিংড়ে দিয়েছে সারাদিন, পরিত্যাক্ত অংশটা এখন বাইরে, জিরুচ্ছে
যাতা
হাত
হাত
মূলত ফস্কে যাবার জন্যেই পৃথিবীতে আসে
আর
আমরা তাকে শক্ত করে ধরতে চাই, সবিশেষ সিদ্ধান্তে ন্যূনতম হলেও একটি আঙুল
ক্ষনপদ
ও ধ্রুপদ সর্বস্ব কোনো বৃষ্টির কংক্রিট দিনে
বেহুলা
ও লখিন্দরের হাতে-হাত ছবি ভাবতে ভালো লাগে বলেই, নদী প্রস্থে বেড়েছে মরা কটালের কালেও
কিন্তু শঙখচূর একটা সাপ সুন্দর নাম ও শরীরের,
মায়া কারুকার্যটা তাঁর কি তবে পৃথিবীর অন্তরের ছাপ! ছাপিয়ে যেতে যেতে কেউ কী ভেবেছে
কোনো নৃত্যময়ী কাপড়ের বাহুর সুতা!
আমিও যেমন ভাবি না, জানি না, আমার হাতেরা
আসলে কার হাতের দিকেই চেয়ে থাকে
পেরেক
আজ সকাল থেকেই, যীশুর কথাটি মনে পড়ছে,মনে
হচ্ছে সে'ও কি জানত, ওরা কী করছে! রক্তও কি বুঝতে পারে ব্যথাও যে অর্গান
আজ সকাল থেকেই দেখছি রোদ ও পাখির আনাগোনা, পাতা
নেড়ে চেয়ে আছে দূরগামী গাছ
আমি তাদের সবার ছায়াকে পাঠ করতে চেয়েছি বলেই
দেখেছি কতোটা সঞ্চরণশীল হয় সব ছায়া, কথার মতোই, ব্যথার মতোই, রক্তের মতোই, শুকানোর
আগে
আজ সকাল থেকেই আমি বুঝতে পারছি পেরেক কিছুই
না, আমার মতোই সে'ও যীশুর রক্তে ভিজেছিল, শুকানোর পরে মরচেতে মিশে গ্যাছে সে
হলুদের খেত
বস্তুর থেকে যতটা সম্ভব স্মৃতি ঝেরে ফেলতে
হয়, যেভাবে কারিগর মাটিকে বানায় লাস্যময়ী প্রতিমার মুখ
হৃদয়ও এক ধারণা কুসুম যার পাখা নেই তবু উড়তে
পারে, হাত নেই ছুড়তে পারে, যেরকম পল্লবিত রোদ সবুজখেকো কোনো হলুদের খেত হয়ে যায়
বিম্ব থেকেই জন্মেছে চিরদিন জল, পুনরায় জলেই
নিভেছে সে আদিভূত ভাষার মতন
স্মৃতিকে পাত্তা দিতে নেই, স্মৃতি হচ্ছে ফল;
কামরাঙা গাছের তলে লেপ্টে গড়িয়ে যায়
কবিতা
কবিতা লিখব বলে মানুষের জীবন থেকে একটু দূরে
যেতে চাই
তাই বুঝতে চেষ্টা করছি, মানুষের জীবনটা কেমন
জীবন আশলে!
অন্ধের হাতিটি দেখার মতো নানা উপাত্ত সংগ্রহ
চলছে... চলছে... চলছে... প্রকল্প আমার, এক পা এগোচ্ছি তো দু'টি পা পিছিয়ে যাচ্ছে পিছনে
আমার কবিতা লেখাটা তাই আর হয়ে উঠছে না, চিন্তা
আমার নদীর জলের দঙ্গলে ফুটে থাকা কোনো কচুরিপানার মতো দুলছে আর দুলছে
যদি যেতে হয়
সামান্য
শিয়ালও বন বিভোরতা ছেড়ে
চলে
এসেছে শহরে
শহরে তাঁর ঘর কেউ জানে না, সবাই ঘরে ফিরে
গেলে, নেমে আসে রাস্তায়
সে'ও বুঝে গ্যাছে জঙ্গলে আর কিছু নাই, এবং
একদিন জঙ্গল নিজেও কোথাও চলে যাবে, হেতাল গাছের স্থানে একটা পেশল শ্রমিক ইট ভাঙার কাজে
অক্লান্ত হাত পা চালিয়ে লবন ছড়াবে কংক্রিটের তলে, লাউডুগি সাপের জায়গায় হয়তো একটা বেতের
চেয়ারে বসে সিগারেট খাবে; বাজখাই শব্দের নামের মালিক, কোনো মোটাসোটা কেউ
নস্যি একটা ভাত শালিকও দেখি ভয়ানক কারেন্টের
থামে বাসা করেছে ধান খেত ছেড়ে, কারণ কী! কিছুই বুঝি না আমি এবং একে একে এভাবে সবাই
কেন মুছে ফেলছে সব!
উপচে পড়া এই শহরে আসলে কী আছে মধু, এরা দলে
দলে এখানে আসছে আর ময়লা নোংরা হয়ে যাচ্ছে তাদের রূপ, দিন রাত ডাস্টবিনের দিকেই যেন তাদের সব চোখ
আমি এদেরকে দিন রাত দেখি আর ভাবি, আমার যাবার
পালায় কোথায় যাবটা আমি, যদি যেতে হয়
শিমফুল
শীতকালে তাকে আমি পরিতাপ ভরা মনে দেখি-- বেগুনি, সাদা
মাটির জঠর থেকে দিবালির ঝিলবাতিটির মতো লাবণ্যপ্রভা নিয়ে ফুঁড়ে হাসছে, যেন প্রসন্ন আলো
আর মাটি তাই বুক উঁচু করে আছে, ফুলের ঘেরেই
ঢেউ খেলছে শিম, হাসছে গেরস্থ বউ খিলখিল খিলখিল, কুলায় পক্ক শিমগুলো যেন জড়ো করছে সুখ,
দোয়েল শিশ দিচ্ছে আঁচলের কাছেইটা তার
এমন সফল দৃশ্যই দেখতে চায় মানুষ ও পৃথিবী
আর এমনকি খোদ শিম গাছও
তাই সে আর মনে রাখতে চায় না বোধহয়, বে-শীতের
দিনে, কুয়াশাবিহীন সব দিন, সমস্ত ছাইচাপা ক্লেদ একদা তাঁর রন্ধ্রকে মজা পুকুর বানিয়েছিল দেউরী বাড়ির, পৃথিবীর নিয়মে স্বয়ং দুঃখও দুঃখকে মনে রাখে না, আর এটাই নিয়ম
আম
পৃথিবীতে ভরা মৌসুমে আমি তাঁর কদর সামান্য
কমে যেতে দেখেছি, সে স্বর্গের ফল, যদিও মহিমা কমেনি তখনো, এমনকি জড়োসড়ো শীতের দিনেও
তাঁর আবেদন থাকেই কিংবা অন্য আরো আকালেও
কী অদ্ভুত অমিল আমাদের ভাগ্যের! আমাদের নামেই
কেবল পাই মিল, সংখ্যায় যখন আমরা হয়ে যাই
মৌসুম নেই কোনো, শীত, গ্রীষ্ম, ঝুবি বরষায় মোদ্দা
কথার সব সব কালেই
আমরা যখন আম বলে পৃথিবীতে পরিচিত হই, আমাদের
মুল্য হয় বস্তা দরে
চিহ্ন
আমার চিহ্নই, তোমার উদ্ধৃতি, আদিভূত অক্ষরে
তোমার পুঁথিটি, এমনকি পাঠ ও নদীর ওঠানামা
উত্থাপন নেই বহুদিন আমাদের কারোরই, মিছা নন্দনে ভুলে আছি সব, নিরন্ন একটা বাগান দেখতে বানিয়েছি
জানলা ও চোখ
তবু শিরা, আহা তরঙ্গ কণা কিলবিল, টেনে নিতে
চায় গড়ের মাঠের দিকে হরপ্পা দিনে, খুলে দিতে চায় ডালা, হাড়ের বাখান, শ্যাওলার নীচে থাকা
খোদিত বরাত
আমার সে চিহ্নই তোমার পাখি, তোমার আকাশ
নীহার লিখন
জন্ম/ ৩ অক্টবর, ১৯৮৩, শিববাড়ী শেরপুর, বসবাস করেন ময়মনসিংহে,
পেশাজীবনে একটি বেসরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ:
ব্রহ্মপুত্র,
আমি আপেল নীরবতা বুঝি,
ব্ল্যাকহোল ও পড়শিবাড়ি,
পিনাকী ধনুক,
মনসিজ বাগানের শ্বেত
অনুবাদ ও কথাসাহিত্য নিয়েও কাজ করেন। ইতোমধ্যে
অনুবাদ করেছেন মিরোস্লাভ হলুভ, জন এশবেরী, ইবসেন, ইয়াং লি-সহ অনেকের কবিতা
বাই লিংগুয়াল এই কবির মৌলিক ইংরেজী কবিতাও
ইতোমধ্যে দেশ ও দেশের বাইরে জার্মানি, আয়ারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সংকলনে সংকলিত হয়েছে, তাঁর
কবিতা অনুদিত হয়েছে রুশ, ইংরেজী ভাষাতেও। বয়ান সহ বেশ কিছু পত্রপত্রিকা ও ছোটকাগজে তাঁর
গল্প প্রকাশিত হয়েছে, প্রথম উপন্যাস ‘মধুপুর’ প্রকাশের অপেক্ষায়
সবগুলো সুন্দর ।
ReplyDelete