লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Monday, August 10, 2020

রণজিৎ অধিকারী

 রণজিৎ অধিকারীর দশটি কবিতা   

 

যে ডুবুরি কিছুই পায় না 

 

যেহেতু অলঙ্ঘনীয়, তাই আমরা খুঁজেই চলেছি

                     একের পর এক নিবিড়তর ঊরুসন্ধি।

যে ডুবুরিরা ডুব দিয়ে কিছু খুঁজে পেয়েছিল, তারা

আজ বিস্মৃত, মৃত।

এসো, আমরা কেবল মণি খুঁজতে নেমে অতলে তলিয়ে যাই,

তলিয়ে যাওয়াই কি ডুবুরির চূড়ান্ত সার্থকতা নয়? জয় নয়?

 

তুমি তো কেবল হারতেই পারোফুলের কাছে, রূপের কাছে,

সুগন্ধি মৃদু হাওয়া আর বিশাল সমুদ্রের কাছে...!

হাঁটুমুড়ে পরাজিত হয়ে যাওয়া ভালো, নিঃশেষিত হতে পারা

ভালো গভীর খাতের দিকে চলে যাওয়া ...

 

এসো, যে ডুবুরি কিছুই পায় নাতার মতো নিরালম্ব

তলিয়ে যেতে যেতে পেরিয়ে যাই তৃষিত নিবিড় ঊরুসন্ধি সকল।

 

 টেবিল তৈরি হচ্ছে   

 

টেবিল তৈরি হচ্ছে।

আমরা হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। চারপাশে উৎসুক গোল হয়ে।

যা যা রাখা হবে টেবিলেতা আগেই প্রস্তুত হয়ে ডাঁই।

কার্যত তারাই বলেছেএবার টেবিল চাই।

আমাদের সাধ্যমতো যে বাগ্মী সে আগ বাড়িয়ে

ছুতোরকে বুঝিয়েছেকেমন কী লাগবে আর

অভিজ্ঞ ছুতোরও চেয়ে নিয়েছে তার সামগ্রী, টুকরোটাকরা।

খিদে তেষ্টা নেই, আমরা দেখেই যাচ্ছি।

 

জিনিসপত্র সব অপেক্ষমাণ— এরই মধ্যে রৌদ্র, ছায়া...

হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে... পৃথিবী হরদম ঘুরছে আমরা কেউ

দেখতে পাচ্ছি না... ব্ল্যাকহোল কপ করে গিলে ফেলল একটা নক্ষত্রকে।

কেউ দেখেনি, কোনো প্রমাণ নেই।

তর্ক করছে কেউ, গুনগুন থেকে হৈহল্লা হুড়দাঙ্গা...

 ওদিকে টেবিল তৈরি হচ্ছে।

 

কীভাবে পড়তে হয় প্রেমে  

 

কীভাবে প্রেমে পড়তে হয় তা কিন্তু সবার জানা উচিত।

কজনই বা জানে বরফ কীভাবে পড়ে; অতি অল্পজনই দেখেছে

খাদের দিকে পাথর গড়িয়ে পড়া।

শিশির পড়তে সত্যি সত্যি তো কেউ দেখেনি!

 

কেন মার্চেই প্রেমে পড়তে হয় কিংবা ভাদ্রমাসের দিকে

তা জানা জরুরি :

কেন নাম জানার আগেই পায়ের গড়ন দেখতে হয়, আর মেয়েটি

                                        কেমন করে তাকায়।

আমরা তো জানি কীভাবে পাতা ঝরে আর দমকা বাতাস দেয়

মার্চেসব এলোমেলো করে দেয়।

ভাদ্রের রাত্রিতে টিপটিপ বৃষ্টিহঠাৎ করেই মনে হয় ঘর শূন্য,

শরীরে অভাব বোধ হয়, কী চায়...

 

হাতে কড়া পড়ে যাওয়া কিংবা উঠোন জুড়ে শ্যাওলা পড়ার

কত আগেই মানুষ প্রেমে পড়েছিলসব ভুলে যায়, একদিন

সব ভুলে যায়।

মার্চের পর মার্চ আসে, ভাদ্র, কত ভাদ্র... মানুষ প্রেমে পড়ে না আর।

 

 

চৈত্রের ভেতরে  

 

চৈত্রের ভেতরে আমার বৈশাখ ঢুকে পড়ছে,

গোড়াতে গলদ না থাকলে এমন হয় না।

চল্লিশোর্ধ্ব সুনিতম্বিনীদের দেখতে দেখতে

পাতা উড়ছে, আজ সারাদিন রোদের তেজ ছিল খুব,

                            বিকেলে কালবৈশাখী।

কীকরে চৈত্রের বুধবারের আগে ঢুকে থাকা বৈশাখী রবিবার

ফের চৈত্রের একফালি সপ্তমী!

কীভাবে কী হয়— মনে হয় শুশুনিয়া পাহাড়ের

গা কেটে বানানো মূর্তির মতো দিন— কোনো অদৃশ্য পাহাড়ও

এইভাবে একদিন ফুরিয়ে যাবে।

 

একটা বানানো মূর্তির ভেতর যেভাবে থাকে আরো মূর্তি ;

বৈশাখের দিনের ভেতরেও থাকে না কি অনেকটা চৈত্র?

আষাঢ়ের ভেতর জ্যৈষ্ঠ আর ভাদ্রও কিছুটা?

আমার বয়সের ভেতরে যেমন কিছুকিছু ছাব্বিশ পনেরো

আর চল্লিশও মিশে আছে।

স্থূলাঙ্গিনীদের এখন আমি মন দিয়ে দেখি— অনেক উচ্ছল সৌন্দর্য

প্রাক্-যৌবনের এখনো থেকে গেছে ঐসব দেহে।

 

 বরফ বিষয়ে 

 

এত বরফ পড়েছে, সকালে বাচ্চারা বরফ নিয়ে খেলতে খেলতে

অনেকটা দূরে চলে যায়, কলকল হাসিতে ছুটে ফিরে আসে।

পৃথিবী এমন গোল করে বানানোবরফ ঢাকা এই সময় টা

নভেম্বর হতে পারে, কোথাও ডিসেম্বর, এপ্রিলেও কি বরফ থাকে না

                                                কোথাও?

 

আজ রেললাইনের ওপর এক ফুট বরফ, জুতোর ভেতর...

যানবাহন বন্ধ, সব স্তব্ধ। বাচ্চারা খেলছে, মা বাবা

আরো যারা এখানে শেষমেশ আসতে পেরে খুব খুশি; কতবার

কী কী কারণে আসতে চেয়েও ভেস্তে গেছেতার মুণ্ডপাত ইত্যাদি

 

নভেম্বরে গাছে একটাও পাতা থাকে না, ডালে ডালে বরফ...

বেড়াতে আসা ক'জন যুবক যুবতীও এখন বরফ ছুঁড়ে খেলছে ;

সুস্থ হাসি কী চমৎকার!

এই শহরে জনজীবন কিন্তু স্তব্ধ! এমন একটা বরফজমা স্তব্ধ-দিনে

আসতে পেরেছে বলে বেড়াতে আসা অভিভাবকরা বারবার

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয়। বরফ কী বিশুদ্ধ! এবার সকলেই খেলছে ;

জনজীবন স্তব্ধ করে দেওয়া এই বরফ কী চমৎকার!

 

 

ভিভালদি কিংবা আমরা   

 

ভিভালদির ভায়োলিন কীভাবে একটা আস্ত শরৎকালকে

বাজিয়ে দিয়েছিল।

আমাদের চোখে দেখা শরৎ তো তার কাছে নস্য।

কীভাবে জ্যান্ত হয়ে ওঠে সব? —এই অভিলাষ আমি পেয়েছি

সেই ফকিরের কাছ থেকে যে সব ছেড়েছুড়ে দিয়েও

গোটাটাই ফিরে পেতে চায়!

ধরো, এক বিপুল ঝড়কে কবিতায় ঢুকিয়ে দিতে পারা কিংবা

শব্দগুলির প্রণয়িনীর মতো শীৎকার করে ওঠা...

আমি শেষপর্যন্ত সেই অজ্ঞাতনামা স্রষ্টা যে ঘনিয়ে তোলে

একটা কালো মেঘ আর সে আস্ত মেঘকেই

কবিতায় রেখে দিতে চায়; চাই একটা বিস্ফারণ

যা শব্দের শৃঙ্খলাকেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে।

আমি নয়তো অন্য কেউ তারপর আরো কেউ এই জগৎকে

পুনরায় নির্মাণ করুক যেভাবে ভিভালদি তাঁর ভায়োলিনে

বসন্তকে প্রকৃতির চেয়েও আরো বেশি সত্য করে তুলেছেন।

 

একটি হিজল গাছের ধারণা    

 

তারপর একটা হিজল গাছ দেখতে পাই।

 

হিজল গাছের ওপারে হয়তো কোনো কান্না আছে ;

হয়তো এপারে এখনো সঙ্গমের প্রার্থনা থেকে গেছে!

 

এখনো সেই অটুট বৃত্তের কথা, সেই পরিধি,

সেই পথের মতো মোহ আমাকে টেনে আনছে।

কখনো মিহিন রোদ কিংবা ঘূর্ণাবর্তের ভেতর দিয়ে এসে

সেই তো দেখতে পাই,

                         একটা হিজল গাছ। কিংবা

এ-সমস্তই আরেক কাল্পনিক পৃথিবী, যারও আছে

হুবহু বিকেল, ভৈরবী, আছে বৈশাখ, ফেব্রুয়ারি,

রাত্রির শঙ্খিনী, পদ্মিনীর মতো অতকিছু...।

তবে আমার এই প্রার্থনার মতো সঙ্গমেচ্ছা, ওপারের

কী এক কান্না আর ওই হিজল গাছ ... এইসবও কি

কাল্পনিক পৃথিবীর নয়!

 

যেকোনো পৃথিবীই হয়তো এক বৃত্ত এঁকে শুরু হয়, ক্রমে

যথাযথ জ্যা, ব্যাসার্ধ ইত্যাদি বসিয়ে নেওয়া তারপর

সময়মতো এপারওপারসহ একটা হিজল গাছ ...

 

 জ্যামিতি বাক্স  

 

কেননা সবচেয়ে জরুরি ছিল একটা বৃত্তের ধারণা তৈরি করা,

আর দলা পাকানো এক মণ্ডকে ঠিকঠাক গোল করে তোলা।

তখন কেই বা জানত ঘুরতে ঘুরতেই তারা সব

         এক এক দাম্ভিক গ্রহ নক্ষত্র হয়ে উঠবে!

আজও যখনই কেউ একটা জ্যামিতি বাক্স হাতে নেয়, আমি

নতুন সম্ভাবনায় কেঁপে কেঁপে উঠি, যেন অযুত প্রাক্-ধারণা

প্রস্তুত হতে থাকে। আবার নতুন নতুন ব্রহ্মাণ্ড তৈরির প্রক্রিয়া

যেন শুরু হবে এই এখুনিই, ওর হাতেই ...

 

কেননা এই সমূহ ব্রহ্মাণ্ড হয়ে ওঠার আগে ছিল মাপজোখের

সামান্য ক'টি ধারণা আর এক অলীক জ্যামিতি বাক্স!

 কার হাতে ছিল!

 

আবিষ্কার কিংবা খুঁড়ে ফেলা   

 

চূড়ান্ত নগ্নতা এক আবিষ্কার কিংবা একটা পটভূমিকে

খুঁড়ে ফেলা। আমরা আবিষ্কার করি, পৃথিবী একদিন

লুকিয়ে ফেলেছিল বিপুল খনিজসেই গোপন ভাঁড়ার

আমরা খুঁজে বের করে আনি।

যেভাবে হাওয়ার ভেতরে থাকা কান্নাকে, সমুদ্রের ভেতরে থাকা

সেই বিপুল মাতলামোকেও একদিন আবিষ্কার করে ফেলব আমরা!

তোমার চরমবিন্দুটি যেখানে রেখেছ— তা খুঁজে চলাই তো আমার

প্রেম; কোটি কোটি আকুল ধাক্কাও সে-বিন্দু স্পর্শ করতে পারেনি।

 

আজও হাওয়ার মতো সমুদ্রের মতো তোমার নগ্নতা একটা পটভূমি।

লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তোমার চোখের ভেতর, বুকের... যোনির ভেতর

খুঁড়ে চলা আমার অচরিতার্থতাই আমার প্রেম।

 

প্রেম এক আবিষ্কারের প্রস্তুতি; যা সমুদ্রের মাতলামি, হাওয়ার কান্না,

এমনকি তোমার চরমবিন্দুকেও খুঁজে বের করে আনবে একদিন।

 

এমনকি তোমার বুকের পাথরও    

    

পাথরের যা আছে, তা হল কিছু বলার ইচ্ছে

কিন্তু কখনোই মুখ খোলে না তারা। ঠান্ডা পাথর হাতে নিলেই

টের পাবে— লক্ষ কোটি বছরের স্মৃতি সে অটুট রেখেছে অথচ

এই সামান্য কামিনী ফুলের গন্ধ কেমন তা তারা বলতে পারে না।

 

যেমন বস্তু, যারা সর্বদাই নিজেকে চিহ্নিত করতে পারে কিংবা

জানে নিজের স্থান নির্দিষ্ট করে ফেলতে! পাহাড়ের গা থেকে

খসে পড়া চাঙড় খাদের দিকে নেমে যেতে থাকে— আমি যেন

তার বাঁকা হাসি লক্ষ করি; কিন্তু কেন কিছু বলে না সে?

 

কীভাবে তারা জমাট ও বোবা হয়ে গেল— আমরা এসে সেসব দেখিনি।

কিংবা তাদের ভাষা যা আমাদের বাচাল ভঙ্গিমা ছাড়িয়ে বহুদূর চলে গেল!

হয়তো তারাই নিবিড়তরভাবে বুঝেছিল রৌদ্র আর ঠাণ্ডার মহিমা!

সব দেখে শুনে অভিমান হতে পারে তাদেরও যে,

আমাদের সমূহ অর্থোদ্ধারের চেষ্টা কেবল সাময়িক— চিরায়ত কিছু নয়।

 

পাথরে হাত দিলে আজও টের পাই— তার বলার ইচ্ছে জমাট হয়ে আছে ;

এমন কিছু, যা আমরা কখনো বলিনি ও শুনতে চাইনি।


5 comments:

  1. In your poem every image itself is a mother of poetry. Thus, all the images used in your poetry seem,in respect of thoughts, to make a world quite different from that of ours.

    ReplyDelete
  2. In your poem every image itself is a mother of poetry. Thus, all the images used in your poetry seem,in respect of thoughts, to make a world quite different from that of ours.

    ReplyDelete
  3. বারে বারে পড়ে তৃপ্তি পেলাম । ভালো লাগলো বেশি ভিভালদি ও আমরা ।

    ReplyDelete
  4. রণজিত দার কবিতা পড়তে হলে এক আশ্চর্য সরল মননের প্রার্থনা রাখতে হয়, কারণ তাঁর কবিতা এমন এক চরাচরকে ইঙ্গিত করে যার প্রবেশপথ অতি দুর্গম। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আগেও বলেছি বহুদূর এগিয়ে গেছেন...

    ReplyDelete
  5. অসম্ভব গভীর লেখা । আপনার কবিতা যত পড়ি ইচ্ছে হয় আপনার সঙ্গে মুখোমুখি লেখা নিয়ে আলোচনা করি । জীবনকে দেখার অদ্ভুত দৃষ্টি আছে আপনার । লিখে চলেছেন একের পর এক নিবিড় ভাষ্য । আমি দশটি কবিতা মন দিয়ে পড়লাম । প্রতিটিই নতুন করে চিন্তার আলো ফুটিয়ে তুলছে । আমার কবিতার মুগ্ধ পাঠক হয়ে পড়ছি প্রতিদিন ।
    ।। শুভদীপ নায়ক ।।

    ReplyDelete