তার হাতে মেঘ, অন্নজল (দ্বিতীয় পর্ব)
―অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
৪
“বারে
বারে বাঁধ ভাঙিয়া বন্যা ছুটেছে
দারুণ
দিনে দিকে দিকে কান্না উঠেছে
ও
গো রুদ্র দুঃখে সুখে, এই কথাটি বাজল বুকে
তোমার
প্রেমে আঘাত আছে, নাইকো অবহেলা… নয় নয় এ মধুর খেলা…”
ঠিক
এই পঙক্তিতে পৌঁছে যত্ন বেড়ে যায় বাবুয়ার। বড় প্রিয় গান তার। গমগমে স্বরে এক পৃথিবী
দরদ ঝরে পড়ল। দ্বিতীয়বার শুরু করল বাবুয়া।
এই
সময়টায় জানালা গলে ভরদুপুরের রোদ পড়ে তক্তপোশে। সবার ভাত খাওয়া হয়ে যায়, সকড়ি, এঁটো
তুলে, কুয়োপাড়ের বিড়ালগুলোকে খাইয়ে, দরজা জানালা ভেজিয়ে এই সময়টায় ঘুমিয়ে পড়ে মা। এই
সময়ে বাবা দোকান থেকে ফেরে না। রোদের গায়ে হিমেল হাওয়া বোঝা যায়। নিরিবিলি পাড়াটা আরও
একটু চুপ করে যায়, আশেপাশের বাড়িগুলো নিস্তেজ হয়ে ঝিমোয়, আর তাকে কিছু বলার মতো কোত্থাও
কেউ থাকে না। তাই এই সময়টায় নিশ্চিন্তে রেওয়াজে বসে বাবুয়া। আজও বসেছিল। হঠাৎ তীব্র
ঝনঝন আওয়াজে চমকে থেমে গেল সে।
কেউ
এসেছে। আরও একবার শুনে পরখ করল বাবুয়া। গ্রিলের গায়ে বন্ধ তালা দিয়ে সজোরে আঘাত করছে
কেউ। একটানা নয়, থেমে থেমে। যেন আঘাতের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সাথে রয়েছে কুণ্ঠাবোধও।
হারমোনিয়াম
ছেড়ে ওঠার আগে গলা তুলে হাঁক দেয় বাবুয়া।
‘কে?’
কোনও
সাড়া আসে না। উঠতে গিয়েও থেমে যায় সে। রিডের উপর আঙুল চালাতে তোড়জোড় শুরু করে। পরক্ষণেই
গ্রিলের গায়ে আবার তালা ঠুকল কেউ।
এবারে
উঠে পড়ে বাবুয়া। আজকাল ঘর বারান্দায় হাঁটাচলা করতে ছড়িটা ব্যবহার করে না সে। সিঁড়ি
দিয়ে উঠতে নামতেও নয়। এতগুলো বছরে আন্দাজ হয়ে গেছে। অভ্যেসবশে দরজা, জানালা, চাবি রাখার
টেবিল, বারান্দার গ্রিল সবই চেনে। চলাফেরাতেও আগের চেয়ে দ্রুততা এসেছে। শুধু রাস্তায়
বেরোলে আলো নিভে আসা চোখে চশমার আড়ালটা রাখে, হাতে ছড়িটা থাকলে একটু ভরসা পায়।
টেবিল
হাতড়ে চাবিটা নিয়ে দরজার পাল্লা ধরে বেরিয়ে এল বাবুয়া। সাবধানী গলায় আবারও জিজ্ঞেস
করল,
‘কে?’
একটা
স্বর বাজল কানে। কব্জির বাধায় সমস্ত চুড়ি একত্রে ঝামরে পড়ার মতো স্বর। কিঞ্চিৎ ভয়ের
সাথে নম্রতা মাখানো একটা স্বর।
‘একটা
ফোন করা যাবে?’
বাবুয়া
জন্মান্ধ নয়। প্রায় ষোলো বছর বয়স অবধি পৃথিবীর রং রূপ সে ভালই চিনেছে, জেনেছে। তারপর
ধীরে ধীরে মাথায় জল জমতে শুরু করে, স্নায়ুর জটিল রোগে দৃষ্টি আবছা হতে থাকে। মাথা থেকে
জল বের করার এক চিকিৎসা পদ্ধতি মাঝেমধ্যে সারা হয়, আবার মাঝেমধ্যে বহু বহু দিন হয় না।
তবু এখনও অন্ধকার হয়ে আসা চোখে বিভিন্ন রং কল্পনা করতে পারে সে। এই যেমন এখন, বাবুয়ার
মনে হল বন্ধ গ্রিলের ওপারে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পরনে একটা গাঢ় সবুজ চুড়িদার, বুকের
কাছে ফেলে রাখা বাসন্তি রঙের ওড়না। ভারি অদ্ভুতভাবে এও মনে হল, যে এসেছে সে’ও হয়তো
মেরুন ফ্রেমের চশমায় আড়াল করেছে চোখ। এই স্বর বাবুয়া চেনে না। তবু মনে হল, যে এসেছে
সে চেনা।
অল্প
অধৈর্য হয়ে মেয়েটি আবার ডাকল।
‘বলছিলাম,
একটা টেলিফোন করা যাবে?’
সম্বিৎ ফেরে বাবুয়ার। চাবির গোছায় একটাই চাবি। দুপুরবেলাগুলোয় তার সুবিধার্থে রাখা। সেটা দিয়ে
আঙুলের আন্দাজে তালা খুলতে খুলতে বলে,
‘হ্যাঁ,
আসুন’।
বারান্দায়
রাখা কেঠো টেবিলটায় একটা লাল-কালো রিসিভার রাখা। সাথে মিটারে লাল আলোর নম্বরে বিল দেখার
ব্যবস্থা। পরিবারে বাড়তি রোজগারের জন্যে চলনসই। দুপুরবেলায় প্রতিবেশী কেউ টেলিফোন করতে
এলে, তাকে কথা বলবার সময়টুকু দিয়ে মিটার দেখতে মা’কে ডেকে আনে বাবুয়া। যদিও দুপুরবেলায়
বড় একটা কেউ আসে না, তবু এই ব্যবস্থা করা। আজ এসেছে। তাকে পাশ কাটিয়ে এইমাত্র টেবিলটার
দিকে এগিয়ে গেল মেয়েটা। বত্রিশ বছরের পুরনো নাকে এক মেয়েলি সুবাস টের পেল বাবুয়া। মিটারের
শব্দে বুঝল, কানে টেলিফোন তুলে নিয়েছে মেয়েটা।
মা’কে
ডেকে দিতে ঘরের দরজার দিকে এগোয় বাবুয়া। খুব নিচু চৌকাঠ পা ফেলে ফেলে পেরিয়ে যায়, ঠিক
তখুনি আবারও মেয়েটার স্বর কানে আসে,
‘আমি
বলছি, শোনা যাচ্ছে?’
বাবুয়ার
মনে হল, অদ্ভুত স্বরে কথা বলে মেয়েটা। ফোনের ওপারে যে আছে সে’ও নিশ্চয়ই মেয়েটার স্বর
শুনলেই চিনতে পারে। নাম বলার কোনও প্রয়োজন পড়ল না তো! এখন মেয়েটা আরও চাপা স্বরে কথা
বলছে, মাঝেমধ্যে হু, হাঁ উত্তর দিচ্ছে। তবু এই চাপা গলার আর্দ্রতা টের পাচ্ছে বাবুয়া।
কে জানে কেন, বাবুয়ার মনে হল, ফোনের ওপারে যে আছে, সে পুরুষ।
শুধু
এই স্বর শোনার লোভে এই প্রথমবার দেওয়ালের এপারে দাঁড়িয়ে রইল বাবুয়া। মা’কে ডাকতে যাওয়ার
কথা ভুলে গেল সে। হয়তো বা যেত, কিন্তু কথা শুরু হওয়ার সামান্য পরেই মেয়েটার স্বর ভেঙে
গেল যে! চাপা হলেও কথা বলতে বলতে আচমকা গলা ধরে এল তার। বাবুয়া টের পেল, তীব্র কান্নার
ঢেউ আটকাবার চেষ্টা করছে মেয়েটা। পারছে না, তবু সামাল দিয়ে আবার বলছে,
‘না,
দু’দিনে আমি কী করে পারবো, বোঝো একটু… না, না, বাড়িতে নয়, বাড়িতে ফোন করলে অসুবিধা
হয়… আমি দেখছি, একটু ভরসা রাখো… প্লিজ’।
একটা
দেওয়াল আর জানালার ব্যবধানে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা মেয়ে। সে কাঁদছে। কখনও নিজেকে সামলাচ্ছে।
স্বর শুনে চিনে নেওয়ার মতো পরিচিত কারোর কাছে মিনতি করছে। কখনও ধৈর্য হারিয়ে ফিসফিসিয়ে
হলেও রেগে উঠছে। আবার কখনও তার গলা এমন অতল খাদে নেমে যাচ্ছে যে কিছুই আর টের পাওয়া
যাচ্ছে না। তবু বাবুয়া দাঁড়িয়ে থাকে। অপরাধ মেনেও দরজার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটির
গলায় অদ্ভুত এক টান, এই ঈষৎ ভাঙা রিনরিনে স্বর বাবুয়ার পা দুটোকে চৌকাঠের কাছেই আটকে
রেখেছে।
হঠাৎ
বাবুয়ার মনে হল এই দুপুরবেলা, নির্জন বারান্দাটা, এই মেয়েটার স্বর, তার কান্না সবটাই
স্বপ্ন। হয়তো সে তক্তপোশের গায়ে শরীর এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। হয়তো দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে
গেছে অথচ চোখ লেগে যাওয়ার কারণে ঘরে আলো জ্বালায়নি সে। হয়তো সুরের ভিতরে সে এমন কোনও
দৃশ্য কল্পনা করছে। এমন কতকিছুই হতে পারে, তবু তার ভাবনা ভেঙে একটু পরে ফোন রেখে দিল
মেয়েটা। বাবুয়ার মনে নেই ঠিক কতক্ষণ সে দাঁড়িয়ে ছিল, কয়েক মিনিট বা কয়েক ঘণ্টাও হতে
পারে। ফোন রেখে দিলে আপনা থেকে খচমচ শব্দে বিল উঠতে শুরু করল। দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাবুয়া
বলল,
‘একটু
দাঁড়ান, মা’কে ডাকছি’।
মেয়েটা
বোধহয় বাবুয়ার অপারগতা এতক্ষণে টের পেল। শান্ত, নম্র স্বরে বলল,
‘আঠাশ
টাকা পঞ্চাশ পয়সা হয়েছে’।
বাবুয়া
ভাবল, এরপরেও মা’কে ডাকতে গেলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চশমাবতীকে অবিশ্বাস করা হবে।
‘বেশ,
দয়া করে খুচরো দিলে ভাল হয়’।
একটা
হাতব্যাগের চেন খোলার আওয়াজ হল। গুণে গুণে কিছু নোট আর খুচরো কয়েন টেবিলে রাখল মেয়েটা।
তারপর আবারও সেই সুবাস পেল বাবুয়া, তাকে পাশ কাটিয়ে গেল। গ্রিলের কাছে গিয়ে মেয়েটা
বলল,
‘আসছি,
দরজাটা বন্ধ করে দিতে পারেন’।
তারপর
চটিজুতোসমেত পায়ের আওয়াজ তিন ধাপ সিঁড়ি নেমে বাঁশের গেটটার দিকে মিলিয়ে গেল, বাবুয়া
টের পেল। চাবিটা আনেনি সে। দু’পাল্লার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে সে ভাবে, মেয়েটা কে? এই পাড়ার?
একই পাড়ার সবাই তো তাকে চেনে। তবে কি পাশের পাড়ার? বা নতুন এসেছে? তবু এই গলার আওয়াজ
সে আগে কখনও শুনেছে।
পাশের
মান্না মাঠে বল ফেলেছে। দুয়েকটা চিৎকার, খেলতে আসার উচ্ছ্বাস ভেসে আসছে। পাশের বাড়িতে
কেউ বোধহয় টিভি চালালো, উচ্চগ্রামে। সামনের সরু রাস্তাটা দিয়ে যেতে যেতে কে যেন টিপ
শব্দে ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বালিয়ে গেল। সত্যিই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। বাবুয়ার
মনে হল, মাঠের ওধারে এখন আকাশের লাল রং। যখন খেলতে যেত, তখন এমন লাল-কমলা রং দেখতে
পেত। হাঁসের ডিমের কুসুম মার্কা সূর্যটা জাহাজবাড়ির আড়ালে নেমে যেত। আজ এত বছর পর ভিতরে
কোথাও খুব হালকা চিনচিনে যন্ত্রণা বুঝতে পারল। আরেকবার মাঠে যেতে ইচ্ছে হল। না খেললেও,
পাশের পাঁচিলটায় বসে খেলা দেখা যেত যদি একবার!
বাবুয়ার
আরও ইচ্ছে হল, দুপুরবেলা যে সবুজ রঙের মেয়েটি এল, তার সম্পর্ক যেন না ভাঙে। সে যেন
টেলিফোনের ওপারের পুরুষটির সাথে সম্পর্ক জুড়ে রাখে। তারা জুড়ে থাকলে মেয়েটি হয়তো আরও
একটিবার আসবে।
৫
ঘরের ভিতরে বেলা পড়ে আসার ঘন ছায়া। আয়নার পাশে কালো
অন্ধকার জমাট বাঁধছে। কুহু ভাবল, এমন সময়ে
তার শ্যামলা মুখখানি আরও শ্যামলা লাগে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আয়নায় নিজেকে জরিপ করছে সে।
যখন রোদ ছিল, তখন দুধে আলতা পিওর সিল্কটা পরবে ঠিক করেছিল। এখন রোদ মরে আসা বাদামি
আলোয় আকাশি ইক্কত পরতে ইচ্ছে করছে। কিংবা সাদা জমিতে সোনালি সুতোর কাজ করা তাঁতের সালোয়ারটা।
অনেকক্ষণ ধরে নানান পোশাক ছড়িয়ে বারবার নিজেকে দেখেছে সে, কোনওটাই ঠিক মনে ধরেনি তার।
এবারে পোশাক ছেড়ে ছোট্ট লম্বাটে বাক্সটা হাতে তুলে নিল সে। রূপোলী বর্ডার দেওয়া খয়েরি
খাপের ভিতর অদ্ভুত রঙের লিপস্টিক। কুহু জানত এই
রঙটা মেরুন। উপহার যে এনেছে, সমীর, সে বলল এই রঙটা মেহগিনি। ঠোঁটের উপর পরম যত্নে বুলিয়ে
নিতে নিতে কুহু দেখল রঙটা তার মুখের সাথে মানায় ভাল।
উপহার!
উপহারের পাহাড়ে বসে থাকে কুহু। একলা। এমন উপহার অনেক পায় কুহু। এই ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
থাকা দামী শাড়ি, নীল ইক্কত, অভিজাত সালোয়ার, বিভিন্ন প্রসাধনী, সবই উপহারে পাওয়া। নীল
ইক্কতটা মলয় দিয়েছিল। পাশের পাড়ায় থাকত। ইন্ডিয়ান আর্মিতে কাজ করত। তার শখ ছিল পরের
ছুটিতে ফিরে এসেই কুহুকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। কুহুরও খুব একটা অমত ছিল না। কিন্তু
মলয়ের অনুপস্থিতিতে শেখর এল। কলেজের বান্ধবী সুপর্ণার দাদা, প্রায় ছ’ফুটের মতো লম্বা,
তামাটে রং, কোঁকড়ানো চুল, চাপদাড়ি, এমন সুপুরুষকে দেখেই মলয়ের বিদায় পাকা হয়ে গিয়েছিল।
শেখর লেখাপড়ায় ভাল, বোন সুপর্ণাকে পড়া বুঝিয়ে দিত। কুহুরও পড়া বোঝার প্রয়োজন পড়ত। সুপর্ণার
বাড়ি ঘন ঘন ছুটে যেত। শেখরের আড় ভাঙতে খুব যে সময় লেগেছিল তা নয়, বরং কুহুরই মোহ ভেঙেছিল
যেদিন ‘গীতবিতান’ এনে তার সামনে রেখেছিল শেখর। উপহার! চোখের দিকে তাকিয়ে কুহু বুঝেছিল,
গম্ভীর ছেলেটা খুব অল্প সময়ে আটকা পড়েছে। কিন্তু এই উপহারে আগ্রহ ছিল না কুহুর। তার
দুনিয়ার সাথে এই ছেলেটার দুনিয়া কত আলাদা বুঝে গিয়েছিল সে। আলাদাই তো! সুপর্ণা কোনোদিনও
কুহুদের এই দুই কামরার টালির বাড়িতে আসেনি। সুপর্ণাদের বাড়ির সবকিছুই অন্যরকম, তিনতলার
বিরাট পরিসর, লাইব্রেরি ঘর, মার্জিত রুচির বৈঠকখানা, শিক্ষা ও আভিজাত্যের অহংকারী ছাপ!
সেখানে অতি অল্প সময়ে, আগের উপহারে পাওয়া পোশাকে দেখেই কুহুকে কী না কী ভেবে নিয়েছিল
শেখর!
অতি
দ্রুত জাল কেটে ফেলতে কুহু জানে। হঠাৎ উদাসীনতার মুখোশ এঁটে এড়িয়ে যাওয়ার প্রাচীন কৌশলে
সরে এসেছে কুহু। অথচ শেখরকে আঘাত দেওয়া গেছে, কুহুর গায়ে লেগে থাকা পলকা কাচের অহংকারে
টোকা লাগেনি এতটুকু। আসলে উপহার! উপহার! উপহারের বহর দেখেই কে যে ওকে বোঝে আর কার সাথে
পোষাবে না, সবটা বুঝে যায় কুহু।
সেদিক
দিয়ে দেখতে গেলে সমীর অনেক বেটার। কুহু জানে, সমীর তার চাহিদা বোঝে। জিটি রোডের ধারে
সমীরের বাবার বিশাল লজ, সাথে আরও কীসব বেনামি ব্যবসা, কাঁচা টাকার ওড়াউড়ি। সমীর নিজেও
যাকে বলে ব্যায়ামবীর। বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করে, যদিও বিদ্যের দৌড় শেখরের মতো নয়,
তবু কুহুকে তো উপহারে মুড়ে রাখে। সে নিজেও সমীরের চাহিদা বোঝে। কিন্তু এব্যাপারে তার
ছুঁৎমার্গ আছে। কতটা আভাস দেবে আর কতটা খেলাবে, সে অনুপাতের হিসেব কুহু ভাল জানে।
এক
কথায় কুহু অত্যন্ত আকর্ষণীয় শরীরের অধিকারী। স্কুলবেলা শেষের আগেই একথা ভাল করে বুঝে
নিয়েছিল সে। তার কোমর ছাপিয়ে নেমে আসা চুল খুলে দিয়ে, গাঢ় কাজল টেনে, ঠোঁটে মেহগিনি
বুলিয়ে এই যে একটু পরেই পরিপাটি হয়ে অভিসারে বেরোবে, কুহু জানে মোড়ের মাথার ছাত্র সমিতি
ক্লাবের ছেলেরা তাকে কী বলে ডাকবে… ‘চাবুক’!
শ্যামলা
রঙের জন্যে চাপা হীনমন্যতা রয়েছে কুহুর। কিন্তু উপযুক্ত প্রসাধনচর্চায় তাকে নিজের হাতিয়ার
বানিয়ে ফেলতে পেরেছে সে। এখন আর কোনোকিছুতেই তেমন ডরায় না সে। পালকের মতো নির্ভার মন
নিয়ে একেকটি বিকেলে বেরিয়ে পড়ে কুহু। সমীরের থেকে একেকটি মহার্ঘ্য উপহার নিয়ে ঘরে ফেরে।
ষাট পাওয়ারের বাল্বের নিচে আধময়লা বিছানার চাদরে ছড়িয়ে সাজিয়ে রাখে উপহার। একদৃষ্টে
তাকিয়ে থাকে।
‘আলো
জ্বালিসনি’?
নিভার
ডাকে ফিরে তাকায় কুহু। প্রায় ছায়ান্ধকার ঘরেও নিভার চোখ জ্বলে ওঠে। ছোটো বোনের ঈর্ষা
টের পায় সে। আজ অনেক বছর ধরেই নিভাকে একারণে নিচু নজরে দেখে কুহু। চৌকি ও আয়নার কাছে
ছড়িয়ে থাকা উপহাররাজি দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকায় নিভা, জিজ্ঞেস করে,
‘তুই
বেরোবি’?
গলায়
যেন ঠেস দেওয়ার সুর। মনে মনে হাসে কুহু। উপহার পেতে শুধু বরাত নয়, আরও কিছু একটা থাকতে
হয়, একধরনের এক্স ফ্যাক্টর, সেটা সবার থাকে না। যেমন ফর্সা গোলগাল চেহারার নিভা সেই
ব্যক্তিত্বের অধিকারী নয়। সে কি কুহুর দোষ! শান্তভাবে উত্তর দেয় সে,
‘বেরবো।
ফিরতে রাত হবে। ঘরটা গুছিয়ে রাখিস’।
‘কোথায়
যাচ্ছিস’?
তীব্র
স্বরে প্রশ্ন শানায় নিভা। উত্তর দিতে ঠোঁট বেঁকে যায় কুহুর।
‘উত্তর
চাওয়ার আগে উত্তর পাওয়ার যোগ্য হতে হয়, জানিস’?
ঠিক
এই সময়গুলোয় জোঁকের মুখে নুন পড়বার অবস্থা হয়, কুহু জানে। ঘুরিয়ে উত্তর দেওয়ার মতো
কথার চালিয়াতি নিভা শেখেনি। ওর ভোঁতা মস্তিষ্ক এই কথার আঘাত মেনে পাশ কাটিয়ে যায়।
‘যেখানে
যাবি, মা’কে বলে যাবি। নিত্যদিন অশান্তি ঠেলতে ভাল লাগে না’!
হেসে
ফেলে কুহু। হাসতে হাসতে বলে,
‘অন্যের
ব্যাপারে যেচে ঢুকবি আর অশান্তি ঠেলবি না, তা হয়’?
খোঁচা
খেয়ে আলো না জ্বালিয়ে পর্দা ঠেলে ছিটকে বেরিয়ে গেল নিভা। যেখানে ওর সমস্ত নালিশ, সেই
মায়ের কাছেও খুব একটা জায়গা পাবে না, কুহু তা জানে।
একটু
পরে বারান্দার ক্ষীণ আলোয় পা ছড়িয়ে দেয় মালতি। কোল থেকে নামিয়ে রাখে তামাকের কুলো।
আঙুলে জড়ানো সুতো খুলে রাখে, কেটে রাখা তালপাতা জড়ো করে রাখে একপাশে। ক্লান্তির আড়মোড়া
ভাঙতে গিয়ে দেখে, ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে এক দীর্ঘাঙ্গি মেয়ে। পরনে ময়ূরকণ্ঠী রঙের সিল্কের
শাড়ি। খোলা চুল, কপালে টিপ, সঙ্গে মানানসই রঙের বাছা বাছা গয়না। ধাঁধা লেগে যায় মালতির।
এ কি তারই মেয়ে? সমবায়তে বিড়ি বাঁধা শ্রমিক মালতির মেয়েই কি কুহু? বহুদিন হল বড়ো মেয়ের
চোখের দিকে তাকাতে পারে না মালতি। আজও চেয়ে থাকার মধ্যে একটা ক্ষীণ ভীতুভাব ছিল। কুহু
মুখ তুলে বলল,
‘কিছু
বলবে’?
মালতি
চোখ সরিয়ে নেয়, পা মুড়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কাঁধ ঝাঁকায় কুহু, তার হিলজুতোয়
ঘোড়ার ক্ষুরের মতো শব্দ হয়। বেপরোয়া কুহু বেরিয়ে যায়। মালতি জানে, আজ কুহুর ফিরতে রাত
হবে!
৬
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে পা কেঁপে গেল নিলয়ের। অস্বাভাবিক! নিজেই অবাক হল সে।
এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। তবু হল। কিছুদিন ধরে এমনই হচ্ছে। মুহুর্মুহু চোরা বিস্ময়ের
স্রোত ওলটপালট করে দিচ্ছে তাকে। বিগত কয়েকদিন তবু দূরত্বের আড়াল ছিল, নিজেকে কিছুটা
সময় দিয়েছিল, আজ আর সেটুকুও নেই। তাই নিলয়ের পা কাঁপছে। আজন্ম চেনা বাড়ি, উঠোন, দোতলার
সিঁড়ি, এখানে বুড়ো, ছোটকেদের সাথে খেলে বড় হয়েছে, তবু আজ মনে হচ্ছে তার ছাব্বিশ বছরের
সুঠাম দেহকে উঠিয়ে দোতলায় পৌঁছতে পারবে না। পৌঁছনো উচিত নয়। একবার পিছনে ফিরে দেখল
নিলয়। সিঁড়ির নিচে খোলা দরজার বাইরে উঠোন, সেখানে সন্ধের নীল অন্ধকার। কাছে কোথাও শাঁখ
বেজে উঠল। একতলায় ভাড়াটেদের ঘরে মশলা ফোঁড়নের শব্দ হল, কোথাও রেডিও বাজছে, ক্ষীণ স্বরে
ভেসে আসছে ‘সংবাদ’। একবার মনে হল ফিরে যাওয়া ভাল। রাস্তার কোনও টেলিফোন বুথ থেকে না
আসার খবর জানিয়ে দিলেই হল। কিন্তু আবারও কী এক চোরাটানে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল।
ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে আবার ফিরে যাওয়ার কথা ভাবল নিলয়। কিন্তু ঘরের আলোয় তার মুখ দেখা
গেছে, সুলতা বেরিয়ে এসেছেন, তাঁর গলায় বিস্ময় মাখা আনন্দ,
‘নিলু যে! তা এত দেরি করতে হয়’?
ছোটোমাসির দিকে প্রায় ধরা পড়ে যাওয়ার মতো চোখে তাকাল নিলয়। আর ফিরে যাওয়ার
প্রশ্ন নেই। নিলয়ের মনে হল চোরাটান জিতে গেল। তার ভয় হল, চোরাটান জিতে যাবে।
সুলতা হাসিমুখে প্রায় উড়ে গেলেন উল্টোদিকের একটা পর্দাটানা ঘরে। খবর দিলেন,
‘শুনছিস? নিলু এসেছে। আয়’!
তারপর ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন, আলতো স্পীডে পাখা চালাতে চালাতে বললেন,
‘আর একটু দেরি হলে কাউকে দিয়ে খবর পাঠাতাম, কখন বেরিয়েছিস তা তো জানতাম
না’!
সুলতার ব্যস্তসমস্ত কথার তোড়ে ক্যাম্বিসের ব্যাগটা আঁকড়ে সোফার কোণে কাঠ
হয়ে বসে নিলয়। তার গুমরে থাকা মুখের বিপরীতে একটা ঘর, দরজায় পর্দাটানা। সেদিকে তাকিয়ে
বুকের শব্দ টের পায় সে। এখনও মন বলছে, ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু উপায় নেই।
পরমুহূর্তেই পর্দা সরে গেল। গোলাপি কাফতানে বেরিয়ে এল এক মেয়ে। ডিম্বাকৃতি
মুখের মধ্যে নজর কাড়ে ধনুকের মতো দুই ভ্রুর মধ্যিখানে ছোট্ট কালো টিপ। দুইদিকে সদ্য
বাঁধা বিনুনি, সাদাটে ফর্সা মুখে একটা হীরের নাকফুল। আর বিশেষ কোনও রূপটান নেই। বুনি!
কিছুদিন হল একটা ভাবনা কিছুতেই তাড়াতে পারেনি নিলয়। আজকাল বুনিকে বুনি বলে নয়, শুধুই
একটা মেয়ে বলে ভাবতে ইচ্ছে করে তার। যতবার ইচ্ছে করে ততবার অপরাধের ভারে কুঁকড়ে যায়
সে। মাথার ভিতরে অদ্ভুত যন্ত্রণা টের পায়। তবে সে জানে, কাটিয়ে উঠবেই। নিজেকে আরেকটু
সময় দিলে এই চোরাবালি থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেবে সে। সেজন্যই এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব
এখান থেকে ফিরে যাওয়া উচিত তার। কিন্তু পথ আগলে দাঁড়াচ্ছে ওই গোলাপি কাফতানের মেয়ে।
কিশোরীলালের প্রথমপক্ষের স্ত্রী ছিলেন নিলয়ের ছোটোমাসি। কিন্তু গরিব ঘরের
মেধাবী নিলয় আজন্ম এই দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রীকেই ছোটোমাসি মেনে এসেছে। কারণটা আর্থিক।
কিশোরীলালের আজ্ঞাবহ ছিল তার বাবা মা। এখনও। কিন্তু অসম্ভব রূপবান, মেধাবী, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের
অধিকারী এই মুখচোরা ছেলেটিকে এবাড়ির সবাই তার নিজগুণেই ভালবাসে। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে
পারার কৃতজ্ঞতাবোধ নিলয়েরও আছে। মেসোমশাই কিশোরীলালকে সে খুবই শ্রদ্ধা করে, সেইসাথে
এতগুলো বছরে এই বাড়ির আপনজন হয়ে উঠেছে। নিজের ছোটোমাসিকে সে দেখেনি, মনে রাখার কারণও
নেই।
কৌতুক মেশানো চোখে এগিয়ে এল বুনি। এই সন্ধেবেলাটায় বুড়ো দা, ছোটকে কেউ থাকে
না। মেসোমশাইয়ের ফিরতে দেরি আছে। সুলতা চা করছেন। একলা সুযোগে আরও বেশি প্রগলভ বুনি।
ভ্রূ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আজ এত দেরি? রাস্তা ভুলেছিলে বুঝি?’
বুনি যেন টের পেয়েছে, প্রশ্রয়ের আঘাতে আঘাতে একটা দরজা খুলে গেছে। নিলয়
আরও কাঠ হয়ে যায়। পাঁজরে কেউ ক্রমাগত ধাক্কাচ্ছে, তবু গম্ভীর হয়ে বলে,
‘অন্য কাজও তো থাকে নাকি?’
ফিচেল হাসি হেসে ওঠে বুনি।
‘এত কাজ থাকলে সময় করে আসা কেন শুনি’?
পাঁচ বছরের ছোট মেয়েটার এমন সব প্রশ্নে দম বন্ধ লাগে নিলয়ের। গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে,
‘বুড়ো দা ডেকেছিল। নতুন দোকানের ট্রেড লাইসেন্সের কাজ করে দিতে। কাল সকালে
সেরে বিকেলে ফিরে যাবো’।
মুখটা মেঘলা হয় বুনির। তারপরে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘বড়দা ট্যুরে গেছে। চারদিনের আগে ফিরবে না’। আবার খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ে,
হাসতে হাসতে ডানদিকের বিনুনি পিঠে ফেলে দেয়।
নিলয়ের টানা চোখ দুটোয় না চাইতেও হাসির ঝিলিক এসে পড়ে। প্রাণপণে চেপে রেখে
বলে,
‘তবে যাই, বুড়ো দা থাকলে আসবো’।
রান্নাঘরের প্যাসেজের দিকে এক পা এক পা পিছতে পিছতে বুনি বলে যায়,
‘মা যেতে দিলে তো’!
কাফতানের গোলাপি রং চোখের আড়াল হতেই ফের ধন্দে পড়ে যায় নিলয়। কথার তোড়ে
যেটুকু দমকা বাতাস বিনিময় হয়েছিল, তা মুহূর্তে সরে যায়। বিগত কয়েকদিনের দমচাপা ভাব
ফিরে আসে। কেন সে এসেছে? এই মুহূর্তে এখানে কী তার কাজ? কাজ না থাকতেও কেন আসার জন্যে
অজুহাত খাড়া করেছে সে? বুনি চোখের সামনে থাকলে আনুষঙ্গিক দুশ্চিন্তা সরে যায় কেন? হিসেব
মতে বুনির সাথে কী তার সমীকরণ? সবশেষে একটাই ভয়ংকর প্রশ্ন মাথায় আসে নিলয়ের। যে প্রশ্নের
সামনে দাঁড়াতে গিয়ে একটু আগের সিঁড়ির মতোই পা কাঁপে নিলয়ের। যেভাবে এতবছর সম্পর্ক গড়ে
উঠেছে, যেমনটা সে শিখেছে, বুনি কি তার মাসতুতো বোন?
নভেম্বরের সন্ধেয় ধোপদুরস্ত ঘরটায় অল্প জোরে পাখা ঘুরছে। তার মধ্যেই ঘাড়ে
কপালে ঘামছে নিলয়। তার মনে হচ্ছে ওই গোলাপি রং, দুই বিনুনি, ওই কালো টিপ এঘরে ফেরার
আগেই পালাতে হবে। এই চেনা বাড়িটা থেকে পালাতে হবে। নিলয়ের নিজের থেকে পালাতে হবে।
ক্রমশ...