লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Tuesday, October 5, 2021

রিয়া চন্দ্র, শারদীয়া সংখ্যা

রিয়া চন্দ্র-র গুচ্ছকবিতা


অনভিপ্রেত


যাপনের সব রন্ধ্রপথে এখন আর চাঁদ থাকে না

বিপন্ন কালো দাগের আততায়ী জ্যোৎস্না 

পৃথিবীময় লেগে থাকে, রাত বদল হতে পারে

তাই যেকোনো অছিলায় প্রায়শই অপ্রতিহত ঘুমে

কতিপয় রূপকথারা তার সাম্রাজ্য সাজায় 

আর অন্ধকারে আহত শরের তীর্যক দৃশ্যে 

নীড় প্রত্যাশী তাঁবুর নীরবতা থেকে ঘূর্ণায়মান

হাওয়ার মতো বিষাদ অক্ষরেরা উঠে আসে

 

মাঠ বন নদী পেরিয়ে বহুদূরে হঠাৎ যেন 

দুলে ওঠে রাজকুমারীর স্বপ্নের পালঙ্ক

ঘোরতর স্বপ্নভঙ্গে তখন ঢেউয়ের প্রমাদ 

গুনতে গুনতে দেখি, দারুণ বৃষ্টিপাতে সর্বাঙ্গ

ঢাকতে চালকবিহীন পদাতিক কেমন করে

বেখেয়ালে নেমে যায় গুহার স্থবিরতার দিকে

 

 

আদিস্রোত

 

জলের ভেতরে আগুন, কতটা গভীর ছিল

প্রান্তিক ডুবুরি তার খোঁজ রাখেনি

স্রোতের কাছাকাছি তন্ময় চন্দ্রালোকে

ঢেউয়ের গান শুনিয়ে যায় আদিমানবেরা

 

আজ শুধু পাতাদের কান্না লেগে রঙিন ডানায়

অথচ তার কোনো দাগ নেই, অপার ডাক নিয়ে

আমি যে ঘরে নেই, রক্ত ও মাংস সাজিয়ে

এ কাকে আহ্বান করছ নিজের ভ্রমর-শরীরে?

 

ডুবছি, ভাসছিও, এভাবেই শূন্যতা লুকিয়ে 

একদিন চলে যাব আমি, কেবল বাহুমূলে

নিবিড়তা শেকড় ছড়িয়েছে যতটুকু, ততটুকুই

পাতার রূপোলী শরীর গোপন দৃশ্যে রেখে যাবে

 

মধ্যরাতের শহর থেকে

 

রাস্তার একপাশে অর্ধমৃত রাতের ভয়াল থাবায়

ধুঁকছে নিঃসঙ্গ ল্যাম্পপোস্ট, আভার নিষেধাজ্ঞা

পেরোতে দু'হাতে ছাড়িয়েছে পতনোন্মুখ

পিপাসার জল, প্রকৃত লিপ্সার দিকচক্রবাল

ঠোঁট নড়ে উঠছে ভাঙা জিপের, নৈশ কোতোয়াল 

তুমি নির্জনতায় ভরে দাও ঘোরলাগা আলো

মধ্যরাতে গলিখুঁজি হয়ে পোড়ো বরফ-সংকেত

বারবার ফিরে যায় সৃষ্টি স্থিতি লয়ের ভেতর

এই স্মৃতিময় রাত জানে সমূহ সম্ভাবনা থেকে

দূরে মানুষের কাছে হরিণীর মতো চোখ তুলে 

সে থেকে যাবে তর্জনীর প্রণয়ে, একা স্পর্ধাহীন

 

 

তৃষ্ণার ভেতর সহজ অঙ্কও জটিল হয়ে যায়

এমন অনতিক্রম্য দীর্ঘ বৃষ্টিপাত, সর্বাঙ্গ স্খলনে

নিয়মের কাটাছেঁড়া শরীর তীরের ফলার মতো

এক গোলার্ধ থেকে অন্য গোলার্ধে ছুটে যায়

কোনো দৃশ্য নেই, প্লাবনের খেয়ালে জলের চঞ্চল

শব্দ রেখে যাচ্ছে আত্মসমাহিত মায়াপাশ

ফুটপাতের নির্জনতা ও ভ্রমররঙিন প্রতিটি

অক্ষরের কৃশ-শরীর দেখে ব্রিজের ওপর রাস্তা

কেমন ভিজে যায়! রাতের নিবিষ্টতা পেরোলে

অর্ধেক ঘুমের আড়ালে পল্লবিত হয়ে ওঠে

কামজলময় অন্তর্দহন, নৈঃশব্দ্যের অঙ্গুলি হেলনে

 

অনুরাগ

 

জন্মান্ধ মেয়েটির চোখের গভীর থেকে 

সাঁতারের চিহ্ন মুছে দিচ্ছে বিষাদী 

কিশোর নদের নষ্ট পাড়

নির্বিকার উপত্যকায় এমনই সঙ্গীহীন 

জলজ হাওয়াদের নিত্য আসা-যাওয়া

এখন বৃষ্টির উঠোন তো তার কেউ নয় 

 

মরমী নদীর কোমল ঠোঁটের মুখোমুখি এসে

দাঁড়িয়েছে শুকনো পাতার প্রণয় প্রস্তাব

এখানে পদ্মপাতায় সঙ্গোপনে 

সেতারের কথা লিখে রাখেন মাটির ঈশ্বর

 

চাঁদেলা নর্তকী

 

স্থবিরতা চেয়ে পাথুরে জমির ওপর স্খলিত

নৈঃশব্দ্যে শিস দিয়ে ওঠে বিচ্ছিন্নতা, যেন মন্ত্রমুগ্ধ

প্রহেলিকা জলের দৃশ্যপটে প্রবাস সেরে তাপাঙ্কে

রেখে গেল অসংখ্য সুতোর মতো জড়ানো জাল

বাগান ভরে উঠেছে শয়তানি জ্যোৎস্নায়

বহুদিন এরকম চন্দ্রাহত রাতে স্নান করেনি 

কোনো প্রেতাত্মা, তার কিছুটা আভাস ছড়িয়েছে

আলো ও অদম্যতার মৃত্যুভয়াতুর হলুদ পোশাক

 

আজ অন্তর্ধান প্রয়োজন, জল-পতনের শব্দে

খুলে যাচ্ছে জোনাকিদের উচ্ছিষ্ট বসন

মগ্নতার আদিম আলোয় পাহারায় বসে শীতের

ওম, অসময়ে হঠাৎ সন্ধ্যে নেমে এলে পাহাড়তলীর

চোরা খাত হয়ে ভাষাহীন ক্ষতের হাঁ মুখে সম্মোহিত

লুটিয়ে পড়ে চাঁদের একজোড়া অবারিত ঘুঙুর

অর্ঘ্য দীপ, শারদীয়া সংখ্যা

অর্ঘ্য দীপ-এর দুটি কবিতা

 

দেখা

 

সবাই বলে, পৃথিবীটা নাকি খুব সুন্দর।

আমি যেরকম ভাবি, তার থেকে অনেক বেশি

সুন্দর এই পৃথিবী...

 

আমারই দেখার চোখ ছিল না হয়তো,

তাই দেখা হয়নি।

 

দেখা হয়নি সমুদ্র

দেখা হয়নি পাহাড়

দেখা হয়নি দূর বরফের দেশে

হলুদ মেপল পাতা

বিষণ্ণ বাতাসে পাক খেতে খেতে

ঝরে যায় অবিরাম

 

একা, একা, আরও একা হয়ে

কত দীর্ঘ পথ আমি হেঁটে গেছি মানুষের ভিড়ে

হয়নি দেখা বন্ধুর মতো কারও সাথে কতকাল!

 

নতজানু হয়ে বসে

প্রেমিকের জীবন চেয়েছি

প্রতিটি প্রার্থনায়

 

অথচ দেখিনি প্রেমিকার মুখ কোনওদিন...

তাতেও কোনও দুঃখ নেই আমার।

 

ভুল প্রেমে

ক্রমশ অন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে,

 

আমি শুধু তোমাকে

 

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে দেখেছি

দু-একবার...

 

তপস্বিনী

 

অজানা বাতাস আসে কালের ইশারা নিয়ে

যেটুকু যা খড়কুটো ভেসে চলে যায়

কোন দিগন্তের পারে

 

যেতে দাও তাকে, যে খুঁজেছে তোমাকে

আলো-অন্ধকারে

 

উপোসের বেলা মুছে দেয়

বিদায়ের সুর

 

কান পেতে শোনো

 

শিবের মতো বর, তুমি তো চাওনি কখনও...

শ্রীময়ী মুখোপাধ্যায়, শারদীয়া সংখ্যা

শ্রীময়ী মুখোপাধ্যায়ের মুক্তগদ্য


অপ্রাসঙ্গিক

কখনও কখনও কিছু এলোমেলো সময় আসে, যখন মনের অগোছালো ভাবটা অকারণ খোঁচাখুঁচি করতে আরম্ভ করে। যদিও আমার ‍মন কোনোদিনই গোছানো ছিল না, কারোরই থাকে না। কিন্তু এই সময়গুলোতে কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ধারপাশ দিয়েও যায় না মনটা। তখন কোনো কিছুরই কার্যকারণ, পরিপ্রেক্ষিত, প্রতিবেশ বুঝতে ইচ্ছে হয় না। কোনো থিসিস অথবা হায়ারার্কিই আর অর্থযুক্ত বলে মনে হয় না। 'আমি' চারপাশের সবটা ঝাপসা লাগে, নগণ্য মনে হয়। ঠিক সেই মুহূর্তগুলোতে 'সবার উপরে মানুষ সত্য' প্রবাদটা অস্থিমজ্জায় উপলব্ধি সম্ভব হয়ে ওঠে। সেই সময়ে কোনো অ্যারিস্টটল, মার্ক্স, হোমার, মহাভারত কিংবা impressionism, Dadaism, বিশ্বযুদ্ধ, ভ্যান গগ— কিছুই আর হৃদয়ে সামান্যতম টোকাও দেয় না।

 

তখন কেবলমাত্র একটা রূপকথার দরকার হয়।

বিশ্বে যা কিছুর অর্থ আছে,সেই সবটুকুকে অস্বীকার করতে ইচ্ছে হয় তখন অর্থহীন, তাৎপর্যহীন হতেই ভাল্লাগে। সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা মিথ্যে প্রতিপন্ন করতে ব্যগ্র হয়ে উঠি। বাস্তবতার চেয়ে অনেক আলোকবর্ষ দূরে একটা মিরর ওয়ার্ল্ড থেকেই যায়। এই মিরর ওয়ার্ল্ডের উপস্থিতিটা সব মানুষের জীবনেই ভীষণভাবে কাম্য। এতে নিজেকে বরাবর বাস্তববাদী ভেবে আসা ধারণায় একটু আধটু ধূলো পড়ে বটে, সে পড়ুকগে!

 

অসংখ্য মৃত্যু দেখেও নার্ভ না হারানোয় নিজেকে হার্টলেস বলে সন্দেহ হবার পরমুহূর্তেই হঠাৎ ডিজনি ব্রেভ হতে ইচ্ছা হয়...ভাগ্যের পিছনে দৌড়ানোটাই কি একমাত্র রিলেটেবলধুত!

 

কথায় বলে, 'যা সবার তা কারোর নয়'

আচ্ছা, তাহলে কি সেই ফর্মুলা মেনেই বলা যেতে পারে, 'যেখানে সবাই পলায়নপর সেখানে কাউকেই এস্কেপিস্ট বলা যায় না'? যা সবার তাই তো সাধারণ আর সাধারণের সংজ্ঞা হয় না।

কেবলমাত্র জ্বরের ঘোরে নয়, তথাকথিত সুস্থতার তাপমাত্রাতেও কখনও কখনও প্রলাপ বকতে ভালো লাগে। সেইসব তালকাটা প্রলাপের জেরে মন, মাথা এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে, সেখানে আর কোনো যুক্তি খাটে না। তখন বিশ্বের অন্যতম সেরা লেখকের বহুল চর্চিত, তুমুল জনপ্রিয়বিতর্কিত উপন্যাসের থেকেও 'তেলেনাপোতা আবিস্কার' অনেকবেশী তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়।

সে যাই হোক, তেলেনাপোতা আবিস্কারের স্পর্ধা নাই হতে পারে, তবে মিরর ওয়ার্ল্ডের ডিজনি ক্যারেক্টারের সাথে বলডান্স করতে কোনো বাধা থাকে না।

লম্বা চুল, কাঁচের জুতো অথবা তীর-ধনুকের অভাবটা আর যাই হোক অন্তত মিরর ওয়ার্ল্ডে complex খাওয়াতে পারে না এতটুকুও।

এটুকুই তো অবাস্তবতার সান্ত্বনা হয়ে টিকে রয়।

 

অবচেতন

খাদের ধারে দাঁড়ানোর অভ্যেসটা একেবারে চলে যায়নি বলেই হয়তো কোনো এক হেমন্তের পিছু ধাওয়া করতে করতে পাহাড়ে ছুটে যাওয়া যায়।

          একটা খুবই অচেনা রাস্তা ধরে ডাঁয়ে বেঁকে  গিয়ে চেনা পাহাড়টাকে পেলেও, ঝোরাটার অস্তিত্ব টের না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাসটা পাতার সরসরানিতে নিজের কান অবধিই পৌঁছোয় না ।

পাথরের গায়ে জলের দাগ জলে ধুয়ে যায় না !

 

নীচের শ্যাওলা ধরা গভীর কালো গহ্বরটার দিকে তাকালে কেমন যেন সম্মোহিত লাগে।

পশ্চিমের যে রাস্তাটা কোনো নামভুলে যাওয়া গ্রামে গিয়ে মেশে, তার ধারে ধারে ফুল ফুটে থাকে।  ছোট্ট ছোট্ট বুনো ফুলনীল রঙের।

মুঠোয় করে তুলে নেওয়ার নিষেধ না থাকলেও মুঠো ভরানোর চেষ্টা বৃথা।

দূরের ঐ কখনও যেতে না পারা গ্রামটায় তিনটে ছেলেমেয়ে হয়তো আসে কখনও কখনও ফুল তুলতে, দেখা হয় না ওদের সাথে।

মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে খাদের দিকে তাকানোর ভয়টা খাদের একদম ধারে গিয়ে দাঁড়ালে আস্তে আস্তে কেটে যায়। অবাক লাগে!

    আগেরবারের বয়ে আনা চারটে নুড়ি ছিল, শহুরে মাঝরাতে কানের কাছে ধরলে ঝরনার জলের শব্দ খেলা করেবাকি রাতটা ঘুম হয় না আর।

আকাশের কপালে পড়ে থাকা কুঁচো চুল গুলো যখন আবছা করে ফেলে সবটা,

গরম ভাপ ওঠার মতই ধোঁয়া হয়ে যায় চশমার কাঁচগুলো, সামনের রাস্তাটা চোখে পড়ে না আর।

যেটা অবধারিত রূপকথা হতে পারত, সেটা ভ্রমণকাহিনীতে পরিণত করার এ ব্যর্থতাহয়ত চা বাগানের সবুজেই লুকিয়ে ফেলতে হয়...

 

ঘুম...

রাত্তিরে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেলে, দিন রাতের তফাৎটা ঠাহর হয় না। যে কোনোদিন রাতে ঘুম ভাঙলে পায়ে হাওয়াই চটি গলিয়ে ছাদে উঠলে তারা গুলো দেখা যায়।

রাতের অন্ধকারটা সেই ত্যারাব্যাঁকা ঝিকিমিকি গুলোর জন্য আরেকটু স্পষ্ট হয়ে ওঠে বটে, তবু ঘোরটা ঠিক কাটতে চায় না। ঘুমটা আসে না, আবার জাগা চোখদুটোও আচমকা বুজে আসতে চায়...হাওয়ায় চুলগুলো ওড়ে অথচ এলোমেলো খোঁপাটা খুলে যায় না কিছুতেই।

ছাদের দরজাটা ক্যাঁচকোঁচ করলেও ভুতের গল্প তৈরীই হয় না, লেখা তো হয়ই না । শুধু পা টিপে টিপে গিয়ে আলতো ছিটকিনিটা দিয়ে আসতে হয়। নির্ঘুমে থাকা বাবা মাকে জাগাতে ইচ্ছে হয় না।

তারাগুলো কথা বলে না, দিক বোঝালেও ছাদে দাঁড়িয়ে মাঝরাতে আর দিক বুঝতে ভাল্লাগেনা।

শীত করে না, তবুও জ্বর আসে আস্তে আস্তে...ধুম জ্বর...

ঘন্টা কেটে যায়, সূর্য ওঠে, শুধু ভোর হয় না...নীচে নেমে আসতে হয়।

নিঃশব্দে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে আসতে হয় বাড়ি থেকে। গেটের তালাটা খোলাই থাকে সেদিন কোনোভাবে, চাবি লাগে না আর।

রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলে পড়া থেকে রোজ বাড়ি ফেরার চেনা গলিটা হঠাৎ ভোরে কেমন যেন গুলিয়ে যায়, ল্যাম্পপোষ্টের ছায়ার দৈর্ঘ্য মাপতে হয় রাস্তার দূরত্ব জানতে। হাওয়াই চটির স্ট্র্যাপটাও হঠাৎ করেই ছিঁড়ে যায়, ওটার মায়া ওখানেই ত্যাগ করতে হয়। আসলে খোঁড়াতে ইচ্ছে হয় না...এই আর কি!

চায়ের দোকানে উনুন ধরে, আঁচ বাড়ে...চা চাপে...জল ফুটে ফুটে মরে আসে...

পোড়া চা পাতায় বারবার চা হয়, চা টাও রঙ বদলায়...মানুষ তো নয়...তাই চিনি দিয়ে ম্যানেজ হয়ে যায়।

 

হাঁটতে হাঁটতে আবার ফিরতে হয়।

ছেঁড়া হাওয়াইটার একটা পায়েই থাকে…

একপাটি টাই এনে তুলে রাখতে হয় ।

এবার কেমন জানি শীত লাগে,

শুধু....ঐ, ঐযে....ঘুম ভেঙে ওঠা মানুষগুলো....

ওরা তবুও জাগে না...

অঙ্কুশ ভৌমিক, শারদীয়া সংখ্যা

অঙ্কুশ ভৌমিকের গুচ্ছকবিতা

 

পাহাড়ি উপকথা

 

নীলিমার সাথে প্রথম আলাপ আমার পাহাড়ে

খাদের ভেতর থেকে পাহাড়ি কুকুরের আওয়াজে

জেগে উঠেছিলাম দুজন

সবুজ উপত্যকার আগুনে

ঝলসেছিলাম বনমুরগি

ছাপান্নবার চুমু খাওয়ার পর ঘুমিয়ে গেছিল ও

 

আমি তখনও বড় হইনি

 

 

 

ইন্টারভিউ

 

সকাল থেকে পায়ের তলায় একটা কি খচ খচ করছে

ডাবল অ্যাকশান বিদ্যুৎ বাম বিক্রি করে যে লোকটা

সে নজর করেছে

কাছে এসে কানে কানে বলল,

এভাবে আর কতদিন?

 

 

সংসার

 

আস্তে আস্তে বাবার হাতগুলো ছোট হয়ে আসছে

মা প্রতিদিন ব্রেকফাস্টে রুটি বানায়

বাবা বলে, “অন্য কিছু তো করতে পারো

মা রান্নাঘরে গিয়ে ডাল সাঁতলায়

আমি রুটি চিবোতে চিবোতে ভাবি আমার পনির খেতে খুব ভালো লাগে

 

 

ভোট পরবর্তী

 

আমার প্রেমিকা একদিন আমার কোলে মাথা রেখে

আমার কাছে একটা উপহার চেয়েছিল

উপহার কিনতে টাকা লাগে বলে শুনেছি

 

আমাদের যখনই দেখা হয়, ও আমাকে চুমু খায়

মাঝে মাঝে যখন আমরা খুব একান্ত হয়ে যাই

আমি ওর স্তনে হাত দিই

ছিঁড়ে খাই ওকে বুনো হায়নার মতো

কষ্ট হয় ওরচোখ থেকে

ও কিছু বলে না।

ও জানে, একদিন আমি ওকে উপহার দেব

সেলিম মণ্ডল, শারদীয়া সংখ্যা

সেলিম মণ্ডল-এর দুটি কবিতা


বর্ষাকাল

স্মৃতি জলে নামতে চায়।

সে মাছ ধরবে।

ছিপ নিয়ে যত গভীরে যায়

হারিয়ে ফেলে তার বঁড়শি...

শেষে, একটা সোনা ব্যাঙ নিয়ে বাড়ি ফেরে।

বাড়িতে বর্ষাকাল থাকলে জলে নামার অপেক্ষা থাকে না।

 

গলাধঃকরণ


ক্ষত নেই, খাতে ঝুলে থাকে কার বেঁটে পা?
লাল জুতো, সাদা মোজা
শিশুর মতো‍‍‍‍‍‍‍—
 
চুক চুক করে স্তনে মুখ লাগায়!
 
বৃদ্ধ হাঁ
 
পৃথিবী ছিঁড়ে
জগৎ গিলে নেয়

সঞ্চালিকা আচার্য, শারদীয়া সংখ্যা

সঞ্চালিকা আচার্য-এর দুটি কবিতা

 

১। মরাসিম

 

যেদিকে চায়, আমায় টেনে নিয়ে যায় স্খলিত গুমটি।

তুমুল ঝরার দিন অবাধ ছুটে আসে

লম্পট বেড়াল।

ডিজিটাল অমূর্ত ফুলদানির দেওয়াল ঝংকারহীন সরু করে মন

শঙ্খসূতার মতো। নপুংসক আক্ষেপে।

মেঝের ময়লা তুলে তুলে হ্রদ ভরে নেয়, নিঝুম চৌকাঠ

পেটে অবুঝ লেখনী নিয়ে দগ্ধ মাংস প্রগাঢ় জলসায়।

বাগানের মধ্যিখানে বিষবাষ্প ছিল, গ্যাসীয় পরিণাম। আর্দ্র রাত্রি চাঁদকে পায়নি কখনও, শুধু নিউজপ্রিন্ট ছয়লাপ করেছিল কেচ্ছা। ঠুনকো তাও। মানুষের হাত সরে যায় রিয়েল এস্টেট এবং আপনার আজকের দিনে।

 

 গোলাপ শুকিয়ে গেলেও কাঁটার নৈমিত্তিক আঁচড় মনে করায় পুরনো কালভার্ট। পিয়ামুখচন্দা।

আর তুমি! বিবাহের আগুন থেকে নির্বিকল্প উঠে এলে। কতটা মদির হিল্লোল পেলে

বিনষ্ট অনুরাগে

জলের দুহিতা

আঁকতে পারে নক্ষত্র-মহিমা অপাংক্তেয় কবিতার দেহে?

 

২। নকল আগুন, নকল শিখা

 

এবং অধিকতর নকল আমাদের সমস্ত ফেটে পড়ার পৌনঃপুনিক ন্যারেটিভ। অথচ ভেবেছিলাম জানি আমরা কোথায় চলেছি। সামনে ছিল কৌলিক ডানার দাগ, অরকা তিমির এটিকেট আয়ত্তে। বেয়ারা বৈঠা তবু আমাদের পশ্চিমে নিয়ে এলো। এই যে নিভে যাচ্ছে জ্যোতি একে একে, বাতিঘর নিশান হারিয়ে ফেলার পর সংস্থান শুধু দেহের নীলাভ উল্কি। যে গল্প মুদ্রিত হয়ে আছে ওই রেখায়, আমাদের কথামালা শোনায় মুখোমুখি বসে

 

শোঁ শোঁ রাত্রিবেলা। শেষের প্রতিটি লহরে নতুন পঙক্তি লেখা হয়। অন্তরীপের গায়ে অচিরেই ঊর্মিভঙ্গের মতো নির্বাপিত হবো। তারপর সহজ শরীরে ঘরের দিকে ফেরা।

 

তখন অনেক দূরে করতোয়ার স্রোতবিথারে পাগলি অতসীর পায়ের কাছে বসে 

তোমারও ঠিক মনে পড়ে যাবে অভাবী দিনগুলো, আর আমাদের গানের গলা।