লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Tuesday, July 13, 2021

প্রসাদ সিং, ১৬

                     প্রসাদ সিং-এর কবিতা

 

অর্ন্তদহন ২ ॥

                             

ঠুঁটো হাতে ছারপোকা ছেড়ে দিয়েছে রাষ্ট্র

ধীরে ধীরে বেদনার সাথে পাতাই বন্ধুত্ব

রাষ্ট্রীয় অন্ধকার চোখ সয়ে যায় বন্য উদযাপনে

বিবর্তনবাদ পড়ছি ছাদ চুঁইয়ে পড়া জলের শব্দে

 

যন্ত্রণা ও বিষণ্নতার মাঝামাঝি বসে আছি 

হলুদ রোদের অপেক্ষায় কাবার হচ্ছে রাত

রাষ্ট্রীয় দূষণে আরো কালো মেঘে ঢাকছে সকাল

নীরবতা লুকিয়ে আছে হলুদ পাতার আড়ালে

 

পাতা মাড়িয়ে, মৃতদেহ মাড়িয়ে রাষ্ট্র এগিয়ে চলে

সহমর্মীদের শোকযাপনে অনুভূতি বিক্রি করছি

মাটি কামড়ে মেটো দাঁতে চুমু দেয় না প্রেমিকা

মুখে মাটি মেখে রাষ্ট্র রূপ নিচ্ছে নদীমাতৃক

 

লেলিহানতায় আগুনের নৃশংসতা মাপা চলছে

ছাইলিপিদের স্থান নেই জীবন্ত সিলেবাসে

হ্যাঁ, আমি ছাই ঘেঁটে দেখার জন্য বসে আছি

অর্ন্তদহনে ঢেলে দেব সভ্যতার ধূসর গোধূলি

মহ. শামীম আফরোজ, ১৬

মহ. শামীম আফরোজ-এর কবিতা

 

লড়াই

 

রোজকার চেনা আমি-র খোলকের আড়ালে

আর একটা যমজের বাসাবাড়ি!

 

রোদ-জল-বৃষ্টিতে মেলে ধরি বাইরেরটাকে,

পালাবদলের খেলায় আঘাতের মিউজিক্যাল

বলটা যখন আমার হাতে এসে থামে

বাইরেরটাকেই এগিয়ে দিই!

সাধ আর সাধ্যের মাঝে সমঝোতা,

পাতলা হয়ে যাওয়া চটিতে নতুন ফিতে,

ছেঁড়া কলারে লেগে থাকা সার্ফের গন্ধ,

ভিড়ের মাঝে ঘামে ভেজা জামা,

সাদা ভাত, সাদা যাপন― এসব দলিলনামা একান্তই তার!

 

স্বপ্নরঙে কাল মিশিয়ে যায় ভিতরের জন,

তারও গুটি কেটে বেরিয়ে আসার লড়াই,

লড়াই― বাইরের আমি-টাকে মুক্তি দিয়ে

পছন্দের নামের পরিচয়পত্র বানানোর!

Saturday, May 15, 2021

অর্ঘ্য কমল পাত্র, ছায়ারোদ ১৫

অর্ঘ্য কমল পাত্রের কবিতা

 

লজ্জা

 

শরীর তো ভাঙা পাড়

শিহরণঅনুভূতি। বেঁধে রাখা

                 পুরোনো নৌকা

 

ছুঁয়ে দিলে কেঁপে যায়।

টলমলে পিছুটান!

জল নড়ে। গুটি গুটি পা পা

 

***

 

বন্দুক

 

বাঁশিকে বন্ধু ভেবে

সুরজন্ম চেয়ে

            একটা রাইফেল

কতই না পড়েছে বিপাকে!

 

ট্রিগারে হাত পড়ে

আততায়ী চিৎকারে

লজ্জিত বন্দুক পিছু হটায়

 

       উদ্ধত কাঁধটাকে

 

 

***

 

প্রচ্ছদ

 

আকাশ যে বিবাহিত

তাকে প্রেমিকা বলতে নেই...

 

এই শোকে স্থির তালগাছ

দাঁড়িয়ে থাকে। মেনে নেয়

               বাজ পড়াটাকেই

 

*****

 

বেণীমাধব শীল

 

চরাচর জুড়ে শুধু ঝাউগাছ।

এখনো নোনা মাটি। বরাবরই

                    চিলেকোঠায় ঢেউ উঠে আসে...   

 

তবু রোদ আসে। তবু জং পড়ে শ্লেষ।

আমাদের, সে না হওয়া বিবাহে

  তরুণ পেরেক পোঁতা আছে

শুভ্রনীল চক্রবর্তী, ছায়ারোদ ১৫

শুভ্রনীল চক্রবর্তীর কবিতা

 

তুমি টের পাওনা

 

মৃত ঠোঁট কথা বললে

      পালকের ওম জেগে ওঠে

পাইনের খাজে লেগে থাকে স্বপ্ন

      পাহারের ভার তীর্যক পথে

তুমি টের পাওনা

কখন বরফ হয়ে যাই স্নানের জলে

 

নাভিপদ্মের আলিঙ্গনে

         স্রোত মিশে যায় বিমোহনে

শেষ দ্রাঘিমায় দাঁড়িয়ে

       কোনো না ফেরা নাবিক

তুমি টের পাওনা

কখন তারা হয়ে যায় সূর্যের অন্তরালে

 

রক্ত ট্রোল হচ্ছে

 

একটার পর একটা রক্ত রোল উঠছে

        অনিচ্ছায় মিশে যাচ্ছে চাকার পাতে

গুটিকয়েক অন্ধকার, ভন্ড আলো সেজে

   পথ দেখাচ্ছে --> সোনার মুকুট --> খলনায়ক

 

রক্তের রোল উঠছে তোমার জলের গ্লাসে

     তবু শ্বাস বায়ু বিক্রি হচ্ছে রাষ্ট্রের দেওয়ালে

        তুমি কিনে নিচ্ছ, মেনে নিচ্ছ সব

           ভালো থাকার অজুহাতে(?)

 

একটার পর একটা রক্তের রোল উঠছে

    রাজার চাকা মেতে উঠছে

        ভগবান হওয়ার খেলায়

 

নৈঃশব্দ্যের কোনো লোভ হয় না

 

নির্লোভ জিহ্বে লেগে থাকে আলগোছে

ঝড়ের আশ্রয়ে ভেঙে পড়ে শিকার

তুমি জানো না কত দেহ মিশে গেলে মাটিতে

অমাবস্যা মেখে নেয় চাঁদের অন্ধকার।

 

শিথিলতা পরিমিত জরায়ুর মন্থনে

হেসে যায় অলিখিত আদর

তুমি জানো না কতটা শক্ত হতে পারলে

মাতৃ দুগ্ধে মেশে সন্তানের কবর।

 

নৈঃশব্দের কাঠ ভোরে আজানের শব্দ মাখে বাতাস

স্মৃতি যত ঝির ঝিরে বৃষ্টির

তুমি জানো না কত রাত না খেলে

শৈশব জলাঞ্জলি দেয় কয়লার হাত।

 

নিষিক্ত পরিবেশের অবগাহন হ্রদে

নিশ্বাস গোনে শেষ হৃদস্পন্দন

তুমি জানো না কত নক্ষত্র মরলে পড়ে

সূর্য মেখে নেয় শেষ রক্ত চন্দন।

সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়, ছায়ারোদ ১৫

সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা

 

সুষুপ্তির জেব্রা ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে

 

১.

ভেবেছো তুমি বাঁচবে তাকে ছাড়া

ছিনিয়ে নেবে প্রতিশোধের দায়

দু'চার আনা ডাকনামের পাড়া

নকশা কাটে জবাবী ঘেন্নায়

 

ভেতরঘরে নজরবন্দিনী

পিদিম জ্বালে বিলিতি সংবাদ

নিজের লেখা যুদ্ধে কোনো দিনই

থাকে না চিৎকারের ইরশাদ

 

অঙ্কহীন ঘুমোও তাকে ছাড়া

আততায়ীর স্বপ্নচিন্তায়

ডাকনামের ছেঁড়া পলেস্তারা

বহন করে ছেড়ে আসার দায়....

 

 

২.

ঝিলের ধারে অঘোর কানাগলি

মোমবাতির বয়স ধরা পড়ে

রাতবধির শরীরে মেনে চলি

তোমার ছায়া, অনুকরণ জ্বরে

 

অরণ্যকে মাথুর ভাবো তুমি

ক্ষরণ শুধু শিরার ডানপাশে

নকল ব্যথা ছেঁড়ার মালভূমি

বেসিন খোঁজে শুকনো ঝুমচাষে

 

খেলিয়ে তোলা মনের জলছবি

চেনা আঁশের আঙুল ছুঁয়ে মরে

সমবয়সী যন্ত্রণার কবি

তোমায় ডাকে অনুকরণ জ্বরে...

 

 

৩.

খেলা এখন পরম রমণীয়

আমায় তুমি সম্পাদনা করো

ভ্যান গঘের চিঠি পেলেন থিও

স্ট্রোকের ভাঁজে ঋতুর মর্মরও

 

এলো তোমার দক্ষিণের ছাদে

এইসময় দুপুর পাশবিক

দেয়ালঘড়ি বেতারে বসে কাঁদে

উন্মাদনা তবুও নির্ভিক

 

মরা রোদের চামড়া তুলে ধরো

আকাশভরা রাতের ধমনীও,

জট পাকালে সম্পাদনা করো

যেহেতু খেলা এখনও রমণীয়...

সন্দীপন দাস, ছায়ারোদ ১৫

সন্দীপন দাসের চারটি কবিতা

 

১. আলো


কয়েকটা মানুষ জটলা করছে এ রাতে আগুনের সাথে

আগুনের খুব অভিমান...

অভিমান অদূরে পড়ে থাকা রক্তাক্ত সন্ধেমণি ফুল,

ছেঁড়া বর্ণপরিচয়ের পাতা, ভিনদেশী অন্ধকারেরও...

#

ঈশ্বর মাটির হয় বুঝি?

পরিযায়ী চোখও কখনো কখনো ভাষা...

#

কয়েকটা মানুষ জটলা করছে শূন্যতার সাথে

চোখে অশান্ত স্বপ্ন বুনে...

স্বপ্নের খুব অভিমান

অভিমান কাছে পড়ে থাকা মাটির ঈশ্বরের, পরিযায়ী চোখের জলেরও...

#

আলো কখনও কখনও বিজয় অভিলাষী হয় বুঝি?

 

২. জেনেসিস

 

একটা তারা খসে গ্যালো তোমার যোনি থেকে

আবারও ক্লোরোফিলের আঁশটে গন্ধ... আরেকটা নিদ্রাহীন রাত...

শরীর ভর্তি সেই অন্ধকার নিয়ে বর্ষার ছাদে

মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছো  তুমি

তোমার পেছনে মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, পাবলো পিকাসো

#

তারও পেছনে ঈশ্বর...

 

 

 

 

৩. ঘুঙুর

 

স্বাভা বিক উদ্ভিদের মতো বেড়ে উঠছি আমি

মে মেয়েটি সুন্দর পরিচর্যায় ডালপালা ছেঁটে বড়ো হচ্ছে

সে বোধহয় জানে আদিম দেবতার গোপন আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখা ঈর্ষার হাজারো কারণ...

অবলীলায় সে ছুঁয়ে দিতে পারে জলের ব্যথা,প্রতিটি ভোরের একাকীত্ব, ঈর্ষাতুর মেঘের দলও...

 

আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখি...

দেখি মেয়েটির শরীর ঘিরে সূর্য ওঠে

জলের ব্যথার সাথে মিশে যাচ্ছে মেয়েটির সাতজন্ম আর আমার একজন্ম...

হে ঠাকুর, সমস্ত অহংবোধ কি আজ তবে শামুকজন্ম?

জলের মতো শুদ্ধ হবো...

আমি পিছন ফিরি,অল্প আলোতে খুঁজতে থাকি অন্য আকাশ,অন্য কোনো গাছের শরীর...

 

৪. দ্য ব্লু প্যালেস

 

অনেকদিন হলো কোনো গল্প শোনাতে গিয়ে কেঁদে ওঠোনি তুমি

আর আমারও মুক্তি ঘটেনি

দেখেছি আমার চারপাশের অন্ধকার ফুঁড়ে উঠে এসেছে এক প্রেমের কাহিনী

যেখানে শূন্যতা প্রেমিক, প্রেমিকা তুমি...

অনেকবার ব্রেক-আপ হয়েছে তোমাদের, তারপর আবার মাটির টানে,

চোখ উপড়ে নেওয়া চেনা কোনো তূণের টানে ফিরে এসছো তুমি

তোমার এই বারবার ফিরে আসাটা মেনে নিতে পারেনি

নদী, জঙ্গল, মনখারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিডও...

এমনকি মনকেমনের মেঘ দু'হাতে হাওয়ায় ওড়াতে ওড়াতে

সাহারা ক্রস করে গ্যাছেন ডিরেক্টর

সূর্য অস্ত গ্যাছে,আবার একরাশ অন্ধকার গ্রাস করেছে আমায়

আমি আর সহ্য করতে পারিনি... শহর ঘুমোলে চুপিচুপি উঠে গ্যাছি

সারাগায়ে অন্ধকার নিয়ে

তুমি আলো হয়ে আসবে বলে...

#

কতদিন কোনো ভাঙ্গা ইমারতের গল্প শোনাতে গিয়ে

কেঁদে ওঠোনি তুমি

আর...

মনোতোষ বৈরাগী, ছায়ারোদ ১৫

মনোতোষ বৈরাগীর দুটি কবিতা


তারে আমি চোখে দেখিনি

 

হঠাৎই একটি মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছি

 

শীতের দুপুরে

আমার দু'একটি দুশ্চিন্তার পাকা চুল দেখে মা বলেছিল, 'বাড়ির জ্যোৎস্না কাকিমা তোর জন্য সম্বন্ধ এনেছেন

 

বয়স পনেরো-ষোলো মোটে। ভিনদেশি। টুকটুকে ফর্সা গড়ন

                                 মা নেই

                               বাবাও নেই...

 

এটুকু শুনেই

হঠাৎই একটি মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছি

 

তেজপাতাকে ভালোবেসে

 

যখন ফিরছি

একটা তেজপাতা গাছ আমাকে দেখে হাসছিল,

                        ক্ষুরধার হাসি

 

সেই কোন কালে

ভ্রমর আসার আগেই সজনে ফুল ঝরে গেছে

তারপর থেকে শ্বেত জবার সাথে

                       শ্বেত গোলাপের সাথে কাটাকুটি

 

এসব ভাবতে ভাবতেই সেই তেজপাতা গাছটিকে ভালোবেসে ফেলি

যার একটি পাতা

অন্তত আমার পায়েসান্নকে পরমান্ন করেছে

শুভদীপ আইচ, ছায়ারোদ ১৫

শুভদীপ আইচের দুটি কবিতা


হত্যাকান্ড  একটি রাত

 

খোয়া বিছানো পথে উদ্ভূত বাকি লঘু-গুরু

দিনের কাছে ভেজে উঠছে শৃঙ্খল

গলিত আত্মার অবধারিত প্রেম

ঘুরিয়ে মেঘ সমন্বয়

মুগ্ধ বিচারে

 

বিকেল থেকে ছুটিয়ে মাখি আলো

বিকলাঙ্গের কাছে বাধা পড়ছে সময়

লোলুপ এক ভেক ধরা ম্যাজিশিয়ান

ছুঁয়ে দিলে এখনো কেঁপে ওঠে জমকালো

 

এদিকে

 

নতুন কিছু অবগাহনের ফাঁকে

বিরক্তি ছিটিয়ে নিচ্ছে সন্দেহ

সরু ও চিকন যা কিছু অবশেষ

সূর্যাস্তের ঘরে বুদবুদ বাড়ালো

 

 

উৎসারিত নীলের ঘামে ঘনিয়ে উঠছে গরল

গোলাপ থেকে গড়িয়ে নামছে মোটিফ

খুন থেকে দূরে দাঁড়িয়ে শুধু

পৃথিবীর কাছে ক্ষমা চাইছ তুমি

 

ভ্রমণ

 

বোয়ালদার থেকে হেঁটে আসি বালুরঘাট পর্যন্ত

শঙ্খ-ধ্বনি ভেসে আসে বাতাসে

উঠোন পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল যে সব কলমীলতা

তারা ক্রমশঃ লুকোচুরি খেলছে নিজেদের সাথে

হাঁসেরা এগিয়ে আসছে জল থেকে ডাঙ্গায়

কখনো ডাঙ্গা থেকে জলে

মাথা মুড়িয়ে ডুব দিচ্ছে জলে

হাঁসেদের কলকলের সাথে তোমার গমগম মিলিয়ে যাচ্ছে...

 

কতবার বলেছি রাস্তায় বেরলে এমন কলকল করতে নেই!

মন্দ মানুষের নজরে পড়ে যায়

অথবা যেমন তেমন পুরুষও মন্দ হয়ে যেতে পারে।

মুখে যতই বুলি কপচাই

এই ক্ষুধার্ত জঙ্গলে তোমার কি খুব প্রয়োজন হরিণী সাজার?

Wednesday, January 20, 2021

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৪

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প

ফেরা


মণিবাবুর গাড়িতে জায়গা না পেলে আজ আর ফেরা হত না আমার। সিনেমা লাইনে কাজ করি, রোজ রাত হবারই কথা। কিন্তু এত রাত হয় না কখনও। এমনিতেই কলকাতার পরিস্থিতি এখন খুব একটা ভালো নয়। ধরপাকড় আর গুমখুনে ছেয়ে গেছে শহরটা। তার উপর আমি খোঁড়া মানুষ বলে স্টুডিও থেকে সন্ধেরাতেই ছাড়া পাই। তবে আজ তা হবার জো ছিল না। প্রোডিউসার আগরওয়াল-এর সাথে আমাদের ডিরেক্টর রমেনবাবু'র ঝামেলা চলছিল অনেকদিনই। আজ তো সন্ধেবেলা সেটের মধ্যেই ধুন্ধুমার বেঁধে গেল। অবিশ্যি তারপর ঝামেলা মিটে ও গেছে, কিন্তু ওই প্যাক আপ হতে হতে এগারোটা বেজে গেল। সুযোগ বুঝে কাটতেও পারলুম না আর।

শেষে উদ্ধার করলেন মণিবাবু। তিনি বর্ষীয়ান অভিনেতা, এই লাইনে আছেন সেই বড়ুয়াবাবুর সময় থেকে, গাড়িতে ওঠার সময়ে আমায় ডেকে নিলেন রাশভারী মানুষটি। মণিবাবু যাবেন লবণ হ্রদের দিকে। ওদিকে এখন বাড়ি তৈরির ঝোঁক তৈরি হচ্ছে। শুনেছি জমিজমাও সস্তা। আবার আমি ফিরব আর্মহারস্ট স্ট্রিট। তাই অনেকটা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শ্রীমানি বাজারের মুখে নেমে যখন হাতঘড়ি দেখি, তখন রাত বারোটা বেজে দশ।

উত্তর কলকাতার ব্যস্ত সমস্ত বড় রাস্তা এখন শুনশান। নভেম্বরের শেষ, শীত টাও বেশ জম্পেশ পড়েছে। তাই অলিগলি সব দরজা জানলা এঁটে গভীর ঘুমে মগ্ন। দূরে দূরে পুলিশের সাইরেন ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। আজকাল দেখছি টহল পুলিশের ভয়ে দেহাতি ঝাঁকা মুটে ওয়ালারাও রাত হলে বেমালুম উধাও হয়ে যায়। অদ্ভুত এক অবিশ্বাসের দমবন্ধ পরিবেশে আটকা পড়েছে মহানগর। এই নিস্তব্ধ আর আতঙ্কিত শহরটায় যেন এখন একা আমিই জেগে! আগেই বলেছি, জোরে পা চালানোর উপায় আমার নেই, খোঁড়া মানুষ। তাও লাঠিতে ভর করে যতটা পারা যায় তাড়াতাড়ি হাঁটি।

চারমাথা'র মোড় পেরিয়ে অর্মহারস্ট স্ট্রিটের রাস্তায় ঢুকতে যাব, দেখি কালো শাল ঢাকা একটি ছায়ামূর্তি হাতিবাগান এর দিক থেকে এসে আমার বাড়ির রাস্তায় ঢুকল। মূর্তিটি এক যুবকের। কালো শালের নীচ থেকে আদ্দির পাঞ্জাবি আর ঢোলা পায়জামা দেখা যাচ্ছে। খুব ধীরে, যেন পায়ের আওয়াজ না পড়ে, সেভাবেই মিহি ধোঁয়াটে কুয়াশায় হেঁটে যাচ্ছে যুবকটি। তার গড়ন, তার হাঁটার ধরন আমার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। একবার মুখ ঘুরিয়ে ছিল সেই ছায়ামূর্তি। আধো আলো, আধো অন্ধকারে, কুয়াশার ভিতর সেই মুখ দেখে দমবন্ধ হয়ে এসেছে আমার। সুবল! ঝাঁকড়া চুল, চাপদাড়ি, আর সেই জ্বলন্ত একজোড়া চোখ। কোনও ভুল নেই। এগিয়ে যাচ্ছে সুবল। চার এর পল্লী গলির মুখে ফুল আর ধূপ কাঠির প্যাকেট পেরিয়ে অবলীলায় গলির ভিতর মিলিয়ে গেল আটমাস আগে এনকাউন্টারে মৃত সুবল!

আমি তখন ঘামছি, সুবলের মুখে যাকে দেখলাম সে আমার বাড়ির গলিতে, আমারই বাড়িতে ঢুকেছে। ভাবলেই আমার গা ভারী হয়ে আসছে! কীভাবে যে পা চালিয়ে বাড়ির গেটে এসেছি, তা আমি জানি না। তবে গেটের মুখে শোভাদিকে দেখে ধড়ে প্রাণ এল আমার। শোভাদি অপ্রকৃতিস্থ। সাত-আট মাস আগে ছোট ছেলে সুবলের মৃত্যু সংবাদের পর থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন। রোজই রাত করে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমি ফেরার পথে হেসে কথা বলি। পরে সুবলের দাদা বৌদি বুঝিয়ে সুঝিয়ে দোতলায় নিয়ে যায়। আজ তাকে দেখেই যেন আশ্রয় পেলাম আমি। আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে সেই বিধবা বললেন, "এই ফিরছ? অনেক রাত হয়ে গেল আজ। দ্যাখো কাণ্ড! সুবলটা এখনও এল না!"

আমি কোনোমতে মাথা নাড়ি। এই শোকে বিহ্বল মাকে কি তাঁর আত্মজর অতৃপ্ত আত্মার আভাস দেওয়া যায়! সুবলের দাদাকে খবর দেব ভাবতে ভাবতে কালো দরজার গেট খুলে উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় এলাম। শিখা আলো জ্বেলে জল এনে দিল। বললাম, "বিমলের বৌকে খবর দাও তো"।

শিখা বলল, "এত রাতে ওদের ডেকে কাজ নেই। আজ দুপুরে শোভাদি মারা গেছেন"। আমার হাত থেকে জলের মগটা পড়ে গেল! টলে পড়ে যাবার আগের মুহূর্তে শিখার গলা পেলাম, "ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক, সময় দেয়নি! একটু আগে নিমতলা থেকে ফিরল সব!"

 

পুনশ্চ: বাহাত্তর সালের সেই শীতের রাতে বাঁচার তাগিদে ভুয়ো মৃত্যু সংবাদ ছড়ানোর পরেও, কোনোভাবে খবর পেয়ে মাকে শেষ দেখা দেখতে সত্যিই লুকিয়ে এসেছিল নকশাল নেতা সুবল। কিন্তু না, মায়ের সাথে সুবলা'র আর দেখা হয়নি।