অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প
রেলগেট
তালাটা
খুলছে না। অল্প ঘুরে ঘুরে বারবার আটকে যাচ্ছে চাবি। সামান্য হোঁচট খেয়ে তালা খুলে যাওয়ার
স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে না আজ। অস্থির হাতে রিঙে বাঁধা দ্বিতীয় চাবিটা দিয়ে চেষ্টা করল
ছেলেটা। কিন্তু খুলছে না। খুলছে না কারণ আজ মন দিচ্ছে না সে। মালিকের থেকে চাবি এনে
রোজ তালা খুলে দোকান পরিষ্কার করে সে। আজ ভোর থেকে মেঘলা, রাস্তাঘাট ভেজা, আকাশটা ফোঁপাচ্ছে।
টিপটিপে বৃষ্টি মাথায় ঠিক সময়ে চাবি এনেছে ছেলেটা। কিন্তু, তালা খুলতে বারবার পিছনে
তাকাচ্ছে সে।
দোকানের
রক থেকে নেমে চওড়া রাস্তাটার ওধারে রিকশাস্ট্যান্ড। এই বাদলার সকালে স্ট্যান্ড প্রায়
ফাঁকা। স্ট্যান্ডের গা লাগোয়া পাঁচটা লোহার বিম দেওয়া ব্যারিকেড। রেলগেট। সিগন্যালের
ব্যবস্থা নেই, তবু লোকমুখে প্রচারিত এটাই রেলগেট। এধার দিয়ে ওধারের রেলগেট, রেললাইন,
ট্রেনের যাতায়াত স্পষ্ট দেখা যায়। সেদিকে ছেলেটার চোখ চলে যাচ্ছে বারবার।
আজ
একটু অন্যরকম দিন। এমন সাতসকালেও রেলগেটে একটা বড় জটলা। লোহার বিমগুলো মানুষের ভিড়ে
ঢেকে গেছে। ভিড়টা বাড়ছে। এতক্ষণ সামনে থাকা কেউ কেউ নাকে মুখে রুমাল চাপা দিয়ে ভিড়
ঠেলে বেরিয়ে আসছে। পিছনের সারিতে থাকা কৌতূহলী চোখগুলি সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটার
মন পড়ে আছে ওদিকে। একবার ভাবল চাবির রিং পকেটে ঢুকিয়ে দেখে আসবে। কিন্তু, সাহসে কুলিয়ে
উঠতে না পেরে তালা-চাবিতে মন দিল সে।
**********************
ইরাবতী-
এই
মুহূর্তে প্রত্যেকে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এমনকি যারা আমায় দেখছে না, আমি টের পাচ্ছি,
তারাও ঠারেঠোরে আমাকেই দেখছে। এই ঘটনার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। অথচ, সবাই ভাবছে,
আমি প্রস্তুত ছিলাম। যাঁদের সাথে একই সারিতে দাঁড়িয়ে রয়েছি, তাঁদের কাউকে আমি চিনি
না। তাঁরা কেউ আমায় চেনেন না। অথচ, আমার গা-হাত-পা-মাথা ছাড়িয়ে উঠছে তাঁদের প্রায় সমবেত
ফিসফাস ধ্বনি। প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে। চোখ তুলে সামনে তাকানোর ক্ষমতা হারিয়েছি কতক্ষণ
জানি না। শুধু মনে আছে, অনেকক্ষণ আগে চোখ তুলতে গিয়ে সামনে দেখেছিলাম সৌম্য’র দাদাকে।
ঘেন্না আর বিরক্তি মাখানো দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম আরও!
এই
অচেনা ভিড়ের মধ্যে, প্রচ্ছন্ন দোষারোপের বিষ হাওয়ার মধ্যে, এখনও আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি
কেন? সৌম্য’র জন্য। ওকে একবার দেখতে চাই। ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম অনেক বছর আগে। ক্যাম্পাসে।
কিংবা, ঠিক যেমনভাবে দেখা হয়েছিল একবছর আগে, এমনই ফেব্রুয়ারির বৃষ্টি ভেজা সকালে, এই
রেলগেটে।
প্রথম
দেখার দিনটা আজও, এই অদ্ভুত মুহূর্তেও মনে করতে পারি আমি।
তখন
আমি ফার্স্ট ইয়ারে। বর্ষার সন্ধে ছিল সেদিন। একঘেয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মাঠে বসার প্ল্যান
ভেস্তে যাওয়ায় ক্যাম্পাস থেকে বেরবো ঠিক করেছিলাম। অপালার সাথে একই পিজিতে ফিরব।
দু’জনে কোনওরকমে মাথা বাঁচিয়ে পা চালাতে গিয়ে মুহূর্তে থমকে গিয়েছিলাম। দু’নম্বর গেট
দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকল একটা অবয়ব। নেভি ব্লু টিশার্টের কাঁধ ভিজছে তার, কোঁকড়ানো চুলের
উপর বিন্দু বিন্দু কাচের গুঁড়ো জল। জিনসের পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বের করে ঘাড়ে,
কপালের জল মুছে নিল। তারপর চশমার কাচ মুছতে মুছতে এগিয়ে এল সৌম্যদা। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ
বিল্ডিং-এর সামনে জোরালো হলুদ আলোয় তাকে দেখে নিজের অজান্তেই শিহরিত হয়েছিলাম আমি।
“তুই
হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের না? উমম, ইলা, রাইট?”
“ইরাবতী”।
গ্রীবা উঁচু করে স্মিত হেসে ভুল শুধরে দিলাম।
“সরি,
সরি, ইরা। তা বেরিয়ে যাচ্ছিস না কি?” বলে গেটের দিকে অঙ্গুষ্ঠ নির্দেশ করেছিল সৌম্যদা। সেই মুহূর্তে আমি দেখেছিলাম, সৌম্যদা’র চলন, বলন, এমনকি আমার বাঁ দিকে একনম্বর
গেটের দিকে অঙ্গুষ্ঠ নির্দেশের কায়দাটুকু পর্যন্ত কী এক নিয়মিত অনুশীলনে নিখুঁত হয়ে
গিয়েছে। যেন এই সবটা শুধু সৌম্যদা’কেই মানায়।
হৃদয়ের
কিছু নির্দিষ্ট খেলা থাকে, সেসব খেলার কিছু নিয়ম ও থাকে। ওই কাঁচা বয়সে কিছু বাঁধাধরা
নিয়ম জানতাম আমি। কী এক অজ্ঞাত কণ্ঠস্বর আমায় বলে দিয়েছিল, এ খেলায় প্রথমেই সংযত হতে
হয় বেশি। উজাড় করার সময় মিলবে অনেক। তাই, আমার সামনে দাঁড়ানো দোহারা শ্যামলা ছেলেটার
সাথে আরও একটু কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও হাসি ছড়িয়ে মাপা উত্তর দিয়েছিলাম, “হ্যাঁ এবার
ফিরব”।
“বেশ
তবে পরে আসিস, আড্ডা হবে”। পাল্টা হাসি ছুঁড়ে তড়িঘড়ি এগিয়ে গিয়েছিল সৌম্যদা।
মনে
আছে, সে চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত সেদিন অরবিন্দ ভবনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে
ভিজেছিলাম আমি।
পরে
মনে পড়েছিল, আমার পাশে অপালাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞাও যেন শুধু সৌম্যদা’কেই মানায়।
একটা
বছর আগে এমনই এক সকালে সৌম্যদা’র সাথে আবার দেখা হয়ে গিয়েছিল। কথা বলতে চাইনি। কিন্তু
রেলগেটে প্রায় মুখোমুখি দেখা! অভদ্র হই কী করে? সৌম্য দা একইরকম আছে। মাপা কৌতুকী চাহনি,
মাপা উচ্ছ্বাস (সেটা এক অদ্ভুত অনুশীলনের বিষয় বটে! আমি ক্যাম্পাস জীবনের বছরগুলিতে
চেষ্টা করেও শিখে উঠতে পারিনি), রাস্তায় অঙ্গুষ্ঠ নির্দেশ করে হালকা হাসি, সবটা আবার
বৃষ্টির সন্ধে মনে করিয়েছিল। মাঝখানের পাঁচটা বছরের অভিমান, ক্ষোভ সব এক নিমেষে উড়ে
গিয়েছিল।
অভিমানের
কারণ ছিল। সৌম্যদা’কে নিজের করে পাওয়ার কিছু বাধা ছিল। প্রথম বর্ষার সন্ধে থেকে আমাদের
বন্ধুত্ব যত এগিয়েছিল ততই সেইসব বাধা আমায় বোবা করে রেখেছিল। সৌম্যদা’র প্রেমিকাকে
দেখেছিলাম ক্যাম্পাসে। তাদের উত্তাল প্রেম জীবন দেখেছি। আস্তে আস্তে সেই বিশাল খ্যাতিমান
জুটির সম্পর্ক শেষ হতেও দেখেছি। সৌম্যদা’র মতন অমন বলিষ্ঠ মনোভাবের ছাত্রনেতাকে দেখেছি
প্রবলভাবে ভেঙে পড়তে। ততদিনে আমারও খুচরো প্রেম ভেঙেছে। সৌম্যদা’কে সঙ্গ দিয়েছি। শেষে
একটা সময় যখন ভাবতে শুরু করেছি সময় আছে, উজাড় করার সময় আছে, তখনই আরও এক ফেব্রুয়ারির
সন্ধেয় নীলার কথা বলেছিল সৌম্যদা।
তখন
ইউনিভার্সিটির পাট চুকিয়ে এসএসসি-র প্রস্তুতি নিচ্ছি আমি। সৌম্যদা একটা মিডিয়া হাউসে
ঢুকেছে। ফেরার সময়ে প্রায়ই আমায় ডেকে নেয়, একটু বেশি রাতের দিকে চা খেতে যাই এইট বি
বাসস্ট্যান্ডের দিকে। আড্ডা হয়। নিখাদ বন্ধুত্বের আড্ডা। কারণ, সৌম্যদা কোনও আভাস
দেয়নি। আর আমি জানতাম সময় আছে। সেরকম এক আড্ডায় নীলা নামটা প্রথম শুনেছিলাম আমি। এমন
কত নাম শুনতাম। কিন্তু সেদিন সৌম্যদা’র চোখে এক অদ্ভুত আলো দেখেছিলাম। নীলা’র নামে
ওই চশমা ঢাকা চোখ দুটোয় শুধু প্রেম ছিল না। ছিল স্নেহ, টান, নামটা উচ্চারণের সময়ে ঈষৎ
লাজুক হাসিতে ছিল আগলানোর ভঙ্গিমা। আমি দেখেছিলাম ডাকসাইটে ছাত্রনেতার কোনও ভঙ্গিমাতেই
নেই কোনও অনুশীলনের ছাপ! হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম! হাতের চা শুদ্ধু মাটির ভাঁড়টা ভেঙে যেতে
যেতে বেঁচে গিয়েছিল। আমার মাথায় বিঁধে গিয়েছিল একটা নাম। নীলা!
নীলা
নামের মেয়েটা এখন আমার থেকে একটু দূরে, রেলের দুটো সমান্তরাল রেখার মধ্যে দু’টুকরো
হয়ে শুয়ে।
আমি
সৌম্য’কে খুঁজে পাচ্ছি না।
সৌম্য
পালকের
মতো হালকা লাগছিল নিজেকে। গতকাল রাত তখন সাড়ে এগারোটা হবে, বোধহয় একটা গানও গাইছিলাম।
ঠিক গান নয়। একটা সুর।
কবরখানার
রাস্তাটা থেকে বাঁয়ে ঢুকলেই আমার যে ঘর, তিন তলায়, ফ্ল্যাট নং 3B, তার দরজায় একটা কাঠের
নেমপ্লেট বসানো আছে। সেখানে লেখা, সৌম্য রায় – নীলা রায় চট্টোপাধ্যায়। আর সবার উপরে
লেখা ছোট্ট একটা শব্দ। “ঘর”। আপাত নিরীহ একটা শব্দ, অথচ কী গভীর! প্রতিরাতে ফেরার সময়ে
আমি নেমপ্লেটের লেখাটা দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি ছুঁড়ে দিতাম। নীলা রায় চট্টোপাধ্যায়― দেখে বিরক্তির সূচ ফুটত মাথায়। তবু “ঘর” শব্দটা উপরে জ্বলজ্বল করে বসিয়ে রেখেছে নীলা।
সেটা দেখে চোখ নামিয়ে ফেলতে হতো। মাথা নামিয়ে দরজা খুলতাম। কালও সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলাম,
বেপরোয়া সুর ভাঁজছিলাম, ডুপ্লিকেট চাবি বের করতে গিয়ে থেমে গেলাম। ঘরের ভিতর থেকে আওয়াজ
আসছে। একটা রাগারাগির শব্দ। নীলার গলা পাওয়া যাচ্ছে। সে যেন কারোর উপর মান করেছে। বলছে,
“ছেড়ে দাও! কালও আসতে হবে না। আমি একা চলে যাবো”।
ভিতরে
নীলার সাথে কেউ আছে? আমার মনে পড়ল, ওর এই কিশোরীসুলভ রাগত কন্ঠস্বর আমি চিনি। অনেকদিন
আগে এই অভিমানের বিপরীতে আমি দাঁড়াতাম। ভাবলাম এত রাতে কার সাথে এভাবে কথা বলছে?
কয়েক
মুহূর্ত চুপ। তারপর আবার নীলার গলা, “বুঝতে পারছি বলেই বলছি। তুমি একেবারে শনিবারে
এসো। কাল নিজের অসুবিধে করে আসার কোনও মানে হয় না!”
অবাক
হলাম, আমি কোনও ঈর্ষা বা সন্দেহ টের পাচ্ছি না তো ভিতরে! অধিকারবোধে ও লাগছে না। তবে
কি নীলা আমার কাজ সহজ করে দেবে? কিন্তু, এত সহজ হোক সবটা, এমনটাও তো চাই না।
ডুপ্লিকেট
চাবি হাতে রেখে বেল বাজালাম। কয়েক সেকেন্ডে দরজা খুলল নীলা। আমি চমকে উঠলাম। কারণ দেখলাম
একজোড়া চোখ। পাঁচবছর আগের একজোড়া চশমা পরা চোখ। যেন এখনও কলেজের গন্ধ যায়নি গা থেকে।
যেন এখনও দুনিয়াদারি বোঝেনি। সরল, অভিমানী, ইউটোপিয়ান দুনিয়ায় বসবাসকারী একজোড়া কাজলটানা
চোখ। এক লহমায় মনে পড়ল কোথায় দেখেছিলাম এই চোখ।
কোনও
অ্যাসাইনমেন্ট ছিল না সেদিন। ফেব্রুয়ারির এক সন্ধেয় হাতে কোনও কাজ না থাকায় শহিদ কলোনি
থেকে ক্যাম্পাসের দিকে যাচ্ছিলাম। তখনও বেশ ঠাণ্ডা, বাতাসে বৃষ্টির পূর্বাভাস। তবু,
সরস্বতী পুজোর ট্রেডমার্ক হাওয়া বইছিল শরীরে। ঝিলের রাস্তাটা হেঁটে রেলগেটে এসে দাঁড়িয়েছিলাম।
যখন স্টেশনে একটা ট্রেন ঢুকছে তখন আচমকা দেখলাম আমার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটার খুব তাড়া!
ডেকে লাভ হতো না। উপস্থিত বুদ্ধিবলে তার সবুজ সোয়েটারে দিলাম এক টান। মেয়েটা হ্যাঁচকা
টান সামলাতে না পেরে আমার দিকে সরে এল। মুহূর্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। আর আমি দেখলাম
সেই চশমা পরা চোখ। আমার চেয়ে ওই পাঁচ-ছ বছরের ছোটো একটা মেয়ে, সারল্য আর তীব্রতা মিশে
আছে চোখে, চশমার কাচে স্টেশনের বিন্দু আলো খেলা করছে। তারপরেই লজ্জিত হয়ে হেসে ফেলল
মেয়েটা।
নীলার
সেই চোখজোড়া কতদিন পর গতকাল রাতে দেখলাম। একটু হাসলও কি? আমার চোখে ধাঁধা লেগে গেল।
কী করা উচিত বুঝে না উঠে অস্বস্তি হল। মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
ঘরে
ঢুকে বুঝলাম ফোনে কথা বলছিল নীলা। হঠাৎ আমার মাথাটা বিগড়ে গেল। মনে হল, আজই এই হাসি,
এই পুরনো চাহনি, সবই নীলার একটা খেলা। আমাকে বিদ্রুপ করছে কারণ ও জেনে গেছে! ও জেনে
গেছে আজ সারা সন্ধে আমি ইরাবতীর ফ্ল্যাটে ছিলাম। ও জেনে গেছে, আজ জীবনে প্রথমবার আমি
ইরাকে দেখলাম! খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, প্রতিটা কোশ, ত্বকের প্রতিটা কোণ, শরীরের প্রতিটা ভাঁজ,
সবটা! দশ বছর ধরে যে ঐশ্বর্য আগলে রেখেছিল ইরা, আজকে আমি তার স্বাদ পেলাম। আর এখন হাসি
দিয়ে খেলাচ্ছে আমায় নীলা। বিরক্ত লাগল। বেডরুমে ঢুকে গেলাম।
আজ
বেশ কয়েকমাস আমাদের কথাবার্তা হয় না। বছরখানেক হল আমাদের শোবার ঘর আলাদা। প্রথম প্রথম
রাগের বশে এমনটা করতাম আমি। নীলা সযত্নে আমার সেই অভ্যেসটা রেখে দিয়েছে। বরং আমাকে
বেডরুমটা ছেড়ে দিয়ে নিজে স্টাডিতে চলে গেছে। সেখানে অনেক রাত পর্যন্ত খাতায় হিজিবিজি
কাটত, বই নিয়ে শুয়ে পড়ত। আমি দেখতে যেতাম না।
গত
একবছর আমি নীলাকে ছুঁইনি। গত একবছর ধরে ইরাবতী আমাকে অধিকার করে নিয়েছে। একটু একটু
করে। নীলা আর ইরার মধ্যে বয়সের নয়, স্বভাবেরও বিস্তর ফারাক। নীলা ছটফটে ছিল, অবুঝ প্রকৃতির,
কিছু কিছু ক্ষেত্রে দারুণ অপরিণত! আমার চোখে লাগত। বরাবরই পারফেকশনিস্ট আমি। ওর খুঁতগুলো
নিজের কাছে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেও পারতাম না। তখনই পুরনো বন্ধু ইরা এল। আচমকা দেখা
হল। ইরা বড্ড স্থির মানসিকতার। একটা পরিশীলিত ভাব। ওর ব্যক্তিত্বের এই শান্ত, বুদ্ধিমত্তার
সাথে সামলে দেওয়ার দিকগুলো আমাকে টানতে শুরু করল। আমি চেয়েছিলাম, একটা সময়ে ভেবেছিলাম
কেন ইরাকে পেলাম না! কিন্তু ওই নেমপ্লেটে লিখে রাখা “ঘর”, আর “ঘর”- এর ভিতর অবুঝ প্রকৃতির
নীলা, কী এক টান যেন ছিল!
নীলা
যেদিন বুঝল, জানল, চরম অশান্তি করেছিল। ওর স্বভাব অনুযায়ী! আরও অশান্তি করলে হয়তো ব্যাপারটা
যেকোনো একটা দিকে গড়াতে পারত, কিন্তু ও আচমকা নিশ্চুপ হয়ে গেল। সম্পূর্ণ শান্ত। শান্ত
না বলে স্তিমিত বলা ভাল। মিইয়ে গেল। সরে গেল। আমাকে ইরার দিকে ঠেলে দিল যেন! তাতে আমার
নীলার প্রতি আক্রোশ আরও বাড়ল। আমি ওকে আশ্রিতের মতো দেখতে শুরু করলাম।
কিন্তু,
নীলা জানে না, গতকাল রাতে ওই চোখজোড়া, ওই হাসি আমাকে নুড়ি পাথর সরাতে বাধ্য করছিল।
কোনও চাপা অপরাধবোধ ছিল কিনা জানি না, বুঝতে পারি না, কিন্তু কাল অনেক রাতে, শেষ সিগারেটটা
পুড়ে যাওয়ার পর, ইরার টেক্সটের পরিবর্তে শুভরাত্রি জানানোর পর, ডাইনিং এর অন্ধকার পেরিয়ে
আমি স্টাডিতে একবার চোখ রেখেছিলাম। বহুদিন পর। দেখেছিলাম, নীলা ঘুমোচ্ছে। বুক থেকে
নেমে গেছে একটা বই। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে। তক্তপোশের পায়ের কাছে একটা ভারী চাদর।
ওর গায়ে চাদর নেই। অল্প অল্প কাঁপছে। তবু, যেন কতদিন ঘুমোয়নি, এমন ক্লান্তিতে বেঘোরে
ঘুমোচ্ছে নীলা। আর, বন্ধ চোখেই আটকে আছে চশমাটা।
এখন
ওই চশমাটা কালো পাথরের উপর ছিটকে গেছে। কাচভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। নীলা ঘুমোচ্ছে।
আমাকে
জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে যেতে হবে। নীলার হিজিবিজি কাটার ডায়রি থেকে নৈঋত নামের একজনের
খোঁজ পাওয়া গেছে। তার খোঁজ চলবে। আমিও তাকে খুঁজব। নৈঋতের কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে।
নৈঋত
পিছিয়ে
যেতে যেতে আটকা পড়ে যাচ্ছি আমি। আজ রোদ ওঠেনি। এখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বেশ কয়েকটা ছাতা
খুলে গেছে। ভিড় সরে গেছে। অদ্ভুত শান্ত চারপাশ। এলাকাটা সামান্য থমকে তার নিজের ছন্দ
ফিরে পেয়েছে আবার। অবস্থাটার সঠিক বর্ণনা করা যাচ্ছে না। নীলা থাকলে পারত। যেকোনো
দৃশ্যের, যেকোনো রাস্তার, যেকোনো স্মৃতির হুবহু বর্ণনা দিতে পারত। কিচ্ছু বাদ যেত
না। গল্পের ছলে বলে দিতে পারত। আমার অবাক লাগছে, ওর চলে যাওয়ার এই রাস্তাটার কোথাও
কিছু কম পড়েনি। ও ঠিকই বলত, কোথাও কিচ্ছু কম পড়ে না।
প্রায়শই
সন্ধে হলে এই রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম দু’জন। নীলা আমায় শেখাত পর্যবেক্ষণের ভূমিকা। মাঝেমধ্যে
থেমে যেত। একেকটি দৃশ্য, রাস্তার ধারের কোণায় জমাট অন্ধকার, কোনও ঘুপচি দোকান, নাইন-বির
ফুটপাতের ফেরিওয়ালা, বা বিকেলবেলায় বাসস্ট্যান্ডে বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলে ওঠা - সমস্ত
অতি সাধারণ দৃশ্য দেখতে থমকে যেত। হা করে একেকটি দৃশ্য গিলত যেন! ওর হাত ধরে টানতাম।
নীলাকে ছুঁতাম। পরস্ত্রী বলে মনে হতো না। ওকে ছুঁলে মনে হতো একরাশ গল্পের শরীর ছুঁলাম।
নীলাকে
প্রথম দেখেছিলাম শরতের বিকেলে। রেলগেটের ওধারে। নীলা আমায় দেখছিল। কিছুটা বিস্মিত চোখে।
যেন চেনে, আবার চেনেও না। ওর দৃষ্টি বিভ্রান্ত ছিল কিনা জানি না, কিন্তু ওই কালো সালোয়ার
কামিজ আর কালো শেলফ্রেমের চশমা মনে আছে। মাঝখানে একটা ট্রেন বেরিয়ে গেল। নীলা রেললাইন
পেরিয়ে এগিয়ে এল। আমার যাওয়ার কথা ছিল এইট বি। আমি তা ভুলে গেলাম। ওর পিছু পিছু রাস্তা
পার হলাম, ঝিলের রাস্তায় প্রায় ওর পাশে হাঁটতে শুরু করলাম।
বিবেক
সংঘের মাঠের কাছে এসে নীলাই প্রথম প্রশ্ন করল, “আপনি এদিকে থাকেন?”
বললাম,
“ঠিক এদিকে নয়, সন্ধ্যাবাজারের দিকটায় থাকি। আপনি কি এদিকেই?”
নীলা
বলল, “সেলিমপুরের দিকে। আজ রোদটা নরম। পুজোর হাওয়া। ভাবলাম হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজ পেরবো”।
ওর
সাথে হাঁটার সেই শুরু। ধীরে ধীরে নীলাকে জেনেছি। ওর হাসি, ওর চাহনি, সবটা ফের ওর মতোই
হয়ে উঠছিল। আমি জানতাম, দেরি হলেও ও ফিরে পাবে যা খুঁজছিল। আমাদের অনর্গল কথায়, প্রতি
সন্ধের হাঁটায় কত কী দরজা খুলত! একেকদিন ওর সাথে চলে যেতাম কলেজস্ট্রিট। নীলা খুব পুরনো
বই কিনত। আর কত কী লিখত। জিজ্ঞাসা করলে বলত, “হিজিবিজি!”
আমি
জানি, দৃশ্যের বর্ণনা লিখে রাখত। খারাপ দৃশ্য, যন্ত্রণার দৃশ্য, আনন্দের দৃশ্য, আপাত
অর্থহীন কোনও সামান্য দৃশ্য, সব। হেমন্তের দুপুরে প্রথম ওর ঘরে প্রবেশাধিকার পেলাম।
ঘর বলতে তক্তপোশ, চেয়ার, টেবিল, আর বই খাতা কলম। কিছু মেয়েলি পোশাক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
তার মধ্যেই শাল রেখে বসেছিলাম আমরা। জেনেছিলাম, পাশের শোবার ঘরটা সৌম্য’র। হাসতে হাসতে
দৃশ্যের বর্ণনা দিচ্ছিল নীলা। আমি জেনে যাচ্ছিলাম এই “ঘর”-এর ভিতরকার পাঁকজল।
তারপর
বহুবার নীলাকে ছুঁয়েছি, প্রায় প্রতিদিন ওর সাথে হেঁটেছি। ওর ডায়রিতে আঁকা আমার মুখ
দেখেছি। নতুন যন্ত্রণা, নতুন লেখা, নতুন আঁকা, নতুন বই, সবটা আমাকে এসে বলত নীলা। সৌম্য’র
চেয়ে বেশি অধিকারবোধ আমার তৈরি হয়েছিল। আমি স্বার্থপর হয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম সৌম্য’র
সাথে নীলার সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ। নীলাকে নিজের করে পাওয়ার এই একটিমাত্র উপায় ছিল। কারণ,
আমি জানতাম সৌম্য কাছে এলে আমি আবছা হয়ে যাবো! নীলা’র মস্তিষ্প্রসূত আমি ক্রমেই অস্তিত্বহীন
হয়ে যাবো।
এখন
নীলার মস্তিষ্ক নষ্ট করা হবে। আমার ভয়, মস্তিষ্কের ভিতর এই নৈঋত নষ্ট হয়ে যাবে।
নীলা
একটা
বিনবিনে শব্দ। একঘেয়ে। বিশ্রী। বন্ধ হচ্ছে না। একটা বড় মাছি। মুখে, ঠোঁটে, কপালে বসছে।
একটা, দুটো করে মাছি বেড়ে যাচ্ছে। বিনবিনে শব্দটা বেড়ে যাচ্ছে। দৃশ্যটা লেখা যাচ্ছে
না।
গতরাতে
ঘুমের মধ্যে একটা দৃশ্য দেখেছিলাম। খুব অস্পষ্ট, হয়তো স্বপ্নের ভিতর, তবু মনে হল যেন
সামনের দরজাটায় খয়েরি অন্ধকারের মধ্যে একটা কালো মূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে। পা টিপে টিপে
এল, আমাকে দেখল, এগোতে চেষ্টা করল, পারল না। দরজায় ঠেস দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ।
মূর্তিটাকে আমি চিনি। সৌম্য!
ভোরবেলা
ঘুম ভেঙে প্রথমেই গতরাতে স্বপ্নের দৃশ্যটা মনে পড়ল। লিখে রাখতে হবে। মনে হল, লিখে রাখার
আগে নৈঋতকে জানাতে হবে। কিন্তু, আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, নৈঋতের বাড়ি কোথায় মনে করতে পারছি
না। অনেক চেষ্টা করলাম। টুকিটাকি কাজের ভিতর, একটু একটু আলো ফোটার ভিতর, মাথার অস্বস্তিকর
যন্ত্রণার ভিতর কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। আমার ভয় করছিল। নৈঋত যদি আর না আসে! মেঘলা
ছিল, অল্প বৃষ্টি পড়ছিল, হালকা চাদরটা গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে এলাম।
কিছুটা
অস্থির পায়ে হাঁটছিলাম। আমার বিশ্বাস দৃঢ় হচ্ছিল, নৈঋতের ঠিকানাটা মনে করতে পারব না।
আমি আতঙ্কিত ছিলাম, নৈঋতের সাথে আর দেখা হবে না। আমি আরও জোরে পা চালালাম। বিবেক সংঘের
মাঠ, শহিদ কলোনি, ঝিল রোড, সবখানে রাস্তার দু’পাশ ফিরে ফিরে দেখেছি। কোথাও দেখা হচ্ছে
না তার সাথে। এদিকে দৃশ্যটাও এখুনি জানাতে হবে!
রাস্তায়
বেশি লোক ছিল না। দুয়েকটা খবরের কাগজের সাইকেল আমাকে ছাড়িয়ে গেল। মুরগির ঝাঁক বাঁধা
সাইকেল অদ্ভুত শব্দে চলে গেল, আমি কোনওদিকে তাকালাম না, কোনও শব্দে দাঁড়ালাম না। দিন
শুরুর শব্দ, ছবি আমায় টানছিল না।
শেষে
রেলগেটে দেখতে পেলাম নৈঋতকে। যেমনটা দেখেছিলাম প্রথম বিকেলে ওকে। আমি ওর জায়গায় দাঁড়িয়ে।
ওপারে ও আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে। একটা এক্সপ্রেস আসছে। আমার বুকে স্বস্তির রক্তস্রোত নেমে
যাচ্ছে। ট্রেনটা চলে যাওয়ার অপেক্ষা। হঠাৎ দেখলাম নৈঋতের কোঁকড়ানো চুল অস্পষ্ট হয়ে
আসছে, শ্যাওলা রঙের পাঞ্জাবির হাত দুটো যেন অল্প অল্প ক্ষয়ে যাচ্ছে, অদৃশ্য হওয়ার খেলা
খেলছে। নৈঋৎ ক্রমেই আবছা হয়ে আসছে।
ওকে
ধরে ফেলতে হবে। ও হারিয়ে যাওয়ার আগেই ওকে ধরে ফেলতে হবে। লাফিয়ে পা বাড়ালাম…
এখন
অন্ধকার… এখানে নৈঋত নেই। এখানে সৌম্য, বহুদিন হল, থাকে না!
**********************
ইরাবতীর
ফ্ল্যাট থেকে নেমে এসে সিগারেট ধরালো সৌম্য। কাল সকালের ফ্লাইটে দিল্লি যাচ্ছে ইরা।
আজীবনের মতো। কথাটা কীভাবে বলবে বুঝতে পারছিল না ও। শেষে সৌম্যই সবটা সহজ করে দিল।
নিজেও বুঝল, চারপাশে একটা ভার নেমে যাওয়ার মতো হাওয়া। লুকোতে চাইলেও ইরা তা টের পেল।
একেই কি “মুক্তির স্বাদ” বলে?
ঝিলের
ধার দিয়ে হাঁটছিল সৌম্য। ক্লাবের দিকে জোরালো আলো। ঝিলের দিকে হালকা অন্ধকার। হঠাৎ
মনে হল উল্টোদিক থেকে যে আসছে তাকে চেনে সৌম্য। কোথায় দেখেছে মনে করতে করতে একটা অদ্ভুত
শিহরণ খেলে গেল। উল্টোদিকের মানুষটাকে সে নীলার ডায়রিতে দেখেছে। আজ প্রায় ছয়-সাত মাস
ধরে বারবার। সে সশরীরে এগিয়ে আসছে! নৈঋত! চেনা লোকের দেখা পেয়ে যেন দ্রুত এগিয়ে গেল
সৌম্য। আলাপ করতে হবে। আলাপ জমাতে হবে। নৈঋতের কাছে সৌম্য’র একটা প্রশ্ন আছে যে!
নীলা
কি নৈঋত’কে ভালবাসত? তাকে ছুঁয়ে দেখত?
সৌম্য
টের পেল, সে হাঁটছে না। সম্মুখে দেখা অবয়বের দিকে ছুটছে!