লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Saturday, May 15, 2021

সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়, ছায়ারোদ ১৫

সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা

 

সুষুপ্তির জেব্রা ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে

 

১.

ভেবেছো তুমি বাঁচবে তাকে ছাড়া

ছিনিয়ে নেবে প্রতিশোধের দায়

দু'চার আনা ডাকনামের পাড়া

নকশা কাটে জবাবী ঘেন্নায়

 

ভেতরঘরে নজরবন্দিনী

পিদিম জ্বালে বিলিতি সংবাদ

নিজের লেখা যুদ্ধে কোনো দিনই

থাকে না চিৎকারের ইরশাদ

 

অঙ্কহীন ঘুমোও তাকে ছাড়া

আততায়ীর স্বপ্নচিন্তায়

ডাকনামের ছেঁড়া পলেস্তারা

বহন করে ছেড়ে আসার দায়....

 

 

২.

ঝিলের ধারে অঘোর কানাগলি

মোমবাতির বয়স ধরা পড়ে

রাতবধির শরীরে মেনে চলি

তোমার ছায়া, অনুকরণ জ্বরে

 

অরণ্যকে মাথুর ভাবো তুমি

ক্ষরণ শুধু শিরার ডানপাশে

নকল ব্যথা ছেঁড়ার মালভূমি

বেসিন খোঁজে শুকনো ঝুমচাষে

 

খেলিয়ে তোলা মনের জলছবি

চেনা আঁশের আঙুল ছুঁয়ে মরে

সমবয়সী যন্ত্রণার কবি

তোমায় ডাকে অনুকরণ জ্বরে...

 

 

৩.

খেলা এখন পরম রমণীয়

আমায় তুমি সম্পাদনা করো

ভ্যান গঘের চিঠি পেলেন থিও

স্ট্রোকের ভাঁজে ঋতুর মর্মরও

 

এলো তোমার দক্ষিণের ছাদে

এইসময় দুপুর পাশবিক

দেয়ালঘড়ি বেতারে বসে কাঁদে

উন্মাদনা তবুও নির্ভিক

 

মরা রোদের চামড়া তুলে ধরো

আকাশভরা রাতের ধমনীও,

জট পাকালে সম্পাদনা করো

যেহেতু খেলা এখনও রমণীয়...

সন্দীপন দাস, ছায়ারোদ ১৫

সন্দীপন দাসের চারটি কবিতা

 

১. আলো


কয়েকটা মানুষ জটলা করছে এ রাতে আগুনের সাথে

আগুনের খুব অভিমান...

অভিমান অদূরে পড়ে থাকা রক্তাক্ত সন্ধেমণি ফুল,

ছেঁড়া বর্ণপরিচয়ের পাতা, ভিনদেশী অন্ধকারেরও...

#

ঈশ্বর মাটির হয় বুঝি?

পরিযায়ী চোখও কখনো কখনো ভাষা...

#

কয়েকটা মানুষ জটলা করছে শূন্যতার সাথে

চোখে অশান্ত স্বপ্ন বুনে...

স্বপ্নের খুব অভিমান

অভিমান কাছে পড়ে থাকা মাটির ঈশ্বরের, পরিযায়ী চোখের জলেরও...

#

আলো কখনও কখনও বিজয় অভিলাষী হয় বুঝি?

 

২. জেনেসিস

 

একটা তারা খসে গ্যালো তোমার যোনি থেকে

আবারও ক্লোরোফিলের আঁশটে গন্ধ... আরেকটা নিদ্রাহীন রাত...

শরীর ভর্তি সেই অন্ধকার নিয়ে বর্ষার ছাদে

মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছো  তুমি

তোমার পেছনে মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, পাবলো পিকাসো

#

তারও পেছনে ঈশ্বর...

 

 

 

 

৩. ঘুঙুর

 

স্বাভা বিক উদ্ভিদের মতো বেড়ে উঠছি আমি

মে মেয়েটি সুন্দর পরিচর্যায় ডালপালা ছেঁটে বড়ো হচ্ছে

সে বোধহয় জানে আদিম দেবতার গোপন আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখা ঈর্ষার হাজারো কারণ...

অবলীলায় সে ছুঁয়ে দিতে পারে জলের ব্যথা,প্রতিটি ভোরের একাকীত্ব, ঈর্ষাতুর মেঘের দলও...

 

আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখি...

দেখি মেয়েটির শরীর ঘিরে সূর্য ওঠে

জলের ব্যথার সাথে মিশে যাচ্ছে মেয়েটির সাতজন্ম আর আমার একজন্ম...

হে ঠাকুর, সমস্ত অহংবোধ কি আজ তবে শামুকজন্ম?

জলের মতো শুদ্ধ হবো...

আমি পিছন ফিরি,অল্প আলোতে খুঁজতে থাকি অন্য আকাশ,অন্য কোনো গাছের শরীর...

 

৪. দ্য ব্লু প্যালেস

 

অনেকদিন হলো কোনো গল্প শোনাতে গিয়ে কেঁদে ওঠোনি তুমি

আর আমারও মুক্তি ঘটেনি

দেখেছি আমার চারপাশের অন্ধকার ফুঁড়ে উঠে এসেছে এক প্রেমের কাহিনী

যেখানে শূন্যতা প্রেমিক, প্রেমিকা তুমি...

অনেকবার ব্রেক-আপ হয়েছে তোমাদের, তারপর আবার মাটির টানে,

চোখ উপড়ে নেওয়া চেনা কোনো তূণের টানে ফিরে এসছো তুমি

তোমার এই বারবার ফিরে আসাটা মেনে নিতে পারেনি

নদী, জঙ্গল, মনখারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিডও...

এমনকি মনকেমনের মেঘ দু'হাতে হাওয়ায় ওড়াতে ওড়াতে

সাহারা ক্রস করে গ্যাছেন ডিরেক্টর

সূর্য অস্ত গ্যাছে,আবার একরাশ অন্ধকার গ্রাস করেছে আমায়

আমি আর সহ্য করতে পারিনি... শহর ঘুমোলে চুপিচুপি উঠে গ্যাছি

সারাগায়ে অন্ধকার নিয়ে

তুমি আলো হয়ে আসবে বলে...

#

কতদিন কোনো ভাঙ্গা ইমারতের গল্প শোনাতে গিয়ে

কেঁদে ওঠোনি তুমি

আর...

মনোতোষ বৈরাগী, ছায়ারোদ ১৫

মনোতোষ বৈরাগীর দুটি কবিতা


তারে আমি চোখে দেখিনি

 

হঠাৎই একটি মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছি

 

শীতের দুপুরে

আমার দু'একটি দুশ্চিন্তার পাকা চুল দেখে মা বলেছিল, 'বাড়ির জ্যোৎস্না কাকিমা তোর জন্য সম্বন্ধ এনেছেন

 

বয়স পনেরো-ষোলো মোটে। ভিনদেশি। টুকটুকে ফর্সা গড়ন

                                 মা নেই

                               বাবাও নেই...

 

এটুকু শুনেই

হঠাৎই একটি মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছি

 

তেজপাতাকে ভালোবেসে

 

যখন ফিরছি

একটা তেজপাতা গাছ আমাকে দেখে হাসছিল,

                        ক্ষুরধার হাসি

 

সেই কোন কালে

ভ্রমর আসার আগেই সজনে ফুল ঝরে গেছে

তারপর থেকে শ্বেত জবার সাথে

                       শ্বেত গোলাপের সাথে কাটাকুটি

 

এসব ভাবতে ভাবতেই সেই তেজপাতা গাছটিকে ভালোবেসে ফেলি

যার একটি পাতা

অন্তত আমার পায়েসান্নকে পরমান্ন করেছে

শুভদীপ আইচ, ছায়ারোদ ১৫

শুভদীপ আইচের দুটি কবিতা


হত্যাকান্ড  একটি রাত

 

খোয়া বিছানো পথে উদ্ভূত বাকি লঘু-গুরু

দিনের কাছে ভেজে উঠছে শৃঙ্খল

গলিত আত্মার অবধারিত প্রেম

ঘুরিয়ে মেঘ সমন্বয়

মুগ্ধ বিচারে

 

বিকেল থেকে ছুটিয়ে মাখি আলো

বিকলাঙ্গের কাছে বাধা পড়ছে সময়

লোলুপ এক ভেক ধরা ম্যাজিশিয়ান

ছুঁয়ে দিলে এখনো কেঁপে ওঠে জমকালো

 

এদিকে

 

নতুন কিছু অবগাহনের ফাঁকে

বিরক্তি ছিটিয়ে নিচ্ছে সন্দেহ

সরু ও চিকন যা কিছু অবশেষ

সূর্যাস্তের ঘরে বুদবুদ বাড়ালো

 

 

উৎসারিত নীলের ঘামে ঘনিয়ে উঠছে গরল

গোলাপ থেকে গড়িয়ে নামছে মোটিফ

খুন থেকে দূরে দাঁড়িয়ে শুধু

পৃথিবীর কাছে ক্ষমা চাইছ তুমি

 

ভ্রমণ

 

বোয়ালদার থেকে হেঁটে আসি বালুরঘাট পর্যন্ত

শঙ্খ-ধ্বনি ভেসে আসে বাতাসে

উঠোন পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল যে সব কলমীলতা

তারা ক্রমশঃ লুকোচুরি খেলছে নিজেদের সাথে

হাঁসেরা এগিয়ে আসছে জল থেকে ডাঙ্গায়

কখনো ডাঙ্গা থেকে জলে

মাথা মুড়িয়ে ডুব দিচ্ছে জলে

হাঁসেদের কলকলের সাথে তোমার গমগম মিলিয়ে যাচ্ছে...

 

কতবার বলেছি রাস্তায় বেরলে এমন কলকল করতে নেই!

মন্দ মানুষের নজরে পড়ে যায়

অথবা যেমন তেমন পুরুষও মন্দ হয়ে যেতে পারে।

মুখে যতই বুলি কপচাই

এই ক্ষুধার্ত জঙ্গলে তোমার কি খুব প্রয়োজন হরিণী সাজার?

Wednesday, January 20, 2021

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৪

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প

ফেরা


মণিবাবুর গাড়িতে জায়গা না পেলে আজ আর ফেরা হত না আমার। সিনেমা লাইনে কাজ করি, রোজ রাত হবারই কথা। কিন্তু এত রাত হয় না কখনও। এমনিতেই কলকাতার পরিস্থিতি এখন খুব একটা ভালো নয়। ধরপাকড় আর গুমখুনে ছেয়ে গেছে শহরটা। তার উপর আমি খোঁড়া মানুষ বলে স্টুডিও থেকে সন্ধেরাতেই ছাড়া পাই। তবে আজ তা হবার জো ছিল না। প্রোডিউসার আগরওয়াল-এর সাথে আমাদের ডিরেক্টর রমেনবাবু'র ঝামেলা চলছিল অনেকদিনই। আজ তো সন্ধেবেলা সেটের মধ্যেই ধুন্ধুমার বেঁধে গেল। অবিশ্যি তারপর ঝামেলা মিটে ও গেছে, কিন্তু ওই প্যাক আপ হতে হতে এগারোটা বেজে গেল। সুযোগ বুঝে কাটতেও পারলুম না আর।

শেষে উদ্ধার করলেন মণিবাবু। তিনি বর্ষীয়ান অভিনেতা, এই লাইনে আছেন সেই বড়ুয়াবাবুর সময় থেকে, গাড়িতে ওঠার সময়ে আমায় ডেকে নিলেন রাশভারী মানুষটি। মণিবাবু যাবেন লবণ হ্রদের দিকে। ওদিকে এখন বাড়ি তৈরির ঝোঁক তৈরি হচ্ছে। শুনেছি জমিজমাও সস্তা। আবার আমি ফিরব আর্মহারস্ট স্ট্রিট। তাই অনেকটা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শ্রীমানি বাজারের মুখে নেমে যখন হাতঘড়ি দেখি, তখন রাত বারোটা বেজে দশ।

উত্তর কলকাতার ব্যস্ত সমস্ত বড় রাস্তা এখন শুনশান। নভেম্বরের শেষ, শীত টাও বেশ জম্পেশ পড়েছে। তাই অলিগলি সব দরজা জানলা এঁটে গভীর ঘুমে মগ্ন। দূরে দূরে পুলিশের সাইরেন ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। আজকাল দেখছি টহল পুলিশের ভয়ে দেহাতি ঝাঁকা মুটে ওয়ালারাও রাত হলে বেমালুম উধাও হয়ে যায়। অদ্ভুত এক অবিশ্বাসের দমবন্ধ পরিবেশে আটকা পড়েছে মহানগর। এই নিস্তব্ধ আর আতঙ্কিত শহরটায় যেন এখন একা আমিই জেগে! আগেই বলেছি, জোরে পা চালানোর উপায় আমার নেই, খোঁড়া মানুষ। তাও লাঠিতে ভর করে যতটা পারা যায় তাড়াতাড়ি হাঁটি।

চারমাথা'র মোড় পেরিয়ে অর্মহারস্ট স্ট্রিটের রাস্তায় ঢুকতে যাব, দেখি কালো শাল ঢাকা একটি ছায়ামূর্তি হাতিবাগান এর দিক থেকে এসে আমার বাড়ির রাস্তায় ঢুকল। মূর্তিটি এক যুবকের। কালো শালের নীচ থেকে আদ্দির পাঞ্জাবি আর ঢোলা পায়জামা দেখা যাচ্ছে। খুব ধীরে, যেন পায়ের আওয়াজ না পড়ে, সেভাবেই মিহি ধোঁয়াটে কুয়াশায় হেঁটে যাচ্ছে যুবকটি। তার গড়ন, তার হাঁটার ধরন আমার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। একবার মুখ ঘুরিয়ে ছিল সেই ছায়ামূর্তি। আধো আলো, আধো অন্ধকারে, কুয়াশার ভিতর সেই মুখ দেখে দমবন্ধ হয়ে এসেছে আমার। সুবল! ঝাঁকড়া চুল, চাপদাড়ি, আর সেই জ্বলন্ত একজোড়া চোখ। কোনও ভুল নেই। এগিয়ে যাচ্ছে সুবল। চার এর পল্লী গলির মুখে ফুল আর ধূপ কাঠির প্যাকেট পেরিয়ে অবলীলায় গলির ভিতর মিলিয়ে গেল আটমাস আগে এনকাউন্টারে মৃত সুবল!

আমি তখন ঘামছি, সুবলের মুখে যাকে দেখলাম সে আমার বাড়ির গলিতে, আমারই বাড়িতে ঢুকেছে। ভাবলেই আমার গা ভারী হয়ে আসছে! কীভাবে যে পা চালিয়ে বাড়ির গেটে এসেছি, তা আমি জানি না। তবে গেটের মুখে শোভাদিকে দেখে ধড়ে প্রাণ এল আমার। শোভাদি অপ্রকৃতিস্থ। সাত-আট মাস আগে ছোট ছেলে সুবলের মৃত্যু সংবাদের পর থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন। রোজই রাত করে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমি ফেরার পথে হেসে কথা বলি। পরে সুবলের দাদা বৌদি বুঝিয়ে সুঝিয়ে দোতলায় নিয়ে যায়। আজ তাকে দেখেই যেন আশ্রয় পেলাম আমি। আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে সেই বিধবা বললেন, "এই ফিরছ? অনেক রাত হয়ে গেল আজ। দ্যাখো কাণ্ড! সুবলটা এখনও এল না!"

আমি কোনোমতে মাথা নাড়ি। এই শোকে বিহ্বল মাকে কি তাঁর আত্মজর অতৃপ্ত আত্মার আভাস দেওয়া যায়! সুবলের দাদাকে খবর দেব ভাবতে ভাবতে কালো দরজার গেট খুলে উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় এলাম। শিখা আলো জ্বেলে জল এনে দিল। বললাম, "বিমলের বৌকে খবর দাও তো"।

শিখা বলল, "এত রাতে ওদের ডেকে কাজ নেই। আজ দুপুরে শোভাদি মারা গেছেন"। আমার হাত থেকে জলের মগটা পড়ে গেল! টলে পড়ে যাবার আগের মুহূর্তে শিখার গলা পেলাম, "ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক, সময় দেয়নি! একটু আগে নিমতলা থেকে ফিরল সব!"

 

পুনশ্চ: বাহাত্তর সালের সেই শীতের রাতে বাঁচার তাগিদে ভুয়ো মৃত্যু সংবাদ ছড়ানোর পরেও, কোনোভাবে খবর পেয়ে মাকে শেষ দেখা দেখতে সত্যিই লুকিয়ে এসেছিল নকশাল নেতা সুবল। কিন্তু না, মায়ের সাথে সুবলা'র আর দেখা হয়নি।

সৌরভ মাহান্তী, ১৪

সৌরভ মাহান্তী'র কবিতা

 

এ ই   শ হ রে র   রা খা ল

 

পাতারা ঝরেছে বহুদিন আগে। তখনও শীতের সকাল।

ফেলে আসা চোট, কুড়িয়ে রাখত এই শহরের রাখাল।

 

১.

এক-একটা শীতকাল ফুরিয়ে আসে ঝরে যাওয়াদের গল্প লিখতে লিখতে। চামড়া খসে পড়ার শব্দে কান্না পায় যে কপোত-কপোতীদের, তারা জানে আজ কার ঘরে নুন ফুরিয়ে এল, কার বটিতে আঁশটে গন্ধ।

 

বেলা শেষে কপোত-কপোতীরা উড়ে যায়। আনন্দ সহকারে রোদ আসে রাখালের ছাদে। রাখালও একে একে উঠোনে বিছিয়ে রাখে মাংসের দোকানগামী পশুদের শোক...

 

২.

যেসমস্ত পথে মানুষ হেঁটেছিল বহুদিন আগে সে পথে হাঁটতে গিয়ে দেখি, পথের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে কোনো এক রাখালের বাঁশি ভেঙে পড়ে আছে। বাঁশি কি বেজেছিল কোনোদিন? তবে সে বাঁশি ভাঙবে কেন?

 

এসব প্রশ্ন করো না আমায়। সুর যে কি বেদনার তোমায় কিভাবে বোঝাই এ অপরাহ্নবেলায়...

 

৩.

প্রভুর গাভী হারিয়ে যাওয়াতে একশো চাবুক খেয়েছিল যে রাখালবালক, আজ তার কথা মনে পড়ে রাঙাধুলোর। তুমি দেখেছো তাকে সারাটাদুপুর আদুড় গায়ে গাঁয়ের মোড়ে মোড়ে ফিরতে। তার মুখে ক্ষীণকায় বাঁশির আঘাত, পিঠে চাবুকের দাগ; বুকেতে কদমফুল।

 

সন্ধেবেলা শঙ্খ বাজলেই যে পাখিরা ঘুমিয়ে যায়। এ ভাবনা ভুল।

দূরের পোল্ট্রিকাটা দোকান থেকে উড়ে আসছে পালক

একটা...দুটো...তিনটে...

সাদা পালক আর ভাঙা বাঁশির টুকরো।

সন্দীপন দাস, ১৪

সন্দীপন দাসে’র কবিতা

 

১. দোয়াব


আর এভাবেই তুমি কেড়ে নিচ্ছ একে একে সব...

বশীভূত আগুন, শেষ তুরুপের তাস, ঐশ্বরিক সব ক্ষমতাও

আমাদের বন্ধুদের সবার অলক্ষ্যে সন্ধে নামছে

আলোর বমি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে মাটির খিদে, প্রজাপতির দল

মায়াবী তূণ লুকিয়ে অদূরে অপেক্ষা করছে জাদুজানলা

যে জানলার সামনে একদিন ঘরে ফেরার পথ হারিয়ে ফেলেছি আমি

আজ সেই জানলার সামনে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন হারিয়ে কাঁদছে অভি,

আত্মহত্যা ভুলে পাখির আকাশরক্ত মুছে আয়না

তবু সন্ধে নামছে হেমলক বন জুড়ে

ডানাপোড়া গন্ধের মতো...

গোপন মন্ত্রের মতো...

হারানো পথের মতোই...

আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছি অভিঐ পাখির আকাশ, আয়না― সবার শরীর ফুঁড়ে

ঝাঁকে ঝাঁকে আবারও উড়ে যাচ্ছে প্রজাপতির দল...

জাদুজানলা থেকে ভেসে আসছে বিষণ্ণ এসরাজের সুরধুলোর ব্যথা,

তোমার বিজয়ের কাহিনী, লেখা এ কবিতা...

 

#

সন্ধে নামছে...

আর এভাবেই তুমি কেড়ে নিচ্ছ একে একে সব...

সব...


২. ভলক্যানো


আকাশ মেঘলা, মনখারাপ করে শুয়ে আছে নদী

একটা সারস উড়ে এসে বসে ঠোঁটে এক অদ্ভুত আলো নিয়ে

অন্ধকার তা দ্যাখে, দ্যাখে সন্ধেমণি ফুল, মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবও...

কিন্তু কেউ সেই আলো ছুঁতে পারে না

শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দ্যাখে তুমি কী নিপুণতায়

ওই আলো নিয়ে মেখে নাও তোমার সারা শরীরে

আর তারপর...

তারপর ঠোঁটে করে সমস্ত মনকেমনমেঘরঙা ইচ্ছে

আর সম্রাটের জন্মান্তর নিয়ে উড়ে যাও কোনো এক

ভলক্যানোর দেশে...

আমার সমস্ত ফেরা মিথ্যে হয়ে যায়

দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখি আকাশ মেঘলা,

মনখারাপ করে শুয়ে আছে চোখ হারানো একটা সারস...

 

৩. সম্মোহন


মাঝেমাঝে খুব অভিমান হয় তোমার যখন একটা রোদেলা সকাল তোমায় বারবার লুকোচুরি খেলায় হারিয়ে দ্যায় আর প্রথাগতভাবে তোমার পৃথিবীকে দু'-তিনটে পলাশ বানিয়ে পিছন ফিরে মুচকি হেসে চলে যায় উদ্ধত সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো... তুমি কাফের! কাফের! বলতে বলতে ছুটে যাও প্রাচীন জলাশয়ের কাছে যেখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে একটা অসমাপ্ত যুদ্ধএকটা মনখারাপের বিকেল... তুমি জলাশয়ে ঝুঁকে পড়ো নিজের মুখ দেখার জন্য, দেখতে পাও না...তার বদলে দেখতে পাও সাম্যবাদের সবুজ রঙমুখ থুবড়ে পড়া একটা অন্ধ পাখির সঙ্গম...তাই দেখে পথ ভুল করে ফ্যালে সমস্ত শিকার, সমস্ত আততায়ী... তোমার আরও মনখারাপ হয়ে যায়... তোমাকে টার্গেটে রেখে কাঁধে ন্যাপস্যাক ঝুলিয়ে অদূরে অপেক্ষা করেন মানুষবেশী ঈশ্বর। পথের সাথে মিশে থাকা লাল, নীল, সবুজ-সব রঙেরও অভিমান হয়ওরা জলাশয়ের দিকে এগিয়ে যেতে চায় শব্দ ছুঁড়ে দিতে... ছুঁড়ে দিতে সঙ্গমলোভী সব যুদ্ধদেরও... তোমার সব গুলিয়ে যায়... তুমি আবার শুন্য থেকে শুরু করতে চাও... শুরু করতে চাও পানিপথের প্রথম যুদ্ধ থেকে...আর ঠিক তখনই কাফের! কাফের! বলতে বলতে ছুটে আসেন অদূরে অপেক্ষা করা মানুষবেশী ঈশ্বর... আবারও তোমার সবকিছু গুলিয়ে যায়... চোখের দৃষ্টি ব্লার হয়ে যায়। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ইসকাবনের গোলামবিবি, সাহেবের কর্পোল অস্থিরতা... তুমি ভয়ে চোখ বুঁজে ফেলো... মনে মনে ভাবো এবারও যুদ্ধ জেতা হল না তোমার... আবারও অভিমান হল তোমার... নিয়ন আলোর রাত তোমায় আরো একবার লুকোচুরি খেলায় হারিয়ে দিল আর তোমার গোলামবিবি, সাহেবদের অভিমানের বাংলা ভাষা বানিয়ে পিছন ফিরে মুচকি হেসে চলে গ্যালো উদ্ধত মোঘল সম্রাট বাবরের মতো... তোমার বুঝি এখন কান্না পাচ্ছে খুব?...

 

৪. জেরোফাইট


আর এভাবেই অবহেলায় কাটছে বিকেলগুলো

একটা কাঁটাগাছ ভিজে যাচ্ছে...

শুধু কিছু চেরা  জিভ লকলক করা সাপ শুধু দেখছে

কিভাবে তাদের মুখের শিকার আলো হয়ে ফুটে থাকছে রাজপথের শিরা-উপশিরা জুড়ে

অদূরে গাছের ডালে বসা পাখিটিও রঙ ভুল করে

মুখ থুবড়ে পড়ছে ওই তীব্র আলোর সামনে

আর এভাবেই এসব দৃশ্য ঢুকে পড়ছে কবির

কার্নিশ,দেওয়ালঅটোবায়োগ্ৰাফি জুড়ে

যেখানে অবহেলায় কাটছে বিকেলগুলো...

আর একটা কাঁটাগাছ ভিজে যাচ্ছে অনবরত...

 

 

৫. ডুয়ার্স

 

এখানে এখন আকাশের রং হলুদ

ঝালং-এর বিন্দু নদীর তীরে সেই কোন সকাল থেকে বসে

তুমি বুঝে নিচ্ছ জলের ওঠা-পড়ার শব্দ

জলস্রোতের সাথে পাথরের গোপন সন্ধি...

#

এখানে এখন গাছেদের রং লাল

রকস্ আইল্যান্ডের এই লাল পাইন, রডোডেনড্রন-এর

মধ্যে বসে লাঞ্চ করতে করতে তুমি একবারমাত্র

মুখ তুললে... দেখলে আশ্চর্য ভাবেই একটা পাহাড়ী পথ এসে মিশল

তোমার আঁচলে, আর তুমি মুচকি হেসে আঁচলটা গুটিয়ে নিলে...

#

হোটেলে ফেরার পথে গরুমারা অভয়ারণ্য যেখানে

আমাদের গাড়ির আওয়াজে ভয় পেয়ে ছুটে যাওয়া

বাইসন, হাতি, হরিণের পেছন পেছন তুমিও ঢুকে গেলে জঙ্গলে

তোমার পেছন পেছন পুরো দার্জিলিং শহর, টি-গার্ডেন, মেসোজোয়িক এরা, রিচার্ড অ্যাভেডন...

আর আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম তখন

অভিমানের রঙ কালো

ঠিক গতরাতের ট্রাইবাল ডান্স আর বোনফায়ারের

আগুনের ডগার মতো...

হোটেলের পাশের মূর্তি নদীর চাঁদভাঙা শান্ত জলের মতো...

#

দূরে... অনেকটা দূরে নীচুস্বর এ হুঁইশেল দিয়ে

নিউ মাল স্টেশন ছেড়ে যায় কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস...

#

আর টুপি হাতে ডিরেক্টর সামসিং-এর কুয়াশাবৃত পথে

তখনও একা দাঁড়িয়ে... একা...

শীর্ষা, ১৪

শীর্ষা’র কবিতা


অণু-পরমাণুর কবিতা

 

নূপুর

সামান্য ধাতুর কাছে যাবজ্জীবন বাঁধা

থাকছে গতি

 

গতি

সন্তানের হাসিটি ঢুকে পড়ল

মায়ের ঠোঁটে

 

ঠোঁট

অন্ধকারের জানালায় বাসা বানাচ্ছে

দুটি পাখি

 

পাখি

চিলতে আকাশের বুকে গড়ে উঠল

পালকের স্বপ্ন-শহর

 

শহর

নিজস্ব আস্তিনে লেগে থাকা বাসি

লিপস্টিকের দাগ

 

দাগ

একটি বক্ররেখা প্রেতাত্মা সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে

ঘুমের ভেতর

 

ঘুম

অবিশ্বাস্য কবিরাজি গাছ মায়ের স্বরযন্ত্রে

বসত বানিয়েছে

 

বসত

ইঁটের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে ফুচকা এবং আলুর

অবৈধ আলাপ

 

আলাপ

ফেরিওলা চুরি করে নিয়ে গেল দ্বিপ্রাহরিক

আরামের ঋতু

 

ঋতু

রোগ এবং শরীর সঙ্গমে লিপ্ত একজোড়া

কোকিলের চোখ