লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Saturday, October 17, 2020

দেবীপ্রসাদ বটব্যাল, দশম সংখ্যা

দেবীপ্রসাদ বটব্যাল-এর কবিতা


য়রামাছ

 

১.

একটি পেন ড্রাইভ

একঘন্টা

তারপর রোদ বৃষ্টি

এবং

 

এ সব চলতে চলতেই

ধুলো উড়ে যায়

 

২.

একটি গাছ, আর একটি ফল

ব্ল্যাকবোর্ডে এঁকে

স্যার ডাস্টার হাতে

আর

 

কোনাকুনি বেঞ্চে

আমার হেলে পড়া মাথায়

বাবার মতো একফালি

রোদ

 

৩.

শুধু মা জানত

শেষ গরাস খেয়ে নিলে

গা'য়ে লাগে

 

যদিও মা কখনো মিথ্যে ইলিশের গল্প

বলেনি

 

মা'র শেষ

ইনহেলার কত দামি

আমার জানা হয়ে ওঠেনি

 

৪.

সবজি বিক্রেতা আর

রবীন্দ্রনাথ

পুষ্টিকর, যোগান

খাওয়া আর গেলার মধ্যে

 

আমি

ফালতু তফাত খুঁজে মরি

 

৫.

আমি নিজেও প্লাটফর্মের

সিঁড়ির মতোন

 

দৌড়ে ফুটব্রিজে উঠে

দৌড়ে নামা

 

পড়ে থাকা পাগলটাই কেবল

আজ পর্যন্ত

ভাগলপুরের ট্রেনের খবর শোনেনি

 

৬.

মা'কে দেখলেই আমার একটা

দেশের কথা মনে পড়ত

 

ধানজমি, কলমিশাক,

আলপথ দিয়ে

 

ঐ যে আকাশটা হেঁটে যাচ্ছে,

ঠিকানাটা

ভরা থোড় খুলে শিশিরভেজা

 

আমি জানি ওখানেই কোথাও

একদিন খুঁজে পাব খয়রামাছ

 

৭.

বাবার সঙ্গে মিল খুঁজতে খুঁজতেই

সাইকেলের ঘন্টি

 

এ পর্যন্ত চাকাদুটো যতদূর গড়িয়েছে

সংসার এবং ধুলো

 

বাবার সঙ্গে মিল খুঁজতে খুঁজতেই

আমার এখনো একটা

রুমাল কেনা হয়নি

 

৮.

যেভাবে মুখগুলো এঁটে বসে

বাতাস সেভাবে ছড়ানো

 

অথচ ঘরের কার্নিসে টিকটিকির

উপদ্রব সত্বেও

 

আমি কেমন তেলাপোকার মতো

নির্ভিক

 

৯.

সিলিংফ্যান আর দড়ির মাঝে

শূন্যের সীমা

শূন্য নিজেও জানে না

সীমাবদ্ধতায়

 

সে আসলে

জীবনের ব্রেকিং নিউজ

 

১০.

ভেবো না। আর কিছুদিনের মধ্যেই

10G আবিষ্কার হয়ে যাবে

 

আমিও পুরনো সব খিস্তি

ফিরে পাব

 

ইচ্ছে হলে তুমিও

স্টেশনে চলমান দুই এস্কিলেটর থামিয়ে

 

শুনতে পারো

পুরনো গজল

Sunday, October 11, 2020

সোহম চক্রবর্তী, নবম সংখ্যা

সোহম চক্রবর্তীর কবিতা

 

দ্বিধা

 

ছোট্ট ছোট্ট কথা

তা-ই যদি ব’লে ফেলি, তারা

বড়ো হ’য়ে দানবের মতো

ঢুকে পড়বে মাঝখানে।

 

আর যদি না-ব’লি ভাবি, থাক্

তবে সে-কথার শূন্য পাতায়

শিরশির ব’য়ে যাবে হাওয়া,

 

কুলকুল ব’য়ে যাবে নদী...

 

এহেন নিশ্চিত তবু

কেন হে বিষাদ তুমি আমাকে ভাবাও?

 

চিঠি

 

হয়তো কোনো দূর বয়সের থেকে

যাচ্ছে উড়ে হাওয়ায় কোনো খাম...

কার চিঠি যে কার কাছেতে গেল;

কার যে তাতে রইল লেখা নাম,

 

সেসব হিসেব হারানো কোন্ খাতার

পিছন পাতায় বিরহী সৈনিক

আজন্মকাল তেমনি জেগে থাকে

তোমার চোখে ঘুম এসে যায় ঠিক।

 

তেমনি কোনো ঘুমের ভিতর আমি

লিখছি চিঠি, ছিঁড়ে ফেলছি ফের

এরচে’ বেশি সাধ্য ছিল না তো

কোনোকালেই ব্যর্থ প্রেমিকের!

 

সেই যে বয়স সাঁতরে উঠে আসি,

সেই যে বয়স শিউরে ওঠে গা-য়

আমার চিঠি পৌঁছবে না জানি

কোনোকালেই তোমার ঠিকানায়...

 

স্মৃতি

 

স্বর্ণযুগের বাংলা গান

নব্বই দশকের গলায় চেপে

ভেসে বেড়াচ্ছে সারাটা প্যান্ডেল...

 

এই দৃশ্যে মফস্বলের পুজো ও কৈশোর

স্থির হ’য়ে আছে।

 

যেন স্থির দূরের বয়সে

মনে পড়ে চোখদু’টি সলজ্জ, করুণ

 

‘যার চোখ তাকে আর মনে পড়ে না’।

অন্তর চক্রবর্তী, নবম সংখ্যা

অন্তর চক্রবর্তীর মুক্তগদ্য

 

ছায়া থেকে বলছি

————————————

 

এ গ্রামে কস্মিনকালেও কেউ কবিতা লেখেনি। তবে একজন ছিল বটে। কবিতার মতো এক নীল সাইকেলে চষত এলাকাটা। পরনে ইঁট রঙের ঢিলেঢালা ফ্যাকাশে পাঞ্জাবি। খুঁটে কিছু চকমকি ও উল্কার টুকরো। কিছু শ্বেতপাথর ও কাচ। রাংতায় মুড়ে এগুলো বিলি করত আট থেকে আশি সব্বাইকে। কিছুদূর সাইকেল এগোলেই তার মনে হতএরা জ্যোৎস্না চেনেনি। রোদ চেনেনি। আগুন চেনেনি। চেনেনি আয়না ও জল। বাকিগুলো না চিনলেও খুব একটা সমস্যা ছিল না। কিন্তু জল ছিল তার বেশিই কাছের। চাইত, চিনতে ও চেনাতে, একখণ্ড আনকোরা ও অজানা সাঁতার। জলের চেয়ে ভালো বন্ধু আর হয় না, এই তরজমা সে আয়ত্ত করেছে এতকাল। প্রলাপ নয়, প্রবাদের গতেই। তবে বর্ষীয়ান অরণ্যের নয়। আজন্ম যাপনপ্রধান ও জ্বলন্ত। তাই দৈনন্দিন টহলের পর তাকে বসতে দেখা যেত গ্রামেরই এক টলমলে পুকুরের কাছে।

 

শোনা যায়, এই ছেলেটির ঈশ্বরে মতিগতি ছিল না। গ্রামের এই পুকুর ছিল তার ঠাঁই, বিশ্বাস। তুলসীবেদীর মতো মেঠো। মা'র হাতপাখার মতো সহজিয়া। তা'বলে সে যে মহাসমুদ্রের নেশায় পড়েনি, তা ভাবা ভুল। বারকয়েক সাগরজলের থাপ্পড় ও নুনের ছিটে নেওয়ার পরে ফিরে এসেছিল। জলকে তো এভাবে চায়নি সে। আদর খোঁজার ফুরসতই পেল না সেভাবে। যেটুকু পেল, শুধুই মায়া ও জ্বর। অগত্যা এই পুকুর। জ্বরের ওপর শ্যাওলাজড়ানো ঠোঁটের আদুরে জলপটি। তা মাখতে মাখতে সে শুধুই চেয়ে থাকত ভিজে সিঁড়িগুলোয়। ঢেউ ঠেলে যদি মুক্তো উঠে আসে? কিন্ত তা হয়নি। উঁকি দিত সামান্য গেঁড়ি, গুগলি, কিছু বন্ধ্যা ঝিনুক। এমন কয়েকদিন চেয়ে থাকতে থাকতে, আর পারল না সে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। নামল, শ্যামলা ছায়াপট ছারখার করে। গভীরে, আরও গভীরে। এদিকে ঝিনুক, গেঁড়ি, গুগলিরা উঠে এল। নিমেষেই সেই খবর পৌঁছে দিল পল্লী থেকে গঞ্জ। ছুটে এল গ্রাম। ছুটে এল সেই চকমকি, কাচ, শ্বেতপাথর, টুকরো উল্কারা। কিন্তু ততক্ষণে....

 

এ গ্রাম এখন কবিতার।

 

উঠে আসা ঝিনুকগুলোয় মুক্তো ছিল কিনা, সে খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে পুকুরটি বদলায়নি। রোজ বিকেলে কবিরা তাতে পা ডুবিয়ে রাখতে ভোলেন না। কবিতাপাঠ চলে। চলে জ্যোৎস্নার উদযাপন। রোদ, আগুন, জল বা আয়নার সমোচ্চারণ। আর এক দৈত্য নাকি নীরবে আগলে রাখছে সেই পুকুর ও কবিদের।

 

তারা সেই দানবেরই উপাসক। যদিও তাদের কাছে সে এই মায়াসরোবর ঘিরে রাখা এক যুগন্ধর বট।

 

কবিকুল যে বৃক্ষের পূজারী, সে দৈত্যাকার হলেও ঈশ্বরস্থানীয়। তবে আগাগোড়া নাস্তিক, আগের মতোই। অতলান্তে বিশ্বাসী। আগন্তুক। ছটফটে। স্নেহপ্রবণ। চিরায়ত।

 

চিরাচরিত....

 

ভাঙা জানালা থেকে বলছি

————————————————

 

আমার জানালারা তন্দ্রা, ক্লান্তি বা উপশমের ফারাক আয়ত্ত করেনি এতদিন। ঘুমের কাঁধে ভাত না শীত বসবে, সেসবও না। এই যেমন আমি, এই গরম দুপুরে জাঁকিয়ে বিছানাকে একটা লম্বা চুমু খাচ্ছি, তখনই ওরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ছে পায়ের ঠিক নীচে। একটা ডাঁই করা দুর্ভেদ্য ঢিবি। পরিত্যক্ত, সোঁদা। সাধারণ। বাইরে দেশলাই, কাগজ, ভাঙা গ্লাস। জ্বরের মতো। আর ভেতরটা নিটোল। চাঁদের অনুসারী। হিমেল। কোনো দেশ নয়। ধরা যাক, একটা ছোটোখাটো মফস্বল। আড়াল-আবডালের গন্ধ নেই। কেবল বিস্তারের শ্বাস ও নির্যাস। তা জুড়ে মাথা নীচু করে হেঁটে বেড়াচ্ছে প্রচুর জবুথবু পাথর। কাছে এগোতেই বোঝা যায়, শুধু পাথর নয়। পিঠে পাথর-বওয়া একসারি ছাইমাখা কচ্ছপ, যাদের পড়িমরি করে রাজপথ শোঁকার গ্যাদগেদে মগজহীন অভিজ্ঞতা নেই। হাসিমুখে এ-ওর দিকে তাকিয়ে তা জড়ো করছে পাশে পড়ে থাকা তাদেরই এক স্বজাতির শবদেহে। এ কী তবে কচ্ছপেরই রাজ্যপাট? ভাবতে না ভাবতেই পাথুরে স্তূপটি আর দেখা যায় না। সেখানে চকিতেই গজিয়েছে এক পরিপাটি আশ্রম। গুল্মের ঘন সমারোহ। আরোপ নেই। ছাদ আগলে শামিয়ানার মতো ঝিরঝির, টুপটাপ। ফটকের কাছে পা ফেললে বোঝা যায়, তা আপাদমস্তক মেঠো, ছাপোষা, মিঠে। নিরাভরণ। তবে গয়নার ঢঙে লেগে আছে ঘেঁটুফুল, জবা ও ক'লাইন সুখপাঠ্য শ্লোক। উঠোনের মাঝে লালচে গেরুয়া আঁচে সমুজ্জ্বল সাগ্নিক। অক্লান্ত। সামনে পরমায়ু অতিক্রান্ত এক ঘেমেনেয়ে ওঠা যাজ্ঞবল্ক্য। অশ্বত্থের অবয়বে। সুউচ্চ, উচ্চাঙ্গ। প্রবুদ্ধ। সম্বুদ্ধও। যাঁর কাছে মনোযোগ রপ্ত করে একে একে ফিরে যাচ্ছে কিছু শামুক ও পিঁপড়ে। প্রণামির ধাঁচে পায়ের মিহি আওয়াজ রেখে যাচ্ছে অশ্বত্থের শিকড়ে হেলান দেওয়া অগ্রজা এসরাজে। অভিভাবক কাছিমদের এসে শোনাচ্ছে, কতটা ঝলমলে আর সুশ্রাব্য সেই পাঠক্রম।

 

ঠিক এইসময়ে বিছানার ভরাট বুক থেকে আমার ঠোঁট সরে যায়। চুল ধরে টেনে তোলে সম্বিৎ। নিমেষেই কাছিমেরা কর্পোরেট হয়ে পড়ে। অশ্বত্থ হয়ে ওঠে ধোপদুরস্ত তুঙ্গনির্মাণ। গুল্মেরা ঝনঝনে মুদ্রার শেকল। উঠোন আবডাল। আর সেই তাপসোদ্যান হয়ে পড়ে একটা চাতুরীমুখর কন্ট্রোলরুম। শামুক ও পিঁপড়ের পিঠে মুহূর্তে আছড়ে পড়ে নাটুকে প্রতিষ্ঠান-তকমা। আগুনের ছলে কালোপানা বিষমুখো চিমনি ফেরি করে পসার জমাতে শুরু করে একদল তোতার রদ্দি নেমসেক।

 

প্রস্থান, শুনতে পাচ্ছ? আমার জানালাগুলো বড্ড নিরীহ। ছেলেমানুষ। কোনো ছটফটে, বাউন্ডুলে ঘর দিয়ো না ওদের। দিয়ো না কোনো অগোছালো, উচ্চিংড়ে আঁতুড়। ফুলে ঢাকা আশ্রম দিয়ো। একটা কচ্ছপজন্ম দিয়ো। শান্ত, ঠাণ্ডা। যাতে ওরা চষে নেয় বিস্তারের রেশ, স্নিগ্ধ শ্রম। যেন খুঁজে নেয় শামুক ও পিঁপড়ের লালনশৈলী।

 

যেন দেখে যেতে পারে তেপান্তরের তথাগত আবির্ভাব। গুল্মেরও। আগুনেরও। অশ্বত্থ, দেবদারু বা তপোবনের সুরেলা জন্মান্তর...

 

লাইটহাউস থেকে বলছি

————————————----

 

ধোঁয়াশার রমরমা ভাঙল ব'লে। ঝিমোনো বালিদের চোখে যে বিন্দুতে এসে এই সাবেকি জলযান ফুটে ওঠে, তাকে কখনোই কোনো স্থাণু বা সন্ধিক্ষণ মনে হয়নি। ভোর বা গোধূলি নয়, একটুকরো নিছক দুপুর, যে এতক্ষণ নির্জলা ছিল। আলো সবেমাত্র উপোস ভেঙেছে। এই হয়তো সেই ছটফটে ক্যানভাসসুলভ মধ্যগগন, যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে দুর্বোধ্য হোমাপাখি উড়েছে এতকাল। জ্ঞানবৃক্ষফল ঠোঁটে নিয়ে। ফিনিক্স বংশোদ্ভূত নয় তারা, তা জেনেও। মুছে গ্যাছে একে একে সন্ততিসহ, আর গঞ্জে মুচমুচে উপকথা হয়ে সেঁটে আছে ওদের না-পারার খতিয়ান। আঠাভর্তি গাদাগুচ্ছের বেনোজল। যেমন আমাদের না-লেখারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই মহাসমুদ্রে। দুরূহ হিমশৈল হয়ে। রাডারের নির্দেশে শুধু জাহাজ ঠেলে গেছি আমরা। তাদের ছাড়িয়ে গেছি, সজ্ঞানে বা অজান্তে। যদিও ছাপিয়ে যেতে পারিনি এতদিন। ঝলমলে বেলুনভ্রান্তিতে যা অনায়াসে আঁকড়ে ধরেছি, তা আসলে লোহায় ধাক্কা লেগে উঠে আসা অলীক বুদ্বুদ। অলৌকিকও বটে। একটু পরেই সাবলীল ভেঁপুতে মিশে যাবে। তা জেনেও তাকে বেঁধে ফেলছি ক্ষণস্থায়ী নারীপ্রবণ ব্যালাডে। নাম রেখেছি 'চিরন্তনী'। মায়াবী, তবে পিশাচসিদ্ধা নয়। যাকে একটু পরেই তড়িঘড়ি খুবলে নেবে হাঙর, নাবিক ও প্রবালের প্রেত। মরসুমী সংকেত ও সম্প্রচারে মুহূর্তে ঢুলে আসবে সেই আর্তি। বাতাস দুলবে। আমরা চোখ তুলে পরের বুদ্বুদে হাত রাখব ফের। এটুকুই বোধগম্য। বাকিটা হয়তো ব্যতিক্রম বা বিভ্রম। আলেয়াসংলগ্ন। ঘোলাটে। তরঙ্গজনিত।

 

বন্দরপোশাকে কিছু একটা স্পষ্ট হচ্ছে এবার। ভাসছে লেনদেনের আওয়াজ। স্পষ্ট থেকে প্রকট। জনান্তিকে আমাদের অপেক্ষায় একরাশ ঝাপটানো ধবধবে উচ্ছ্বাস। অভিপ্রেত পায়রা তো নয়ই। না হোমাপাখি, না ফিনিক্স। সুমেরু পরিব্রাজকের পাঠানো বিরল কাকাতুয়া। আশাতীত, তবে ভাষাতীত নয়। এক যুবক হাওয়াদূত।

 

শুধু কুহকই ধ্রুব। সুবিস্তীর্ণ। অসীম। আমরা যা হতে চেয়েছি প্রতিটি পৃথিবীকণায়। এক-একটা সমুদ্র নিংড়ে। আর শীতার্ত আঙুল থেকে নিঁখুত আদলে খসে পড়েছে বরফের থমথমে রোয়াব।

 

অভিযান বা ভ্রমণ নয়। কেবল কুহকই অপার। অনর্গল...

সায়ন্তনী হোড়, নবম সংখ্যা

সায়ন্তনী হোড়-এর কবিতা

 

সম্পর্কের ঋতুকথা

 

       

 

ব্যস্ততা পেরিয়ে সন্ধ্যা মিলিয়ে যাচ্ছে

জোনাকিদের আঁতুড়ঘরে

অথচ রোদ্দুর খুঁড়লে এখনও সম্পর্কের

মাইথোলজি পাওয়া যায়

 

        

 

সিঁড়ির পাশে লেপ্টে আছে আলোকরশ্মির ক্ষত

দূরত্বের অক্ষরেখা দৃঢ় হচ্ছে

ক্র

 শীর্ণ গাছেদের কথোপকথনে

ফুলের আত্মকথা ধ্বনিত হচ্ছে বারবার

 

             

আবেগ উড়িয়ে দিয়ে কথারা হেঁটে চলেছে মরুভূমির পথে

রাস্তার সেলাই খুলে খুলে আসছে

বি

তি

দিশাহীন কাঁকরের জন্ম হচ্ছে প্রতিনিয়ত

 

          

চিঠির ঠিকানা বদলে যাওয়ার আগে

অভিমানের জ্বরে আক্রান্ত শরীর

ম্মো

ধোঁয়া ওঠা আকাশের নীচে

তখন বিভক্ত হচ্ছে নগ্নতার অভিধান

 

        

মীন ও মিথুনের বৈপরীত্যে জ্বলে ওঠে সংসার

পোড়া পোড়া পালকের মতো

নামহীন সম্পর্কের অস্তিত্ব ভেসে আসছে

 

খোলা ছাদের কার্নিশ ঋণী হতে থাকে

সিগারেটের ধসূরতার কাছে...

 

                                    

সিদ্ধার্থ দাস, নবম সংখ্যা

সিদ্ধার্থ দাস-এর কবিতা

 

দেবী পক্ষ    

 

চরণ ধোয়া জল

বিলাসবহুল দরবার।

ওত পেতে আছে সিংহাসন।

 

দেবলোক দুষ্টু টিপ কপালে

পাগল চারণ সরু গ্রামের গলি।

শহরতলা ফিরে গুলঞ্চ ভাদ্র

সুন্দরী, প্রেমে পড়ার বিষয়!

 

ধান দুব্যো মাথা ঠেকিয়ে আশীর্বাদ।

দুর্যোগ তোমার বাড়ি মাড়ায়নি

কাঞ্চনকন্যা সবক শিখে প্রেম দস্তুর বরবাদ।

 

অতি কাঁচা হাত কাটে ব্লেড

পেন্সিলে ফুটকি লিখছিল।

কবির বিপরীত কবিতা বোঝে দূরহি।

 

মন্বন্তরে মুখ পুড়িয়েছে যীশু।

মেরী গজে গমন। ফল শষ্যপূর্ণা বসুন্ধরা।

 

বৃথা চেষ্টা ভাই

 

বলি হে দেবেন্দ্র, তোমার পড়াশোনা যদ্দুর জানি

বোগেনভিলিয়া প্রবেশদ্বার।

যেভাবে খিচুড়ি স্কুলে রঙ চিনতে শেখায় দিদিমণি,

স্পষ্ট দেখতে চাই পাওনা ডিম সেদ্দ মাসকাবার।

 

আদতে ভাষা খুঁজছি স্কুলছুট সহজপাঠ

গীতবিতান হারিয়ে যায় স্রোতে।

অফিসপাড়ায় সহকর্মী বন্ধু নিত্যনতুন গবেষণা।

শিশুশ্রমিক গেঞ্জি কাপড় মোছা লালারস।

কৃষ্ণচূড়া পলাশ হতে পারেনি। তবে আসক্ত ঘুরপাক চেতনা।

 

কপালে প্রাইভেট টিউশন বিরহ গৃহী।

এ জীবনে খেদ নয়, তৃষ্ণা নিয়ে ডাকছে মহর্ষি।

সল্টলেক লবনহ্রদ ছিল কোনো এক করুণাময়ী।

 

দিনমজুরের ঘুড়ি

 

গল্পের নিজস্ব সত্তা আছে তাকে শেষ করা যায় নিমেষে। 

কবিতার অর্ধেক উদ্ধার হল আজও, ময়নাতদন্ত চলছে।

ফলিডল শিশি কে সরিয়েছে? নেতাজি অন্তর্ধান

 

মান্যবর, মুনিষ খাটো করার দৈত্য দেখেছি। ভয়ে তটস্থ বেলতলা।

দুপুরে নড়েনি পাতা, ছায়া সুরে এপাশ ওপাশ মগজ ধোলাই।

 

সিন্ধুকে দলিল রেখে প্রসাদী কারবার। অঘটন ডাকাত পড়লে,

ঘোড়ার পিঠে রাজকুমারী চলে ভিনদেশ,

সেখানকার রাজকুমার সুঠাম পয়মন্ত।

 

পিঙ্গল ঘোড়ায় রাজার হিতৈষী, ছড়া কেটে কিস্তিমাত!

যেন রাজকুমারীর আগে পৌঁছাতে পারে বিচারসভায়।

যেন বলা যায়, এ মেয়ে তো আপনার, গ্রামের ঝিউড়ি

আস্ত রাক্ষস রাজা মা'য়ের অভাব চিরকালীন,

পুত্রবধু নয় কন্যা অমাবস্যায়। মেঘ গুমোট বাড়িয়েছে

রাজ দরবারে সেটা প্রাসঙ্গিক কালবিলম্ব প্রয়াস!

 

যে কোনো কবিতা রাজার কন্যা ফিরে পাওয়া টুকরো গল্প।

শাড়ির ম্যাচিং কানের দুল। শ্রাবণ ইনবক্সে রিনিঝিনি..

রাজস্ব ফাঁকি দিলে পেয়াদা ঠেঙানি, তথৈবচ।

আলিউজ্জামান, নবম সংখ্যা

আলিউজ্জামান-এর কবিতা

রাজহংসী, তোমাকে

 

(১)

এসব তোমাকে বোঝানো সহজ না,

কাছাকাছি এলে সকল বৃত্তই বিন্দু হয়ে যায়।

এতদূর থেকে বোঝায় যায় না জন্মের টানেই বৃষ্টি পড়ে...

পাহাড়ি ফাটল চুইয়ে খুব সাবধানে টপকায় পাঁচিল।

 

সিলিং ফ্যানের নীচে শুয়ে আছে অশ্লীলতা।

দেখি,

এখানে তোমার মতো কেউ না!

 

 

(২)

তোমার কথা মনে পড়লে

শান্ত নদীর বুকে জাগে সাপের ভাষা।

মাছ-মাছালি, পাখ-পাখালি ,

যেন বিস্ফোরণের পর বহুগামী বারুদ।

 

 

(৩)

খাবার ও খিদের মধ্যিখানে সাঁকো ডুবে আছে।

ভাঙাচোরা, রংচটা অস্তিত্ব তোমার ওগো...

মাঠে হারানো পিংপং বল!

আমি ব্যাডমিন্টন খেলি মাঝে-সাঁঝে।

 

 

(৪)

একতারা বিহীন লোকধর্মের মতো

রাতের জমানো কফ সকালে বুক বাজিয়ে যায়।

তোমাকে ফেলে পাঁচিলতোলা এনট্রপি,

সকালের কেটলি বাতাসে ভাসিয়ে দেয়

 

আবহাওয়ার পূর্বাভাস।

জলীয়বাষ্প সঠিক জমাট বাধলে।

আজ আকাশ সর্বত্র মেঘলা থাকবে।

 

(৫)

ভিখারির অন্ধচোখে তোমার কাছে ফেরা।

থালায় পয়সা বাজিয়ে বাজিয়ে,

এই গান গেয়ে চলে যাওয়া।


যেন পিঁপড়েদের সমাজতন্ত্র চলে গেছে পঞ্চায়েতে।

 

এবার দেখা যাক!

স্বাদহীনতায় শিশুরা ফেরে কিনা স্তনের দিকে।

 

(৬)

কাটলেই বড়ো হয় পুকুর।

এরকমই জটিল প্রশ্নের সহজ উত্তর তুমি।

 ছায়া ভেসে আছে, শুধু তুমি ডুবে গেছো শরীর।

 

(৭)

তোমাকে জমিয়েছি মাটির ভাঁড়ের ভেতর।

ফুরিয়ে যাবে বলে কখনও বের করিনি।

 

তবু, ছেলেবেলার অন্যমনস্ক হাত থেকে খসে

গিয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ মাটি বেজে উঠে মেঝের উপর।

তুমি কি টের পাও?

রাস্তা ভাসিয়ে এখন বর্ষার জল চলে যাচ্ছে

 

ওই নদীটির দিকে...