লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Saturday, September 12, 2020

জয়ীতা ব্যানার্জী

জয়ীতা ব্যানার্জী’র কবিতা

 

ঘুড়ি রাত্রির কবিতা

 

সন্ধের আজানে আরও কিছুটা সময় বাকি

পানাপুকুরের হাঁস মনিবের ডাক শুনে

মেঠো পথ ধরেছে এখন

তোমার আসার কথা আজও সত্যি জেনে

মেঘের অনতিদূরে দ্রুতবেগ ঘুড়িগুলি দেখি

 

দেখি জোড় গাছটির পায়ে সকালের বাতাসা ছড়ানো

আর অপরাজিতার কুঁড়ি। মনে হয়

পৃথিবীর সব মায়া, ব্যর্থতা যেন এই এক গাঢ় নীলে

সফলতা ভ্রমে কেউ নৈবেদ্য সাজিয়ে দিয়ে গেছে

 

সারিবদ্ধ কীট আসে, তাকে ঘিরে অবেলায়

মাছি ওড়ে বিষাদের মতো

 

যেমন সকাল আর সরোদের মধ্যবর্তী এই

একফালি মোহ, সুখ বৃষ্টিকে অনিবার্য করেছে

তেমনই হাওয়ার রোখ, পাঁপড়ির কেঁপে ওঠা, আলো

আমাকে সে অদৃষ্টের কাছাকাছি আনে

 

যাকে দেখবার সাধ দূরতর পাখিটির স্বর

 

অথবা সফল সেই ঘুড়িটির মতো, যার

অনন্ত উড়ান দেখে নিচেই কোথাও তার মনিবের

গরিমা- আঁচ করা যায়

 

রাত্রি-কে 'নির্মোহ' নাম দিয়ে কারা চলে যায়

ওদের প্রেমিকা আছে। দিনের অন্তিম- আছে থালা ভরা ভাত

পথের কুকুরগুলি পরস্পরের থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে

এই মোহহীন রাতে চাঁদ দেখে

নক্ষত্রের মতো দানা শুকনো ভাতের। অতঃপর

তারা- ঘোলাটে চোখে মানুষের দলটির পিছু নেয়

 

যাত্রা এবং স্বর্গারোহণ যে এক-

ধর্ম সে কথাটুকু প্রকাশ্যে বলে না, শুধু

লেজ নেড়ে সম্মতি জানায়

রঞ্জন মৈত্র

রঞ্জন মৈত্র’র কবিতা

 

আঙুল ১


যে ঝলক খানিক পুড়িয়ে যায়

খানিক আলো অন্ধজনে

ব্রেইল অক্ষরে সূর্য চাঁদের যাওয়া আসা

দু'একটা হিউমার আর একটা দুটো শব্দমিথুন

তাকে প্রেমিক বললে ধাঁধায় পড়ি

কাকে ভালবাসে আমার আঙুল

ছুঁয়ে বোঝা দশ টাকার কয়েন

সে সূর্য নাকি চাঁদ

আমি তোমার পাশটুকু খুব মন দিয়ে চিনি

তুমি উত্তর তুমি নিরুত্তর কাছে বসে থাকি

চার জোড়া লাইন ও তাদের প্ল্যাটফর্ম

যত যাওয়া সবুজ ঝলকে

আসার অপেক্ষাও যতটা সবুজ

তোমার চশমাকাল ঢুকে পড়ে ডাউন লাইনে

আমার পাওয়ার নেই

প্লাস মাইনাস নেই

বসে আছি হে, ছুঁলেই তরঙ্গ হয়ে যাব

           

ছাদ


থাকার কথা ভাবলে বাড়িটি সাহায্য হয়ে ওঠে

একটি ভোরের মধ্যে স্থির হয়ে বসা

মানেময় পঙ্‌ক্তির সামনে আধো আলোর দেয়াল

হাত নাড়ো ছাদ নাড়ো

অন্ধকার দোমোহানীতে টেকনিক নয়

জলধ্বনি গড়ে তোলে নদীনাম

পথ পালটে ধুলোয় এসেছি

দূর আবাসন থেকে চলকে পড়ে আলো

ঝলসে ওঠে প্যানডেমিশিয়া

ইয়ে হাত মুঝে দে দে

নিরক্ষর রেখাগুলি ভালবেসে পড়ি

তাদের রক্তমাংস সমবেত আঙুল

মেঘলা বাড়িটি ডাকে

তার পরমাণুগুলি সোঁদা চব্বিশ পরগণা হয়ে যায়

 

এডিটেড চোখ

 

শরীরে থকথক করছে নীল কাদা

তুমি কি নদী

পাতায় উপচে পড়ছে অ্যাক্রিলিক গ্রিন

তুমি কি বনানী

হাতে এত আগুন ও রামদা

তুমি কি পাড়ার লোক

বুক করে বসে আছি

অ্যামাজনের জুতো

জোম্যাটোর বিরিয়ানি

কখন জল বন্ধ আলো অফ

আগুন জ্বলে উঠবে আর

রক্ত যার টুপ এখনও শুনিনি

ভাললাগার ঠিকঠাক অ্যাংগেল আছে

ধ্বসন্ত মকান বা সুচিত্রার মাটি

কাগজ দেখে মেঘ কালো বলা বাচিক পাখিটি

খুঁজেছিলাম চোখ

ভাবতাম বলব ওগো চোখ

ক্যামেরার পিছনে এত প্যাস্টেলের খালি বাক্স

এত দাঙ্গা ও কল্যাণ মণ্ডপম

পাড়াটি হারিয়ে যায়।

দেবার্ঘ সেন

দেবার্ঘ সেনের কবিতা

অঙ্গসংস্থানগত

 

ক)

বুকের প্রতিশব্দ কি কি একথা ভাবতে ভাবতে

বুকটাই কেঁপে উঠলো হঠাৎ...

ভারসাম্যহীনতায় দুহাত থেকে বই উল্টে যায় যেভাবে।

 

খ)

প্রতিস্থাপন চর্চা করতে করতে হাতের লক্ষ্মী পায়ে

ঠেলে দিয়ে একদিন যে হাত কামড়েছিল।

এখন তার হাত লম্বা হয়েছে এতোটাই

যে,

পৃথিবীই তার ব্যধি।

 

গ)

মুখ বুজে খেতে বসতে শিখে গেলে

1 : 1 অনুপাতে প্রয়োজনীয় খাবারকে ভাগ করে নেওয়া যায়।

অর্থাৎ সমবন্টনে খোটার সাথে

কীভাবে ভাত মেখে নিতে হয়, তা তুমি জেনে গ্যাছো।

 

ঘ)

মানুষের দ্বিপদ গমন দু’প্রকারের

এক ছেড়ে আসা/যাওয়া আর দুই ফিরে যাওয়া/আসা

শুধু এক আকাশ প্রশ্ন থাকে অভিমুখকে ঘিরে।

 

ঙ)

নিজেরই যেসব লেখায় যন্ত্রণার উল্লেখ পাই,

তার কাছে আগুন পাঠাই, এভাবেই ভোর হয়ে আসে।

চামড়া তুলে নেয় বারবনিতা।

ধুয়ে যায় বুক-হাত-মুখ-পা

বাইরে বৃষ্টি পড়ে...

Thursday, September 10, 2020

সন্দীপন দাস

 সন্দীপন দাসের তিনটি কবিতা

 

১.

ক্যাথারসিস

 

চোদ্দ প্রদীপের আলো ম্লান হয়ে যায়

যখন জীবন দ্যাখে যে নদী চেয়েছে সে তুমি নও

যখন না-পাওয়ার রং ফুটে ওঠে শিকড় ফুঁড়ে

যখন ক্লান্ত হাতে দিনান্তে মা ফিরে যান রান্নাঘরের ঝুলকালি হয়ে

যখন অনেক আকাশ, অনেক রঙিন মুখোশ পেরিয়ে

এক যাযাবর দাঁড়িয়ে থাকে এক আকাশের নিচে

ডিভাইস তখন খসিয়ে ফ্যালে সব একেশ্বরবাদ, সব দর্শনশাস্ত্র...

মুহূর্তে বোকা চোখে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকেন

ভিক্টোরিয়ান এরা'র সব পোয়েটস্‌রা

এভাবেই ভুল করে ফ্যালে দিগন্ত,সব বন্ধুরা, ঐ যাযাবর

 

চোদ্দ প্রদীপের আলো ম্লান হয়ে আসে

যখন তুমি দ্যাখো সোনার বিগ্ৰহ, পরমান্ন চেয়ে

পেয়েছ প্ল্যানচেটের আত্মা...

 

২.

ইদিপাস

 

সবকিছু জানতে নেই, সবকথা শুনতেও নেই

এই যে রাতবিরেত জেগে থেকে তুমি নিঃশপলক চোখে দেখছ

শতাব্দীর পর শতাব্দী সন্ধ্যাতারার নিপুণ অভিনয়

লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে ছুঁতে চাইছ আলোর শরীর, একাকিত্বের স্থাবর-অস্থাবর

তোমার লুকিয়ে রাখা ব্রক্ষ্মাস্ত্র কি জানে?

আমিও শরীরের গোপনে লুকিয়ে রাখি শেষ তুরুপের তাস

ভাবি, একদিন ওদের দু'জনের ঠিক দ্যাখা হবে

সব চুপকথা, বোবা অভিনয়ের ভিড় উপচে পড়বে বৃষ্টির বন্দিশ

ঠিক একদিন...

 

৩.

ওয়াচটাওয়ার

 

দেখি সন্ধেমণি ফুল শুয়ে আছে তোমার পাশে

তারও পাশে ঈশ্বর...

ফুরিয়ে আসা বিকেল অলিতে গলিতে মুখ লুকিয়ে কাঁদে

সন্ধের আড়ালে গোপনে জমিয়ে রেখে দ্যায়  অনেক আগুনরঙা ছুরি

তবু জল ছুঁয়ে দ্যাখেনি আহত আলো

শহরের অসুখ, দিগ্‌বিজয়ী ঘোড়ার লাশ, অনেক দ্বাদশী রাত

ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে সেও রেখে যায় পাতার খিদে, ধুলোর মৃত্যু...

 

হে প্রভু, আলোর দুনিয়ায় এভাবে না দাঁড়িয়ে দূর থেকে

সে আলোকে শিরায় শিরায় জাগানো ঢের ভালো...

ঢের...

কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়

কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়-এর কবিতা

গুহামন

১.

চাঁদের কাছে যাবো বলে টিকিট করেছিলাম

কিন্তু হঠাৎ-ই চাঁদ ভালোবাসা হারিয়ে ফেলায়

আমার সফর বাতিল হয়েছে

 

কোনও উজ্জ্বলতা কি আমার সহ্য হয় না

নাকি আমাকে সহ্য হয় না উজ্জ্বলতার

 

অথচ রোদ্রালোকিত সময়, চন্দ্রালোকিত সময়

আমাকে বিভোর করে

 

কীসের এত বিভাজন        বুঝি না

 

মন ও মান দুটিই খুব সূক্ষ্ম জানি

ভালোবাসা কি তার চেয়েও সূক্ষ্ম

 

২.

হাইওয়ে ধরে ছুটে যাওয়া মন

স্মৃতি কোনোদিন ভুলবে না

 

একটা জলজ নদী

আর তার গভীর নাব্যতায়

আজও রোদ চিক চিক করে

 

আমি জানি প্রেম মানে একটা শিশুকাল

 

সব কালে সব প্রেমের ভেতর

শিশুরাই লুকিয়ে থাকে

 

৩.

ও ভাবে ডেকো না আকাশ

ও ভাবে ডেকো না মাটি

 

আমি তো মানুষ

অস্থির হয়ে যাই

 

অলীক শূন্য আর গভীর বাধা

অনন্ত আলো আর ভীষণ আঁধার

সবকিছু সমান আজ আমার কাছে

 

বুকের ওপরে কার শ্বাস পড়ে

 

ও কি আমি না আমার পৃথিবী

 

উদাসী সময় একান্তে লিখে রাখছে ---

ফুলগুলি ফুটেছিল

ফুলগুলি ঝরে যাচ্ছে নিয়মেই

 

৪.

সীমাহীন আকাশ ছিল তার

অথচ ওইটুকু তো বুক

 

আজানের সুর আর সন্ধে শাঁখের আওয়াজ

বিভোর করে রাখতো সময়

 

অস্ফূট কথা তার, কাতর কথা

রাত্রি আর শিউলি ঝরিয়ে দিত

 

মেরুর টানে জানি গভীর চুম্বক

তার চেয়েও গভীর টানে নিবিড় পাখি

 

৫.

তবে কি নদীর অভিশাপ মিলে যাবে

তবে কি জলের অভিশাপ মিলে যাবে

ওগো দুঃখ বিলাসী জীবন

কালপুরুষের কাছে তুমি কি কিছুই শিখলে না

 

ঋতুতে ঋতুতে আকাশ অপরিবর্তনীয়

মেঘের আভাসটুকু নিয়ে বেঁচে থাকা দিন

কেবলই কল্পজগতের জন্ম দেয়

চাঁদ আসে, জ্যোৎস্না আসে

সদাগর নৌকা ভাসাই গভীর মনে

 

অসংখ্য বুদবুদ আর স্রোতের থেকে

যে অতীত উঠে আসে

তার সবটাই অভিশাপের প্রতিচ্ছবি

 

৬.

মানুষই মানুষকে সবেচেয়ে বেশি ব্যবহার করে

এবং কাজ শেষ হয়ে গেলে ছুড়ে ফেলে দেয়

 

মানুষই মানুষকে ভেলকি দেখায়, আয়না দেখায়

রঙিন বাক্সের সামনে বসিয়ে বলে

এই নাও তোমার সমুদ্র নদী সূর্য এবং চাঁদ

 

মানুষ মানুষের কাছে সব সময়ই বোকা

চালাকি বলে যে শব্দটি উঠে আসে

সেটা তার অন্তর্গত মন, মনের ব্যর্থ প্রকাশ

 

একটা স্বচ্ছ দরজার কাছে এসে মানুষ

খুলে ফেলে তার প্রকৃত চরিত্র

 

৭.

ভালোবাসা তাপ ও ওম ভেঙে গেছে বারবার

জলের কিনারে দাঁড়িয়ে জলের প্রতিশ্রুতি

সূর্যাস্ত আকাশ দেখছে আজ

 

ফল ও পল্লবে সুসজ্জিত নগর---

সবুজ জলবায়ু

কোনও কোনও পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যায়

 

তবু পথ ও সময় কিছুই থেমে থাকে না

 

যেমন ভ্রূণের জন্মরহস্য যাদের কাছে অধরা ছিল

তারাই আজ নতুন পৃথিবীর জন্ম দেয়

 

৮.

তোমার ক্ষমার পাশে কোনোদিন বসাবে না জানি

তবু ভুলকে ভুল ভেবে ধরে নিলে

জানি বকুল ঝরে যাবে আমাদের যৌথ বাগানে

 

আমাদের মাথার ওপর প্রতিদিন

একটি একটি করে জন্মকণারা আসে

তার হাত ও চক্র

মনের জলবায়ু বদলে বদলে দেয়

 

কী ভীষণ মায়াময় এই সংসার জগত

সকালসূর্য আর বিকেলসূর্যর মাঝে

যে দীর্ঘ আলোকচিহ্ন

সে শুধু সূত্রের পাশে প্রশ্নবোধক

ক্ষমা ও ভুল একে অপরকে চিনতে পারে না কোনোদিন

 

৯.

পৃথিবী একটি ধূসর গোলক

আমার বিকেলবেলা নীলধূসরতা মন টেনে রাখে

 

একটি নদীর কথা মনে পড়ে

একটি তীব্র স্রোতের কথা

একটি উপাসনা মণ্ডপ আর

ভীষণ ঘনিষ্ঠ হওয়া ব্রহ্মমন্ত্র

 

শরীরে কি ঘাম খুব বেশি ছিল

অথচ প্রকৃতি ছিল খুব যত্ন মাখা

 

সেই প্রথম ও শেষ

সেই শেষ ও প্রথম

 

আজও নদীর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে

নদীর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে

ধূসর পৃথিবী আমার প্রথমটুকুই বয়ে নিয়ে যায়

 

 

১০.

জীবন একটি বৃত্তাকার পরিক্রমণ

 

ফেলে আসা ঘাট, জল, স্রোতের সাথে

প্রায়শই দেখা হয়ে যায়

 

যে মেঘ কথা দিয়েছিল

বর্ষাকে আমার সাথে রাখবে

সেই মেঘকে মাঝে মাঝেই দেখি

আমাদের খিড়কি মাঠে বর্ষাকে নিয়ে

ঘুরে বেড়াতে

 

আসলে জীবন নিজেই একটা আস্ত পৃথিবী

যার নিজস্ব দণ্ডের ওপর

গুহাচিত্রের মতো আঁকা থাকে মায়াবি গহ্বর