লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Sunday, August 16, 2020

সোহেল হাসান গালিব

                            সোহেল হাসান গালিবের কবিতা

 

গিঁট

 

খুলতে কি সবাই পারে?

হোক না তাদের গ্রীবা যতই গ্রন্থিল, থাক ওই

আঙুলে ধূর্ততা। সত্যি যে পেরেছে সে বোঝেনি কিছু।

না-হলে গ্রন্থ নিজেই বলত কথা।

 

এই শুনে একদিন আমার কলার ধরে টান মেরে

বলেছিলে, ‘তাহলে তুমিই খুলে দ্যাখো...

 

জন লক আর হিউমের কাছ থেকে সরে এসে

খানিকটা হিম হয়ে, তারপর

এক আত্মম্ভরি মাছরাঙার আদেশে

জাল ফেলতে গিয়ে কিনা জড়ায়ে ফেলেছি নিজেকেই

 

এতসব প্রস্তুতি সত্ত্বেও, হায়,

খুলতে গিয়ে দেখি, ভুলে গেছি গেরো খুলবার

সকল উপায়।

 

 

আত্মা

 

কবরেরপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে কেউ যদি ফের চলে আসে

ভোরবেলা নগ্নপায়, সেই ভয় চুপিচুপি জ্বলে রত্নদীপে

আমার সমস্ত রাত্রি।

 

রাত্রি কি নিঃসঙ্গ এক বাদুড়ের নাম,

হৃদয়, মৃতের মুশায়েরা?

 

পাতালে সুড়ঙ্গ আছে, চাতালে ময়ূরশয্যা।

 

সুড়ঙ্গের এই শেষ মাথায় এসেই জানলাম,

অসমাপ্ত পৃথিবীর পথ।

 

বুঝেছি, নিষ্কৃতি নয়,

ছাতিম গাছের নিচে বসে, তুমি হে মৌনী, সেদিন

নিষ্ক্রান্তিই চেয়েছিল তবে!

 

কার থেকে? প্রেম আর প্রত্যাশার ফাঁকগুলো আজ

দাও যদি ভরিয়ে, গলিয়ে দেহমোম

 

আমি তবে সে তাড়নাপুষ্প হয়ে ফুটি।

 

 

ভাষা

 

হাতজোড় বসে থাকা এই রাতভর

ভোরবেলা বাক্য হয়ে যদি ঝরে পড়ে

যদিবা তাতেই পাখি পায় শস্যদানা

পায় ফুল ফোটার ইন্ধন, তবে আর

তুমুল উৎপ্রেক্ষা কই, কোথায় উপমা

কেন চাও এই সফলতা? কেন ডাকো

ফণীমনসার ঝোপ?—যদি না চুম্বন

সিল্কবৃষ্টি, স্নিগ্ধ কাঁটা; যদি না এ ঠোঁট

রক্তাপ্লুত গান। ক্ষত নিয়ে, দ্বিধা নিয়ে

এতদিন পরও, ভাষা, তুমি নতজানু।

এতদিন পরও দেখি মাছের সাঁতার

নভতলে। অথচ তুমিই দিলে ডুব।

ভাসালে হৃদয়। টেনে তুলে তারপর

ছুটেছ কোথায় কার পায়ে বেঁধে মল?

কোজাগরী

 কোজাগরীর কবিতা


সঙ্গম-সঙ্গীত...


কবিতারা হরতালে গেলে নগরের সিঁড়ি বেয়ে অনেকটা হেঁটে যাই।

অভিধান থেকে খুঁজে নিই শব্দহীন গন্তব্য।

শাল কাঠের জানলা থেকে ঘষা কাচের স্লাইডিং।

অনেকটা হাঁটতে থাকি...

ভেসে আসে বৃষ্টির সঙ্গম সঙ্গীত

রাত্রি রাত্রি মৃত্যু নামে।

 

সব রঙ চেনা হয় না বলেই-

একাকিত্বের হিম বাগানে জীবনের অন্ত্যমিল

ট্রামকার্ডে যাযাবর নক্ষত্র, জলছাপ।

কবিতারা মাঝে মধ্যে হরতালে গেলে

জীবনের নুড়ি ভেঙে সাড়ে তিন হাত, সাড়ে পনেরো আনা...।

 

গোধূলি


দুপুরের ভাত ঘুম শেষ

জানলা লাগোয়া প্রাচীরটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নাগরিক সন্ধে নেমে আসে।

বেঁচে থাকার টুকরো টুকরো স্বপ্নের রঙ তুলি, মনের অদৃশ্য কাশবনে জলছবি এঁকে যায়

মেঘেদের ভাঁজে ভাঁজে মাটির স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, বৃষ্টিভেজা অক্ষর

অথচ কবিতা লিখব বললেই কবিতা লেখা যায় না....


তৃষ্ণা

 

যদিও আষাঢ় শ্রাবণ বর্ষাকাল, অথচ সারা বছর-ই বৃষ্টি পড়ে। 

হৃদয়ের আনাচে-কানাচে হরেকরকম যন্ত্রণা।

কাঠখোট্টা দুপুর

বাজপরা তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে জীবন।

 

ঘুমের মধ্যরাতের দরজায় নির্জন সৌন্দর্য। তৃষ্ণা কখনো কখনো কেঁদে ওঠে।

সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া শুরু হয়।

এক একটি দুঃখ নিয়ে জীবনও  বড় হয়।

ভেতরে ভেতরে জলহীন বৃক্ষ ফুসফুসে নিকোটিন সঞ্চয় করে।

অভিজিৎ পালচৌধুরী

              জন্মদিনের কবি


অভিজিৎ পালচৌধুরীর কবিতা


উনুনের গপ্পো

 

১.

আমরা বলতে পারিনি

পৃথিবী কোন দিকে ঘোরে

যদিও গ্যালিলিও উত্তরটা

বলে গেছেন বহুদিন

মিথ্যেবাদীর মতো

উত্তরটা জেনেও তাই আমরা লিখিনি

হল ছেড়ে বেরিয়ে এসে

কলেজ স্কোয়ারে ওয়াটার পোলো দেখেছি

উদ্ধত যুবকের মতো ভেবেছি

বিদ্যাসাগরের ধড়ে তবে

জুড়ে দেওয়া যাক গান্ধিজির মাথা

কিংবা চারু মজুমদার

ওহে লাল বাজার

বাজার লাল করে আমাদের তুলে আনো

আর ছড়িয়ে দাও বরানগর থেকে কোন্নগরে আমাদের উদ্ভট স্বপ্ন

 

২.

 

গ্যালিলিও এখনো বসে আছেন রাইটার্সের ছাদে দূরবিনে আকাশের তারা গুনছেন

আর ভাবছেন কবে তাদের পকেটে পুরবেন

যাতে অবাধ্য যুবকেরা তার কথা শোনে

ওদিকে চটকলে যৌথ রান্নাঘরে উনুন নিভে যায় দিল্লি কয়লা পাঠায়নি বলে

হেই দিল্লি হেই দিল্লি

বলে ছুটে যান ধুতি পরা ভদ্রলোক

আড়কাঠিরাও আসে কথাবার্তা হয়

দেশ চলে

উনুন নিভে যায়

 

বজ্রবিদ্যুতের মতো রক্তে বিদ্যুৎ নিয়ে

জেগে ওঠেন বক্রেশ্বর

আর তারই আশীর্বাদে রাগী যুবকেরা

বন্দুকের নল ছেড়ে

গিটারে সুর ভাঁজে

উনুন নিভে যায়

 

ফরাসিরা হোটেল খোলে

খগেনবাবু স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে

উটি বেড়াতে যান

কোকাকোলা আসে

সেনেরা টাকা ধার দেয়

সেই টাকায় জনস্বাস্থ্য, জনকল্যাণ

সেই টাকায় জুলাই মাস

সেই টাকায় সুইজারল্যান্ড

 

৩.

 

উনুন নিভে গেছে

গ্যালিলিও আকাশের শেষ তারাটিকে

পকেটস্থ করে ফেলেছেন আর কি

এমন সময় কোথ্থেকে ছুটে আসে

লক্ষ পায়ে, লাল কালো ছোপ্ ছোপ্

না ওরা রাগী যুবকের দল

ওরা লক্ষ ক্ষ্যাপা মোরগ

আকাশে তখনো দলছুট একটি তারা

ক্রমে ঘিরে ফেলে লালবাজার

লাল রাইটার্স

লাল মোরগের দল

তারা এক যোগে তীব্র স্বরে ডেকে ওঠে

গ্যালিলিও ভয় পেয়ে পালানোর পথ পান না তাদের কণ্ঠনাদে সুদূর সুইজারল্যান্ডে

বরফ গলে ধ্বস নামে

 

চরাচর জুড়ে উঠে আসে

এক প্রকাণ্ড অগ্নিগোলক

পৃথিবীময় যৌথ রান্নাঘরের উনুনে

 

ওটা সূর্য নয়

গ্যালিলিও কি বলবেন আপনি ?

 

অন্য খাত

 

আমি তো ডাকিনি

তবু তুমি এলে

 

দেখালে এই নদীখাত

চেনালে তার ধূ-ধূ বালিয়াড়ি

দিনের আলোয় তার হাঁ-মুখ

গিলে খায় আমাকে

আর রাতের কালিমায়

আমাকে ফিরিয়ে দেয় বেলাভূমিতে

 

বলে- পার হও, পেরিয়ে যাও সব কিছু

এই বালুকণা, এই খুচরো জীবনের

সব ন্যানো পার্টিকল্...

পেরিয়ে দেখ

মহাকর্ষহীন অস্তিত্বে

আর কোনো নদীখাত নেই

নেই বালিয়াড়ি

শুধু অনন্ত তমসা...

 

আমি অন্ধের মতো

অনুসরণ করছি

আর শুনতে পাচ্ছি

কোনো শীর্ণ জলধারার শব্দ

কোন অলক্ষ্যে এই বালিয়াড়ির

সমান্তরালে বইছে

 

অন্য খাতে...

 

ব্রহ্মকমল শব্দ

 

শব্দের অন্তরালে আদৌ

কোনো নিরাকার ব্রহ্ম আছেন

কিনা জানা নেই;

ভরা কোটালের বান তবু

আমাকে নদীগর্ভে টানে

বলে : ডুব দাও,  তুলে আনো

ব্রহ্মকমল শব্দ দুহাতে;

 

আমি জোয়ারে ভাসি

ডুবি, ওঠে শুধু বেনোজল

ভাটায় ফিরি

দুহাতে শূন্যতা মেখে...

 

ঘড়ি


ঘড়ির হাত দুটো

ডানা মেলে সকালের শালিক

খুঁটে খাওয়া ঘন্টা মুহূর্ত

 

সময়ের ফলক যত বাতাসে ওড়া পালক

ফলকহীন দূরত্বের সিঁড়িতে ধ্বস

 

ডায়াল জুড়ে ঝড়ের রতিচিহ্ন

উন্মত্ততা, ভাঙচুর, স্তব্ধতা

 

বিধ্বস্ত ঘড়ির নিচে

কুণ্ডলী পাকিয়ে

কুকুর-স্বপ্নে কেউ !

 

কথার কথা


কথার পিঠে কথা জমা হলে

স্তব্ধতার দেওয়াল চারপাশে

কথার ওপর কথা জমে গেলে

কথার খই ফোটে আকাশে

 

কথার ভেতর কথা জন্মালে

কথা ভরা চোখের ভাষা

পড়ে কি কেউ

কথার আগুনে চোখ জ্বলে ওঠে

না-বলা কথার

আছড়ে পরে ঢেউ

 

কত কথা বলার কথা

কত কথা না-বলার

বোঝার মতো কথক অমিল

রক্ত ঝরে বারবার

 

কথার শেষে কথা-ই তাই

কথার চাই মুক্তি

ভালবাসায় কথা হোক

ভালবাসাই যুক্তি

 

ভালবাসায় কথা হোক

ভালবাসাই যুক্তি ।।

 

 

তবু মনে রেখো...


কলেজস্ট্রিটের ফুটপাতের ব্যস্ততায় আর বই দোকানিদের টানাটানিতে আটকে গেল পা। প্রেসিডেন্সির গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছে যেন "নায়ক"-এর শর্মিলা ঠাকুর, একজন। কালো রেক্টাঙ্গুলার ফ্রেমের চশমার পেছনে ফিজিক্স অনার্স পেরোনো একটা জানালা, খোলা। একইরকম, ক্লাশ এইট-এর মতো। আর অন্য জানালায় যখন উন্মুখ ক্লাশ নাইন ।

ফ্রকের কোলে রাখা বইয়ের পাতার উত্তুরে বাতাসে উড়ে যাওয়া; সানশেডে মাধবীলতার নুয়ে পড়া ঝাড়ের আড়ালে ক্লাশ নাইন-এর প্রহর গোনা। দুই জানালার মাঝখানে নরম রোদ বিছানো ভালোলাগার পাগলামি।

 সময়ের দমকা হাওয়ায় একদিন জানালার ফ্রেম ডানা মেলে উড়ে যায় ঠিকানা বিহীন আকাশে। উড়তে উড়তে আবার একদিন নেমে আসে প্রেসিডেন্সির গেট আর কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে।

জানালার ভেতর থেকে দেখা স্মৃতি ভারে গাঢ় হলে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে উত্তরের দিকে। বসন্ত কেবিন। দু'কাপ চা-এর মাঝখানে আবার ওঠে নরম রোদের আলো। দেখার বিনিময়ে অদেখাকে দেখা। চা শেষ হয়, দেখা হয় না। অশেষ দেখা টুকু নিয়েই চলে যায় ট্রাম দক্ষিণের দিকে ।

সময়ের বাতাস প্রলম্বিত হতে হতে আজো এই তেষট্টির জানালায় ধাক্কা মারে। জানালার বাইরে যখন অপার শূন্যতায় হারিয়ে গেছে সেই জানালার ফ্রেম, অদৃশ্য এক ছায়াপথ এঁকে।

 

স্পা গার্ল


কী অবলীলায় শরীর থেকে শরীর

খুলে যায়, 

স্নায়ুতে তন্ত্রীতে অবরুদ্ধতার নাগপাশ

মিডল্ ক্লাশ ট্যাবু

 

শরীরের ভেতর কোনো ভিক্ষা নেই

শুধু দান-খয়রাতি 

বডি-টু-বডি, ব্লো-জব পেরিয়ে

জাকুজির ঘেরাটোপ

সরানো জলের আড়াল

টিপস্ দিয়ে হারিয়ে যাওয়া

মাইগ্রেটরি ক্লায়েন্ট

 

শহরের স্পা-গুলি

কিনে নিচ্ছে নিষিদ্ধ যৌনতা

খিদের বিনিময়ে

 

সন্ধে নামলে

দলা দলা অন্ধকার মাখছে,

খুঁড়ে খাচ্ছে অন্ধকার

স্পা-গার্ল 

 

বয়ফ্রেন্ড বাইক নিয়ে

বাইপাসে, মোবাইল ঘাঁটে

উড়ে যাবার অপেক্ষায় ।।

 

জোনাকি আলো


সেই ধূসর-সবুজ অভিমান,

জোনাকি আলো

অন্ধকার যখন গাঢ়তর

নিঝুম চারদিক, অন্তরিণ সময়

বিস্মরণ ভাঙে বিমূর্ত ধূসর

 

যে প্রবাহ নামে অতর্কিতে

ভাসায় দু-কূল সবুজ ধূসরতায়

খড় কুটোর হদিশ আনে

নিরুদ্দেশের নৌকো

নিমজ্জনের ছবি এঁকে 

 

সে প্রবাহে নিরন্তর উচ্ছেদের নোটিশ তর্জন-গর্জন মুখরিত কীট সভ্যতা

কোথাও থিতু হওয়ার নেই

নেই কি ভালবাসার সঞ্চয়

বাধ্যতার বাতাসে গান বেজে উঠলে

বিরুদ্ধতার আকাশ মেঘ জড়ো করে

 

বিপরীত স্রোত

দুলে ওঠে নৌকো,

অবগাহন বিস্মৃত হয়, প্রবাহ কীট

জোনাকি আলো হয়ে জ্বলে ।