লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Sunday, August 16, 2020

দেবার্ঘ সেন

দেবার্ঘ সেনের কবিতা


ক্যামেরা


(১)

জল জমে আছে, নিষ্কাশন হোক তস্য উদাসীন।

সাপেদের সমবেত বিবৃতি…

 

(২)

অস্থায়ী কোশ আর তার হলুদ হলুদ ফুল,

এক পা অথবা তিন পা বোরখা পরতে চায়।

 

(৩)

স্মৃতি = মুহূর্তের লাশ,

ঔজ্জ্বল্যতার সূত্রে পাংশু ন্যাপথলিন।

 

(৪)

বৃষ্টিকে ধরবে!! সে সাধ্য কই,

বরং ফেনিয়ে উঠে কান্নায় বুক চিরে রাঙাও ঘরোয়া ট্রাপিজিয়াম।

 

(৫)

জড়তা কেটে গেলেই, মন জানে

নিপাট দুর্বলতায় তুমিও উদ্ভিদ।

 

(৬)

 

অক্ষিকাচের অবহেলা তবু,

কবিত্বের দাবি ন্যাড়াগাছটা ঘুমোচ্ছে।

 

(৭)

ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়ে দুমুখো সাপেরা আখের গুছিয়ে

যুগ যুগ ধরে দিয়ে আসছে হীনমন্য পোজ।

 

(৮)

কান্না এবং কান্নার কারণের ফারাকটুকু মেপে

কষ্টি পাথরে ঘষলে উৎকর্ষতার বোধ বৃদ্ধি পায়।

 

(৯)

পাতা ঝরে, পাতা গজায়..

শিকড়ের মনে থাকে মায়া আর সেইসব আদিম কসরত।

 

(১০)

 

তারপর, একদিন কী ভীষণ উত্তাপে গলে যাচ্ছে সব

ঘুম ভাঙা শহরের খাটের তলায় গোটা সূর্যের সমর্পণে।

নীহার লিখন

 নীহার লিখনের কবিতা

আমার মা

মা'কে নিয়ে অনেক লিখেছি আমি কবিতায়

যখন ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে লাইক পাই না, তখন খুব ব্রহ্মাস্ত্রের মতো মা'র ছবি ও কথা সামান্য আবেগ মিশিয়ে ছেড়ে দিলেই দেখেছি, শাপলার মতো ফুটে উঠেছে যেন বিলের শোভা, আমার ওয়ালে

 

এভাবেই মা হয়েছে প্রকারান্তরে এক প্রকার নির্ভেজাল আবেগের প্রডাক্ট, কম্পিটিটিভ বাজারে

আমি আর কোনো ব্যবসা করব না বলে ভেবেছি বলেই, এই গোমরটি রাষ্ট্র করে দিচ্ছি

আর সত্যি বলছি, আমি এখন কোনো সুফিটির মতো করে আমার মা'কে ঈশ্বর ভেবে তাঁর সাথে জীবন কাটিয়ে দেব, দেখব পৃথিবীর সমস্ত লাইকগুলো কেন তাঁর সামান্য সাদাকালো কোনো ছবি ও কথায় উড়ে আসে!

 

যাতাকল

 

বহুদিন আগে সেই শিশুকালে

যবের ছাতুর খোঁজে পড়শির বাড়িতে দেখেছি যাতাকল

 

একটা উপরে, ঠিক তাঁর সমানই আরেকটা নীচে

ভিতরে পিষনে আছে কী দেখা যায়নি, শুধু মনে আছে তাঁদের গোলাকার প্রান্তের কিনার জুড়ে বেরিয়ে আসছে আকাঙ্ক্ষার বাদামি ছাতু, শিশু বলেই হয়তো ভেবে পাইনি, যাতার কলের ভিতরে কী আছে, কখন ঢুকেছে!

 

আজ বহুদিন পরে, নগরের এক সন্ধ্যা বেলায়, ফ্যাক্টরি ফেরত শ্রমিকের লাইন দেখে মনে হল, এরা যাতাকল থেকে বের হল, সবটা ঘাম নিংড়ে দিয়েছে সারাদিন, পরিত্যাক্ত অংশটা এখন বাইরে, জিরুচ্ছে যাতা

 

হাত

 

হাত মূলত ফস্কে যাবার জন্যেই পৃথিবীতে আসে

আর আমরা তাকে শক্ত করে ধরতে চাই, সবিশেষ সিদ্ধান্তে ন্যূনতম হলেও একটি আঙুল

 

ক্ষনপদ ও ধ্রুপদ সর্বস্ব কোনো বৃষ্টির কংক্রিট দিনে

বেহুলা ও লখিন্দরের হাতে-হাত ছবি ভাবতে ভালো লাগে বলেই, নদী প্রস্থে বেড়েছে মরা কটালের কালেও

 

কিন্তু শঙখচূর একটা সাপ সুন্দর নাম ও শরীরের, মায়া কারুকার্যটা তাঁর কি তবে পৃথিবীর অন্তরের ছাপ! ছাপিয়ে যেতে যেতে কেউ কী ভেবেছে কোনো নৃত্যময়ী কাপড়ের বাহুর সুতা! 

আমিও যেমন ভাবি না, জানি না, আমার হাতেরা আসলে কার হাতের দিকেই চেয়ে থাকে

 

পেরেক

 

আজ সকাল থেকেই, যীশুর কথাটি মনে পড়ছে,মনে হচ্ছে সে'ও কি জানত, ওরা কী করছে! রক্তও কি বুঝতে পারে ব্যথাও যে অর্গান 

আজ সকাল থেকেই দেখছি রোদ ও পাখির আনাগোনা, পাতা নেড়ে চেয়ে আছে দূরগামী গাছ

আমি তাদের সবার ছায়াকে পাঠ করতে চেয়েছি বলেই দেখেছি কতোটা সঞ্চরণশীল হয় সব ছায়া, কথার মতোই, ব্যথার মতোই, রক্তের মতোই, শুকানোর আগে

আজ সকাল থেকেই আমি বুঝতে পারছি পেরেক কিছুই না, আমার মতোই সে'ও যীশুর রক্তে ভিজেছিল, শুকানোর পরে মরচেতে মিশে গ্যাছে সে

 

হলুদের খেত

 

বস্তুর থেকে যতটা সম্ভব স্মৃতি ঝেরে ফেলতে হয়, যেভাবে কারিগর মাটিকে বানায় লাস্যময়ী প্রতিমার মুখ

হৃদয়ও এক ধারণা কুসুম যার পাখা নেই তবু উড়তে পারে, হাত নেই ছুড়তে পারে, যেরকম পল্লবিত রোদ সবুজখেকো কোনো হলুদের খেত হয়ে যায়

বিম্ব থেকেই জন্মেছে চিরদিন জল, পুনরায় জলেই নিভেছে সে আদিভূত ভাষার মতন

স্মৃতিকে পাত্তা দিতে নেই, স্মৃতি হচ্ছে ফল; কামরাঙা গাছের তলে লেপ্টে গড়িয়ে যায়

 

কবিতা

 

কবিতা লিখব বলে মানুষের জীবন থেকে একটু দূরে যেতে চাই

তাই বুঝতে চেষ্টা করছি, মানুষের জীবনটা কেমন জীবন আশলে!

অন্ধের হাতিটি দেখার মতো নানা উপাত্ত সংগ্রহ চলছে... চলছে... চলছে... প্রকল্প আমার, এক পা এগোচ্ছি তো দু'টি পা পিছিয়ে যাচ্ছে পিছনে

আমার কবিতা লেখাটা তাই আর হয়ে উঠছে না, চিন্তা আমার নদীর জলের দঙ্গলে ফুটে থাকা কোনো কচুরিপানার মতো দুলছে আর দুলছে

 

যদি যেতে হয়

 

সামান্য শিয়ালও বন বিভোরতা ছেড়ে

চলে এসেছে শহরে

শহরে তাঁর ঘর কেউ জানে না, সবাই ঘরে ফিরে গেলে, নেমে আসে রাস্তায়

সে'ও বুঝে গ্যাছে জঙ্গলে আর কিছু নাই, এবং একদিন জঙ্গল নিজেও কোথাও চলে যাবে, হেতাল গাছের স্থানে একটা পেশল শ্রমিক ইট ভাঙার কাজে অক্লান্ত হাত পা চালিয়ে লবন ছড়াবে কংক্রিটের তলে, লাউডুগি সাপের জায়গায় হয়তো একটা বেতের চেয়ারে বসে সিগারেট খাবে; বাজখাই শব্দের নামের মালিক, কোনো মোটাসোটা কেউ

নস্যি একটা ভাত শালিকও দেখি ভয়ানক কারেন্টের থামে বাসা করেছে ধান খেত ছেড়ে, কারণ কী! কিছুই বুঝি না আমি এবং একে একে এভাবে সবাই কেন মুছে ফেলছে সব!

উপচে পড়া এই শহরে আসলে কী আছে মধু, এরা দলে দলে এখানে আসছে আর ময়লা নোংরা হয়ে যাচ্ছে তাদের রূপ, দিন রাত ডাস্টবিনের দিকেই যেন তাদের সব চোখ

আমি এদেরকে দিন রাত দেখি আর ভাবি, আমার যাবার পালায় কোথায় যাবটা আমি, যদি যেতে হয়

 

শিমফুল

 

শীতকালে তাকে আমি পরিতাপ ভরা মনে দেখি-- বেগুনি, সাদা

মাটির জঠর থেকে দিবালির ঝিলবাতিটির মতো লাবণ্যপ্রভা নিয়ে ফুঁড়ে হাসছে, যেন প্রসন্ন আলো

আর মাটি তাই বুক উঁচু করে আছে, ফুলের ঘেরেই ঢেউ খেলছে শিম, হাসছে গেরস্থ বউ খিলখিল খিলখিল, কুলায় পক্ক শিমগুলো যেন জড়ো করছে সুখ, দোয়েল শিশ দিচ্ছে আঁচলের কাছেইটা তার

এমন সফল দৃশ্যই দেখতে চায় মানুষ ও পৃথিবী আর এমনকি খোদ শিম গাছও

তাই সে আর মনে রাখতে চায় না বোধহয়, বে-শীতের দিনে, কুয়াশাবিহীন সব দিন, সমস্ত ছাইচাপা ক্লেদ একদা তাঁর রন্ধ্রকে মজা পুকুর বানিয়েছিল দেউরী বাড়ির, পৃথিবীর নিয়মে স্বয়ং দুঃখও দুঃখকে মনে রাখে না, আর এটাই নিয়ম

 

আম

পৃথিবীতে ভরা মৌসুমে আমি তাঁর কদর সামান্য কমে যেতে দেখেছি, সে স্বর্গের ফল, যদিও মহিমা কমেনি তখনো, এমনকি জড়োসড়ো শীতের দিনেও তাঁর আবেদন থাকেই কিংবা অন্য আরো আকালেও

কী অদ্ভুত অমিল আমাদের ভাগ্যের! আমাদের নামেই কেবল পাই মিল, সংখ্যায় যখন আমরা হয়ে যাই

মৌসুম নেই কোনো, শীত, গ্রীষ্ম, ঝুবি বরষায় মোদ্দা কথার সব সব কালেই

আমরা যখন আম বলে পৃথিবীতে পরিচিত হই, আমাদের মুল্য হয় বস্তা দরে

 

 

চিহ্ন

 

আমার চিহ্নই, তোমার উদ্ধৃতি, আদিভূত অক্ষরে তোমার পুঁথিটি, এমনকি পাঠ ও নদীর ওঠানামা 

উত্থাপন নেই বহুদিন আমাদের কারোরই, মিছা নন্দনে  ভুলে আছি সব, নিরন্ন একটা বাগান দেখতে বানিয়েছি জানলা ও চোখ

তবু শিরা, আহা তরঙ্গ কণা কিলবিল, টেনে নিতে চায় গড়ের মাঠের দিকে হরপ্পা দিনে, খুলে দিতে চায় ডালা, হাড়ের বাখান, শ্যাওলার নীচে থাকা খোদিত বরাত

আমার সে চিহ্নই তোমার পাখি, তোমার আকাশ

 

 

নীহার লিখন

জন্ম/ ৩ অক্টবর, ১৯৮৩, শিববাড়ী শেরপুর, বসবাস করেন ময়মনসিংহে,  

পেশাজীবনে একটি বেসরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন।

 

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: 

 

ব্রহ্মপুত্র,

আমি আপেল নীরবতা বুঝি,

ব্ল্যাকহোল ও পড়শিবাড়ি,

পিনাকী ধনুক,

মনসিজ বাগানের শ্বেত

 

অনুবাদ ও কথাসাহিত্য নিয়েও কাজ করেন। ইতোমধ্যে অনুবাদ করেছেন মিরোস্লাভ হলুভ, জন এশবেরী, ইবসেন, ইয়াং লি-সহ অনেকের কবিতা

 

বাই লিংগুয়াল এই কবির মৌলিক ইংরেজী কবিতাও ইতোমধ্যে দেশ ও দেশের বাইরে জার্মানি, আয়ারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সংকলনে সংকলিত হয়েছে, তাঁর কবিতা অনুদিত হয়েছে রুশ, ইংরেজী ভাষাতেও। বয়ান সহ বেশ কিছু পত্রপত্রিকা ও ছোটকাগজে তাঁর গল্প প্রকাশিত হয়েছে, প্রথম উপন্যাস ‘মধুপুর’ প্রকাশের অপেক্ষায়

মন্দিরা ঘোষ

 মন্দিরা ঘোষের কবিতা


এবার ঘুরিয়ে নাও চোখ

 

১.

এবার ঘুরিয়ে নাও চোখ

চতুষ্কোণে দাঁড়িয়ে আছে সিদ্ধান্তের কাঁটা

সময় এসে বুলিয়ে নেবে ঠোঁট

 

গোলাকার সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাবে ভাঙন

চারিদিকে রতিঘুঙুরের লালা

থকথকে প্রজাপতির ঘিলু

ছেটানো ফুলের গর্ভচক্র

মাড়িয়ে যেতে গেলে গোটা দেশ ডিঙোতে

হয়

ডিঙোতে হয় রজঃ রক্ত অণুচক্রিকার আঁধার

 

বেগুনি আতঙ্কের বাঁশিওয়ালার দল

লন্ডভন্ড করছে শিষকণার ভবিষ্যৎ

ফসলের প্রসবযন্ত্রণায় ককিয়ে উঠছে মাটি

এবার জল গড়িয়ে যাবে সেই দিকে

যেদিকে কোনো জ্যোৎস্নার নদী নেই

একটাই রাস্তা যেখানে কুয়াশারা

প্রতিবাদী হয়ে ওঠে

অথচ ছোঁয়া যায় না তাদের স্বর

 

সব লৈখিক ভয় জ্যা মুক্ত হলে

লোকালয় ফুটে বেড়িয়ে আসবে নীল ধুতুরাভোর

বিপর্যয়ের জলকেলিতে মেঘ ফেটে

 জন্ম নেবে অতিবেগুনি শৈশব

 

২.

দিনের মৌখিক সারণিতে সাজানো

 আচার বিধির জটিল সূত্রগুলি

সমান্তরাল চাহিদায় দাঁড়িয়ে আছে

বাষ্পীয় অভিমান

 

রুমালের ঘাম মেখে উড়ে যাচ্ছে মিথ্যের শাঁসালো ডানা

ভাঙা হাঁটুতে অস্পষ্ট ফেরতের ধারবাকি

অবাধ্য উইপোকারা খেয়ে ফেলছে

অবশিষ্ট ক্যালসিয়াম আর খনিজ

 

পারস্পরিক ঠোঁটের ভূমিকায়

কিলোমিটারের বাঁক

কুয়াশাখেয়ালে ডুবে যাচ্ছে ধ্বনিমৈথুন

 

মাটির গর্ভাশয়ে জরাঘুম

নিরুপায় ঘামে ভেজা উদ্ভিদের জানলা

শূন্যের গা ঘেঁষাঘেষিতে ভরাট

অন্তরিন অসুখের ঘর

 

৩.

এ এক আশ্চর্য  মন্থন গান

যখন সব শব্দ গুটিয়ে নিয়েছে ডানা

বুকের নিচে শ্বেতকরবীর গ্রাম

থেকে থেকে একটা কোকিলের ডাক

শুষে নিচ্ছে অভ্যন্তরীণ ঋতুর সংলাপ

 

ফাঁকা রাস্তায় মেলে দিয়েছে রোদ

স্বাধীন ভবিষ্যৎ

 

 ফ্ল্যাশলাইটে উঁকি মারছে

খেলার মাঠ, হলুদ পোষ্টকার্ড, ডুরেশাড়ি

 যারা নিজেদের বদলে নিয়েছে

 দুপুরের মাত্রাজ্ঞানে

 

জানলাজীবনের ঘেরাটোপে 

উথলে ওঠা বুদ্বুদ

 ফিরিয়ে দিচ্ছে বসন্তের ধারাবিবরণী

 

৪.

পুরোনো গলির সকাল হাতে নিয়ে

দাঁড়িয়ে আছে একদল শিশু 

একঝাঁক মেঘের ফেরিওয়ালা

বৃষ্টি ফেরি করছে মাটির ঘরে ঘরে

 

একটা আলতো নদী ফুটপাত ভেঙে

          নেমে যাচ্ছে রাস্তায়

 

রোদে গলে পড়ছে শপিংমলের মেকআপ

বালির নিচে লুকোনো আলো খুঁজে চলেছে ক্লান্ত শহর

 

এবার আলপথ ধরে হেঁটে যাবে

     নিখুঁত বলিরেখার চরিত্রেরা

একটা গরীব রঙের বাড়ির ঠোঁটে

        ঝুলে থাকবে পাঠশালার ভূগোল

পাখি আর ঘুড়ির মাঝে

         মাথা গলাবে না স্কাইস্ক্র‍্যাপার

 

   বিকল্প সময়ের হাতপাখা

এবার মুখোমুখি হবে আয়নাপোশাকে 

 

৫.

 তেরছা আলোর গাম্ভীর্যে মুখ বাড়ায়

 দিনের ভাষ্যকার

ময়ুরচিবুকে রোদ মেলে দেয়

বনঘাগরার সকাল

 

শালিখদুপুরে বকুলচিঠির খাম

  জলাশয়ে ক্ষমা ফেলে যায় মাছরাঙা

দুটো হর্তেল বিনিময় করে ঘামসংক্রান্ত

আন্তরিকতা

সন্ধের শিষ দুপুরের স্তব্ধ ঠোঁটে

 

গোধূলি আলোর বাজনায় ডুবে যায়

বিকেলের ঐচ্ছিক

 

৬.

জেগে ওঠার পর পুরনো হাইওয়ে ধরে

 হেঁটে যায় ঘুম ও পূর্ববর্তী কর্মসূচি

বিকারের মতো ঘরোয়া অসুখে

আক্রান্ত পৃথিবীর সব স্যান্ডক্লক

বালি থেকে সরে যাচ্ছে

 মিশরীয় সভ্যতার শিশির

 

বৃষ্টির সাথে পুরনো চিঠিপত্তরের যোগসাজশে

বন্দি কিশোরীমেঘ

 

বর্ষার ভিজে শাড়ি বিরহপ্রিয় হয়ে ওঠে

 দেরাজে সাজানো বিচ্ছেদকোটরে

 ধিকিধিকি পিতৃতন্ত্রের ধোঁয়া

 

রোদের স্বীকারোক্তিতে সিদ্ধান্তের ভুল

 জড়ো করছে একঝাঁক পায়রা

 কোর্টমার্শালে বেঁকে যাচ্ছে পুরুষতন্ত্রের পিঠ

 

৭.

বিনীত সকালের গায় লেগে আছে

 প্রসবের দাগ

পাখিরাও জানে কীভাবে

সাজিয়ে তুলতে হয় ঘর

ঠোঁটে ঠোঁটে খড়কুটোর অনুরোধ 

 পালকে কিশোরী বীজের আলো

 

আমাদের গ্রামময়তা

 উপমায় জিরেতজ্যোৎস্না

  মাটির গর্ভে ফসলের উৎসাহ

ফুলের পরাগ ধ্বনি

আশ্বিনশরীরে ছায়ামাঠ ডাকে

 

  বিরতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নদী

শৈত্যপাথরে কান্নার মৈথুন আঁকা

 এবার রজঃস্বলা মেঘ  মুছে দেবে

কিশোরী ঘুঙুরের কালশিটে

 

৮.

সব বন্দী আলো রোদ হয়ে ওঠার অপেক্ষায়

 করাত কলে কাটা পড়ছে

পাখির পায়ের দাগ

 

 নামাজের রং মেখে এবার উঠে দাঁড়াবে

 ছেঁড়া ছেঁড়া সবুজ জনপদ

 

 ভাষ্যকার তৈরি করছে পরবর্তী

ধারাবিবরণী

পাতায় পাতায় বিচ্ছেদ লিখে

 উড়ে যাচ্ছে একদল মেঘতিতির

 

 এখনো গ্রিলের গায়ে লেগে থাকা

বৃষ্টি ফোঁটা সাবালক হলো না বলে

জলাশয় হয়ে উঠছে ঘর

 

শাদা হাঁসের বিকেল

মাটি ছুঁয়ে দ্যাখো

 সব আলো আলো নয়, মুখোশেরও নাম

 

রাতের মৌখিক লেখা আছে

ভোরের মৈথুনে

 ত্রিভুজের কোণে বেড়ে যায় ভুলের মিথোগ্রাফি

 

জলবিষুব ধরে হেঁটে যায়

সাদা হাঁসের বিকেল

 তোমরা চুপ থাকার অঙ্ক শিখে ফ্যালো

 

খিদে

এত খিদের কাছে আকাশ পুড়ে যায়

বৃষ্টিও অঝোর আঁকে না আর

 

 শোকেরও ভোর নেই

যে স্পর্শ খুলে যাবে

 

এত খিদে নিয়ে কোথায় কুড়োবি মেঘ!

কোথায় ধরবি জল!

চোখে যে সমুদ্র আঁকা থরে থরে

জয়শ্রী ঘোষ

জয়শ্রী ঘোষের কবিতা


শ্রাবণ


কপালে দিলাম লাল টিপ

ছোটবেলায় মা যখন চাঁদ দেখিয়ে বলত

"আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা"

সেইদিন কি জানতাম চাঁদে কলঙ্ক!

প্রতিটি পূর্ণিমার রাতে মায়ের কথা মনে পড়ে

পূর্ণিমারাতে কলঙ্কিনী হওয়ার জন্য

ছটফট করি

কলঙ্কিত চাঁদের মতোই ঝলমল করতে ইচ্ছে করে

পূর্ণিমা রাতগুলিতে

চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করে আমার মায়ের মুখ

ও চাঁদ

 

আমার কবিতার বই উৎসর্গ করেছিলাম

আমার ভালোবাসার মানুষগুলোকে

'চাঁদ তোকে'

আমি ভাবতাম আমি শিল্পী হবো

চাঁদের গায়ে তুলি দেব নিজেই

সৃষ্টির আসা যাওয়া ওখান থেকেই শুরু হবে

আমার প্রেমের মানুষটিকে আমি চাঁদ বলি

আমার পেটেরটি, তাকেও চাঁদ বলেই ডাকি

আমার শৈশব রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে ফেলতে

চেয়েছিলাম বহুবার

তবু প্রেরণা তো প্রেরণাই

 

মৃত্যুর চেয়ে বড় সত্যি নেই

হৃৎপিন্ড স্তব্ধ হলেই নদীতে কলকল জল বয়

বয়ে যাওয়া জলে শুধু জড়শব্দ

আমি নদীর পারে বসে থাকি

মায়ের কথা লিখি

কিন্তু সব শব্দ বোঝা অত সহজ তো নয়

প্রবেশ করি অরণ্যের পথে

গাছ আর গাছ রাস্তা আঁকাবাঁকা

গাছের সঙ্গে নদীর একটা সম্পর্ক আছে

যার কখনো শেষ নেই

 

আমাদের গন্তব্য আরো দীর্ঘ হোক

যখন রাতের পর রাত জাগি, নিশাচর জীবন কাটাই, ভরসা শুধু কতকগুলি স্লিপিংপিল,

ঘুম আসে না! সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, শুনতে পাই রাস্তায় কুকুরের দলের মারামারি, বাচ্চাকুকুরের আর্তনাদ আমাকে বিদ্ধ করে আমাকে রক্তাক্ত করে। আমাদের বাড়ির পাশে যে বারটা আছে! মধ্যরাতে শুনতে পাই অনেক গুলি মহিলা, পুরুষ কণ্ঠ। মনে হয় যেন তাদের মধ্যে চলছে হাতাহাতি, ধস্তাধস্তি আর তারপরেই মহিলার হেরে যাওয়া কান্না। শব্দ পাই পুলিশের গাড়ির, ছ-তলার ঘরে আমি চুপ থাকি

 

আমি সন্তানটিকে জড়িয়ে শুয়ে থাকি, সেও মাঝেমাঝেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই বলে মা আমাকে ধরো, আমি আরো চেপে ধরি। অন্ধকার রাত্রি কখন যে আলোকিত হয়? মা চুল বেঁধে দিচ্ছে, মায়ের সাথে কত গল্প হাসাহাসি, মায়ের গোছানো সংসার, দরজা জানালা মুছতে ব্যস্ত। আমি ঘুমোচ্ছি, মায়ের শাঁখের আওয়াজ ঘুম ভেঙে যায় কিন্তু ঘুম ছাড়ে না। আমি ঘুমোই, মা পাশে বসে সেলাই করছে। এ ঘর ও ঘর ছোটাছুটি পুরনো গল্পের খাতা খুলে যায়। মায়ের রান্নার গন্ধ, আমার মেয়ে আমার মায়ের দখলে। রাত্রিটা ক্রমশ ছোট হয়ে যায়। আকাশে আলো ফুটেছে, স্বপ্ন! শুধু কান্না পায়

 

দুই ছেলে থাকা সত্তেও ঈশ্বরের কাছে মা চেয়ে ছিল পুত্রসন্তান আর বাবা কন্যা। এই সব গল্প মায়ের কাছেই শোনা। কারণ মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে হয়, তা বড় কষ্টের। অনেকটা পথ চলার পর আজ আমি এই মুহূর্তে এক পথশিশু! ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কান্না পাচ্ছে, আবার ছোট্টটি হতে ইচ্ছে করছে, তোমার মুখ খুব মনে পড়ছে, একবার ডাকবে আমায়?

 

 

তুমি এখন বহু দূরে

প্রতিটি সুন্দর দিন দুষ্কৃতিরা কেড়ে নিয়েছে

যে নির্জন সন্ধেবেলায় তুমি প্রকৃতির বাতাস উপভোগ করতে প্রকৃতপক্ষে তা বিষাক্ত

ভোরের বেলা তোমরা হেঁটে ফিরে

ফুল তুলতে সেই গাছেদের গায়ে ঘৃণা

মাঝেমাঝে ভাবি তোমরা নেই, বেঁচে গেছ

এই পৃথিবীতে আকর্ষণ ছাড়া আর কিছুই নেই

 

এমন একটা সময়ের মধ্যে আমরা হাঁটছি

হত্যা হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত প্রতিটি দিন, রাত্রি

পথেঘাটে মানুষ নেই

হাওয়ায় উড়ছে ছেঁড়া পলিথিন

পলিথিনে পলিথিনে দেশটা শেষ করে দিচ্ছে

ছিটকে যাচ্ছে মানুষের রান্নাঘর

অসহায় কুকুরগুলো দাঁড়িয়ে ভিজছে

বুঝতে পারছি না

কীভাবে শুরু করব

 

 

মস্তিষ্কের ভিতরে ঢুকে দেখি শূন্যতা

আমার সমস্ত ইচ্ছা তোমার বাম অলিন্দে বাঁধা

বাঁকা কথার মেয়েটা এখন আকাশ

পাখিরা আকাশ মেখে গান গায়

তোমার গ্রিন টিতে এনে দেব এক টুকরো উষ্ণতা

যে কথাগুলোয় তুমি ব্যথা পাও

তা হচ্ছে ভালবাসা

 

১০

স্পষ্ট হচ্ছে অশ্বের কাতর হ্রেষা

পবিত্র ওমে রাত পাখিটা এখনো ডাকছে

যে দীঘিতে আকাশ দেখো

তুমি নাড়া দাও আমি ঝরি

এ শ্রাবণ যেন আমারই ব্যথা

'বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি'