লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com
Showing posts with label গল্প. Show all posts
Showing posts with label গল্প. Show all posts

Sunday, February 20, 2022

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প


রেলগেট

 

                           

 

তালাটা খুলছে না। অল্প ঘুরে ঘুরে বারবার আটকে যাচ্ছে চাবি। সামান্য হোঁচট খেয়ে তালা খুলে যাওয়ার স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে না আজ। অস্থির হাতে রিঙে বাঁধা দ্বিতীয় চাবিটা দিয়ে চেষ্টা করল ছেলেটা। কিন্তু খুলছে না। খুলছে না কারণ আজ মন দিচ্ছে না সে। মালিকের থেকে চাবি এনে রোজ তালা খুলে দোকান পরিষ্কার করে সে। আজ ভোর থেকে মেঘলা, রাস্তাঘাট ভেজা, আকাশটা ফোঁপাচ্ছে। টিপটিপে বৃষ্টি মাথায় ঠিক সময়ে চাবি এনেছে ছেলেটা। কিন্তু, তালা খুলতে বারবার পিছনে তাকাচ্ছে সে।

 

দোকানের রক থেকে নেমে চওড়া রাস্তাটার ওধারে রিকশাস্ট্যান্ড। এই বাদলার সকালে স্ট্যান্ড প্রায় ফাঁকা। স্ট্যান্ডের গা লাগোয়া পাঁচটা লোহার বিম দেওয়া ব্যারিকেড। রেলগেট। সিগন্যালের ব্যবস্থা নেই, তবু লোকমুখে প্রচারিত এটাই রেলগেট। এধার দিয়ে ওধারের রেলগেট, রেললাইন, ট্রেনের যাতায়াত স্পষ্ট দেখা যায়। সেদিকে ছেলেটার চোখ চলে যাচ্ছে বারবার।

 

আজ একটু অন্যরকম দিন। এমন সাতসকালেও রেলগেটে একটা বড় জটলা। লোহার বিমগুলো মানুষের ভিড়ে ঢেকে গেছে। ভিড়টা বাড়ছে। এতক্ষণ সামনে থাকা কেউ কেউ নাকে মুখে রুমাল চাপা দিয়ে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসছে। পিছনের সারিতে থাকা কৌতূহলী চোখগুলি সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটার মন পড়ে আছে ওদিকে। একবার ভাবল চাবির রিং পকেটে ঢুকিয়ে দেখে আসবে। কিন্তু, সাহসে কুলিয়ে উঠতে না পেরে তালা-চাবিতে মন দিল সে।

 

**********************

 

ইরাবতী-

 

এই মুহূর্তে প্রত্যেকে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এমনকি যারা আমায় দেখছে না, আমি টের পাচ্ছি, তারাও ঠারেঠোরে আমাকেই দেখছে। এই ঘটনার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। অথচ, সবাই ভাবছে, আমি প্রস্তুত ছিলাম। যাঁদের সাথে একই সারিতে দাঁড়িয়ে রয়েছি, তাঁদের কাউকে আমি চিনি না। তাঁরা কেউ আমায় চেনেন না। অথচ, আমার গা-হাত-পা-মাথা ছাড়িয়ে উঠছে তাঁদের প্রায় সমবেত ফিসফাস ধ্বনি। প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে। চোখ তুলে সামনে তাকানোর ক্ষমতা হারিয়েছি কতক্ষণ জানি না। শুধু মনে আছে, অনেকক্ষণ আগে চোখ তুলতে গিয়ে সামনে দেখেছিলাম সৌম্য’র দাদাকে। ঘেন্না আর বিরক্তি মাখানো দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম আরও!

 

এই অচেনা ভিড়ের মধ্যে, প্রচ্ছন্ন দোষারোপের বিষ হাওয়ার মধ্যে, এখনও আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি কেন? সৌম্য’র জন্য। ওকে একবার দেখতে চাই। ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম অনেক বছর আগে। ক্যাম্পাসে। কিংবা, ঠিক যেমনভাবে দেখা হয়েছিল একবছর আগে, এমনই ফেব্রুয়ারির বৃষ্টি ভেজা সকালে, এই রেলগেটে।

 

প্রথম দেখার দিনটা আজও, এই অদ্ভুত মুহূর্তেও মনে করতে পারি আমি।

 

তখন আমি ফার্স্ট ইয়ারে। বর্ষার সন্ধে ছিল সেদিন। একঘেয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মাঠে বসার প্ল্যান ভেস্তে যাওয়ায় ক্যাম্পাস থেকে বেরবো ঠিক করেছিলাম। অপালার সাথে একই পিজিতে ফিরব। দু’জনে কোনওরকমে মাথা বাঁচিয়ে পা চালাতে গিয়ে মুহূর্তে থমকে গিয়েছিলাম। দু’নম্বর গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকল একটা অবয়ব। নেভি ব্লু টিশার্টের কাঁধ ভিজছে তার, কোঁকড়ানো চুলের উপর বিন্দু বিন্দু কাচের গুঁড়ো জল। জিনসের পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বের করে ঘাড়ে, কপালের জল মুছে নিল। তারপর চশমার কাচ মুছতে মুছতে এগিয়ে এল সৌম্যদা। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং-এর সামনে জোরালো হলুদ আলোয় তাকে দেখে নিজের অজান্তেই শিহরিত হয়েছিলাম আমি।

 

“তুই হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের না? উমম, ইলা, রাইট?”

 

“ইরাবতী”। গ্রীবা উঁচু করে স্মিত হেসে ভুল শুধরে দিলাম।

 

“সরি, সরি, ইরা। তা বেরিয়ে যাচ্ছিস না কি?” বলে গেটের দিকে অঙ্গুষ্ঠ নির্দেশ করেছিল সৌম্যদা। সেই মুহূর্তে আমি দেখেছিলাম, সৌম্যদা’র চলন, বলন, এমনকি আমার বাঁ দিকে একনম্বর গেটের দিকে অঙ্গুষ্ঠ নির্দেশের কায়দাটুকু পর্যন্ত কী এক নিয়মিত অনুশীলনে নিখুঁত হয়ে গিয়েছে। যেন এই সবটা শুধু সৌম্যদা’কেই মানায়।  

 

হৃদয়ের কিছু নির্দিষ্ট খেলা থাকে, সেসব খেলার কিছু নিয়ম ও থাকে। ওই কাঁচা বয়সে কিছু বাঁধাধরা নিয়ম জানতাম আমি। কী এক অজ্ঞাত কণ্ঠস্বর আমায় বলে দিয়েছিল, এ খেলায় প্রথমেই সংযত হতে হয় বেশি। উজাড় করার সময় মিলবে অনেক। তাই, আমার সামনে দাঁড়ানো দোহারা শ্যামলা ছেলেটার সাথে আরও একটু কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও হাসি ছড়িয়ে মাপা উত্তর দিয়েছিলাম, “হ্যাঁ এবার ফিরব”। 

 

“বেশ তবে পরে আসিস, আড্ডা হবে”। পাল্টা হাসি ছুঁড়ে তড়িঘড়ি এগিয়ে গিয়েছিল সৌম্যদা।

 

মনে আছে, সে চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত সেদিন অরবিন্দ ভবনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম আমি।

 

পরে মনে পড়েছিল, আমার পাশে অপালাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞাও যেন শুধু সৌম্যদা’কেই মানায়।

 

একটা বছর আগে এমনই এক সকালে সৌম্যদা’র সাথে আবার দেখা হয়ে গিয়েছিল। কথা বলতে চাইনি। কিন্তু রেলগেটে প্রায় মুখোমুখি দেখা! অভদ্র হই কী করে? সৌম্য দা একইরকম আছে। মাপা কৌতুকী চাহনি, মাপা উচ্ছ্বাস (সেটা এক অদ্ভুত অনুশীলনের বিষয় বটে! আমি ক্যাম্পাস জীবনের বছরগুলিতে চেষ্টা করেও শিখে উঠতে পারিনি), রাস্তায় অঙ্গুষ্ঠ নির্দেশ করে হালকা হাসি, সবটা আবার বৃষ্টির সন্ধে মনে করিয়েছিল। মাঝখানের পাঁচটা বছরের অভিমান, ক্ষোভ সব এক নিমেষে উড়ে গিয়েছিল।

 

অভিমানের কারণ ছিল। সৌম্যদা’কে নিজের করে পাওয়ার কিছু বাধা ছিল। প্রথম বর্ষার সন্ধে থেকে আমাদের বন্ধুত্ব যত এগিয়েছিল ততই সেইসব বাধা আমায় বোবা করে রেখেছিল। সৌম্যদা’র প্রেমিকাকে দেখেছিলাম ক্যাম্পাসে। তাদের উত্তাল প্রেম জীবন দেখেছি। আস্তে আস্তে সেই বিশাল খ্যাতিমান জুটির সম্পর্ক শেষ হতেও দেখেছি। সৌম্যদা’র মতন অমন বলিষ্ঠ মনোভাবের ছাত্রনেতাকে দেখেছি প্রবলভাবে ভেঙে পড়তে। ততদিনে আমারও খুচরো প্রেম ভেঙেছে। সৌম্যদা’কে সঙ্গ দিয়েছি। শেষে একটা সময় যখন ভাবতে শুরু করেছি সময় আছে, উজাড় করার সময় আছে, তখনই আরও এক ফেব্রুয়ারির সন্ধেয় নীলার কথা বলেছিল সৌম্যদা।

 

তখন ইউনিভার্সিটির পাট চুকিয়ে এসএসসি-র প্রস্তুতি নিচ্ছি আমি। সৌম্যদা একটা মিডিয়া হাউসে ঢুকেছে। ফেরার সময়ে প্রায়ই আমায় ডেকে নেয়, একটু বেশি রাতের দিকে চা খেতে যাই এইট বি বাসস্ট্যান্ডের দিকে। আড্ডা হয়। নিখাদ বন্ধুত্বের আড্ডা। কারণ, সৌম্যদা কোনও আভাস দেয়নি। আর আমি জানতাম সময় আছে। সেরকম এক আড্ডায় নীলা নামটা প্রথম শুনেছিলাম আমি। এমন কত নাম শুনতাম। কিন্তু সেদিন সৌম্যদা’র চোখে এক অদ্ভুত আলো দেখেছিলাম। নীলা’র নামে ওই চশমা ঢাকা চোখ দুটোয় শুধু প্রেম ছিল না। ছিল স্নেহ, টান, নামটা উচ্চারণের সময়ে ঈষৎ লাজুক হাসিতে ছিল আগলানোর ভঙ্গিমা। আমি দেখেছিলাম ডাকসাইটে ছাত্রনেতার কোনও ভঙ্গিমাতেই নেই কোনও অনুশীলনের ছাপ! হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম! হাতের চা শুদ্ধু মাটির ভাঁড়টা ভেঙে যেতে যেতে বেঁচে গিয়েছিল। আমার মাথায় বিঁধে গিয়েছিল একটা নাম। নীলা!

 

নীলা নামের মেয়েটা এখন আমার থেকে একটু দূরে, রেলের দুটো সমান্তরাল রেখার মধ্যে দু’টুকরো হয়ে শুয়ে।

 

আমি সৌম্য’কে খুঁজে পাচ্ছি না।

 

 

 

সৌম্য

 

পালকের মতো হালকা লাগছিল নিজেকে। গতকাল রাত তখন সাড়ে এগারোটা হবে, বোধহয় একটা গানও গাইছিলাম। ঠিক গান নয়। একটা সুর।

 

কবরখানার রাস্তাটা থেকে বাঁয়ে ঢুকলেই আমার যে ঘর, তিন তলায়, ফ্ল্যাট নং 3B, তার দরজায় একটা কাঠের নেমপ্লেট বসানো আছে। সেখানে লেখা, সৌম্য রায় – নীলা রায় চট্টোপাধ্যায়। আর সবার উপরে লেখা ছোট্ট একটা শব্দ। “ঘর”। আপাত নিরীহ একটা শব্দ, অথচ কী গভীর! প্রতিরাতে ফেরার সময়ে আমি নেমপ্লেটের লেখাটা দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি ছুঁড়ে দিতাম। নীলা রায় চট্টোপাধ্যায় দেখে বিরক্তির সূচ ফুটত মাথায়। তবু “ঘর” শব্দটা উপরে জ্বলজ্বল করে বসিয়ে রেখেছে নীলা। সেটা দেখে চোখ নামিয়ে ফেলতে হতো। মাথা নামিয়ে দরজা খুলতাম। কালও সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলাম, বেপরোয়া সুর ভাঁজছিলাম, ডুপ্লিকেট চাবি বের করতে গিয়ে থেমে গেলাম। ঘরের ভিতর থেকে আওয়াজ আসছে। একটা রাগারাগির শব্দ। নীলার গলা পাওয়া যাচ্ছে। সে যেন কারোর উপর মান করেছে। বলছে, “ছেড়ে দাও! কালও আসতে হবে না। আমি একা চলে যাবো”।

 

ভিতরে নীলার সাথে কেউ আছে? আমার মনে পড়ল, ওর এই কিশোরীসুলভ রাগত কন্ঠস্বর আমি চিনি। অনেকদিন আগে এই অভিমানের বিপরীতে আমি দাঁড়াতাম। ভাবলাম এত রাতে কার সাথে এভাবে কথা বলছে?

 

কয়েক মুহূর্ত চুপ। তারপর আবার নীলার গলা, “বুঝতে পারছি বলেই বলছি। তুমি একেবারে শনিবারে এসো। কাল নিজের অসুবিধে করে আসার কোনও মানে হয় না!”

 

অবাক হলাম, আমি কোনও ঈর্ষা বা সন্দেহ টের পাচ্ছি না তো ভিতরে! অধিকারবোধে ও লাগছে না। তবে কি নীলা আমার কাজ সহজ করে দেবে? কিন্তু, এত সহজ হোক সবটা, এমনটাও তো চাই না।

 

ডুপ্লিকেট চাবি হাতে রেখে বেল বাজালাম। কয়েক সেকেন্ডে দরজা খুলল নীলা। আমি চমকে উঠলাম। কারণ দেখলাম একজোড়া চোখ। পাঁচবছর আগের একজোড়া চশমা পরা চোখ। যেন এখনও কলেজের গন্ধ যায়নি গা থেকে। যেন এখনও দুনিয়াদারি বোঝেনি। সরল, অভিমানী, ইউটোপিয়ান দুনিয়ায় বসবাসকারী একজোড়া কাজলটানা চোখ। এক লহমায় মনে পড়ল কোথায় দেখেছিলাম এই চোখ।

 

কোনও অ্যাসাইনমেন্ট ছিল না সেদিন। ফেব্রুয়ারির এক সন্ধেয় হাতে কোনও কাজ না থাকায় শহিদ কলোনি থেকে ক্যাম্পাসের দিকে যাচ্ছিলাম। তখনও বেশ ঠাণ্ডা, বাতাসে বৃষ্টির পূর্বাভাস। তবু, সরস্বতী পুজোর ট্রেডমার্ক হাওয়া বইছিল শরীরে। ঝিলের রাস্তাটা হেঁটে রেলগেটে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। যখন স্টেশনে একটা ট্রেন ঢুকছে তখন আচমকা দেখলাম আমার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটার খুব তাড়া! ডেকে লাভ হতো না। উপস্থিত বুদ্ধিবলে তার সবুজ সোয়েটারে দিলাম এক টান। মেয়েটা হ্যাঁচকা টান সামলাতে না পেরে আমার দিকে সরে এল। মুহূর্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। আর আমি দেখলাম সেই চশমা পরা চোখ। আমার চেয়ে ওই পাঁচ-ছ বছরের ছোটো একটা মেয়ে, সারল্য আর তীব্রতা মিশে আছে চোখে, চশমার কাচে স্টেশনের বিন্দু আলো খেলা করছে। তারপরেই লজ্জিত হয়ে হেসে ফেলল মেয়েটা।

 

নীলার সেই চোখজোড়া কতদিন পর গতকাল রাতে দেখলাম। একটু হাসলও কি? আমার চোখে ধাঁধা লেগে গেল। কী করা উচিত বুঝে না উঠে অস্বস্তি হল। মুখ ফিরিয়ে নিলাম।

 

ঘরে ঢুকে বুঝলাম ফোনে কথা বলছিল নীলা। হঠাৎ আমার মাথাটা বিগড়ে গেল। মনে হল, আজই এই হাসি, এই পুরনো চাহনি, সবই নীলার একটা খেলা। আমাকে বিদ্রুপ করছে কারণ ও জেনে গেছে! ও জেনে গেছে আজ সারা সন্ধে আমি ইরাবতীর ফ্ল্যাটে ছিলাম। ও জেনে গেছে, আজ জীবনে প্রথমবার আমি ইরাকে দেখলাম! খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, প্রতিটা কোশ, ত্বকের প্রতিটা কোণ, শরীরের প্রতিটা ভাঁজ, সবটা! দশ বছর ধরে যে ঐশ্বর্য আগলে রেখেছিল ইরা, আজকে আমি তার স্বাদ পেলাম। আর এখন হাসি দিয়ে খেলাচ্ছে আমায় নীলা। বিরক্ত লাগল। বেডরুমে ঢুকে গেলাম।

 

আজ বেশ কয়েকমাস আমাদের কথাবার্তা হয় না। বছরখানেক হল আমাদের শোবার ঘর আলাদা। প্রথম প্রথম রাগের বশে এমনটা করতাম আমি। নীলা সযত্নে আমার সেই অভ্যেসটা রেখে দিয়েছে। বরং আমাকে বেডরুমটা ছেড়ে দিয়ে নিজে স্টাডিতে চলে গেছে। সেখানে অনেক রাত পর্যন্ত খাতায় হিজিবিজি কাটত, বই নিয়ে শুয়ে পড়ত। আমি দেখতে যেতাম না।

 

গত একবছর আমি নীলাকে ছুঁইনি। গত একবছর ধরে ইরাবতী আমাকে অধিকার করে নিয়েছে। একটু একটু করে। নীলা আর ইরার মধ্যে বয়সের নয়, স্বভাবেরও বিস্তর ফারাক। নীলা ছটফটে ছিল, অবুঝ প্রকৃতির, কিছু কিছু ক্ষেত্রে দারুণ অপরিণত! আমার চোখে লাগত। বরাবরই পারফেকশনিস্ট আমি। ওর খুঁতগুলো নিজের কাছে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেও পারতাম না। তখনই পুরনো বন্ধু ইরা এল। আচমকা দেখা হল। ইরা বড্ড স্থির মানসিকতার। একটা পরিশীলিত ভাব। ওর ব্যক্তিত্বের এই শান্ত, বুদ্ধিমত্তার সাথে সামলে দেওয়ার দিকগুলো আমাকে টানতে শুরু করল। আমি চেয়েছিলাম, একটা সময়ে ভেবেছিলাম কেন ইরাকে পেলাম না! কিন্তু ওই নেমপ্লেটে লিখে রাখা “ঘর”, আর “ঘর”- এর ভিতর অবুঝ প্রকৃতির নীলা, কী এক টান যেন ছিল!

 

নীলা যেদিন বুঝল, জানল, চরম অশান্তি করেছিল। ওর স্বভাব অনুযায়ী! আরও অশান্তি করলে হয়তো ব্যাপারটা যেকোনো একটা দিকে গড়াতে পারত, কিন্তু ও আচমকা নিশ্চুপ হয়ে গেল। সম্পূর্ণ শান্ত। শান্ত না বলে স্তিমিত বলা ভাল। মিইয়ে গেল। সরে গেল। আমাকে ইরার দিকে ঠেলে দিল যেন! তাতে আমার নীলার প্রতি আক্রোশ আরও বাড়ল। আমি ওকে আশ্রিতের মতো দেখতে শুরু করলাম।

 

কিন্তু, নীলা জানে না, গতকাল রাতে ওই চোখজোড়া, ওই হাসি আমাকে নুড়ি পাথর সরাতে বাধ্য করছিল। কোনও চাপা অপরাধবোধ ছিল কিনা জানি না, বুঝতে পারি না, কিন্তু কাল অনেক রাতে, শেষ সিগারেটটা পুড়ে যাওয়ার পর, ইরার টেক্সটের পরিবর্তে শুভরাত্রি জানানোর পর, ডাইনিং এর অন্ধকার পেরিয়ে আমি স্টাডিতে একবার চোখ রেখেছিলাম। বহুদিন পর। দেখেছিলাম, নীলা ঘুমোচ্ছে। বুক থেকে নেমে গেছে একটা বই। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে। তক্তপোশের পায়ের কাছে একটা ভারী চাদর। ওর গায়ে চাদর নেই। অল্প অল্প কাঁপছে। তবু, যেন কতদিন ঘুমোয়নি, এমন ক্লান্তিতে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে নীলা। আর, বন্ধ চোখেই আটকে আছে চশমাটা। 

 

এখন ওই চশমাটা কালো পাথরের উপর ছিটকে গেছে। কাচভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। নীলা ঘুমোচ্ছে।

 

আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে যেতে হবে। নীলার হিজিবিজি কাটার ডায়রি থেকে নৈঋত নামের একজনের খোঁজ পাওয়া গেছে। তার খোঁজ চলবে। আমিও তাকে খুঁজব। নৈঋতের কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে।

 

 

 

নৈঋত

 

পিছিয়ে যেতে যেতে আটকা পড়ে যাচ্ছি আমি। আজ রোদ ওঠেনি। এখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বেশ কয়েকটা ছাতা খুলে গেছে। ভিড় সরে গেছে। অদ্ভুত শান্ত চারপাশ। এলাকাটা সামান্য থমকে তার নিজের ছন্দ ফিরে পেয়েছে আবার। অবস্থাটার সঠিক বর্ণনা করা যাচ্ছে না। নীলা থাকলে পারত। যেকোনো দৃশ্যের, যেকোনো রাস্তার, যেকোনো স্মৃতির হুবহু বর্ণনা দিতে পারত। কিচ্ছু বাদ যেত না। গল্পের ছলে বলে দিতে পারত। আমার অবাক লাগছে, ওর চলে যাওয়ার এই রাস্তাটার কোথাও কিছু কম পড়েনি। ও ঠিকই বলত, কোথাও কিচ্ছু কম পড়ে না।

 

প্রায়শই সন্ধে হলে এই রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম দু’জন। নীলা আমায় শেখাত পর্যবেক্ষণের ভূমিকা। মাঝেমধ্যে থেমে যেত। একেকটি দৃশ্য, রাস্তার ধারের কোণায় জমাট অন্ধকার, কোনও ঘুপচি দোকান, নাইন-বির ফুটপাতের ফেরিওয়ালা, বা বিকেলবেলায় বাসস্ট্যান্ডে বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলে ওঠা - সমস্ত অতি সাধারণ দৃশ্য দেখতে থমকে যেত। হা করে একেকটি দৃশ্য গিলত যেন! ওর হাত ধরে টানতাম। নীলাকে ছুঁতাম। পরস্ত্রী বলে মনে হতো না। ওকে ছুঁলে মনে হতো একরাশ গল্পের শরীর ছুঁলাম।

 

নীলাকে প্রথম দেখেছিলাম শরতের বিকেলে। রেলগেটের ওধারে। নীলা আমায় দেখছিল। কিছুটা বিস্মিত চোখে। যেন চেনে, আবার চেনেও না। ওর দৃষ্টি বিভ্রান্ত ছিল কিনা জানি না, কিন্তু ওই কালো সালোয়ার কামিজ আর কালো শেলফ্রেমের চশমা মনে আছে। মাঝখানে একটা ট্রেন বেরিয়ে গেল। নীলা রেললাইন পেরিয়ে এগিয়ে এল। আমার যাওয়ার কথা ছিল এইট বি। আমি তা ভুলে গেলাম। ওর পিছু পিছু রাস্তা পার হলাম, ঝিলের রাস্তায় প্রায় ওর পাশে হাঁটতে শুরু করলাম।

 

বিবেক সংঘের মাঠের কাছে এসে নীলাই প্রথম প্রশ্ন করল, “আপনি এদিকে থাকেন?”

 

বললাম, “ঠিক এদিকে নয়, সন্ধ্যাবাজারের দিকটায় থাকি। আপনি কি এদিকেই?”

 

নীলা বলল, “সেলিমপুরের দিকে। আজ রোদটা নরম। পুজোর হাওয়া। ভাবলাম হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজ পেরবো”।

 

ওর সাথে হাঁটার সেই শুরু। ধীরে ধীরে নীলাকে জেনেছি। ওর হাসি, ওর চাহনি, সবটা ফের ওর মতোই হয়ে উঠছিল। আমি জানতাম, দেরি হলেও ও ফিরে পাবে যা খুঁজছিল। আমাদের অনর্গল কথায়, প্রতি সন্ধের হাঁটায় কত কী দরজা খুলত! একেকদিন ওর সাথে চলে যেতাম কলেজস্ট্রিট। নীলা খুব পুরনো বই কিনত। আর কত কী লিখত। জিজ্ঞাসা করলে বলত, “হিজিবিজি!”

 

আমি জানি, দৃশ্যের বর্ণনা লিখে রাখত। খারাপ দৃশ্য, যন্ত্রণার দৃশ্য, আনন্দের দৃশ্য, আপাত অর্থহীন কোনও সামান্য দৃশ্য, সব। হেমন্তের দুপুরে প্রথম ওর ঘরে প্রবেশাধিকার পেলাম। ঘর বলতে তক্তপোশ, চেয়ার, টেবিল, আর বই খাতা কলম। কিছু মেয়েলি পোশাক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তার মধ্যেই শাল রেখে বসেছিলাম আমরা। জেনেছিলাম, পাশের শোবার ঘরটা সৌম্য’র। হাসতে হাসতে দৃশ্যের বর্ণনা দিচ্ছিল নীলা। আমি জেনে যাচ্ছিলাম এই “ঘর”-এর ভিতরকার পাঁকজল।

 

তারপর বহুবার নীলাকে ছুঁয়েছি, প্রায় প্রতিদিন ওর সাথে হেঁটেছি। ওর ডায়রিতে আঁকা আমার মুখ দেখেছি। নতুন যন্ত্রণা, নতুন লেখা, নতুন আঁকা, নতুন বই, সবটা আমাকে এসে বলত নীলা। সৌম্য’র চেয়ে বেশি অধিকারবোধ আমার তৈরি হয়েছিল। আমি স্বার্থপর হয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম সৌম্য’র সাথে নীলার সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ। নীলাকে নিজের করে পাওয়ার এই একটিমাত্র উপায় ছিল। কারণ, আমি জানতাম সৌম্য কাছে এলে আমি আবছা হয়ে যাবো! নীলা’র মস্তিষ্প্রসূত আমি ক্রমেই অস্তিত্বহীন হয়ে যাবো।

 

এখন নীলার মস্তিষ্ক নষ্ট করা হবে। আমার ভয়, মস্তিষ্কের ভিতর এই নৈঋত নষ্ট হয়ে যাবে।

 

 

 

নীলা

 

একটা বিনবিনে শব্দ। একঘেয়ে। বিশ্রী। বন্ধ হচ্ছে না। একটা বড় মাছি। মুখে, ঠোঁটে, কপালে বসছে। একটা, দুটো করে মাছি বেড়ে যাচ্ছে। বিনবিনে শব্দটা বেড়ে যাচ্ছে। দৃশ্যটা লেখা যাচ্ছে না।

 

গতরাতে ঘুমের মধ্যে একটা দৃশ্য দেখেছিলাম। খুব অস্পষ্ট, হয়তো স্বপ্নের ভিতর, তবু মনে হল যেন সামনের দরজাটায় খয়েরি অন্ধকারের মধ্যে একটা কালো মূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে। পা টিপে টিপে এল, আমাকে দেখল, এগোতে চেষ্টা করল, পারল না। দরজায় ঠেস দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ। মূর্তিটাকে আমি চিনি। সৌম্য!

 

ভোরবেলা ঘুম ভেঙে প্রথমেই গতরাতে স্বপ্নের দৃশ্যটা মনে পড়ল। লিখে রাখতে হবে। মনে হল, লিখে রাখার আগে নৈঋতকে জানাতে হবে। কিন্তু, আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, নৈঋতের বাড়ি কোথায় মনে করতে পারছি না। অনেক চেষ্টা করলাম। টুকিটাকি কাজের ভিতর, একটু একটু আলো ফোটার ভিতর, মাথার অস্বস্তিকর যন্ত্রণার ভিতর কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। আমার ভয় করছিল। নৈঋত যদি আর না আসে! মেঘলা ছিল, অল্প বৃষ্টি পড়ছিল, হালকা চাদরটা গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে এলাম।

 

কিছুটা অস্থির পায়ে হাঁটছিলাম। আমার বিশ্বাস দৃঢ় হচ্ছিল, নৈঋতের ঠিকানাটা মনে করতে পারব না। আমি আতঙ্কিত ছিলাম, নৈঋতের সাথে আর দেখা হবে না। আমি আরও জোরে পা চালালাম। বিবেক সংঘের মাঠ, শহিদ কলোনি, ঝিল রোড, সবখানে রাস্তার দু’পাশ ফিরে ফিরে দেখেছি। কোথাও দেখা হচ্ছে না তার সাথে। এদিকে দৃশ্যটাও এখুনি জানাতে হবে!

 

রাস্তায় বেশি লোক ছিল না। দুয়েকটা খবরের কাগজের সাইকেল আমাকে ছাড়িয়ে গেল। মুরগির ঝাঁক বাঁধা সাইকেল অদ্ভুত শব্দে চলে গেল, আমি কোনওদিকে তাকালাম না, কোনও শব্দে দাঁড়ালাম না। দিন শুরুর শব্দ, ছবি আমায় টানছিল না।

 

শেষে রেলগেটে দেখতে পেলাম নৈঋতকে। যেমনটা দেখেছিলাম প্রথম বিকেলে ওকে। আমি ওর জায়গায় দাঁড়িয়ে। ওপারে ও আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে। একটা এক্সপ্রেস আসছে। আমার বুকে স্বস্তির রক্তস্রোত নেমে যাচ্ছে। ট্রেনটা চলে যাওয়ার অপেক্ষা। হঠাৎ দেখলাম নৈঋতের কোঁকড়ানো চুল অস্পষ্ট হয়ে আসছে, শ্যাওলা রঙের পাঞ্জাবির হাত দুটো যেন অল্প অল্প ক্ষয়ে যাচ্ছে, অদৃশ্য হওয়ার খেলা খেলছে। নৈঋৎ ক্রমেই আবছা হয়ে আসছে।

 

ওকে ধরে ফেলতে হবে। ও হারিয়ে যাওয়ার আগেই ওকে ধরে ফেলতে হবে। লাফিয়ে পা বাড়ালাম…

 

এখন অন্ধকার… এখানে নৈঋত নেই। এখানে সৌম্য, বহুদিন হল, থাকে না!

 

 

 

**********************

 

 

 

ইরাবতীর ফ্ল্যাট থেকে নেমে এসে সিগারেট ধরালো সৌম্য। কাল সকালের ফ্লাইটে দিল্লি যাচ্ছে ইরা। আজীবনের মতো। কথাটা কীভাবে বলবে বুঝতে পারছিল না ও। শেষে সৌম্যই সবটা সহজ করে দিল। নিজেও বুঝল, চারপাশে একটা ভার নেমে যাওয়ার মতো হাওয়া। লুকোতে চাইলেও ইরা তা টের পেল। একেই কি “মুক্তির স্বাদ” বলে?

 

ঝিলের ধার দিয়ে হাঁটছিল সৌম্য। ক্লাবের দিকে জোরালো আলো। ঝিলের দিকে হালকা অন্ধকার। হঠাৎ মনে হল উল্টোদিক থেকে যে আসছে তাকে চেনে সৌম্য। কোথায় দেখেছে মনে করতে করতে একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল। উল্টোদিকের মানুষটাকে সে নীলার ডায়রিতে দেখেছে। আজ প্রায় ছয়-সাত মাস ধরে বারবার। সে সশরীরে এগিয়ে আসছে! নৈঋত! চেনা লোকের দেখা পেয়ে যেন দ্রুত এগিয়ে গেল সৌম্য। আলাপ করতে হবে। আলাপ জমাতে হবে। নৈঋতের কাছে সৌম্য’র একটা প্রশ্ন আছে যে!

 

নীলা কি নৈঋত’কে ভালবাসত? তাকে ছুঁয়ে দেখত?

 

সৌম্য টের পেল, সে হাঁটছে না। সম্মুখে দেখা অবয়বের দিকে ছুটছে!

Thursday, February 17, 2022

রিনি ভট্টাচার্য্য

রিনি ভট্টাচার্য্যের গল্প

 

রসপুলি আর মালপোয়া

 

মাসটা পৌষের শেষ। আজ পনেরোই জানুয়ারি আমাদের বাড়িতে বাস্তুপূজা। মা ভোর তিনটেতে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে নিয়ে ভেজা গরদের শাড়ি পড়ে ঘোমটা টেনে কাঁপতে কাঁপতে সত্যেন-ভাইয়ার গোবর জল দিয়ে লেপামোছা উঠোনের ঠিক মধ্যিখানে ছটি পাটকাঠিকে জল দিয়ে ফুলের মালায় সাজিয়ে একটা ঝকঝকে কাঁসার পরাতে রেখেছেন। তারপর ছখানি এঁটেল মাটির গোল গোল মন্ড বানিয়ে মাটিতে খুরপি দিয়ে গর্ত করে তার ভেতরে পাঠকাঠিগুলো চেপে বসিয়ে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বাগানের থেকে বাবার তুলে দেওয়া, আমার গাঁথা নানা রকমের ফুলের মালা নিয়ে মা সেগুলোকে সাজিয়ে দিলেন। কী অপরূপ লাগছিল দেখতে!

 

একপাশে কাঠকয়লার উনুনে মা আমাদের বাড়ির জার্সি গরুর দুধ দিয়ে পায়েস বানালেন। বিনা চিনিতে। তারপর ধোয়া কলাপাতায় সেই পায়েস সাজিয়ে দিলেন। পাশে পাশে একটু একটু করে নতুন খেজুর গুড়ের টুকরো রাখলেন। তারপর কাঠকয়লার উনুন জ্বালিয়ে তার ওপরে পেতলের কড়াই বসিয়ে তার মধ্যে বনস্পতি ডালডা ঢেলে বাটা মুগের ডালের সাথে বেসন, ময়দা, ক্ষীর ,মধু, কিসমিস, গুঁড়ো ছোট এলাচ মিশিয়ে চটকে মেখে গোল গোল ছোটো ছোটো  গুলি করে ছেড়ে ফুটন্ত ডালডায় ছান্তা দিয়ে নাড়তে লাগলেন। বেশ কড়া করে ভেজে ছেড়ে দিলেন চিনির রসের কড়াইয়ে। এগুলো হল রসপুলি।  কী অপুর্ব ই না খেতে! এবার ময়দা, ক্ষীর, বেসন, সুজি, চালের গুড়ো দিয়ে পাতলা পাতলা গোলা তৈরী করে বেলনা চাকি দিয়ে বেলে গরম ডালডায় ভেজে আখের গুড়ের রসে ডোবানো হল। এ হল মালপোয়া। তার সাথে মার হাতে বানানো নারকোলের নাড়ু, পাঁচ রকমের গোটা ফল, ভেজা সোনা মুগের ও কালো নেনিয়া চাল দিয়ে নৈবেদ্য সাজানো হল। বাঁ ধারে দীপ-ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।  পুরো বাড়িটা মধুর সুবাসে ভরে উঠল।

 

এ সবই হল বাস্তু পূজার উপচার। কত সুন্দর করে মা সাজিয়ে দিলেন সেই পাটকাঠি ঠাকুরদের সামনে! এখন অপেক্ষা আমাদের গৃহ পুরোহিত অমূল্য বক্সীর জন্য। তিনি আসেন শালগ্রাম শিলা  হাতে নিয়ে। তাই মৌনীবাবা হয়ে থাকতে হয়। এমনিতে সাধারণত একটু তুতলে কথা বলেন। আমরা তিন ভাই-বোন ওঁকে জেঠুমনি বলে ডাকি।

 

আমি শৈলেয়ী। বড়ো দাদা শিরীষ। ছোটো দাদা শিল্পিক। বাবা শিরোদেশ গঙ্গোপাধ্যায়। মা পদ্মাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায়। আমাদের এই বাড়িটাতে অনেক গাছ আছে। তাতে কত ধরনের পাখির বাসা! একটা লিচু গাছ আছে। সে গাছের মাঝের শক্ত শাখায় দাদারা একটা সেগুন খাটের পিঁড়িতে পুরনো কাপড় দিয়ে জড়িয়ে চার ধারে ফুটো করে চারফালি পাটের দড়ি দিয়ে বেঁধে একটা দোলনা বানিয়েছে। আমরা তাতে দুলে দুলে লেখাপড়া করি।

 

বাস্তুপূজা সকাল নটার মধ্যেই শেষ হল। আমরা তিন ভাই-বোন কুয়োর জলে স্নান করে স্কুল যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। তারপর মার দেওয়া পুজোর প্রসাদ খেতে বসলাম। বিনা চিনির পায়েস খেজুরের গুড় দিয়ে মেখে খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। তার সাথে রসপুলি ও মালপোয়া! ভাবা-ই যায় না!

 

 

 

বড় দাদা পড়ে ক্লাস টুয়েলভে। ছোটজন দশম শ্রেণীতে। আমি ক্লাস এইটে। মা ও বাবাকে প্রণাম করে যে যার স্কুলের দিকে রওনা দিলাম বাবার ঠিক করা রিক্সা করে। এই দিনটা বড়ই স্পেশাল। খুশিমনে এগোতে শুরু করলাম। স্কুলেও আমরা খুব মজা করলাম। টিফিনে পিঠে খেলাম। মায়ের বানানো পিঠেপুলি-পায়েস-নাড়ু তো অতুলনীয়! স্কুল থেকে ফিরে দেখি বাড়ি ভর্তি লোকজন। অতিথি।  আমাদের উৎরাই পাড়ার মানুষেরা, বাবার বন্ধু ও সহকর্মী, দাদাদের বন্ধুরা, ও আমার কয়েকজন খেলার সাথী।

 

সবাই আমাদের গোলাকার আঙিনার চারপাশে বসে মার বানানো রসপুলী ও মালপোয়া  পরম পরিতৃপ্তির সাথে খাচ্ছেন ও খাচ্ছে। একদম পিছনের সারিতে এক অচেনা কিশোর লাজুক মুখে বসে আছে। কিছুই খাচ্ছে না। বড়ো দাদা তার কাছে গিয়ে বলল,  কী রে জহর? খাচ্ছিস না কেন রে? অত লজ্জা দেখাতে হবে না। খেয়ে নে। না হলে আমাদের মা-বাবা কষ্ট পাবেন। বুঝিস না?”

 

সেই ছেলে মৃদু কন্ঠে বলল, “পুজোর প্রসাদ তো! আমার কি খাওয়া উচিত?”

 

সেকথা শুনে মা তার কাছে গিয়ে বললেন, “কেন রে বাবা খাচ্ছিস না? খেতে ইচ্ছা করছে না বুঝি?”

 

সে  মাথা নিচু করে বলল, “মাসিমা! আমি যে মুসলমান। আমার পুজোর প্রসাদ কি খাওয়া উচিত?”

 

মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উত্তর দিলেন, “খা তো। কিচ্ছু হবে না। কিছু হয় না ভালবাসার প্রসাদ খেলে। তোদের বাড়িতে ইদের দিন গিয়ে আমরাও খেয়ে আসবো

 

জহর হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মাকে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি? যাবেন আমাদের বাড়িতে। ছোটো বাড়ি কিন্তু! অসুবিধে হবে না তো?” আমি দেখছিলাম, শুনছিলাম, ভাবছিলাম যে মুসলমান হওয়াটা কি অপরাধ? অন্যায়? পাপ?

 

সবার খাওয়া হলে  লোহার বালতিতে রাখা জল দিয়ে দাদারা তামার ঘটি করে সকলের হাত ধুইয়ে দিলেন। জহর নামের ছেলেটি বিনীতভাবে দাদাদের বলল, “ছেড়ে দাও না গো! আমি নিজেই হাত ধুয়ে নিচ্ছি। আমাকে অত সমাদর করার কী দরকার শিরীষ?” দাদা সত্যিই রেগে গিয়ে জহরের কান ধরে নিজে ঘষে ঘষে ওর হাত ধুইয়ে দিল। তারপর ওর হাত ধরে টানতে টানতে আমাদের বসার ঘরে নিয়ে এসে বসালো। আমার কাছে একটা তোয়ালে চাইল। আমি এনে দিলাম। দাদা ওর হাত দুটো মুছে দিলো। সে সময় আমি জহরকে ভালো করে দেখলাম। ভারি হ্যান্ডসাম দেখতে। বেশ পাঠানী পাঠানী চেহারা।

 

ও আমার দিকে তাকলো। আর আমি ওর দিকে। কী যে হল জানিনা। আমরা দুজনে একে অপরের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলাম। সময় পেরোতেই থাকলো। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়ালো। দাদাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এবার যাই রে দোস্ত। কাল সকালে কলেজে যেতে হবে। একটা প্রোজেক্টের দায়িত্ব আমায় দিয়েছেন রজত স্যার। তাই রাত জেগে কাজটা শেষ করতেই হবে!

 

আমার জানতে ইচ্ছে করছিল ও কী পড়ে? কোন কলেজে? কীসের প্রোজেক্ট? দাদাকে জিজ্ঞেস করতে বেশ লজ্জা লাগছিল। তারপর জহর মা ও বাবাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। অন্যান্য অতিথিদের নমস্কার করে বেরিয়ে গেল। আমার ভেতরটা শূন্য হয়ে গেল।  এমন উপলব্ধি তো আগে কখনও হয়নি! বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছিল।

 

রাতে খাওয়ার সময় বাবা দাদাকে প্রশ্ন করলেন, “শিরু! তোর বন্ধু তো মুসমান। ওর নাম জহর কেন?” দাদা এক মর্মন্তুদ কাহিনী শোনালো-  জহরের আব্বার নাম ছিল তাজঊদ্দিন আহমেদ। ওরা চট্টগ্রামের মানুষ। মেসোমশাই যুক্ত হলেন মাস্টারদা সূর্য্য সেনের সাথে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ভয়ংকর কাজে যোগ দিয়েছিলেন এবং সেই অসম লড়াইয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের গুলীতে মারা গিয়েছেন। ওর আম্মা পরভিন বিবি এক পুলিশ অফিসারের দ্বারা ধর্ষিতা হয়ে আত্মহনন করেন। ও তখন ছিল এক বছরের এক অনাথ শিশু। এরপর দেশ স্বাধীন হল। অনাথ আশ্রমের কর্মাধক্ষ এক হিন্দু ব্যক্তি যাঁর নাম সুবিমল সেন। তিনি ঐ বাচ্চাটার বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে ওকে দত্তক নিলেন। ওঁর স্ত্রী ছিলেন মুসলিম। তাঁদের কোন সন্তান ছিল না। তাই তাঁরা দুজনেই ওকে পরম স্নেহে গড়ে তুললেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে। ওর ডাক নাম জহর। অফিশিয়াল নাম মুনাব্বর আহমেদ। ও জেলা স্কুল থেকে মাত্র পনেরো বছর বয়সে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছিল ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়ে। এখন গভর্নমেন্ট কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। ফার্স্ট ইয়ারে। ওর বাবা ও মা এখন বৃদ্ধ। আয়ও কিঞ্চিৎ। আজকাল মাসিমা ও মেসোমশাই দীনবাজারের মেন রোডের ধারে একটা ছোটো চা ও জলখাবারের দোকান চালান। বাকি সংসার খরচ চলে  জহরের টিউটোরিয়াল হোমে পড়ানোর আর স্কলারশিপের টাকায়। এসব সৎ মানুষদের দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজ কি মনে রাখে? বলো বাবা?”

 

বাবার দুচোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।  মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আমাদের তিন ভাই-বোনের চোখেও জল। আমাদের বাস্তুপূজার আনন্দের অন্ত হলো এক সম্মিলিত চোখের জলের নদীতে!!!

 

দিন পেরোতে থাকলো, আমাদের কাঞ্চনগুড়ি শহরের দুই খান নদীর বহমান জলের মতো। এর মধ্যে জহর কতবার এসেছে আমাদের বাড়ি। আমরা ও গিয়েছি ওদের বাড়ি সব কটা ইদের দিনে। ইদের বিরিয়ানি, অন্যান্য  খাবার ও ফিরনি ও শরবত খেয়ে এসেছি। ওকে আমার ভাললাগা যে গভীর ভালবাসায় রূপান্তরিত, আমরা দুজনেই টের পাইনি। ও এখন বিখ্যাত মেকানিক্যাল ইন্জিনিয়ার। দাদারা কলেজের পাঠ সমাপ্ত করে একজন এম বি এ করছে আর একজন আই এস আই এ পড়ছে। আমি ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে পড়াশুনা করছি। আমরা আলাদা করে দেখাও করি। ও আমায় ছোঁয়। আমিও ওকে। কী যে ভালো লাগে! মা-বাবা-দাদারা অল্প-বিস্তর বোঝেন। আমাকে যথেষ্ঠ প্রশয় দেওয়া হয়। কারণ জহরের মতো ভালো ছেলে এ পৃথিবীতে বোধহয় একটিই আছে।

 

এদিকে ওর চাকরির বন্দোবস্ত প্রায় হয়েই গেল। জিআরই-তে অসাধারণ মার্কস পেয়ে রিসার্চ করার জন্য বোস্টনে এমআইটি-তে চান্স পেয়ে গেল। ইতিমধ্যে ওর বাবা প্রয়াত হলেন। ও ভাবছিল মাকে সাথে নিয়েই যাবে না কি। আরো একজনকে নিয়ে যাবার জন্য ও কথা বললো আমার মা-বাবা-দাদাদের সাথে। তাঁরা রাজি। আমি তো বিহ্বল হয়ে পড়েছি। ও তো আমার মুন। আর আমি ওর শৈলী।

 

আমাদের আত্মীয়স্বজন ও পাড়ার বেশিরভাগ মানুষ এই বিয়ের ব্যাপারটাতে বেশ বিরক্ত হলেন। মা ও বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। আমরা প্রায় সামাজিক ভাবে একঘরে হয় গেলাম। তাতে কারোরই কোনও উচ্চবাচ্য ছিল না। স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন অফিসে নোটিশ দেওয়া হল।

 

এর মধ্যে যা ঘটলো তাতে বাড়ির সকলে সত্যিই চিন্তিত ও ভীত হয়ে পড়ল। শহরের কুড়ি-পঁচিশ জন মস্তান ধরনের লোক বাবা ও দাদাদের শাসিয়ে গেল। তাদের বক্তব্য হল, এই বিয়ের আগেই আমাদের চরম বিপদ আসন্ন। তারা জহরের ক্ষতি করবে এবং আমারও। এর পরে মা,বাবা ও দাদারা আশঙ্কিত হয়ে পড়লেন। দুই দাদাই জহরের বাড়িতে গেল। ওকে সব কিছু বলে আপাতত বাড়ি থেকে বেরোতে মানা করে এল। আমি এতই ভাবিত হলাম যে মাকে বললাম, “মা গো! এই বিয়েটা ভেঙে দাও। জহরের প্রাণের থেকে বিয়েটা কি বেশি জরুরি? আমারও তো কোনও না কোনও বিপদ হতেই পারে। তাছাড়া, বাবা ও দাদাদের নিরাপত্তার কথাও তো ভাবা দরকার

 

মা চোখের জল মুছে রুখে দাঁড়িয়ে বললেন, “তুই আমার  মেয়ে হয়ে এত ভীতু কি করে হলি? কি করতে পারে ওরা? কতটা ক্ষতি? আমরা হার মানবো না। বিয়ের পর তোরা তিনজনে বিদেশ চলে যাবি। পাসপোর্ট-ভিসা সব তো প্রস্তুত। বিয়ে হবেই। আমাদের নিজের শহর। আমাদের কিছু আত্মীয়রা, তোর বাবার ও দাদাদের হিতৈষীরা তো আমাদের পাশে আছে রে। ভালো কাজে কত বিপদ আসে। সেগুলোকে ভেদ করে এগিয়ে যেতে হয় এক আলোকময় জীবনের পথে। তুই একদম ভয় পাবিনা। আমরা তো আছি রে!মা আমার কপালে চুমু দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। মায়ের কথা কখনও ভুল হতেই পারেনা

 

দিন এসে গেলো রেজিস্ট্রির। আমাকে মা সাজিয়ে দিলেন তাঁর মনের মতো করে। ওদিকে মুনকে দাদারা প্রস্তুত করে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে গেলো রেজিস্ট্রি অফিসের উদ্দেশে। মা-বাবার সাথে আমিও রওনা হলাম। মাত্র তিন কিলোমিটার পথ। যাবার সময়ে রাস্তার দেখলাম অনেক পুলিশ। চারপাশে ছমছমে। নিঃশব্দ। হঠাৎ ফায়ারিং- এর প্রচন্ড আওয়াজ শুনতে পেলাম। একজন পুলিশ  অফিসার আমাদের গাড়িটা থামিয়ে দিলেন। এবং বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। রাস্তার মোড়ে নাকি ভীষন গণ্ডগোল হচ্ছে। একজন মৃত। আমরা শিউরে উঠলাম। বাবা জানতে চাইলেন, “তার পরিচয় জানেন কি? নাম ইত্যাদি?”

 

তিনি বললেন, “ঐ মুনাব্বর আহমেদ নামের এক টেররিস্ট। যান...যান...বাড়ি ফিরে যান। একটু পরেই খানাতল্লাশি শুরু হবে ও কার্ফু লাগু করা হচ্ছে 

 

আমি আর কিছু জানিনা। কতকাল কেটে গেল। আমি তো এখন পুদুচেরিতে অনাথ শিশুদের পড়াই। ভালোই আছি।

Wednesday, January 20, 2021

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৪

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প

ফেরা


মণিবাবুর গাড়িতে জায়গা না পেলে আজ আর ফেরা হত না আমার। সিনেমা লাইনে কাজ করি, রোজ রাত হবারই কথা। কিন্তু এত রাত হয় না কখনও। এমনিতেই কলকাতার পরিস্থিতি এখন খুব একটা ভালো নয়। ধরপাকড় আর গুমখুনে ছেয়ে গেছে শহরটা। তার উপর আমি খোঁড়া মানুষ বলে স্টুডিও থেকে সন্ধেরাতেই ছাড়া পাই। তবে আজ তা হবার জো ছিল না। প্রোডিউসার আগরওয়াল-এর সাথে আমাদের ডিরেক্টর রমেনবাবু'র ঝামেলা চলছিল অনেকদিনই। আজ তো সন্ধেবেলা সেটের মধ্যেই ধুন্ধুমার বেঁধে গেল। অবিশ্যি তারপর ঝামেলা মিটে ও গেছে, কিন্তু ওই প্যাক আপ হতে হতে এগারোটা বেজে গেল। সুযোগ বুঝে কাটতেও পারলুম না আর।

শেষে উদ্ধার করলেন মণিবাবু। তিনি বর্ষীয়ান অভিনেতা, এই লাইনে আছেন সেই বড়ুয়াবাবুর সময় থেকে, গাড়িতে ওঠার সময়ে আমায় ডেকে নিলেন রাশভারী মানুষটি। মণিবাবু যাবেন লবণ হ্রদের দিকে। ওদিকে এখন বাড়ি তৈরির ঝোঁক তৈরি হচ্ছে। শুনেছি জমিজমাও সস্তা। আবার আমি ফিরব আর্মহারস্ট স্ট্রিট। তাই অনেকটা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শ্রীমানি বাজারের মুখে নেমে যখন হাতঘড়ি দেখি, তখন রাত বারোটা বেজে দশ।

উত্তর কলকাতার ব্যস্ত সমস্ত বড় রাস্তা এখন শুনশান। নভেম্বরের শেষ, শীত টাও বেশ জম্পেশ পড়েছে। তাই অলিগলি সব দরজা জানলা এঁটে গভীর ঘুমে মগ্ন। দূরে দূরে পুলিশের সাইরেন ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। আজকাল দেখছি টহল পুলিশের ভয়ে দেহাতি ঝাঁকা মুটে ওয়ালারাও রাত হলে বেমালুম উধাও হয়ে যায়। অদ্ভুত এক অবিশ্বাসের দমবন্ধ পরিবেশে আটকা পড়েছে মহানগর। এই নিস্তব্ধ আর আতঙ্কিত শহরটায় যেন এখন একা আমিই জেগে! আগেই বলেছি, জোরে পা চালানোর উপায় আমার নেই, খোঁড়া মানুষ। তাও লাঠিতে ভর করে যতটা পারা যায় তাড়াতাড়ি হাঁটি।

চারমাথা'র মোড় পেরিয়ে অর্মহারস্ট স্ট্রিটের রাস্তায় ঢুকতে যাব, দেখি কালো শাল ঢাকা একটি ছায়ামূর্তি হাতিবাগান এর দিক থেকে এসে আমার বাড়ির রাস্তায় ঢুকল। মূর্তিটি এক যুবকের। কালো শালের নীচ থেকে আদ্দির পাঞ্জাবি আর ঢোলা পায়জামা দেখা যাচ্ছে। খুব ধীরে, যেন পায়ের আওয়াজ না পড়ে, সেভাবেই মিহি ধোঁয়াটে কুয়াশায় হেঁটে যাচ্ছে যুবকটি। তার গড়ন, তার হাঁটার ধরন আমার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। একবার মুখ ঘুরিয়ে ছিল সেই ছায়ামূর্তি। আধো আলো, আধো অন্ধকারে, কুয়াশার ভিতর সেই মুখ দেখে দমবন্ধ হয়ে এসেছে আমার। সুবল! ঝাঁকড়া চুল, চাপদাড়ি, আর সেই জ্বলন্ত একজোড়া চোখ। কোনও ভুল নেই। এগিয়ে যাচ্ছে সুবল। চার এর পল্লী গলির মুখে ফুল আর ধূপ কাঠির প্যাকেট পেরিয়ে অবলীলায় গলির ভিতর মিলিয়ে গেল আটমাস আগে এনকাউন্টারে মৃত সুবল!

আমি তখন ঘামছি, সুবলের মুখে যাকে দেখলাম সে আমার বাড়ির গলিতে, আমারই বাড়িতে ঢুকেছে। ভাবলেই আমার গা ভারী হয়ে আসছে! কীভাবে যে পা চালিয়ে বাড়ির গেটে এসেছি, তা আমি জানি না। তবে গেটের মুখে শোভাদিকে দেখে ধড়ে প্রাণ এল আমার। শোভাদি অপ্রকৃতিস্থ। সাত-আট মাস আগে ছোট ছেলে সুবলের মৃত্যু সংবাদের পর থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন। রোজই রাত করে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমি ফেরার পথে হেসে কথা বলি। পরে সুবলের দাদা বৌদি বুঝিয়ে সুঝিয়ে দোতলায় নিয়ে যায়। আজ তাকে দেখেই যেন আশ্রয় পেলাম আমি। আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে সেই বিধবা বললেন, "এই ফিরছ? অনেক রাত হয়ে গেল আজ। দ্যাখো কাণ্ড! সুবলটা এখনও এল না!"

আমি কোনোমতে মাথা নাড়ি। এই শোকে বিহ্বল মাকে কি তাঁর আত্মজর অতৃপ্ত আত্মার আভাস দেওয়া যায়! সুবলের দাদাকে খবর দেব ভাবতে ভাবতে কালো দরজার গেট খুলে উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় এলাম। শিখা আলো জ্বেলে জল এনে দিল। বললাম, "বিমলের বৌকে খবর দাও তো"।

শিখা বলল, "এত রাতে ওদের ডেকে কাজ নেই। আজ দুপুরে শোভাদি মারা গেছেন"। আমার হাত থেকে জলের মগটা পড়ে গেল! টলে পড়ে যাবার আগের মুহূর্তে শিখার গলা পেলাম, "ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক, সময় দেয়নি! একটু আগে নিমতলা থেকে ফিরল সব!"

 

পুনশ্চ: বাহাত্তর সালের সেই শীতের রাতে বাঁচার তাগিদে ভুয়ো মৃত্যু সংবাদ ছড়ানোর পরেও, কোনোভাবে খবর পেয়ে মাকে শেষ দেখা দেখতে সত্যিই লুকিয়ে এসেছিল নকশাল নেতা সুবল। কিন্তু না, মায়ের সাথে সুবলা'র আর দেখা হয়নি।