নয়নতারা
সোহিনী চ্যাটার্জী
|১|
সকাল সাতটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। কুয়াশার
চাদর গায়ে দিয়ে সবে আড়মোড়া ভাঙছে নতুন সূর্যটা। পাতা ঝরানো কাঠগোলাপ গাছটা এখনো
দু'একটা খয়েরী পাতার বাহারে নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করছে ভোরের আলোয়।
আজ সোমবার। একটু তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠে
পড়েছে টুবাই। স্কুলে তার ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা হবে আজ। টুবাই এবার ক্লাস ফাইভে
উঠবে। মা বলেছে, এই পরীক্ষায় প্রথম দশ জনের মধ্য স্থান পেলে, পাশের পাড়ার বিকাশদা’র
দোকান থেকে তার সবচেয়ে পছন্দের রিমোট কন্ট্রোল গাড়িটা কিনে দেবে। সেটা পেলে টুবাই
কোন্ কোন্ বন্ধুকে সবচেয়ে
আগে দেখাবে, কাদের সাথে সবার আগে খেলবে, সবকিছু ঠিক করে রেখেছে। অপেক্ষা এখন শুধু রেসাল্টের।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে এইসবই ভাবছিল টুবাই। ব্যস্ত ভঙ্গীতে
দুধ কর্নফ্লেক্সের বাটি হাতে ঘরে ঢুকলো মা। ধমকের সুরে বলল, "কিরে! এখনো টাই'টাও
পড়িসনি? আটটা বাজতে যায়। আয়, আমি বেঁধে দিচ্ছি। ততক্ষণ কর্নফ্লেক্সেটা খেয়ে নে।"
ঠিক এই সময় কলিং বেলটা বাজল। কর্নফ্লেক্সের
বাটিটা মেঝেতে রেখে বারান্দায় দৌড়ে গেল টুবাই। এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন দরজার কাছে।
পরনে একটা মলিন, তাপ্পি দেওয়া ফতুয়া, আর ঢলঢলে একটা পায়জামা। কাঁধে একটা মলিন শ্যাওলা
রঙের ঝোলা ব্যাগ। মুখের অর্ধেকের বেশি অংশ ঢাকা সাদা দাড়িতে। চোখের রঙ কটা। এই লোকটাকে
চেনে টুবাই। পাড়ায় সবাই ওকে বিধু পাগল বলে ডাকে। ফুটপাতের পাশে ঐ পুরোনো বাড়ির রকটায়
বসে থাকে। সারাদিন কি যেন সব লেখে। রাতে আর তাকে দেখা যায় না। সকাল হলে বাড়িতে বাড়িতে
গিয়ে কড়া নাড়ে, আর বলে, "গল্প নেবে? অনেক রকম গল্প লিখেছি, একটা গল্পের দাম
মাত্র পাঁচ টাকা। নেবে?"
আজ অবধি লোকটার একটা গল্পও বিক্রি হয়েছে
বলে শোনেনি টুবাই। সবাই বলে লোকটা নাকি পাগল। এক সময় খুব ভালো লিখত, কিন্তু বিভিন্ন
বইমেলায়, পাবলিশারদের দোরে দোরে ঘুরেও পয়সার অভাবে একটাও বই কোনদিন প্রকাশ করতে পারেনি।
তারপর চরম অর্থাভাবে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই বিধুর এমন অবস্থা। টুবাইয়ের খুব
ইচ্ছে করে একদিন ওর টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে গল্প কিনতে। মায়া হয় লোকটার জন্য। কিন্তু
মা জানতে পারলে খুব রাগ করবে বলে সাহস পায় না।
বিধু তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলল,
"কিগো খোকাবাবু, একটা গল্প নেবে? ঠিক তোমার পছন্দের মতো একটা খাসা গল্প আছে। দাম
পাঁচ টাকা।"
টুবাই কিছু বলার আগেই, পিছন থেকে তার মা চিৎকার
করে ওঠে, "কিরে টুবাই! তুই আবার ঐ লোকটার সাথে কথা বলছিস? আটটা বাজে, এখনো অবধি
খাবারটাও শেষ করিসনি। এক্ষুনি পুলকার এলো বলে। ভেতরে আয় বলছি!"
টুবাই আর কিছু না বলে চুপচাপ ঘরে ফিরে আসে।
কিছুক্ষণ পর পুলকার এলে, রওনা হয়ে যায় স্কুলের দিকে।
|২|
বিকেল চারটে বেজে পনেরো মিনিট। অস্তগামী লাল
সূর্যটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছে টুবাই। মাত্র পাঁচ নম্বরের জন্য সে ক্লাসে
প্রথম দশ জনের মধ্যে স্থান পায়নি। মা, বাবা কেউ তার সাথে কথা বলছে না। তার কাঁদতেও
ইচ্ছে করছে না, পড়তেও ইচ্ছে করছে না। থেকে থেকে বিধু পাগলের মতো মনে হচ্ছে নিজেকে।
তার সাথেও তো কেউ কথা বলে না। সে একাই লেখে, একাই সবার সাথে কথা বলে, আবার উত্তর না
পেয়ে হাসি মুখে একাই ফিরে যায়। হঠাৎ কি মনে হতে, এক ছুটে বারান্দায় চলে গেল টুবাই।
সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বিকাশদা’র দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আজকেও তার
প্রিয় রিমোট কন্ট্রোল গাড়িটা চোখে পড়ল। কিন্তু আজ বড়ো অভিমান হল গাড়িটার ওপর,
তাকাতেও ইচ্ছে করল না ঐদিকে। দোকান পেরিয়ে পাড়ার একমাত্র খেলার মাঠটার সামনে এসে
দাঁড়াল টুবাই। অঙ্কিত, বাবলা, ওরা সবাই ক্রিকেট খেলছে। টুবাইকে ডাকলো বেশ কয়েকবার।
আজ খেলতে ইচ্ছে করছে না টুবাইয়ের। সে সাইকেলের স্পীড বাড়িয়ে চলে গেল। মাঠটা পেরোতেই
দেখতে পেল বিধু, সেই পুরোনো বাড়িটার রকে বসে আছে। কি সব যেন লিখছে সাদা পাতায়। বেশ
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। লোকটাকে দেখে অবাক লাগে টুবাইয়ের, এত অপমান, এত অবজ্ঞা
সহ্য করেও সব সময় হাসিটা লেগেই থাকে তার মুখে। সে কাছে এগিয়ে দেখার চেষ্টা করল কি
লিখছে লোকটা? কোন জাদুমন্ত্র নাকি? চোখ তুলে একগাল হেসে বিধু বলল, "আরে খোকাবাবু,
কি ব্যাপার, আজ মাঠে খেলতে যাওনি?" কি মনে হতে টুবাই বলল, "তোমার পাশে কিছুক্ষণ
বসতে দেবে গো?" আবার ঠিক একই রকম হেসে, নিজের পাশে জায়গা করে দিতে দিতে বিধু
বলল, "এসো বাবু, বসো এখানে।" টুবাই বসল। তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে, বিধু
জিজ্ঞেস করল, "তোমার মন খারাপ?" টুবাই ওপর নিচে মাথা নাড়ালো। বলল,
"তোমার সাথে তো কেউ কথা বলে না বিধু দাদু। তোমার মন খারাপ করে না?"
বিধু আবার এক গাল হেসে বলল, "কই না তো!
আমার তো বেশ ভালো লাগে। কেউ কথা বললে, সেই মানুষটার একটা নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায়
ঠিকই। কিন্তু কেউ যখন কোন কথা শোনার পরেও উত্তর দেয় না, তখন সে কি কি উত্তর দিতে পারত,
উত্তরের ভিত্তিতে দিলে বাকি কথোপকথনটা কোন দিকে গড়াত, সেই সব সম্ভাবনা দিয়েই কত ভিন্ন
ভিন্ন কত রকম গল্প হয়ে যায়! আমার গল্প লিখতে সুবিধাই হয়।" খুব অবাক লাগল টুবাইয়ের,
এভাবে তো সে কখনো ভেবে দেখেনি। টুবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে, উদাহরণ দেওয়ার ভঙ্গীতে
বিধু বলল, "এই যেমন ধরো তুমি জিজ্ঞেস করলে আমার পাশে বসতে পারো কিনা। আমি হ্যাঁ
বললাম, তাই তোমার সাথে এত কথা হচ্ছে। ধরে নাও আমি যদি না বলতাম। তাহলেও অনেক গুলো সম্ভাবনা
হতে পারত, এক তুমি রেগে যেতে, আমাকে কিছু খারাপ কথা বলতে। দুই তুমি কথা না বাড়িয়ে
চলে যেতে। তিন তুমি জোর করে আমার পাশে এসে বসতে। একেক ক্ষেত্রে একেক ভাবে সংলাপ এগোত।
আমার বিভিন্ন গল্পে বিভিন্ন ঘটনা কাজে লাগত।"
আরো অবাক হয়ে গেল টুবাই। মানুষ এভাবেও ভাবতে
পারে? সে বলল, "তোমার কাছে কি সব মন খারাপেরই ওষুধ আছে বিধু দাদু?" এবার
হোহো করে হেসে ওঠে বিধু। "মন খারাপ? ভালো বললে খোকাবাবু। অনেকদিন মন খারাপ হয়নি
আমার। তোমার কি মনে খারাপ বলো? ভেবে দেখি ওষুধ থাকে যদি।" এবার আর না চাপতে পেরে
বলেই ফেলল টুবাই, " আমি ক্লাসে এক থেকে দশের মধ্যে আসতে পারিনি তাই মা বাবা আমার
সাথে কথা বলছে না। আর আমার প্রিয় লাল রিমোট গাড়িটাও কিনে দিচ্ছে না।" বিধু কিছুক্ষণ
চিন্তা করে বলল, "তোমার দুঃখটা কোনটা দাদুভাই? মা বাবা কথা বলছে না সেটা? প্রথম
দশের মধ্যে স্থান পায়নি সেটা? নাকি রিমোট গাড়ি কিনে দেয়নি সেটা?" প্রশ্নটা
শুনে বেশ চিন্তায় পড়লো টুবাই। এইভাবে তো সে ভাবেনি। মাথা চুলকে বলল, "যদি বলি
তিনটের জন্যেই মন খারাপ?" বিধু বলল, "বেশ। তাহলে কোনোটাই তেমন গভীর নয়।
ওষুধ আছে আমার কাছে, তুমি আমার সাথে এসো।" সাইকেলটা দাঁড় করানো রইল রকের গা ঘেঁষে।
বিধুর হাত ধরে এগিয়ে চলল টুবাই। রাস্তার বাঁকটা পেরোলেই একটা ছোট্ট পুকুর। পুকুরের
উপরে একটা পাথরের ঢিপি। আর সেটা পেরোলেই একটা ঘন জঙ্গল। ঢিপিটার ওপর গিয়ে বসল বিধু।
আঙুলের ইশারায় পাশে এসে বসতে বলল টুবাইকে। সূর্য ডুবে গেছে কিছুক্ষণ হল। তার শেষ লাল
টুকু এখনো লেগে আছে পৃথিবীর গায়ে। এক অদ্ভুত মায়া মায়া রঙ ধরেছে জলে। জলের উপর কাঁপা
কাঁপা ছায়া পড়েছে টুবাইয়ের। সেই ছায়াতেও শেষ সূর্যের রঙ লেগে। বিধু বলল,
"জলের ভেতরেই আরেকটা তুমি আছো। সেই তোমার কোনো কিছু অধরা নয়। আকাশ, জল, এমনকি
সূর্য অবধি স্পর্শ করতে পারে সেই আরেকটা তুমি। তোমার যত দুঃখ আছে, তুমি ওকে বলো। দেখবে
ভালো লাগবে।" টুবাই তাই করল। সবকিছু বলতে গিয়ে কেঁদেও ফেলল দু একবার। বিধু বসে
রইলো পাশে, কিন্তু কোনো সান্ত্বনা দিল না। কিছুক্ষণ পর টুবাই যখন ফিরল, তখন সে অনেকটা
হালকা। গাড়িটার কথাও খুব একটা মনে পড়ছিল না আর।
এরপর প্রায় রোজই বিকেল বেলায় বিধুর সাথে
দেখা করতে যায় টুবাই। বিধু কখনো কখনো তাকে বাগানে নিয়ে যায়। সন্ধে না হওয়া পর্যন্ত
তারা দুজন মিলে শুয়ে থাকে আকাশের নিচে। আকাশের কাছে নিজের সুখ, দুঃখ, পাওয়া, না পাওয়া
সব কিছুই খুব ছোট মনেহয়। অনেক সময় তারা আবার যায় ঐ পুকুরটার ধারে। সন্ধেবেলায় তারা
ঝিলমিল করে। ধ্রুবতারা চিনিয়ে দেয় বিধু। তারাদের নিয়েও কত রকম গল্প বলে। তারা গঙ্গার
ঘাটে যায়, দেখে কত নৌকা খেয়া পারাপার করছে নিভে আসা আলোয়। চুপি চুপি অনেক কথা বলে
যায় চোরা ঢেউয়ের গর্জন। তাদের ভাষা বুঝতে পারে না টুবাই। শুধু বুকের মধ্যে কি যেন
অনুভব করে। বিধু বলে, আরেকটু বড়ো হলে সেই ভাষাও নাকি সে বুঝতে পারবে, অনেক গল্প লেখা
যাবে তখন। মাঝে মাঝে তার বাড়ি থেকে আমলোকী নিয়ে আসে বিধু। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে
নুন লঙ্কা মাখা আমলকী খেতে দিব্যি লাগে টুবাইয়ের। তার সমবয়সী বন্ধুদের সাথে আর খেলতে
যেতে ইচ্ছে করে না। বিধু থাকলে সব সন্ধেই যেন রূপকথা হয়ে যায়।
|৩|
বিকেল ছটা। বিধু আর টুবাইয়ের বন্ধুত্ব হওয়ার
পর, মাঝখানে পেরিয়ে গেছে একটা বছর। এখন টুবাইয়েরো বিধুর মতো জীবনটা রূপকথার মতো লাগে।
কোন দুঃখই আর দুঃখ বলে মনে হয়না। বিধুর শরীর বেশ কিছুদিন ধরে খুব একটা ভালো নেই। তাই
সে আর রোজ আসতে পারছে না। প্রতি শুক্রবার দেখা করে তারা। আজ নিয়ে দ্বিতীয় শুক্রবার,
বিধু আসেনি দেখা করতে। আকাশে ঘন মেঘ। বাদলা হাওয়ায় ভিজে মাটির গন্ধ লেগে। ইদানিং
বড়ো চিন্তা হয় টুবাইয়ের। বিধু তো আগে এমন করেনি কোনদিন। সে তো বিধুর বাড়িও চেনে
না যে খোঁজ নেবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরেই আসছিল টুবাই। হঠাৎ পিছন থেকে একটা মিহি
কন্ঠস্বর শুনতে পেল, "দাদুভাই!"
ফিরে তাকাতেই টুবাই দেখল শীর্ণকায় শরীরে
একটা ছেঁড়া চাদর জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে দাঁড়িয়েছে বিধু। এতদিন বাদে প্রিয় বন্ধুকে
দেখে আনন্দের থেকেও বেশি কান্না পেল তার। এ কি অবস্থা হয়েছে বিধুর! সে ছুটে গিয়ে
জড়িয়ে ধরল বিধুকে। বলল, "একি অবস্থা তোমার বিধু দাদু!" বিধু কাঁপা কাঁপা
কন্ঠে বলল, "শরীরটা একদম ভালো যাচ্ছে না দাদুভাই। তোমার সঙ্গে কিছু জরুরী কথা
আছে বলেই এলাম। এসো আমার সঙ্গে।" খেলার মাঠ পেরিয়ে, পুকুর ধার পেরিয়ে জঙ্গলের
ভেতরের রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা টিনের চালের ঘর। ঘরের ঠিক পাশে একটা
নয়নতারা গাছ। সেখানেই এসে থামল বিধু। দরজা খুলে বলল, "এই আমার বাড়ি দাদুভাই।
কখনো তোমায় আনিনি ভাবলাম একবার শেষবার অন্তত নিয়ে আসি। বন্ধু বলতে আমার গল্পেরা ছাড়া
এক তুমিই তো ছিলে!" ঘরের ভেতর একটা মাটির প্রদীপ জ্বলছে। ঘরের এক পাশে একটা ছোট্ট
মাটির উনুন। আরেক দিকে একটা খাটিয়া, আর বিছিয়ে রাখা একটা মলিন চাদর। টুবাইকে খাটিয়ায়
বসতে বলে, চাদরটা জড়িয়ে তার পাশে এসে বসল
বিধু। বলল, "দাদুভাই, পরের শুক্রবার থেকে তুমি আর আমার জন্য অপেক্ষা করো না কেমন?
আমি যা যা মন খারাপের ওষুধ জানতাম, তোমায় এতদিন শিখিয়েছি। মনে রেখো।" শুনে টুবাইয়ের
চোখ ছাপিয়ে জল এলো। তার শিশু মনেও সে বুঝতে পারলো, এই বোধহয় তার শেষ দেখা বিধু দাদুর
সাথে। এত মন খারাপের মন্ত্র জানা সত্ত্বেও তার চোখের জল বাঁধ মানলো না। কোনরকমে বলল,
"তোমায় ছাড়া থাকার যে দুঃখ, তার কোন ওষুধ নেই দাদু?" এই প্রথমবার হাসতে
পারল না বিধু। তার চোখেও কি জল? টুবাইয়ের মাথায় হাত রেখে বলল, "তোমার দিদা বেঁচে
থাকতে ঐ নয়নতারা গাছটা লাগিয়েছিলাম আমরা দুজন মিলে। একদিন জ্বরের ঘোরে ওষুধের অভাবে
তোমার দিদা মারা গেল। আমি ওষুধ, পথ্য কোন ব্যবস্থাই করতে পারিনি। রয়ে গেল শুধু ঐ নয়নতারা
গাছটা। ওকেই প্রাণ দিয়ে বড়ো করলাম। আমারো খুব ইচ্ছে, একদিন নয়নতারা হয়ে যাবো তোমার
দিদার মতো। এরপর থেকে নয়নতারা দেখলে তাকে যত্ন করো কেমন? দুঃখ কমবে কিছুটা । তবে এই
বাড়িতে আর এসো না। এই জঙ্গলেও আর এসো না দাদুভাই। আমার খোঁজ করো না, আর দুঃখ করো না।"
বিধুর বলার ধরণে এমন কিছু একটা ছিল, হাজার
ইচ্ছে থাকতেও একটাও পাল্টা প্রশ্ন করতে পারলো না টুবাই। চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়ে
গেল সে।
।৪।
আরো চারটে বছর কেটে গেছে। এ বছর মাধ্যমিক
দেবে টুবাই। এখন সে ক্লাস টপার। পড়াশোনা ছাড়া আর বিশেষ কোনদিকে নজর থাকে না টুবাইয়ের।
অবসরে সে গল্পের বই পড়ে। গল্পের বইয়ের মধ্যে দিয়ে কথা বলতে চায় বিধু দাদুর সাথে।
একদিন টিউশন ফেরতা রাস্তা খারাপ থাকায়, তাকে কিছুটা সাইকেল ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা ধরতে
হল। এসে পড়লো বিধু দাদুর সেই রকটার সামনে। হঠাৎ কি মনে হতে সে বাড়ির দিকের রাস্তায়
না গিয়ে পুকুর পেরিয়ে সেই জঙ্গল যেদিকে ছিল, সেই রাস্তা ধরল। বহু বছর পর এইদিকে এলো
টুবাই। বিধু দাদুর নিষেধ মেনে কোনদিন আসেনি আর এদিকে, আর আসার কথা ভাবলেই বড্ড কান্না
পেত তার। জঙ্গলটা আর নেই। একটা পাঁচতলা এপার্টমেন্ট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ
দেখলে বিশ্বাসই করবে না এখানে জঙ্গল ছিল একটা সময়। ফিরে আসতে গিয়েও, একবার থমকে দাঁড়ালো
টুবাই। এপার্টমেন্টের ছাদের ঠিক নিচে একটা ফাটল ধরেছে। আর সেই ফাটল থেকেই মুখ বার করে
তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে একটা নয়নতারা গাছ।
সমাপ্ত