লেখা পাঠান আমাদের chayarodpatrika@gmail.com

Sunday, January 12, 2025

বাপি গাইন-এর কবিতা, ছায়ারোদ নতুন সংখ্যা

 বাপি গাইন-এর কবিতা

 

ব্যূহ

 

এই দেওয়াল কথা বলবে

আর মাথা নীচু করে সরে আসবে মানুষের কুকুর

 

দেখো— স্পর্শমুখ ভেঙে পড়বে কিছুদূর গিয়ে

আলো ও বাতাস দিয়ে তাকে আর সামলানো যাবে না

অন্যথাও করা যাবে না সে প্রচন্ডকে

 

দুঃখ প্রকাশ করা যাবে কেবল

সম্পর্কের মাথায় হাত দিয়ে দু’এক বিন্দু জল রচনা করা যাবে

যে কোনো দেওয়ালের সামনে জলের প্রতিভার ব্যূহ রচনা করা যাবে কেবল।

 

 

২। অসুখ


মিথ্যে প্রশস্তি বাক্যের মতো দিন যায়

সরলরেখার মতো এ জীবনে

গতি নেই, গতিরোধ নেই কোনো

 

অসুখের ভেতরে বসে শুধু আলো দেখি

জানালার বাইরে দিয়ে 

পৃথিবীর আলো আসে হাওয়া আসে

এই দেহে;

পৃথিবীর ঘ্রাণে কদাচিৎ ভ্রম হয় বেঁচে আছি

 

বেঁচে আছি— এই অনুভূতি ছেড়ে দিতে মায়া হয় খুব

এই দেহ খাবে বলে জেগে আছে আমার অসুখ।

 

 

৩। ব্যর্থ

 

একটি পা চিতায় আর একটি সংসারে

এখন আমি পথভ্রষ্ট আলোর অন্ধকারে

 

দাঁড়িয়ে আছি, অমোঘ যদি স্বল্প দেখা দেয়

হয়তো আমি মুক্তি পাবো, পাবো তো নিশ্চয়?

 

কিন্তু দিকে দিকে পাহারা সম্ভাবনা কই

দাঁড়িয়ে থাকার সম্পর্কে আমিও বন্ধু হই

 

ওই আসাটির, যা এখনও আসতে দেরি আছে

শরীর ভীতু শরীর আমার ব্যর্থ হয়ে বাঁচে।

 

 

৪। স্মৃতি


স্মৃতি এক অভিশপ্ত জোনাকি

একা মানুষের ঘরে

আটকে পড়েছে। 

Saturday, January 11, 2025

সোহিনী চ্যাটার্জী'র ছোটোগল্প, ছায়ারোদ নতুন সংখ্যা

নয়নতারা

 

সোহিনী চ্যাটার্জী

 

|১|

সকাল সাতটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। কুয়াশার চাদর গায়ে দিয়ে সবে আড়মোড়া ভাঙছে নতুন সূর্যটা। পাতা ঝরানো কাঠগোলাপ গাছটা এখনো দু'একটা খয়েরী পাতার বাহারে নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করছে ভোরের আলোয়।

আজ‌ সোমবার। একটু তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে টুবাই। স্কুলে তার ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা হবে আজ। টুবাই এবার ক্লাস ফাইভে উঠবে। মা বলেছে, এই পরীক্ষায় প্রথম দশ জনের মধ্য স্থান পেলে, পাশের পাড়ার বিকাশ‌দা’র দোকান থেকে তার সবচেয়ে পছন্দের রিমোট কন্ট্রোল গাড়িটা কিনে দেবে। সেটা পেলে টুবাই কোন কোন্‌ বন্ধুকে সবচেয়ে আগে দেখাবে, কাদের সাথে সবার আগে খেলবে, সবকিছু ঠিক করে রেখেছে। অপেক্ষা এখন শুধু রেসাল্টের। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে এইসবই ভাবছিল টুবাই। ব্যস্ত ভঙ্গীতে দুধ কর্নফ্লেক্সের বাটি হাতে ঘরে ঢুকলো মা। ধমকের সুরে বলল, "কিরে! এখনো টাই'টাও পড়িসনি? আটটা বাজতে যায়। আয়, আমি বেঁধে দিচ্ছি। ততক্ষণ কর্নফ্লেক্সেটা খেয়ে নে।"

ঠিক এই সময় কলিং বেলটা বাজল। কর্নফ্লেক্সের বাটিটা মেঝেতে রেখে বারান্দায় দৌড়ে গেল টুবাই। এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন দরজার কাছে। পরনে একটা মলিন, তাপ্পি দেওয়া ফতুয়া, আর ঢলঢলে একটা পায়জামা। কাঁধে একটা মলিন শ্যাওলা রঙের ঝোলা ব্যাগ। মুখের অর্ধেকের বেশি অংশ ঢাকা সাদা দাড়িতে। চোখের রঙ কটা। এই লোকটাকে চেনে টুবাই। পাড়ায় সবাই ওকে বিধু পাগল বলে ডাকে। ফুটপাতের পাশে ঐ পুরোনো বাড়ির রকটায় বসে থাকে। সারাদিন কি যেন সব লেখে। রাতে আর তাকে দেখা যায় না। সকাল হলে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়ে, আর বলে, "গল্প নেবে? অনেক রকম গল্প লিখেছি, একটা গল্পের দাম মাত্র পাঁচ টাকা। নেবে?"

আজ অবধি লোকটার একটা গল্পও বিক্রি হয়েছে বলে শোনেনি টুবাই। সবাই বলে লোকটা নাকি পাগল। এক সময় খুব ভালো লিখত, কিন্তু বিভিন্ন বইমেলায়, পাবলিশারদের দোরে দোরে ঘুরেও পয়সার অভাবে একটাও বই কোনদিন প্রকাশ করতে পারেনি। তারপর চরম অর্থাভাবে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই বিধুর এমন অবস্থা। টুবাইয়ের খুব ইচ্ছে করে একদিন ওর টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে গল্প কিনতে। মায়া হয় লোকটার জন্য। কিন্তু মা জানতে পারলে খুব রাগ করবে বলে সাহস পায় না।

বিধু তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলল, "কিগো খোকাবাবু, একটা গল্প নেবে? ঠিক তোমার পছন্দের মতো একটা খাসা গল্প আছে। দাম পাঁচ টাকা।"

টুবাই কিছু বলার আগেই, পিছন থেকে তার মা চিৎকার করে ওঠে, "কিরে টুবাই! তুই আবার ঐ লোকটার সাথে কথা বলছিস? আটটা বাজে, এখনো অবধি খাবারটাও শেষ করিসনি। এক্ষুনি পুলকার এলো বলে। ভেতরে আয় বলছি!"

টুবাই আর কিছু না বলে চুপচাপ ঘরে ফিরে আসে। কিছুক্ষণ পর পুলকার এলে, রওনা হয়ে যায় স্কুলের দিকে।

 

|২|

 

বিকেল চারটে বেজে পনেরো মিনিট। অস্তগামী লাল সূর্যটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছে টুবাই। মাত্র পাঁচ নম্বরের জন্য সে ক্লাসে প্রথম দশ জনের মধ্যে স্থান পায়নি। মা, বাবা কেউ তার সাথে কথা বলছে না। তার কাঁদতেও ইচ্ছে করছে না, পড়তেও ইচ্ছে করছে না। থেকে থেকে বিধু পাগলের মতো মনে হচ্ছে নিজেকে। তার সাথেও তো কেউ কথা বলে না। সে একাই লেখে, একাই সবার সাথে কথা বলে, আবার উত্তর না পেয়ে হাসি মুখে একাই ফিরে যায়। হঠাৎ কি মনে হতে, এক ছুটে বারান্দায় চলে গেল টুবাই। সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বিকাশদা’র দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আজকেও তার প্রিয় রিমোট কন্ট্রোল গাড়িটা চোখে পড়ল। কিন্তু আজ বড়ো অভিমান হল গাড়িটার ওপর, তাকাতেও ইচ্ছে করল না ঐদিকে। দোকান পেরিয়ে পাড়ার একমাত্র খেলার মাঠটার সামনে এসে দাঁড়াল টুবাই। অঙ্কিত, বাবলা, ওরা সবাই ক্রিকেট খেলছে। টুবাইকে ডাকলো বেশ কয়েকবার। আজ খেলতে ইচ্ছে করছে না টুবাইয়ের। সে সাইকেলের স্পীড বাড়িয়ে চলে গেল। মাঠটা পেরোতেই দেখতে পেল বিধু, সেই পুরোনো বাড়িটার রকে বসে আছে। কি সব যেন লিখছে সাদা পাতায়। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। লোকটাকে দেখে অবাক লাগে টুবাইয়ের, এত অপমান, এত অবজ্ঞা সহ্য করেও সব সময় হাসিটা লেগেই থাকে তার মুখে। সে কাছে এগিয়ে দেখার চেষ্টা করল কি লিখছে লোকটা? কোন জাদুমন্ত্র নাকি? চোখ তুলে একগাল হেসে বিধু বলল, "আরে খোকাবাবু, কি ব্যাপার, আজ মাঠে খেলতে যাওনি?" কি মনে হতে টুবাই বলল, "তোমার পাশে কিছুক্ষণ বসতে দেবে গো?" আবার ঠিক একই রকম হেসে, নিজের পাশে জায়গা করে দিতে দিতে বিধু বলল, "এসো বাবু, বসো এখানে।" টুবাই বসল। তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে, বিধু জিজ্ঞেস করল, "তোমার মন খারাপ?" টুবাই ওপর নিচে মাথা নাড়ালো। বলল, "তোমার সাথে তো কেউ কথা বলে না বিধু দাদু। তোমার মন খারাপ করে না?"

বিধু আবার এক গাল হেসে বলল, "কই না তো! আমার তো বেশ ভালো লাগে। কেউ কথা বললে, সেই মানুষটার একটা নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায় ঠিকই। কিন্তু কেউ যখন কোন কথা শোনার পরেও উত্তর দেয় না, তখন সে কি কি উত্তর দিতে পারত, উত্তরের ভিত্তিতে দিলে বাকি কথোপকথনটা কোন দিকে গড়াত, সেই সব সম্ভাবনা দিয়েই কত ভিন্ন ভিন্ন কত রকম গল্প হয়ে যায়! আমার গল্প লিখতে সুবিধাই হয়।" খুব অবাক লাগল টুবাইয়ের, এভাবে তো সে কখনো ভেবে দেখেনি। টুবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে, উদাহরণ দেওয়ার ভঙ্গীতে বিধু বলল, "এই যেমন ধরো তুমি জিজ্ঞেস করলে আমার পাশে বসতে পারো কিনা। আমি হ্যাঁ বললাম, তাই তোমার সাথে এত কথা হচ্ছে। ধরে নাও আমি যদি না বলতাম। তাহলেও অনেক গুলো সম্ভাবনা হতে পারত, এক তুমি রেগে যেতে, আমাকে কিছু খারাপ কথা বলতে। দুই তুমি কথা না বাড়িয়ে চলে যেতে। তিন তুমি জোর করে আমার পাশে এসে বসতে। একেক ক্ষেত্রে একেক ভাবে সংলাপ এগোত। আমার বিভিন্ন গল্পে বিভিন্ন ঘটনা কাজে লাগত।"

আরো অবাক হয়ে গেল টুবাই। মানুষ এভাবেও ভাবতে পারে? সে বলল, "তোমার কাছে কি সব মন খারাপেরই ওষুধ আছে বিধু দাদু?" এবার হোহো করে হেসে ওঠে বিধু। "মন খারাপ? ভালো বললে খোকাবাবু। অনেকদিন মন খারাপ হয়নি আমার। তোমার কি মনে খারাপ বলো? ভেবে দেখি ওষুধ থাকে যদি।" এবার আর না চাপতে পেরে বলেই ফেলল টুবাই, " আমি ক্লাসে এক থেকে দশের মধ্যে আসতে পারিনি তাই মা বাবা আমার সাথে কথা বলছে না। আর আমার প্রিয় লাল রিমোট গাড়িটাও কিনে দিচ্ছে না।" বিধু কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, "তোমার দুঃখটা কোনটা দাদুভাই? মা বাবা কথা বলছে না সেটা? প্রথম দশের মধ্যে স্থান পায়নি সেটা? নাকি রিমোট গাড়ি কিনে দেয়নি সেটা?" প্রশ্নটা শুনে বেশ চিন্তায় পড়লো টুবাই। এইভাবে তো সে ভাবেনি। মাথা চুলকে বলল, "যদি বলি তিনটের জন্যেই মন খারাপ?" বিধু বলল, "বেশ। তাহলে কোনোটাই তেমন গভীর নয়। ওষুধ আছে আমার কাছে, তুমি আমার সাথে এসো।" সাইকেলটা দাঁড় করানো রইল রকের গা ঘেঁষে। বিধুর হাত ধরে এগিয়ে চলল টুবাই। রাস্তার বাঁকটা পেরোলেই একটা ছোট্ট পুকুর। পুকুরের উপরে একটা পাথরের ঢিপি। আর সেটা পেরোলেই একটা ঘন জঙ্গল। ঢিপিটার ওপর গিয়ে বসল বিধু। আঙুলের ইশারায় পাশে এসে বসতে বলল টুবাইকে। সূর্য ডুবে গেছে কিছুক্ষণ হল। তার শেষ লাল টুকু এখনো লেগে আছে পৃথিবীর গায়ে। এক অদ্ভুত মায়া মায়া রঙ ধরেছে জলে। জলের উপর কাঁপা কাঁপা ছায়া পড়েছে টুবাইয়ের। সেই ছায়াতেও শেষ সূর্যের রঙ লেগে। বিধু বলল, "জলের ভেতরেই আরেকটা তুমি আছো। সেই তোমার কোনো কিছু অধরা নয়। আকাশ, জল, এমনকি সূর্য অবধি স্পর্শ করতে পারে সেই আরেকটা তুমি। তোমার যত দুঃখ আছে, তুমি ওকে বলো। দেখবে ভালো লাগবে।" টুবাই তাই করল। সবকিছু বলতে গিয়ে কেঁদেও ফেলল দু একবার। বিধু বসে রইলো পাশে, কিন্তু কোনো সান্ত্বনা দিল না। কিছুক্ষণ পর টুবাই যখন ফিরল, তখন সে অনেকটা হালকা। গাড়িটার কথাও খুব একটা মনে পড়ছিল না আর।

 

 

এরপর প্রায় রোজই বিকেল বেলায় বিধুর সাথে দেখা করতে যায় টুবাই। বিধু কখনো কখনো তাকে বাগানে নিয়ে যায়। সন্ধে না হওয়া পর্যন্ত তারা দুজন মিলে শুয়ে থাকে আকাশের নিচে। আকাশের কাছে নিজের সুখ, দুঃখ, পাওয়া, না পাওয়া সব কিছুই খুব ছোট মনেহয়। অনেক সময় তারা আবার যায় ঐ পুকুরটার ধারে। সন্ধেবেলায় তারা ঝিলমিল করে। ধ্রুবতারা চিনিয়ে দেয় বিধু। তারাদের নিয়েও কত রকম গল্প বলে। তারা গঙ্গার ঘাটে যায়, দেখে কত নৌকা খেয়া পারাপার করছে নিভে আসা আলোয়। চুপি চুপি অনেক কথা বলে যায় চোরা ঢেউয়ের গর্জন। তাদের ভাষা বুঝতে পারে না টুবাই। শুধু বুকের মধ্যে কি যেন অনুভব করে। বিধু বলে, আরেকটু বড়ো হলে সেই ভাষাও নাকি সে বুঝতে পারবে, অনেক গল্প লেখা যাবে তখন। মাঝে মাঝে তার বাড়ি থেকে আমলোকী নিয়ে আসে বিধু। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে নুন লঙ্কা মাখা আমলকী খেতে দিব্যি লাগে টুবাইয়ের। তার সমবয়সী বন্ধুদের সাথে আর খেলতে যেতে ইচ্ছে করে না। বিধু থাকলে সব সন্ধেই যেন রূপকথা হয়ে যায়।

 

|৩|

বিকেল ছটা। বিধু আর টুবাইয়ের বন্ধুত্ব হওয়ার পর, মাঝখানে পেরিয়ে গেছে একটা বছর। এখন টুবাইয়েরো বিধুর মতো জীবনটা রূপকথার মতো লাগে। কোন দুঃখই আর দুঃখ বলে মনে হয়না। বিধুর শরীর বেশ কিছুদিন ধরে খুব একটা ভালো নেই। তাই সে আর রোজ আসতে পারছে না। প্রতি শুক্রবার দেখা করে তারা। আজ নিয়ে দ্বিতীয় শুক্রবার, বিধু আসেনি দেখা করতে। আকাশে ঘন মেঘ। বাদলা হাওয়ায় ভিজে মাটির গন্ধ লেগে। ইদানিং বড়ো চিন্তা হয় টুবাইয়ের। বিধু তো আগে এমন করেনি কোনদিন। সে তো বিধুর বাড়িও চেনে না যে খোঁজ নেবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরেই আসছিল টুবাই। হঠাৎ পিছন থেকে একটা মিহি কন্ঠস্বর শুনতে পেল, "দাদুভাই!"

ফিরে তাকাতেই টুবাই দেখল শীর্ণকায় শরীরে একটা ছেঁড়া চাদর জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে দাঁড়িয়েছে বিধু। এতদিন বাদে প্রিয় বন্ধুকে দেখে আনন্দের থেকেও বেশি কান্না পেল তার। এ কি অবস্থা হয়েছে বিধুর! সে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল বিধুকে। বলল, "একি অবস্থা তোমার বিধু দাদু!" বিধু কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, "শরীরটা একদম ভালো যাচ্ছে না দাদুভাই। তোমার সঙ্গে কিছু জরুরী কথা আছে বলেই এলাম। এসো আমার সঙ্গে।" খেলার মাঠ পেরিয়ে, পুকুর ধার পেরিয়ে জঙ্গলের ভেতরের রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা টিনের চালের ঘর। ঘরের ঠিক পাশে একটা নয়নতারা গাছ। সেখানেই এসে থামল বিধু। দরজা খুলে বলল, "এই আমার বাড়ি দাদুভাই। কখনো তোমায় আনিনি ভাবলাম একবার শেষবার অন্তত নিয়ে আসি। বন্ধু বলতে আমার গল্পেরা ছাড়া এক তুমিই তো ছিলে!" ঘরের ভেতর একটা মাটির প্রদীপ জ্বলছে। ঘরের এক পাশে একটা ছোট্ট মাটির উনুন। আরেক দিকে একটা খাটিয়া, আর বিছিয়ে রাখা একটা মলিন চাদর। টুবাইকে খাটিয়ায় বসতে বলে,  চাদরটা জড়িয়ে তার পাশে এসে বসল বিধু।‌ বলল, "দাদুভাই, পরের শুক্রবার থেকে তুমি আর আমার জন্য অপেক্ষা করো না কেমন? আমি যা যা মন খারাপের ওষুধ জানতাম, তোমায় এতদিন শিখিয়েছি। মনে রেখো।" শুনে টুবাইয়ের চোখ ছাপিয়ে জল এলো। তার শিশু মনেও সে বুঝতে পারলো, এই বোধহয় তার শেষ দেখা বিধু দাদুর সাথে। এত মন খারাপের মন্ত্র জানা সত্ত্বেও তার চোখের জল বাঁধ মানলো না। কোনরকমে বলল, "তোমায় ছাড়া থাকার যে দুঃখ, তার কোন ওষুধ নেই দাদু?" এই প্রথমবার হাসতে পারল না বিধু। তার চোখেও কি জল? টুবাইয়ের মাথায় হাত রেখে বলল, "তোমার দিদা বেঁচে থাকতে ঐ নয়নতারা গাছটা লাগিয়েছিলাম আমরা দুজন মিলে। একদিন জ্বরের ঘোরে ওষুধের অভাবে তোমার দিদা মারা গেল। আমি ওষুধ, পথ্য কোন ব্যবস্থাই করতে পারিনি। রয়ে গেল শুধু ঐ নয়নতারা গাছটা। ওকেই প্রাণ দিয়ে বড়ো করলাম। আমারো খুব ইচ্ছে, একদিন নয়নতারা হয়ে যাবো তোমার দিদার মতো। এরপর থেকে নয়নতারা দেখলে তাকে যত্ন করো কেমন? দুঃখ কমবে কিছুটা । তবে এই বাড়িতে আর এসো না। এই জঙ্গলেও আর এসো না দাদুভাই। আমার খোঁজ করো না, আর দুঃখ করো না।"

বিধুর বলার ধরণে এমন কিছু একটা ছিল, হাজার ইচ্ছে থাকতেও একটাও পাল্টা প্রশ্ন করতে পারলো না টুবাই। চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল সে।

 

।৪।

আরো চারটে বছর কেটে গেছে। এ বছর মাধ্যমিক দেবে টুবাই। এখন সে ক্লাস টপার। পড়াশোনা ছাড়া আর বিশেষ কোনদিকে নজর থাকে না টুবাইয়ের। অবসরে সে গল্পের বই পড়ে। গল্পের বইয়ের মধ্যে দিয়ে কথা বলতে চায় বিধু দাদুর সাথে। একদিন টিউশন ফেরতা রাস্তা খারাপ থাকায়, তাকে কিছুটা সাইকেল ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা ধরতে হল। এসে পড়লো বিধু দাদুর সেই রকটার সামনে। হঠাৎ কি মনে হতে সে বাড়ির দিকের রাস্তায় না গিয়ে পুকুর পেরিয়ে সেই জঙ্গল যেদিকে ছিল, সেই রাস্তা ধরল। বহু বছর পর এইদিকে এলো টুবাই। বিধু দাদুর নিষেধ মেনে কোনদিন আসেনি আর এদিকে, আর আসার কথা ভাবলেই বড্ড কান্না পেত তার। জঙ্গলটা আর নেই। একটা পাঁচতলা এপার্টমেন্ট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ দেখলে বিশ্বাসই করবে না এখানে জঙ্গল ছিল একটা সময়। ফিরে আসতে গিয়েও, একবার থমকে দাঁড়ালো টুবাই। এপার্টমেন্টের ছাদের ঠিক নিচে একটা ফাটল ধরেছে। আর সেই ফাটল থেকেই মুখ বার করে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে একটা নয়নতারা গাছ।

 

সমাপ্ত

আরণ্যক দাসের কবিতা, ছায়ারোদ নতুন সংখ্যা

যে অন্ধকার আমাকে শক্তি চেনায়নি

 আরণ্যক দাস

 

১.

 

তিন ঘরে তিনটে লাইট

               তিনটে ফ্যান

               তিনটে প্রাণ।

একজন দিন শেষে ঝিমিয়ে আসে

একজন দেশের, দশের খবর জেনে রক্ত মাথায় তুলে সময় করছেন নষ্ট

আমি ফোনে ব্যস্ত

ফোনে বন্ধুরা...

 

দু'একবার চিৎকার শুনেই

গণশক্তি গুছিয়ে বাবা ভেঙচি কাঁটা ক্ষোভ উগড়ে দেন আমার ওপর।

মা'কে খুশি রাখবার দায় আমাদের

 

কখন নন্টে ফন্টে

          কখন পাহাড়

                  কখন টম এন্ড জেরি

খাওয়ার টেবিলে একসাথে দুটো মুখের মৃদু হাসি আমার নজর এড়ায় না।

এসব দেখেই খুশি থাকতে হয় আমাদের।

 

২.

 

গঞ্জে বহুদিন বৃষ্টির দেখা নেই

বাড়িতে খিচুড়ি রান্না প্রায় বন্ধ

মুখ দুটো ব্যাজার হয়ে থাকে।

 

৩.

 

বাবার বহুকাল কিডনির সমস্যা

মায়ের সমস্যা ফুসফুসে

ওদের মিলিত সমস্যা আমি।

 

৪.

 

আমার বাড়ির ডোমিনেটিং মহিলাদের ভুল সিদ্ধান্তে

পুরোপুরি অন্ধকারে ঢাকা গলিতে এসে পড়েছি

এ জায়গা আমার বসবাসযোগ্য নয়।

 

৫.

 

দিনের শুরুতে মায়ের কোল

দিন শেষে মায়ের বুক

মায়ের গন্ধ।

এই আমার স্থান

কেবল এই গন্ধ নেওয়া আমার কাজ।

 

৬.

 

অগষ্টস জনের মতো অপরিপাটি ছিলাম না।

অন্ধকার গলিটার কুকুরগুলোর সমগোত্রীয় আমি এখন।

সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা, ছায়ারোদ নতুন সংখ্যা

সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা

হিং টিং ছট


 

সৈনিকের সরবতায় আচার সুরধুনি

চুলকে মাথা সূর্য ফেলে দাও,

দাবনাবিস্তারের যা যা শ্লোগানতম, ফাউ

 

লৌহফাঁদে আছড়ে ভৌতিক

 

টকেছে দাঁত প্রিয়ংবদা বিষ?

 

***

তিলোত্তমা সংক্রমণে পাগল ঠাওরালে

 

বঁটির আঁশ ইন্দ্রজালে গিলছে মা'গো ওরা কি

ঝালবাটা?

রসিক বিনা উস্কানির শাঁসালো ভুল চুক?

 

এ নির্মমে কবিশেখর বিবাগী, তেলতেলে

 

***

অপার তুমি ক্ষয়েছ ঘোড়াশালে

কুয়াশাটিও বিন্দুবৎ

নালের ঠোকা সয়েছে পশ্চিমে

 

ফর্মা তিন বায়না এল বারান্দার ঝাঁকে

কুমিরে কম্পাসের মালিকানা

 

***

শিকারদোষে রাগপ্রধান তুমি

 

স্নায়ুবিরত জোনাক হয়ে যাও আলোর

নির্বিকার মূলে

 

***

ধনুক ভাঙে আগুনে পরিযায়ী

গর্ভ তার ব্যক্তিগত হাঁড়ির ঢাকনাটি

সমূহ নাসা হারিয়ে আগলায়

 

***

আরণ্যক বল্লমের দিশারী ঘটকালী

অফুরন্ত লগ্নে ফসকাচ্ছে আনবাড়ির মাথাব্যথা

 

বদ্ধজমি পাকানো মৃগনাভি

যে টংকারে শুশুক উল্টোয়

 

***

বন্দুকের ডগায় দেখি নৃত্যপরচুলো

 

আরশোলার পুতুল হাঁচে পলকা জানলায়

প্রথমবার বাতাস লেগে স্মারকলিপি হল

 

আর ক'জন দিস্তে লাগে তুকতাকের জলে?

গুটি চলেছে পেনসিলের মদে ছলাৎ

তালিকাপ্রাণ আঁতকে উঠবে না?

 

***

সানাই হোক দ্বিতীয় মুদ্রণ

নহবতের ঘামাচি মারা পেশা

যে-হাত মাখে শিরদাঁড়ার অনেক খড়িমাটি

 

ছাপার ভুলে দাঁও মেরেছে

গন্ধতেলে খাস্তা সংসার

 

***

ভিড়ের মতো তুমি কে আর আছে?

আঁটো পোশাক বারংবার শৈশবের শিবিরে পস্তায়

 

***

যত্ন তুমি নির্মমতা গড়ো

ভীমপলাশী তাম্বুলের পাখনা খুলে রুদ্ধ হয়ে ওঠে

বাক্যে মাপো সহায়িকার পেছনপাকা চিঠি

শৌর্যদীপ গুপ্ত'র কবিতা, ছায়ারোদ নতুন সংখ্যা

 শৌর্যদীপ গুপ্ত'র কবিতা

ফ্যালাসি

 

যাদের চলার পথে বন্ধুরতা নেই

তাদের দিগন্তে কোনো আকাশও দেখি না

 

ক্ষয়ের প্রসাদ থেকে যে জীবন আদতে বঞ্চিত

তার চিতা খুঁজে নিতে

পথ হাঁটে শ্মশানের পথে

 

নিজের মুখাগ্নি সেরে গঙ্গাস্নান থেকে

           উঠে আসে তাপস যুবক

ভিক্ষা মাগে, এ জীবনের সমুদ্ভুত আয়, অপব্যয়—

 

স্বগত হাসির ছলে আমার শ্রীভাঁড় হাতে তুলে

নিমেষে আছাড় মারে চাতালের ঢালে

 

তার মুখে অকস্মাৎ

আমার অভূত এক জন্মান্তর দেখি

 

ফিরে আসি একসাথে পথে ও পাথরে ঘষা খেয়ে

আলোর ধারালো ফণা ঠিকরে দেয় নায়াব ওজুদ

অথচ বাইরে তার আশ্চর্য আঁধার

 

হুজুমে হুজুগে ঘুরে— হ্যাটা খাই বাজারে বাজারে

মানুষের মুখ দেখি

মুখের গোপন তহবিলে

উৎসুক আলোর লোভে হন্যে হয়ে দেখি

 

সবাই সবার ভাঁজে আঁধার লালন ক’রে

অন্যকে সন্দেহ করে

তথাপি তাদের ওই মিথোজীবি আত্মার ভিতরে

 

নেই কোনো যুক্তি, নেই আত্মক্ষয়,

প্রশ্নের জর্জরে প্রারব্ধের নেই বিহ্বলতা

 

আপস শাশ্বত জেনে মেছো হাত

                 সুযোগ সন্ধানে ঘোরে—

পশ্চিম সূর্যের বিপরীতে

          নিজেকেই অবশেষে পায় সে প্রতিচ্ছায়ায়

 

ভাবে : এই তার সফল সংগ্রাম

           এই তার বড় হয়ে ওঠা

 

গোপাল ভাঁড়

 

বস্তুত আপনারই সব—

সন্তানসন্ততি এ ভারতে ঘোরে ফেরে

অফিস কাচারি করে আদালতে হাসপাতালে

                 সংবাদ মাধ্যমে

প্রকৃষ্ট মুখোশ পরে ঠাটে বাটে সঙ সেজে

পোশাকের ধুলো ঝেড়ে ঢুকে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে

                                 কবিতা সভায়

 

সবাই বেভুল জানে সবার আড়ালে ঠিক

                  কার মুখ আসলে কেমন

 

মানুন না মানুন, মশাই

বস্তুত আপনারই সব— সন্তানসন্ততি এরা

 

দীনের দুঃখ শুনে সতত কাতর হয় আর—

 

হোমড়া চোমড়া দুনিয়ার নবাব বাদশাকে

চিমটি কেটে ভাবে আচ্ছা নাকাল করেছে

 

বদলে বাগিয়ে নেয় রাজ-পুরস্কার

                    রাজার বালাই

বরখাস্ত হলে পর, শেষ রক্ষা, বুদ্ধির বড়াই

           করে, সুকৌশলে সভাসন ঠিক ফিরে পান

 

এ ঔরস নির্ভুল তোমারই, আব্বাজান

 

মাৎস্যন্যায়ে, শোষণে উৎসবে

কাকুতি মিনতি করে রাজাকে ভাঙিয়ে খাব তবু

                           রাজদ্রোহে কখনও যাব না

 

ডিসেম্বর

 

উপাস্য বুকের ধানে কুহকিনী শীত

গোপনে গহনে ভাষা চায়

হেজে যাওয়া বন্ধ্যা জমি— আয়ুর ফাটল

আবাদির প্রগলভ উচ্ছলতায়

 

ঢলে পড়ে অনায়াসে

পাতার ঝরার ঢঙে, কোলে

 

কিছু আলো পালকে পালকে

আর কিছু ফসলে ফসলে দুলে ওঠে

 

সময় ধারালো ঠোঁটে

যে আদর মুছে গেছে তার ক্ষতচিহ্ন এঁকে রাখে

 

শাশ্বতীর কাঁখ থেকে

কত জল গলে যায় অকঠিন বালুকাবেলায়!

 

আমি তা-ই, করুণ গণ্ডুষে ভরে

যে আসেনি তার দুচোখে তাকাই, বলি: শোনো

 

শরীর দাদন নাও, বলো

আর ছেড়ে যাবে না কক্ষনো!

অর্ঘ্যকমল পাত্রের কবিতা, ছায়ারোদ নতুন সংখ্যা

কয়েকটি কবিতা

 অর্ঘ্যকমল পাত্র

১.

কবিতায় প্রেমের কথা আসে। কবিতায় আঘাতের কথা আসে। কবিতাই ঘাতক— তাই তোমাকে অস্বীকার করি৷ তোমার চোখ, ঠোঁট, শৌখিন দাঁত, ওদের তাচ্ছিল্য করি৷ তোমার নমনীয় দেহ, উদাত্ত স্তন— তাতে হেলায় থাবা বসাই; আবার ভুলে যাই পরক্ষণে। কবিতায় দেহের কথা আসে। কবিতায় শূন্যতার কথা আসে। কবিতার শূন্যতা— এ-কথা বুঝতে গিয়ে আমি নির্বাক তাকিয়েছি তোমার দিকে; দেখেছি এক-আধটা গাছ, কেমন দীঘির দিকে ঝুঁকতে থাকে কিছুদিন সোজা থাকার পর। দেখি, তারপর চোখ বুজি— প্রেমে কবিতার কথা আসে।

আঘাতে, সম্পূর্ণ কবিতা…

 

২.

কবির কাছে কবিতার আসা একটি দুর্ঘটনা মাত্র। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো। সেই দূর্ঘটনার কবলে পড়েই, মফঃস্বলের একটি তরুণের দু-চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। অগত্যা, তার দৃষ্টি চলে গিয়ে, যেটুকু পড়ে আছে— তা শব্দ। ফলত, সমস্তরকম গদ্য বাদ দিয়ে, মেদুর অক্ষরবৃত্তে এখন তার নিয়ত চলাচল। একটি কবিতা লেখা শেষ হলে, তা পাঠ করে। একা একা শোনে। এভাবেই দীর্ঘদিন শব্দে অভ্যাস হয়ে যায়। যেমন সিগারেটে। যেমন বিষণ্ণতায়। যেহেতু চোখ নেই, এখন সে আরও অধিক বুঝতে পারে শব্দের জোর! শুনতে পায় ফুল ফোটার শব্দ, ভোরের আলো কেমনভাবে মাটির উপর পা ছড়িয়ে বসার আগে ধুলো ঝাড়ে। শুনতে পায় দেওয়ালের অপরপ্রান্ত থেকে কার যেন এক কামাতুর নিমন্ত্রণ। একটি কবিতা লিখতে গিয়ে শুনতে পায়— তার পেট থেকে উঠে আসছে খিদের চিৎকার…

 

৩.

আর মৃত্যু দেখব না বলে, মৃত্যু বেছে নিয়েছিলাম। তুমি এলে। জাগিয়ে তুললে। দুগ্ধ সজীবতায় জন্ম দিলে নতুন। দেখলাম খাড়াই। চূড়া স্পর্শ করে বুঝলাম— পৃথিবী আদতে ঢালু। কত বাঁক, চোরাবালি, উপত্যকা। কত ভ্রমণ বাকি থেকে গেছিল বলে জীবন বিস্মাদ! কত শব্দ কানে আসেনি বলে আকন্ঠ সুরহীন! মৃত্যু দেখব না বলেই মৃত্যু বেছে নিয়েছিলাম। তুমি এলে। জাগিয়ে তুললে৷ কত রহস্যময় জঙ্গল। শিকারী পশুর থাবা, লালারস— কী বিচিত্র মোহ! রোমাঞ্চকাহিনী। কানে কানে বলে গেলে— জঙ্গলের ভেতরে, নির্জন গুহার ঠিকানা৷ সভ্যতার বিপ্রতীপে বঞ্চিত সময়,  অবহেলিত বিষাদ। মৃত্যু দেখতে চাইনি বলেই মৃত্যু বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এলে গুহার দরজায়। জাগিয়ে তুললে। আর আমার পরিত্যক্ত লিঙ্গ থেকে তৈরি হতে থাকল নতুন কবিতা…

ছাব্বির আহম্মেদে'র কবিতা, ছায়ারোদ নতুন সংখ্যা

ছাব্বির আহম্মেদে'র কবিতা

 

রাত্রিবাসে ডুবে গেছে মোহিনী চারুকলা


একটা নীরব আকাশ

যেখানে সারিসারি চোখের মাইল ফলক

আর হাজারো নক্ষত্রের রাত্রিবাসে

ডুবে গেছে মোহিনী চারুকলা

 

বহ্নিশিক্ষার আঁচল ছুঁয়ে আছে সময়ের বালুচরে

বুকের ভিতর গেয়ে ওঠে সমুদ্রের তলার নিস্তব্ধতা

এক অস্থায়ী মরীচিকার আত্মাকে সঙ্গে নিয়ে

সূর্যের ডানার ভিতর ঝুলিয়ে রাখছিলাম আমার আর্তনাদ

 

সুদূর মৃত্যুপুরীর পথ

যেদিক দিয়ে যাওয়ার জন্য সমস্ত পৃথিবীর পরিচয় লাগে

আর খোলা আকাশের চিঠি

তবুও দেখতে দেখতে পার হতে পারি ঐতিহাসিক ঘড়ির কাটা

যার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা নদীর সাঁকোর মতো রাজসভা

 

জীবন পারাপারের ব্যস্ততায়

সন্ধ্যার মুখের প্রলেপ যেন খসে পড়ছে

নৌকার দাঁড়ের আঘাতে কতগুলো জোনাকি উঠে আসছে

আর আমি ডুবে যাচ্ছি জীবনের অন্তিম নদীতে

 



অপরিপক্ক ঠোঁটের অস্থিমজ্জা

 

ঘুণ ধরা বাঁশের মতো পলাশের ঔদ্ধত্যও হারিয়েছে

পৃথিবীর বর্ণালীতে যত আলো ছিল

সবগুলোই এক এক করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে

তোমার গায়ের ফুলদানির গৌরবময় আঁচলে

 

শিশিরের চুপ থাকার কারণে সজাগ দৃষ্টি দিয়ে

আমি ফিরে পেয়েছি হিমাদ্রির সকাল

যেখানে উন্মাদ সহিষ্ণুতা দিয়ে আপন খেয়ালে চলে যাবো

মৃদু বাসন্তীর মরীচিকায়

 

কোকিলের সুরে এক চিলতে রোদ্দুর ছেঁকে নিয়ে

ঘুরিয়ে দিয়েছি তোমার বসন্তের ছায়াবৃত্ত

আর দিল-দরদিয়া মায়ায় চোখের কাজলে ধুয়েছি

তোমার কপোল গড়া অশ্রু

 

আকাশের কালসর্পের নিথর অপেক্ষায়

আমার অপরিপক্ক এক কোনায় ভাতের মাড়ের মতো চাপটে লেগে থাকে

তোমার ঠোঁটের অস্থিমজ্জা

আর আবছা নদীর বালুচরে বসে হাতের ছোঁয়ায়

গড়ে তুলি সেই খোঁপার পাহাড়

 

 

অঘ্রানী পেয়ালার ঠোঁট

 

তুমি হয়তো বলবে জীবনের প্রতিটা মুহুর্তই পোয়াবারো,

কিন্তু একটা অগোছালো মানুষকে গুছিয়ে রাখতে না পারলে,

তার দায় প্রলেপ দেওয়া হৃদয়ের কার্নিশ নেয় না

তবে এই যে ঘটা করে বিভর হয়ে থাকা দরদিয়া সম্বোধন

তোমার কাছ থেকেই শিখেছি প্রিয়

 

কেনো এমন হয় বলতে পারো?

আকাশের ফুটফুটে বুকে

সাদা বকের আলতা মাখা পা'গুলো সাঁতার কাটে

যদিও বা সেখানে কোনো নদী নেই,

শুধুমাত্র দুটো মখমল জান্নাতী সহজিয়া ঠোঁটের অপুষ্টতা জমে আছে,

আর তাতেই তোমার আঁচলের বৈকুন্ঠে কিঞ্চিৎ বেবাগী রঙ লাগে

 

সমস্ত টানাপোড়নে তটিনীর স্থবিরতা,

গোধুলি বেলায় তোমার হাতের ছোঁয়ায় ঝিমিয়ে পড়লে

একটা একটা করে স্বপ্নের ঘাটে সাজিয়ে রেখেছি

কাঠ পোড়ানোর মতো বিপরীত মেরুর বেনিয়মের শরীর

 

ভোরের বাসি কাপড়ের মতো যত অবহেলিত দিন ছিল

সেখানে আমার মধ্যবিত্ত সংসারে ক্লান্ত কোকিল বড়োই অসহায়

আর তোমার নানান ইঙ্গিতের শরীর সহ্য করে

কড়াই-এর মতো সন্ধ্যার নিষ্ঠুর অত্যাচার

কিন্তু তুমি দুচোখ চন্দ্রমল্লিকায় ভরে দিয়েছিলে

গেয়েছিলে প্রদীপের কলতানী সুর

 

মনপিঞ্জরের ঝরে যাওয়া কদম যেমন করে দিনলিপি আঁকে,

যেমন করে খড় বিছানো সভাস্থলে রাত্রি বাসর হয়

ঠিক তেমন করে তুমি আমার অঘ্রানী পেয়ালার হাতল ধরে

জীবনের স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছো, যার কোনো গন্তব্য নেই