সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটোগল্প
মধ্যবিত্ত
রোববার নাগাদ মুচকুন্দ দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, এই যে
তার থলেটা(বাজারের) ক্রমশ ভারী হয়ে যাচ্ছে আর হাতলের নাইলন ডানহাতের চার আঙুলের কর
বরাবর কেটে বসে যাচ্ছে এবং তার মতো আগু-পিছু দাঁড়ানো অন্যান্য মানুষদেরও মুখচোখ দেখে
সহজেই এই সাম্যাবস্থাটি অনুমান করা যাচ্ছে, এই এতগুলো মস্তিষ্ক সম্মিলিত ভাবে এটা সহ্য
করছে কেন?
কারণটা সম্ভবত বাঁ হাতের অপেক্ষাকৃত ছোট অথচ অপার সম্ভাবনাময়
এবং মূল্যবান থলেটির মধ্যে নিহিত। যেখানে কুচো-মাঝারি-বড় তাই কাটা মাছেদের রূপোলি আহ্বানে সাড়া
দেওয়ার পরও আরও খানিকটা শূন্যস্থান পড়ে থাকে। সেই শূন্যস্থানে গ্রামার টামারের ধার
না ধেরেই নানা আকারের নানা প্রকারের একেকটি নধর দেহাংশ প্রবেশ করে।
মুচকুন্দর স্থির বিশ্বাস ঈশ্বরের অনেক অবতারের মধ্যে মুরগিও একটি
অবতার। না তাই বলে পাঁঠা-পাঁঠি-ভেড়া কিংবা কাছিমের গোপনতাকে সে মোটেই ছোট করে না কিন্তু
মুরগির প্রতি তার অনেকটা প্রথম প্রেমিকার চকোলেট চুমুর মতো দুর্বলতা আছে। আচ্ছা, মুরগি
এত স্বর্গীয় বলে অনায়াসে মারা যাওয়ার পর অনায়াসে স্বর্গবাসী হয়, তা তো নিশ্চিত। বাংলা
সাহিত্যের জ্ঞানীরা লিখে গিয়েছেন। স্বর্গেও তাহলে তাদের জন্য খোঁয়াড় রয়েছে। কিন্তু
সেখানে যখন তারা ভাজা-সেদ্ধ-আধসেদ্ধ(না, নারকীয় ভাবে নয়) হয়ে থালা-বাটি-প্লেটের গরিমা
বাড়ায়, তারপরে কি তাদের পুনর্জন্ম হয়? স্বর্গে কিছুদিন থেকে আরও বেশি স্বাদে ভরপুর
হয়ে তারা কি আবার ফিরে আসে? ওই যে খাঁচার মধ্যে কেউ ডানা ঝাপটাচ্ছে(অকারণে) কেউ ধ্যান
করছে কেউ মাতালের মতো ঢুলুঢুলু চোখে এই তালঢ্যাঙা লাইনটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, ওর মধ্যেই
কি কেউ স্বর্গের অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত? মুচকুন্দ তীক্ষ্ণ চোখে বোঝার চেষ্টা করে। সেরকম
কিছুই নাগালে পায় না। হতাশ হয়। বুঝতে পারে, ভালোবাসায় এখনও খামতি রয়ে গেছে, না হলে
মুরগিদের নিজস্ব ভাবনা বা স্মৃতিচারণ সে এতদিন পরেও কেন ধরতে পারে না!
লাইনটা খুব ধীরে এগোচ্ছে। এক একটা আস্ত প্রাণী ক্যুইক মার্চের
ছন্দে খাঁচা থেকে বেরোচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকটি অর্ধ-আবিষ্কৃত জ্যামিতিক আকারে ছড়িয়ে
পড়ছে ওজনযন্ত্রের ওপর আর তারপর কালো প্লাস্টিকের ব্যাগে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে ঝপাৎ শব্দে
কোনও এক নাইলনের ব্যাগের সম্ভাব্য স্বাদ ও মূল্য দুটোই বাড়িয়ে গন্তব্যের দিকে দৌড়চ্ছে
অবলীলায়।
জল্লাদ না না কসাই(আচ্ছা আরেকটু নরম কিছু বলা যায় না?) ছেলেটার
বাঁ-হাতের মধ্যমার ঠিক মাঝখানটায় একটা বড়সড় আঁচিল। যখন একটি মুরগি জাতধর্মের হরেক চাহিদা
পেরিয়ে বঁটির সামনে গলা পাতে আর ছ্যাঁড়াৎ করে একটা অপার্থিব শব্দ হয় আর মুন্ডুটা মাটিতে
ছিটকে পড়ে হঠাৎ ভাষা ফিরে পায় যেন আর ধড়টা ডানার শক্তি ও তাৎপর্য সবেমাত্র বুঝতে পেরে
ছরফর অথবা ছড়ফড় শব্দে খুশি বা আপত্তি জাহির করতে থাকে তখন মুচকুন্দ প্রতিবার বড় মুগ্ধ
হয়ে সেই আন্দোলন চাক্ষুষ করে। একমূহুর্তের জন্যও চোখ সরায় না। কিন্তু মুশকিল টা হয়
তার একটু পরেই। ছেলেটা যেই মন দিয়ে জ্যামিতি আঁকতে বসে মুচকুন্দের চোখ আপনা-আপনি ব্যাদড়া
বাছুরের মতো ওই আঁচিলটার ওপরে গিয়ে থিতু হয়। প্রতিবার বঁটির ফলার গা বেয়ে টকটকে সৌন্দর্য
গড়িয়ে পড়ে, ছেলেটার আঙুল গুলো অফুরন্ত হোলির আনন্দে মাতোয়ারা হয় আর মুচকুন্দ আঁতকে
ওঠে। এই বুঝি আঁচিলটা আলাদা হয়ে গেলো। এই বুঝি সাধের পাকস্থলীর গায়ে মিশে গেল ঈষৎ
ছাইরঙের একটা তুলতুলে গুটিপোকা।
মুচকুন্দ চোখ সরিয়ে নিতে চেয়ে বলল,
"দেখুন দেখুন, ওই যে ছোট্টমতো মুন্ডুটা এইমাত্র মাটিতে পড়লো,
ওটা কেমন সুন্দর কথা বলার চেষ্টা করছে। ওই দেখুন, পরিষ্কার 'আ' বললো!"
সামনের ভদ্রলোক সিগারেটে একটা লম্বা টান মেরে ধোঁয়াটাকে ছাড়তে
যাচ্ছিলেন। মাঝপথে সেটা গিলবেন না ধরে রাখবেন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে প্রবল
বিষম খেলেন। মুচকুন্দ তাড়াতাড়ি পিঠ চাপড়াতে গিয়ে শুনলো ভদ্রলোক নিঃশ্বাস নিতে নিতেই
খুব হালকা করে "বোকা-ইত্যাদি", তৎসহ " সক্কাল সক্কাল এইসব শান্তির
ছেলেগুলো যে কোত্থেকে এসে জোটে!" এই কথা'কটি স্পষ্ট উচ্চারণে বলে ফেললেন। মুচকুন্দ
ভীষণ মুগ্ধ হয়ে গেল,
"আরে মশাই, আপনি যে দেখছি নাক দিয়ে চমৎকার কথা বলতে পারেন!
কী দারুণ প্রতিভা! আমাকে শেখাবেন?"
ভদ্রলোক এবার কান ভুরু
কুঁচকে কিছু একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলালেন, তারপর স্বাভাবিক গলায় বললেন,
"দাদা, এত সকালেই চড়িয়ে এসেছেন না কি? ভুলভাল বকে মাথা খাচ্ছেন কেন?"
মুচকুন্দ অবাক হয়ে সঙ্গে সঙ্গে পাজামার গিঁটের নিচটায় তাকাল,
"না দাদা, চড়িয়ে তো আসিনি! সেরকম চড়েও না কোনওদিন! আপনার
এরকম মনে হচ্ছে কেন?"
ভদ্রলোক একবার মুচকুন্দের কপাল থেকে পায়ের পাতা অবধি চোখ দিয়ে
পায়চারি করলেন। কী যেন ভেবে একটু সরে দাঁড়ালেন আর বললেন,
"দাদা, আপনি আমার আগে দাঁড়ান।"
"এমা, না না তা কী করে হয়! আপনি এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন..."
"আরে কোনও অসুবিধে নেই। আমার অভ্যেস আছে। আপনি আগেই আসুন।"
"ধন্যবাদ আপনাকে", বলে মুচকুন্দ আর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে
গেলো।
চতুর্ভুজ ষড়ভুজের চেয়ে ত্রিভুজ অথবা বৃত্তই বেশিরভাগ খদ্দেররা
পছন্দ করে। দোকানি ছেলেটা খুব ভালো করে জানে। সে নিপুণ কায়দার মোচড়ে উপপাদ্য ও সম্পাদ্যগুলি একের পর এক শেষ করে নম্বর গুনে নিয়ে বাক্সে ঢোকায়
আর মুচকুন্দ একসময় লাইন থেকে বেরিয়ে আসে। ভরন্ত ভাদ্রের রোদ এখন বড় বেশি গায়ে পড়ছে নাছোড়
ভিখারির মতো। কাজেই হনহনিয়ে হাঁটতে থাকে সে।
ডানহাতের থলেটির ভেতর দায়গ্রস্ত গেরস্থের মতো সব্জি গুলো একে
অন্যের পেছনে মুখ লুকোচ্ছে। মুচকুন্দ হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে একটা ক্যাপসিকামের দিকে
তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে সেটা একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বেশ কয়েকটা ধনেপাতার ছাউনির নিচে গা-ঢাকা
দেয়। মুচকুন্দ হঠাৎ কেমন উদাস বোধ করে। বাবার কথা মনে পড়ে তার।
একমাথা চুল, অত্যন্ত ঘন দাড়ি(যার ফলে বাবাকে কোনওদিন গাল চুলকোতে
হতো না) আর পুরু ঠোঁটের সুদর্শন বাবা। একমাত্র ছেলে সামনে এলেই চোখ কুঁচকে যেত তাঁর।
মুচকুন্দের মুখটা একেবারেই তাঁর মতো শুধু ওই চুল দাড়ি আর ঠোঁটের গাঢ়ত্ব বাদ দিয়ে।
না মানে চুল তার ছিলো, তবে খুবই পাতলা, সহজেই খুলির রঙ দেখা যেত। একবিন্দু দাড়িও কোনওদিন
গজায়নি, এমনকি মরসুমি ক্রিমও তার গালে বসতি স্থাপন করতে পারত না, দ্রুত স্খলনের লজ্জা
নিয়ে গড়িয়ে যেত। আর তার ঠোঁট, একটা সময় পর্যন্ত প্রায় নজরেই আসত না। মা মাঝে-সাঝে কাপড় মেলার ক্লিপ দিয়ে অধরোষ্ঠ দুপাশে টেনে রাখতেন।
এই ছোটখাটো ব্যাপারগুলোকে সামান্য কল্পনা করে নিতে পারলেই ছেলে আর বাবা একেবারে যমজ।
কিন্তু বাবার কল্পনাশক্তি ছিল না, থাকলেও সে বাবাকে ভয় পেত।
হপ্তার শেষাশেষি মায়ের
কোলে বসে উত্তমকুমার আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দিকে মায়ের মতোই জুলজুল করে তাকিয়ে
থাকত মুচকুন্দ। একটু বড় হওয়ার পর যখন সে বুঝল উত্তমকুমার আর সৌমিত্র টিভির বাইরে
কোথাও থাকেন না তখন সে লুকিয়ে বাবা-মা'র ঘরে যেতে শুরু করে। কেন লুকিয়ে? তা সে জানত না কিন্তু চুপিচুপি যেতেই ইচ্ছে করত বরাবর। আলমারি খুলে বাবার শার্ট ফতুয়ার মধ্যে
মুখ গুঁজে দিতো। বাবা যখন অফিস থেকে ফিরে ঘামে ভেজা জামাপ্যান্ট বারান্দার আলনায় ছুড়ে
ফেলে বাথরুমে যেতেন তখন ওই জামাটায় বিশেষত প্যান্টের কোমরের কাছটায় ছোট্ট নাক দাড়িহীন
গাল আর প্রায়-অদৃশ্য ঠোঁটসহ সে কেমন একটা মিশে যেতে চাইত।
বেশ চলছিলো। একদিন বাবার চোখে পড়ে যায়। অবশ্য তার আগে অ্যাশট্রে
থেকে বাবার ফেলে দেওয়া সিগারেটের ফিল্টার তুলে নিয়ে ঠোঁটে প্রাণপণ চেপে ধরা রয়েছে।
স্কুল থেকে ফেরার সময় ভরাভরতি ট্রেনের কামরায় অচেনা লোকের সঙ্গে কোমরের নিচে নিরূপায় এবং আশ্চর্য ঘেঁষাঘেঁষির
চাহিদা রয়েছে। ন্যাদাইদাদার হাত ধরে লৌকিকতাহীন দুপুরে চিলেকোঠায় গিয়ে তখনও অর্ধস্ফুট
ঠোঁটে অদ্ভুত এক স্বাদ ও ব্যথার অনুভূতি রয়েছে। তা এসব পেরিয়ে যেদিন বাবার নজরে পড়ে
যায়, সেদিন বাবার চোখের দিকে চোখ পড়তে শিউরে উঠেছিল সে। আরও অবাক হয়েছিল যে ব্যাপারটায়,
বাবা বকুনি বা পিটুনি কোনওকিছুরই বিন্দুমাত্র ধারপাশ দিয়ে যায়নি আর এতে তার আশ্বস্ত
হওয়ার কথা থাকলেও সে যেন কীরকম এক অস্বস্তির কবলে পড়ে প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের
পছন্দের কর্মকাণ্ডগুলো নিজের মধ্যেই গুটিয়ে নিয়েছিল।
কয়েকদিনের মধ্যেই তার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হয়। একদিন বাবার
বন্ধু ডাক্তার কাকা এসে খানিকক্ষণ কীসব পরীক্ষা-টরীক্ষা করে। তারপর গম্ভীর মুখে পাশের
ঘরে গিয়ে বাবা-মা'র সঙ্গে সিলেবাসের ভার্সাই চুক্তির মতো কঠিন কোনও এক শলাপরামর্শ করে।
পরের দিন থেকে হঠাৎ তার স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ হয়। পাড়ায় শক্তিশালী কোনও এক জাদুমন্ত্রে
সবাই জেনে যায় যে, তার নাকি ভয়ানক অসুখ করেছে। বিছানা থেকে এখন অনেকদিন ওঠাই বারণ।
বন্ধুরা দু'একবার দেখা করতে আসে আর বাবার চোখ তাকে যেন জাদুবলেই সম্পূর্ণ বোবা বানিয়ে
রাখে।
একে একে বন্ধুরা দূরে সরে যায়, দুয়ে দুয়ে বন্ধুদের চেহারা আবছা
হয়ে যায়, তিনে তিনে তাদের নামগুলোও মনে পড়ে না, চারে চারে, পাঁচে পাঁচে, ছয়ে ছয়ে, সাতে
সাতে একের পর এক দিদিমণি তাকে পড়াতে আসে এবং বাড়ি বসেই সে উঁচু থেকে উঁচুতর ক্লাসে
প্রমোশন পেতে থাকে, আটে আটে সে বুঝতে পারে বাবা নামক লোকটার ক্ষমতা বিশাল, না'হলে স্রেফ
বাড়ি বসে এতগুলো রেজাল্ট আর সার্টিফিকেটের কাগজ কীভাবে তার করায়ত্ত হয়? নয়ে নয়ে হঠাৎ
একদিন সে একটা চকচকে আপিসে যাতায়াত শুরু করে যেখানে সবাই বোবা— ঘাড় গুঁজে খালি কাজ
করে যায় আর দশ অবধি এসে সে নিজেকে অতুলনীয় এক ছাদনাতলায় আবিষ্কার করে আর শুভদৃষ্টির
সময় অন্যদিকের দৃষ্টির শুভময়তা সে সহজেই টের পায় কেননা এই নতুন আঁখিপল্লবের সন্ধান
ও রচনা বাবা নিজের হাতে সাঙ্গ করেছিলেন। বাবার ওপর অগাধ ভরসা বশতঃ সে এই নবাগতা সংযোজনের
টিকে যাওয়া বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়।
বাবা-মা দু'জনেই প্রায় একইসঙ্গে তার ঠিক পরপর যেন অনেকযুগের চেপে
রাখা শ্বাস প্রচন্ড গতিতে ছাড়তে ছাড়তে মুচকি হেসে চোখ বুজে ফেলেন।
মুচকুন্দ অ্যাদ্দিনে ভেদ করবার যথেচ্ছ সুযোগ যদিও পেয়েছে এবং এখনও পায় কিন্তু
তার মনের অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং মুখচোরা এক গলির মধ্যে ধারণ করবার যে ইচ্ছাটি
সে একসময় লালন করত, সেটি বিকলাঙ্গ হয়ে স্বাভাবিক অভিযানের দিক থেকে লক্ষ্মীপেঁচার
মতো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অবশেষে।
বেঁচে থাকা এক বড়সড় বালাই তাই অভিমান ঘেন্নায় বিবর্তিত হতে যতটা
সময় লাগে তার ইঞ্চিটাক আগে সে খড়কুটোর মতো এই মুরগিপ্রেম আঁকড়ে ধরেছে। একে শখ, আবেশ
কিংবা অনুগামীতা যা'ই বলা হোক, তার কিচ্ছু আসে যায় না। বউ নামক প্রাণীটির শরীরের সক্ষমতার
প্রতি সমস্ত ঈর্ষা সে ঝোল ও ঝালের সৌকর্যে মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে এইভাবে।
ডোরবেল বাজানোর কিছুক্ষণ পরে বউ দরজা খোলে।
বউয়ের শরীর থেকে টাটকা অক্সিজেন ভেসে আসে আর মুচকুন্দের নাক জ্বালা
করে। সে কলঘরের দিকে যেতে যেতে থলে দুটো একরকম ছুড়েই মারে বউয়ের দিকে। রোজকার মতো আজও
বউ ক্যাচ মিস করে না।
মুচকুন্দ কৃত্রিম বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে নাক ঘষে। চোখ ছোঁয়।
গলা থেকে সাবান বোলাতে বোলাতে নাভির ঠিক ওপরে এসে থামে। টের পায়
ফেনা গড়াচ্ছে। গড়িয়ে নামছে। নাভি পেরোচ্ছে। তলপেট ছুঁয়ে ফেলল এবার আর একটু...আর একটু নামলেই...সে চোখ টিপে বন্ধ করে বৃষ্টির বেগ বাড়িয়ে
নেয়। ততক্ষণে অত্যাশ্চর্য এক সুগন্ধী বাড়ির আনাচে-কানাচে জবরদখল বসিয়েছে।
মুচকুন্দ রান্নাঘরের চেয়ে একটু দূরে ডাইনিং টেবিলে এসে বসে। টিভি
চালায়--কোথায় যেন যুদ্ধ বেধেছে। যে দেশ হারছে তার মজুত করা সব খাবার যে দেশ জিতছে তারা
খেয়ে নিচ্ছে বেমালুম আর একবারও ঢেঁকুর তুলছে না। হেরো দেশ থেকে পিলপিল করে মানুষ বেরিয়ে
আসছে। অনেক উঁচু থেকে ছবি তুলছে কেউ অথচ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তারা মানুষ ছাড়া অন্য কিছু
নয়। মুচকুন্দ ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো, "তাহলে কি মহাকাশ থেকেও মানুষকে মানুষ বলে
চেনা যাবে যদি কারও ফোকাস পালোয়ানের মতো হয়?" চারদিকে তাকিয়ে দেখল শোনার মতো
কেউই নেই। একটু লজ্জা পেলো সে।
মানুষগুলো এদিকে টিভির গোটা পর্দা জুড়ে লাইন দিয়েছে। বিরাট লাইন।
এগোচ্ছেও না মোটে। মানুষগুলো ধৈর্য হারিয়ে একে অন্যের ঘাড়ের ওপর উঠে এগোতে চাইছে কিন্তু
কেউ জায়গা ছাড়তে রাজি নয়। লাইন আরও লম্বা হচ্ছে মিনিটে মিনিটে। যে দেশ থেকে তারা বেরিয়ে আসছে তার ধারণ ক্ষমতা আন্দাজ করে মুচকুন্দ মুগ্ধ ও উত্তপ্ত
হয়ে উঠল। অথচ যে দেশে তারা যাচ্ছে সেখানে কারও হাতে আঁচিল নেই। দেরী হচ্ছে, সময় লাগছে
খুব।
মুচকুন্দ আরও উত্তপ্ত হয়ে টিভি থেকে চোখ সরালো আর অন্যান্য দিনের
মতোই মুগ্ধ হয়ে গেলো। ঝাঁঝালো সুগন্ধী অদূরের কড়াই থেকে উড়ে এসে তার রোমকূপে বসছে ধীরে
ধীরে।
"কী গো, হলো তোমার? আর কতক্ষণ?"
"এই তো, হয়ে এসেছে"
টিভির পর্দায় গোলমালটা এইটুকুর মধ্যেই আরও বেড়ে গিয়েছে। লাইনে
দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ দু'হাত তুলে চেঁচাচ্ছে। ওসব দেশেও কীর্তনের চল আছে না কি! তবে যেভাবে মুখ বিকৃত করে চেঁচাচ্ছে
তাতে মনে হয় গালাগালিই দিচ্ছে কাউকে। বৃদ্ধের চোখ সামনের দিকে আর দুটো হাত আকাশের দিকে।
মুচকুন্দ বুঝতে পারল না বৃদ্ধ ঠিক কাকে গালাগালি দিচ্ছেন। যে দেরী করাচ্ছে তাকে না
কি ভগবানকে! দু'জনকে একসঙ্গেও দিতে পারেন। চেঁচাতে চেঁচাতে বৃদ্ধের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে
আসছে। গলার শির অসম্ভব ফুলে গিয়ে শুয়োরের গোঙানির মতো শোনাচ্ছে। বোধহয় অনেকক্ষণ জল খাননি। একজনও তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা
করছে না।
"কী গো, কী হলটা কী?"
"এই তো, দিচ্ছি এবার!"
হঠাৎ দারুণ শব্দে টিভির পর্দাটা যেন থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। একসঙ্গে
একহাজারটা মেশিনগান অবাধ্য ফলতঃ অনাথ শিশুর মতো তারস্বরে কান্নাকাটি আরম্ভ করলো। পর্দার
এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ধবধবে সাদা, পরক্ষণে ধূসর, পরক্ষণে কালো। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে
না আর। শুধু ঘন ঘন ছ্যাঁড়াৎ ছ্যাঁড়াৎ করে কীসের একটা শব্দ আছড়ে পড়ছে। এই বুঝি ছিটকে
পর্দার এপারে চলে আসে। ভলিউমটা এত বাড়াল কে? রিমোটটা কোথায়? হাতের কাছেই তো ছিলো!
আঃ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? রিমোটটা কোন চুলোয়?
"বলি মরে টরে গেলে নাকি? এতক্ষণ লাগে একটা সামান্য কাজ করতে?"
"এই তো, এসে গে..."
পরের টুকু মুচকুন্দ শুনতে পেলো না। এত শব্দ এত শব্দ!
পৃথিবী যেন আড়মোড়া ভাঙবার আর সময় পেলো না! হাতড়ে হাতড়ে মুচকুন্দ
একটা টুকরোর নাগাল পেয়েই শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিতে মুখে ফেলল আর সঙ্গে সঙ্গে ত্রিলোক-বিদারী
এক চিৎকার নিজেকে দেখে নিজেই আতঙ্কিত হয়ে মেঝেয় আছড়ে পড়ে খানখান হয়ে গেলো।
না ঝাল না নুন না মিষ্টি কেউ কাউকে ঘুণাক্ষরেও চিনতে পারে নি।
থালার ময়দান জুড়ে একের পর একের পর এক নিখুঁত উপপাদ্য-সম্পাদ্যেরা হাসিমুখে তাকিয়ে রয়েছে
অথচ কেউ কাউকে চিনতে পারছে না। সবাই একে অন্যের থেকে মুখ ফিরিয়ে কোনদিকে যে তাকিয়ে
আছে বোঝাই যাচ্ছে না।
মুচকুন্দ হাঁ-করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। রোমকূপগুলো একটা একটা
করে শুয়ে পড়ছে যার যার প্রিয় ভঙ্গিমায়। হাতদুটো কেমন জলের মতো হালকা এবং বিপজ্জনক লাগছে।
অতিকায় একটা হিমবাহ গলে তার প্রত্যেকটা শিরার মধ্যে চলাচল বইয়ে দিচ্ছে যেন কতকালের
চেনা।
মুচকুন্দ হাঁ বন্ধ করল। তারপর হাসি হাসি মুখে পা ছড়াল ময়দানে।
লাইনটা এগোচ্ছে এবার।
আঃ বড় আরাম...বড় আরাম...